[বড়ু চণ্ডীদাসের প্রামাণ্য জীবনী পাওয়া যায় নি। অনুমান করা হয় তিনি পঞ্চদশ শতকের মানুষ। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির সমসাময়িক। বিদ্যাপতির মতো তাঁর লেখায় নাগর-বৈদগ্ধ্য নেই। জয়দেবের পরে তিনি রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার কাব্য লিখেছেন। গীতিরস থাকলেও তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি কাহিনিকাব্য। নানা কারণে এই কাব্যটি বাংলাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য] আজ থাকছে ২য় পর্ব।
। । দানখণ্ড ।।
দিনকয়েক পরের কথা। আবার দধি-দুগ্ধের পসরা সাজিয়ে বড়াইএর সঙ্গে রাধা চলেছেন মথুরার পথে। এদিকে রাধার গমন পথে মহাদানী সেজে বসে আছেন কৃষ্ণ। রাধা কাছে আসতে তিনি বললেন, ‘শোনো রাধা, আমি দানী, দান আদায় করি। এতদিন ফাঁকি দিয়েছ তুমি। আজ আর পারবে না ফাঁকি দিতে। তোমার কটিদেশ এত ক্ষীণ যে হাতের মুঠোয় ধরা যায়; দাড়িম্বসদৃশ তোমার স্তনযুগল বড় সুন্দর। আমার প্রাপ্য দান পরিশোধ করে আমাকে আলিঙ্গন করো ।’
কৃষ্ণের কথা শুনে রাধা হতবাক। বড়াইকে তিনি বলেন, ‘তোমার কৃষ্ণ তো বড় নির্লজ্জ। কামলালসা চরিতার্থ করার জন্য সে মহাদানী সেজেছে। আমার যৌবন, আমার কটিদেশ, আমার স্তনযুগলের কথা বলে কেন সে? কেন আমাকে সে অপমান করছে? এর একটা বিহিত করো তুমি।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘রাজার কাছ থেকে পথ আর হাটের শুল্ক আদায়ের ভার নিয়েছি। দধি-দুগ্ধের পসরা নিয়ে তুমি প্রতিদিন যাও মথুরায়। কিন্তু দান দাও না। তোমার বহু দান বাকি পড়েছে।’
খড়ি পেতে দান গণনা করেন কৃষ্ণ, তারপর বলেন, ‘তোমার নয় লক্ষ কড়ি বাকি পড়েছে ; বারো বছরের দান।’
রাধা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘ কি যা তা বলছ! আমার বয়স এগারো, তাহলে বারো বছরের দান বাকি থাকে কি করে! দেখো কানাই, আমি সম্ভ্রান্ত বংশের কন্যা, সম্ভ্রান্ত বংশের বধূ, আমার রুপ-যৌবনে লাভ কি তোমার? গাছের উপর পাকা বেল দেখে কাকের লোভ হলেও সে কি তা খেতে পারে? তোমাকে মিনতি করছে, আমার মান রাখো, আমাকে যেতে দাও।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘তোমার রূপ দেখে আমি পাগল হয়েছি রাধা।’
–‘তাহলে গলায় পাথর বেঁধে জলে ডুবে মরো।’
-‘তুমি আমার গঙ্গা, তুমি আমার বারাণসী, তুমি সর্বতীর্থসার।’
-‘ছি ছি, লজ্জা হয় না তোমার! আমি না তোমার মাতুলানী!’
-‘সে সম্বন্ধ সত্যি নয়। সত্যি হল, আমি দেবরাজ, আর তুমি আমার রানি।’
– ‘কামজ্বরে ভুগছ তুমি। বিকারের ঘোরে বলছ এ সব।’
— ‘যাই বলো রাধা, কিন্তু আমার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার আশা ছেড়ে দাও।’
–‘ছি কানাই, ছিঃ। শুল্ক আদায়ের ছলনায় তুমি তোমার মামির উপর বলপ্রয়োগ করছ! জানো না, পরস্ত্রীর প্রতি লোভ মহাপাপ!’
