| 19 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে গদ্য সাহিত্য

জীবন ও সাহিত্যের শিক্ষক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যে আচমকা বছরখানেকের অসুখে চলে যাবেন, তা এই ১৬ বছর বাদেও কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। তিনি আমার সেই শিক্ষক, যেমন শিক্ষক এই মহাপৃথিবী, এই প্রকৃতি, এই জীবন। শ্যামলকে যত পড়ি, তত তিনি উন্মোচিত হন। ১৯৭৭-এ এই আশ্চর্য মানুষটির সঙ্গে দেখা। আড্ডা গল্প হৈ-হল্লা, সাহিত্য থেকে চাষবাস, জমি আর মাটি, পরগণে মেদনমল্ল, বিদ্যাধরীর ফেলে যাওয়া খাত—সাপের খোলস, নদীর বয়স, হাটবাজার—শ্যামলের জানার শেষ ছিল না, কৌতূহলেরও শেষ ছিল না। তাঁর সঙ্গে আড্ডায় বসা মানে জীবনে জীবনে ধারাস্নান। এমন প্রাণবান মানুষ দেখা এই জীবনে আর হয়নি। আর এমন প্রজ্ঞা ও সাহিত্যবোধ আমি আর কোনো লেখকের ভেতরে দেখিনি।

শ্যামলবাবু ছিলেন জীবন ও সাহিত্যের শিক্ষক। তাঁর গল্পে বাস্তব-অবাস্তবের কোনো সীমারেখা থাকে না। রাখাল কড়াই গল্পে গ্রামবাসী তিনপুরুষ আগে তাল ডোঙায় করে বিদ্যাধরী বেয়ে সুন্দরবনে ভেসে যাওয়া পোড়ো গায়েনের জন্য অপেক্ষা করে। তেঁতুল গাছটিতে তার জন্য একটি ডাল বরাদ্দ আছে। তাকে পোড়ানো হবে সেই ডালে। কিন্তু ফিরবে কী করে? বিদ্যাধরীই তো হারিয়ে গেছে। মরে গেছে পোড়ো গায়েনের সেই নদী।

শ্যামলবাবুর গল্প আমাকে ঘুরে ঘুরে পড়তে হয়। পড়তে হয় নিজ প্রয়োজনে। যখন কিছুই থাকে না কাছে, সবকিছু শূন্য মনে হয়, শ্যামলে নিজেকে সমর্পণ করি। সেই রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বর মাচানতলায়, দখল, যুদ্ধ, হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী, অন্নপূর্ণা থেকে দুগগাপুর হল্ট। নখদর্পণ, সিমেন্টের আয়ু, ঝিঝোঁটি দাদরা—কোন গল্পের কথা বলব? শ্যামল পড়েই যে এতটা বয়স পাড় করেছি। তাঁর যেকোনো গল্পের কথাই বলতে পারি। আমি বলছি ‘ঝিঝোঁটি দাদরা’ নামে সে গল্পটি, যা পড়তে পড়তে আমার চোখে ভেসে উঠছিল শ্যামলবাবুর সেই প্রতাপাদিত্য রোডের বাসা বাড়ি, সকালে তিনি লিখতে বসেছেন, রেকর্ডে চলছে বড়ে গুলাম কিংবা কিশোরী আমনকর। এখন এই কমপ্যাক্ট ডিস্ক আর ইন্টারনেট ইউটিউবের যুগে সবকিছু কত সহজে হাতে এসে পৌঁছায়, পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো দেবিকারানির অচ্ছুৎ কন্যার সেই গান, কিৎ গায় হো/ খয়বন হিয়ারে-এ-এ / কিৎ গয়া হো… কেউ না কেউ আপলোড করেছে ইউটিউবে। শ্যামলবাবু আপনি থাকলে সেই গানের সমুদ্রে ডুব দিতেন।

‘ঝিঝোঁটি দাদরা’ কোন এক শোভনলালের গল্প যে কি না একবার ভবানীপুরে ট্রাম থেকে দুপুরবেলা নামতেই জগুবাজারের উল্টোদিকের ফুটপাথে তিনখানা নোটকে গলাগলি করে শুয়ে থাকতে দেখে চারপাশ দেখে বুকপকেটে চালান করেছিল। তখন সে বেকার প্রেমিক। পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা একেই বলে। শোভন বছর ১৫ আগে বর্ষাবোঝাই শেষ রাতে স্বপ্ন দেখত, তার ঘরের বাইরেই জানালার ঠিক নিচে ঘাসের ভেতরে কয়েকটা সিকি আধুলি কাঁচা টাকা পড়ে আছে। শেষে দেখত অফুরন্ত সিকি আধুলি। কুড়িয়ে তা শেষ হয় না। এহেন স্বপ্নপ্রবণ শোভনলাল যখন টের পায় সে খুবই অর্ডিনারি, জীবনে বা অফিসে তার কোথাও বিশিষ্ট হওয়ার কোনো চান্স নেই—তখন সে মর্নিংওয়াক, ডাকঘরের টাকা ডবলের সার্টিফিকেট ক্রয় আর গানে ডুব দিল। ফৈয়াজ খাঁ, রসুলেন বাঈ, জ্ঞান গোঁসাই শুনতে লাগল। কেদার, কাফি, তিলক, কামোদ তাকে যেন দুদণ্ড শান্তি দিল। তার মুখের ভেতর এক শান্ত ভাব এলো। এরপর সে ধর্মতলার ফুটপাতে ৭৫ পয়সায় গওহরজানের ৮০ বছর আগে গাওয়া গানের রেকর্ড পায়। শ্যামলবাবুর এই গল্পে রাগ-রাগিণী বেজে ওঠে নিরন্তর। আর তিনি যেন গানের ভেতর দিয়ে ফিরে যেতে থাকেন পিছনে।

কী আশ্চর্য গান রেখে তাঁরা, সেই সব মানুষ চলে গেছে এই জীবন ছেড়ে, তা দিয়ে নিজের জীবনকে সুন্দর করে নিচ্ছে যেন শোভনলাল। আমাদের গল্পের একটি প্যাটার্ন আছে, কাহিনীর একটি প্যাটার্ন আছে, শ্যামলবাবু তা থেকে বেরিয়ে যেতে পারতেন। বেরিয়ে গিয়ে নতুন এক ভুবনে প্রবেশ করতেন তাঁর পাঠককে নিয়ে। তাঁর ভেতরে ছিল এক অন্তর্লীন তন্ময়তা। সে তন্ময় ভাব এই গল্পের শোভনলালের ভেতর। আসলে লেখক নিজেকেই যে উন্মোচিত করেছেন এই গল্পের এক এক বাক্যে, বাক্যবন্ধে। কানা কেষ্ট—কে সি দের রেকর্ড বগলে নিয়ে শোভনলাল টের পায় পৃথিবীতে এখনো চৌদ্দ আনা পড়ে পাওয়া যায়। জীবনে অনেক কিছু এখনো তার পাওয়ার আছে। এই সব গান যেন খনির মণি। যখন গাওয়া হয়েছিল ওই গান সে সময়কার পৃথিবী আর নেই। নেই তখনকার মানুষগুলোও। রয়ে গেছে গান। যতবার বাজাও, সেই তেজ, দাপট। সেই লাবণ্য।