কৃষ্ণ গম্ভীরভাবে বলেন, ‘বসুদেব আর দৈবকীর পুত্র আমি। কংসাসুর আমার মাতুল। সেই সূত্রে তুমি আমার শ্যালিকা, মাতুলানী নও। এ সব বাজে কথা বাদ দাও। একবার প্রসন্ন হয়ে আমার দিকে মুখ তুলে চাও। তোমার উন্নত পয়োধরে পীড়ন করো আমাকে। তাহলেই দূর হবে আমার সন্তাপ। রাধা, তোমার দেহের মাপ সাড়ে তিন হাত, তার জন্য দান হবে দুই কোটি মুদ্রা। মাথায় ফুলের মালার দান লক্ষ মুদ্রা। তোমার সুন্দর কেশরাশির দান দুই লক্ষ মুদ্রা। সীমন্তের সিন্দুর দুই লক্ষ মুদ্রা। নিষ্কলঙ্ক আননের দান চার লক্ষ মুদ্রা। নীলোৎপলসদৃশ নয়ন দুটির দান পাঁচ লক্ষ। গরুড়সদৃশ নাসিকার দান ছয় লক্ষ। কর্ণকুণ্ডলের জন্য সাত লক্ষ, দন্তরাজির জন্য আট লক্ষ, বিম্বফলের মতো অধরের জন্য নয় লক্ষ, বাহুদুটির জন্য এগারো লক্ষ, নখপংক্তির জন্য বারো লক্ষ মুদ্রা দান দিতে হবে তোমাকে। না, না, শেষ নয় এখানে। তোমার স্তনযুগলের জন্য তেরো লক্ষ, কটিদেশের জন্য চোদ্দ লক্ষ, কদলীসদৃশ উরুর জন্য পনেরো লক্ষ, চরণযুগলের জন্য যোল লক্ষ আর হেমপটনিন্দিত জঘনের জন্য চৌষট্টি লক্ষ মুদ্রা দান দিতে হবে।’
–‘এ সব কি বলছ তুমি? কিসের ঘাট? কিসের দান? এ সব কপটতা ছাড়ো। মানুষের দেহের উপর আবার দান ধরা হয় না কি! দেখো কানাই, পরদার গ্রহণে বিষম পাপ। ভৈরবপত্তনে গিয়ে দেহ বিসর্জন দিয়ে তুমি পাপমুক্ত হও। ’
রাধার কথা শুনে কৃষ্ণ হেসে বলেন, ‘রাধা তোমার উরুদুটিই ভৈরবপত্তন; তা যখন এত কাছে আছে, তাহলে দূরে যাই কেন! কলসি বেঁধে গঙ্গায় ডুবে মরার কথা বলছ? তোমার কুচযুগলই তো কলসির মত, সেই কলসি বেঁধে আমি লাবণ্যগঙ্গাজলে ডুবে মরতে রাজি।’ এরপরে একটু গম্ভীর হয়ে কৃষ্ণ বলেন, ‘পাপ খণ্ডনের কৌশল আমি জানি রাধা, তোমার কাছে সে সব শুনব কেন?’
রাধা বলেন, ‘তোমার আসল অভিসন্ধি বুঝতে বাকি নেই আমার। অনেক হয়েছে, এবার পথ ছাড়ো।’
-‘আমার আসল অভিসন্ধি? তা যখন বুঝেছ, তখন এসো আমার কাছে। রতিদান করো রাধা, না হলে ছাড়ব না তোমাকে, কিছুতেই না।’
রাধা বুঝতে পারেন, কৃষ্ণের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। তিনি বড়াইকে বলেন, ‘আমি পাখি হলে এখান থেকে উড়ে যেতাম। দেখো বড়াই, কৃষ্ণ যদি বলপ্রয়োগ করে তাহলে আমি প্রাণত্যাগ করব। নিজের মাংসের জন্য হরিণী জগতের বৈরী। আমার রূপই কাল হল। সেই রূপে প্রলুব্ধ কৃষ্ণ। কিন্তু তার আশা পূর্ণ হবে না।’
রাধার কথা শুনে একটুও বিচলিত হন না কৃষ্ণ। বরং আত্মপ্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠেন। জানান যে কালো জগতের আলো। এ সব শুনে আরও হতাশ হন রাধা। পথ ছেড়ে দেবার জন্য কাতর অনুরোধ করেন কৃষ্ণকে। কিন্তু কৃষ্ণ অবিচলিত, তখন রাধা বড়াইকে বলেন, ‘বড়াই তোমার কি মনে হয়, নন্দনন্দন কৃষ্ণ আমার যোগ্য? মর্কটের গলায় কি গজমুক্তা মানায়?’
চতুর বড়াই দেখতে থাকেন রাধাকে। মুখে প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু তাঁর সর্বাঙ্গে রতিরঙ্গের লক্ষণ প্রকট। ঈষৎ হেসে বড়াই বলেন, ‘এত দেরি হল কেন তোমার? তুমি কি বনে কৃষ্ণের সঙ্গে ছিলে?’
।। নৌকাখণ্ড ।।
অনেক দিন রাধার সঙ্গে দেখা হয় নি কৃষ্ণের। তাই তাঁর মন বড় ব্যাকুল। কি ভাবে দেখা পাওয়া যায় রাধার? বড়াইকে কৃষ্ণ বলেন, ‘রাধাকে মথুরার হাটে যাবার কথা বলো। বলো যে এবার ভিন্ন পথে যাবে, তাহলে কৃষ্ণ তার হদিশ পাবে না।’
বড়াই সম্মত হন। কৃষ্ণকে তিনি যমুনার ঘাটে নৌকা গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন। বড়াইএর কথা শুনে কৃষ্ণ এমন নৌকা তৈরি করেন, যাতে মাত্র দুজনের স্থান হয়। এরপর আরও একটা বড় নৌকা তৈরি করেন তিনি, আর সেটা ডুবিয়ে রাখেন জলে। বড়াইএর কথা শুনে যথাসময়ে ঘাটে এলেন রাধা। কিন্তু দেখা গেল বড়াই সেখানে নেই।
নদীতে একটা নৌকা আছে। কিন্তু বড্ড ছোট সে নৌকা। সখীদের নিয়ে সে নৌকায় যাওয়া অসম্ভব। একজন একজন করে পার হতে হবে।
কিন্তু কোথায় ঘাটোয়াল?
রাধা ভালো করে তাকিয়ে দেখে বুঝলেন, ঘাটোয়াল আর কেউ নয়, সেই নন্দনন্দন কৃষ্ণ।
কি আর করেন রাধা! নৌকায় উঠে তিনি ঘাটোয়ালকে বলেন, ‘ওহে ঘাটোয়াল, আমাকে পার করে দাও তাড়াতাড়ি। পথে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করো না। মনে রেখো, আমাদের সম্পর্কের কথা। তোমার মা যশোদা আমার ননদ, আর তুমি আমার ভাগনে।’
আরো পড়ুন: রাধাকৃষ্ণপ্রেমের দ্বিতীয় কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (পর্ব-১)
।। ভারখণ্ড ।।
বৃন্দাবনের অভ্যন্তরে গিয়ে কৃষ্ণ চামর গাছের ডাল কেটে তৈরি করেন বাঁক। ঝামা দিয়ে ঘষে চিকন করে তোলেন তাকে। পাটের দড়ি দিয়ে তৈরি করেন শিকে। এ ভাবে রাধার জন্য প্রস্তুত হয় ভার। কিন্তু রাধার বুঝতে বিলম্ব হয় না কৃষ্ণের অভিসন্ধি। নিশ্চয়ই তার কোন বদ মতলব আছে। রাধার পেছন পেছন আসতে থাকেন কৃষ্ণ।
রাধা কৃষ্ণকে বলেন, ‘আমার পেছন পেছন আসছ কেন? তোমার কি লজ্জা নেই? তবুও আসছ? বেশ, আমার সঙ্গে আসতে চাও যদি, তাহলে এই দধি-দুগ্ধের ভার বহন করো।’
ছদ্মরাগে কৃষ্ণ বলেন, ‘এ কি বলছ রাধা? আমি হলাম ত্রিভুবনের অধিপতি। জমলার্জুন আর শকটাসুরকে আমি বধ করেছি। কংসাসুরকে বধ করার জন্য আমার জন্ম। সেই আমি ভার বহন করব তোমার? যৌবনের অ্হংকারে এসব কি যা তা বলছ তুমি?’
-‘যমুনার ঘাটেই তো এক প্রহর বেলা কেটে গেল। মথুরার হাটে কখন যাব? আমার সখীরা সব এগিয়ে গেছে। তুমি ভার বহন করবে কি না বলে দাও। রাজি না হলে আমি আমার হার বিক্রি করে অন্য কোন ভারীকে নিযুক্ত করব।’
রাধার কথা শুনে এগিয়ে এলেন কৃষ্ণ। ভার বহনের ছলনায় নষ্ট করে দিলেন দধি-দুগ্ধ। হায় হায় করে উঠলেন রাধা, কৃষ্ণকে হাত লাগাতে বললেন তিনি।
কৃষ্ণ বললেন, ‘তোমার কথায় লোকে আমাকে উপহাস করছে। আমি কেমন করে তোমার ভার বহন করব?’
রাধা বলেন, ‘গোয়ালা হয়ে কে না ভার বহন করে? দেখো কানাই, দয়া করে এখন এটুকু করো, ফেরার পথে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করব।’
রাধার কথা শুনে আনন্দিত হলেন কৃষ্ণ।
গবেষক