সেই গানের রেকর্ড খুঁজতে খুঁজতে রেকর্ডের মজুদদার বিশু ঘোষের সঙ্গে শোভনলালের বন্ধুতা হয়। সেই সঙ্গে আরো গানের সমঝদারের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। পারুল ঘোষের গান শুনতে শোভনলাল যায় হীরুবাবুর বাড়ি। হীরু থাকে টবিন রোডে। তার বাড়িতে গান নিয়ে আড্ডা বসে। সবাই আসে গান শুনতে। কী এক অদ্ভুত গল্প লিখেছেন লেখক। গল্পটি ক্রমশ দার্শনিকতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এই জীবন, সফলতা অসফলতা নিয়ে শোভনলাল নিজের মতো করে কথা বলে যায়। বলেন শ্যামলবাবু। শোভনের ছেলেরা বড় হয়ে দূরে চলে গেছে। বাড়িটা ফাঁকা। সেই বাড়ির ফাঁকা জায়গায় পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো আশ্চর্য সব গানের রেকর্ড সস্তায় নিয়ে এসে গাদা করে দিতে লাগল। গান নয় যেন স্টক করে রাখা আনন্দ আহ্লাদ। মনের ভেতরটা ঝলমলিয়ে ওঠে। প্রতি রোববার বিকেলে হীরুবাবুর টবিন রোডের ডেরায় গানের আনন্দ নিতে শোভন, ননী গোঁসাই, বিশু ঘোষেরা হাজির হয়। হীরুর মেসিনে তাদের খুঁজে আনা রেকর্ড চাপিয়ে দেয়। শোভন তখন পাগল হয়েছে ঝিঁঝোটি দাদরা শুনে। কোথায় শুনেছে, ফিল্ম ফেস্টিভালে গিয়ে? অশোককুমার আর দেবিকারানির সিনেমা ‘অচ্ছুৎ কন্যায়’?

পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগের গান, তখনো প্লেব্যাক আসেনি। সিনেমার পর্দায় এক কাঠকুড়ুনির গলায় শোনা এই গানে মাতাল হয়ে গেছে শোভনলাল। হীরুর বাড়িতে গিয়ে ওই গানের জন্য অধীর শোভন বলে, লীলা চিটনিস কিংবা দেবিকারানি অশোককুমারকে চিঠি লিখবে কি না। সিনেমায় শুনল একবার। আবার চাই তার, আবার। রেকর্ড সে পাবে কোথায়? হীরু তার রেকর্ডের জাবদা খাতার পাতা উল্টে উল্টে দেখে নিয়ে তাক থেকে সাত পুরোনো একটি রেকর্ড বের করে আনে। মুছে যন্ত্রে বসায়। বাজতে আরম্ভ করে সেই ঝিঁঝোটি দাদরা। সে একটা ব্যাপার হলো বটে। গান উথলে পড়ে হীরুর ঘরের বাইরে, টবিন রোডের ভিড়ে ঢুকে পড়ে কী সব করে দিতে লাগল। গান শেষ হতে হীরুর বউ একটি বাচ্চা কোলে করে ঘরে ঢুকে বলে, এই দেখুন আমার নাতি।

হীরুর কাছে শোভনলাল কৃতজ্ঞ। তাকে ৫০ বছর আগের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ১০ টাকা দিয়ে সে হীরুর নাতির মুখ দ্যাখে। ঝিঁঝোটি দাদরাই পারল, হীরুর নাতির মুখ দেখে হীরুর দেশের কথা জিজ্ঞেস করতেই বেরিয়ে এলো ভৈরব নদের গায়ের খালিশহর, দৌলতপুর, বেলেপাড়া, পুকুরপাড়ের বাড়ি… ঝিঁঝোটি দাদরায় স্নান করছে যেন হীরু আর শোভনলাল। কেউ কাউকে চিনতে পারেনি এত দিন। পাশাপাশি থাকত পঞ্চাশ বছর আগে। তারা দুজনেই সব ভুলে গেছে কে কেমন ছিল। কী করে পারবে, তারা দুজনেই যে অন্য রকম দেখতে ছিল… বলল হীরুর বউ। গল্প আর কী? এমনি। ঝিঁঝোটি দাদরা নিয়ে আর কী বলব? সুধী পাঠক শুনতে শুনতে দেখুন ৫০-৬০ বছর আগে পৃথিবীটা ছিল কেমন। আমরাই বা ছিলাম কেমন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত