| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

নিজেদের শ্মশান I শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

তুহিন বোসকে শরদিন্দু বিশ্বাস চিনতেন। নানাভাবে। কখনো দেখা হয়েছে দই-সন্দেশের দোকানের সামনে। তুহিন নানারকমের নেশা করে মিষ্টি খেত। তখন মুখ দিয়ে আপনাআপনি লালা ঝরত। আটকানো যেত না। সেই অবস্থাতেই তুহিন বলত, শরদিন্দুদা– ওই গল্পটা যা লিখেছেন না– খানিকটা থেমে আবার বলত– তুলনা হয় না। উঃ! তুলনা হয় না। দিন, ঝট করে একটা টাকা দিন তো।

আগে আগে শরদিন্দু দিতেন। পরে আর দেননি। এক টাকায় তুহিন তখন অঢেল শুকনো নেশা করে ফেলত। কখনো বড়ি। কখনো চরস।

আবার তুহিনের গলায় তারই লেখা কবিতা শোনা ছিল এক রকমের অভিজ্ঞতা। মোটা দানার গলা দিয়ে কবিতা, কবিতার ভেতরকার শিরা ফুটে উঠত। কিংবা যখন কাশীপুর, বনহুগলীর মস্তানদের রোলে মেজাজ দিয়ে অভিনয় করে দেখাত– যখন ও একবার পুলিশের ও. সি. হয়ে ধমকাত– আর গলা পাল্টে প্যাঁচে পড়া মস্তান হয়ে বলত– হাতে মারবেন না। দোহাই আপনার– হস্তরেখা মুছে যাবে স্যার– তার বদলে পায়ে মারুন বড়বাবু– পায়ে মারুন। আপনার সুবিধে হবে–

অমনি তুহিন ও. সি. হয়ে যেত। কড়া গলায় ধোলাই এক্সপার্ট হাবিলদারকে ডাকত– আই! টাইগার!! টাইগার!!! আচ্ছাসে মেরামত করো– পুলিশ সম্পর্কে অচলা অটলা ভক্তি ছিল তুহিনের।

একদিন বলেছিল– জানেন শরদিন্দুদা– আমাদের ওদিককার রতনবাবুর ঘাটে ভর সন্ধ্যেবেলা এক মস্তান আরেক মস্তানকে খুব অন্তরঙ্গ গলায় বলছিল– জানিস আমাদের নতুন ও. সি. খুব সাত্ত্বিক। পয়লাবার দোষ করলে ওয়ারনিং দেয়। দোসরাবার দোষ করলে কোনো ছাড়ান নেই। ন্যাড়া করে সারা মহল্লা ঘোরায়। মহল্লা গরম করে দেয়। মাইরি।

তুহিনের কবিতা আমায় টানত। কবিতাতেও মস্তান ছিল। তাদের পৌরুষ আর পরাজয়– দুই সে লিখে গেছে। আর তার সঙ্গে সে মিশিয়ে দিত নাচের মেয়ের হিলের আওয়াজ– ট্রামপেটের ট্রর-র-র! জয়ঢাকের দুম! দুম্‌! দু-ম!! কখনো বা গুলি ছুটে যাওয়ার আওয়াজ।

ও প্রায়ই বলত, বাড়ির শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে নামছি– ল্যান্ডি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। মনে পড়ল, আজ তো চিংড়ির মালাইকারী খাব। সেখান থেকেই বাবুর্চিকে ডেকে পাঠালাম।

আমরা এতদিনে জেনে গেছি, ও একজন সেকালের জমিদারের নিঃস্ব বংশধর। শুকনো নেশায় লালা ঝরার সময় ওর স্মৃতিগুলোও ঝরে ঝরে পড়ে। এর ভেতর ওর নিজের কবিতা গড়গড় করে বলত।

আমাদের আস্তাবলের ঘোড়াগুলো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। জানেন– একটা অস্ট্রেলিয়ান ওয়েলার– আজকাল আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোতে পারে না।

একথা শুনে আমরা ওয়েলারটার জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়তাম। খুবই চিন্তিত। আমরা জেগে থেকে স্বপ্নে দেখতে পেতাম– গঙ্গার গায়ে এইসব ঘোরায় টানা কোচবক্সে কেমন কেমন বাবু ঘুরে বেড়াতে পারেন।

আমরা গদ্য লিখে যা দু’চার পয়সা পেতাম– তা ও ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে ভাবতে ভালোবাসত। ও একখানা চটি উপন্যাসই লিখে ফেলল, যাতে প্রতিষ্ঠিত অর্থবান সব চিত্রকর, কবি, উপন্যাসিক একটা দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে ঠিক করল– নৌকায় বেড়াতে বেরোবে। চল্লিশ পাতা জুড়ে সেই নৌকো তৈরি আর সাজানোর কথা। তাকে ঘিরে শিল্পীদের সে কি অর্থব্যয়। তেমন খরচা শুধু সৌখীন।

একেক সময় ও ভাবত– ও একজন বড় ম্যুরাল আর্টিস্ট। একবার বলল, লেডি রায়ের কথায় কীভাবে ও একটা বাড়ির বসার ঘরের পুরো দেওয়ালে ম্যুরাল করেছে। কয়েক হাজার টাকা দেবার পর লেডি রায় এখন উপুরহস্ত। অ্যাসিস্ট্যান্টদের পেমেন্ট করা হয়নি। অথচ লেডি রায়ের কাছেও বারে বারে তাগাদা দেওয়া যায় না। কী মুশকিল বলুন তো। ঘোড়াগুলো বেচে দিলে সব ঠিক হয়ে যায়–

গাড়ি যখন টানছে না– তখন বসিয়ে বসিয়ে খাইয়ে লাভ কি? বেচে দাও।

কিন্তু ও ঘোড়া কে কিনবে শরদিন্দুদা। আর ওদের টানা গাড়ি কলকাতার কোন রাস্তা দিয়ে যাবে?

তাও সত্যি তুহিন। তাহলে লেডি রায়ের ওখানে গিয়ে তাগাদা চালাও।

লেডি বলে কথা শরদিন্দুদা। একি বাকি-পড়া বাড়িভাড়ার তাগাদা। বানিয়েছি ম্যুরাল। তার পাওনাগণ্ডা চাইবারও একটা আদবকায়দা আছে।

তবে ভোগো।

তাহলে তিনটে টাকা দিয়ে যান। ভুগতেও তো টাকা লাগে।

দিতে হয়েছিল শরদিন্দু বিশ্বাসের। এরকম তুহিন বসু একদিন গরমের বিকেলে কটকটে রোদের ভেতর যাকে বলে বিশুদ্ধ বাস্তব– তার চোয়ালের নিচে পড়ে যায়। তার সঙ্গে ছিল শরদিন্দুদের বয়সী এক কবি। হাল্কা পাতলা চেহারার। আর তুহিনের অনুগত নবীন আরেক কবি। দু’জনে তুহিনকে মাঝখানে নিয়ে হাঁটছিল। যাবে ওয়েলিংটন ব্যায়ামাগারের পাশ দিয়ে কে. টি.-তে। তাড়াতাড়ি তরল ভরে নিয়ে রগে রগে বিদ্যুৎ চমকাবে বলে।

বক্সিং রিংয়ে গ্লাভস্‌ পরে নিয়ে দুটো মেয়ে সমান তালে ট্রট করছিল। প্রায় তালে তালে। আর এর ঘুঁষি ঘুষি গদাম করে ওর গায়ে গিয়ে পড়ছিল। ওরা ভাগাভাগি করে ঘুঁষি খাচ্ছিল।

চলন্ত তুহিন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ফুটপাতে। আহা হা! আ! ছাপ্পান্ন চুরি জানকীবাঈ!! একজোড়া!! নারীর ভেতর শক্তি যখন চলকায়-

কথা শেষ করতে পারল না তুহিন। বক্সারদের ভেতর একটি মেয়ে ঘুরে তাকাল। অমনি নিজের কথা গিলে নিয়ে দু’পাশের দু’দশকের কবিদের নিয়ে তুহিন বোবা কাঠ পুতুলের স্টাইলে রাস্তাটা পার হয়।

কে. টি.-তে ঘণ্টাখানেক কী দেড় ঘণ্টা। ফিরতি পথে ওরা তিনজন সেই ফুটপাথেই ফিরছিল। ওয়েলিংটন ব্যায়ামাগারের ফুলগাছ ঘেরা গেটটা ওদের সামনে টুক করে খুলে গেল।

প্রথমেই দু’খানা অ্যাথলেট উরু। তুহিনের চোখে তা জ্বলন্ত লাগল। তার ওপরের দিকটা একটি মেয়ের গ্লাভস্‌ দুটো চোখে পড়তেই তুহিন বুঝল, সে তখন চোয়ালের একদম নিচে।

আপনি ডাকছিলেন আমায়?

তুহিন মনে করল এসব স্বপ্নের ভেতর আলতো করে ঘটে যাচ্ছে। অতএব সে কোনো বিপদের কথা ভাবতে চাইল না। আসুন না বসি– পার্কের ওই বেঞ্চটায় বসে কথা হবে।

ইয়ার্কি পেয়েছেন? আপনাকে চিনি না– আপনার সঙ্গে পার্কে বসব। জানেন আমি কে?

তখনি শরদিন্দুর বয়সী হালকা পাতলা কবি, ওয়েলিংটনের মাঠে গিয়েই শুয়ে পড়ে। সে দিশিতে ভেতরে বাইরে সমানে হামাচ্ছিল। নবীন কবি তখনো তুহিনের পাশে। তুহিন বলল, আমিও তো আপনাকে চিনি না। কোথায় দেখা বলুন তো শেষবার?

চুপ! আমি ন্যাশনাল ওমেনস্‌ বক্সিং চ্যাম্পিয়ান। মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব। যাঃ!

নবীন কবি তুহিনকে টানতে টানতে মেয়েটির ঘুঁষোর আওতার বাইরে নিয়ে এল। তারপর তুহিনকে বলল, হতো আমাদের বরানগর– দেখিয়ে দিতাম। আমরা হলাম গিয়ে কচিদার ডাইরেক্ট চেলা। আমাদের ধমকানো।

পুরো ব্যাপারটাই তুহিন শরদিন্দুকে গুছিয়ে বলেছিল। তুহিনের নিজস্ব গলায়। তাতে ওয়েলিংটনের বিকেল, নেশা, ভয়, নারী–সবই ঘুটে ঘুটে বেরোচ্ছিল।

শরদিন্দু বিশ্বাস সব শুনে বলেছিল, তুমি গল্প লেখ না কেন তুহিন?

কখন লিখব বলুন। এই ম্যুরালের কাজ। কাজ হাতে এলে তো নিঃশ্বাস ফেলতে পারি না। তাই ফাঁকে-ফোকরে সময় করে পদ্য লিখি। জানেন–আমার ঠাকুরদার আমলের একখানা মেঘরাগের রেকর্ড আছে। সেতারের। আলাউদ্দিন খাঁর বড়দা বড় সাধক ছিলেন। তিনি রোজ ভোরে সেতারে গত তুলে ঠাকুরদার ঘুম ভাঙাতেন। তা শ্রাবণ-ভাদ্রে ঠাকুরদা একটানা খরায় সেই মেঘরাগের রেকর্ডটা চালিয়ে দিতেন। বড় সুন্দর হাত ছিল আলাউদ্দিনের বড়দার। তিনি মৈজুদ্দিনের সোম সময়কার সেতারী। জলদে মেঘরাগ ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে রেকর্ডটা তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে থাকত। তার মানে মেঘকে আকাশ ছেয়ে উঠতে সময় দিত। তারপরই রেকর্ডে মেঘরাগ। খানিক বাদেই আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি। শ্রাবণ-ভাদ্রে ধান রোয়ার সময় সেই রেকর্ডখানা কত জায়গায় চেয়ে নিয়ে গেছে বৃষ্টির অভাবে। আমিও ছোট্টবেলায় শুনেছি। দাদু তখনো বেঁচে।

ধানক্ষেতে রেকর্ড বাজত কি করে?

কেন? কলের গানে। কলের গান শোনেননি? আগে তো ব্যাটারি সেট ছিল না। ছিল না গাঁয়ে গাঁয়ে ইলেকট্রিক।

হুঁ–এর বেশি আর কথা আসেনি শরদিন্দু বিশ্বাসের।

ঠিক এই সময়টাতেই লিট্‌ল ম্যাগাজিনগুলোয় তুহিনকে বলা হচ্ছিল– বাংলা কবিতার মুকুটহীন রাজা। আর শরদিন্দু বিশ্বাস গাবদা গাবদা উপন্যাস লিখেও পাবলিকেশানের দোকানে গিয়ে চা পাচ্ছিল না– পাচ্ছিল না সারা বছরের হিসেব কিংবা ডিউ রয়ালটি। উপরন্তু একদিন ক্যানিংয়ে এক সাহিত্য সভায় গিয়ে শুনলে, তার নাম সেখানে কেউ শোনেননি। তখন তার লেখালেখির বয়স প্রায় বছর।

এর ভেতর একদিন শরদিন্দু খবর পেলেন, তুহিন মারা গেছে। হাসপাতালে। শুকনো নেশার দরুন চেহারাটা শেষদিকে পাকিয়ে দড়ি-দড়ি হয়ে গিয়েছিল। বাংলা কবিতার এই মুকুটহীন রাজার জন্যে শোকসভার আয়োজন হলো। তুহিনদেরই পারিবারিক বাড়িতে। ভাগ্যি ভালো সে বিয়ে করেনি। নয়তো ছেলেপুলে নিয়ে এই বয়সে তুহিনের বউ কি বা করত? তুহিনের এই ক্যাটাসট্রোফিতে সভাপতি হওয়ার ডাক পড়ল শরদিন্দুর। কোনো এক গরমের বিকেলে। তরুণরাই ধরল তাকে।

শরদিন্দু বিশ্বাস জানত, তুহিনের শোকসভা আর সভাপতিত্ব– কোনোটাই কোনো কাগজে বেরোবে না। কারণ, তুহিন তো কোনোদিনই তেমন কোনো জায়গায় পৌঁছয়নি। কবিতায় হয়তো কোথাও একটা পৌঁছেছিল। কিন্তু তা যে কোনো বড় নাম এগিয়ে এসে স্বীকার করেনি– তাই সে যথেষ্ট জানা কবি হয়েও আমল পায়নি। আর শরদিন্দু তো ছাপার ফরফে একডাকে পরিচিত নয়! যদিও তার প্রকাশিত বইয়ের গ্রন্থের সংখ্যা বাইশ। আর তিনখানা বই যন্ত্রস্থ। এবং এখন সে গ্রন্থাবলীর কথাও ভাবে। মৃত্যুর পর অমরত্বও তার পাওনা বলে বিশ্বাস!

এমন শোকসভায় সে যেতই না। কিন্তু তুহিনের বন্ধুরা যখন বলল, ওদের নিজেদের বাড়িতেই শোকসভা– ওর ভাইয়েরা, বউদিরা থাকবেন। আর ওরা তো সবই বাড়ির ভেতর করে। শবদাহ থেকে শোকসভা।

শবদাহ?

হুঁ। ওদের তো নিজেদের শ্মশান।

শ্মশান জমা নেওয়া আছে? তাহলে তো ভালো আয়।

তুহিনের সেই চোয়ালের নিচে পড়ে যাওয়া কাহিনীর নবীন অনুগত কবি বলেই শরদিন্দুর একজনকে মনে হলো। সে বলল, না না- তা নয় শরদিন্দুদা। তুহিনদারা মরলে কখনো পাবলিক শ্মশানে যায় না। বাড়ির ভেতরেই ঠাকুরদা প্রাইভেট শ্মশান করে রেখে গেছেন। একদম রিজার্ভ জায়গা।

বল কি? তাহলে তো শোকসভায় যেতে হচ্ছে। জায়গাটা নিজের চোখে দেখে আসব।

কলকাতার যে জায়গায় বাগানবাড়ি হয় স্টুডিও নয় সরকারি ইনস্টিটিউট অথবা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে– যেসব জায়গা এখন শুধুই কারখানা, বস্তিবাড়ি, খাটাল- সেখানেই তো পয়সাওয়ালা মানুষজন একশো-দেড়শো বছর আগে ভিলা, কুটির, প্রাসাদ, কুঞ্জ বানাত। কাছেই গঙ্গা।

এরকম এক জায়গায় লাল খোয়া ওঠা, চওড়া, নিজের নামের রাস্তায় তুহিনের ঠাকুরদার লাল রংয়ের পুরনো ভিলা। বোঝাই যায় যিনি এ-বাড়ি বানিয়েছিলেন- কাজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। ঢালাই লোহার ময়ূর, পংকের পদ্ম। মার্বেল পাথরের বারান্দা। ঘরগুলো মাঝারি হোটেলের বলরুম। বাড়িটায় কোনো কোনো দিক একটুও নষ্ট হয়নি। মনে হবে ঘাসের ভেতর নতুন ব্লেড পড়ে আছে। আবার এক-একদিক যশিডি মধুপুরে বাঙালি উকিল ডাক্তারবাবুদের পড়ে-থাকা পোড়ো বাড়ি।

বিরাট এক হলঘরে সবাই তুহিনের কথা বলছিল। বলতে বলতে সেখানে কেউ তুহিনের নিন্দাও করে ফেলছিল। যেমন- বেহিসেবি, কল্পনাবিলাসি, হ্যালুসিনেশনে যা দেখত বা ভাবত–তাই-ই সত্যি বলে মনে করে নিত। তাই অনেকে ওকে মিথ্যেবাদীও মনে করত।

শোকসভার গা ঘেঁষে তুহিনের দাদারা বসে। ছোট ভাই বসে। বৌদিরা পাশের ঘরে যাবার দরজা ধরে দাঁড়ানো। এক বড়ভাই কাছে এসে ফিসফিস করে শরদিন্দুকে কানের কাছে বলল, ওর কবিতাগুলো বের করবে বলে এক পাবলিশার আসার কথা ছিল। কিছু আগাম দেবে বলেছিল। কিন্তু পাবলিশার তো এল না। আপনি চেনেন কাউকে– যাকে ওর কবিতা দিলে আমরা কিছু টাকা পাই।

কানের কাছে লোকটি মাথা আনতেই শরদিন্দু একটা মিষ্টিমতো গন্ধ পেয়েছেন। পরিষ্কার বুঝতে পারেন– এও শুকনো নেশার খদ্দের। গাঁজা তো নিশ্চয়। সেই সঙ্গে গা- গুলোনো সস্তা পাউডারের ঘেমো গন্ধ।

তখন তুহিনের আরেক দাদা বলছিল, ও তো বিয়ে করল না। দাদুর আমলের বুড়ো চাকর সুগ্রীব ওকে ছোটবেলা থেকেই দেখাশুনো করত। আমাদের মা অনেকদিন গত। বছর পনেরো হলো বাবা গেছেন।

শরদিন্দু জানতে চাইল, হাসপাতালে তুহিনকে কে দেখতে যেত।

সুগ্রীবই সব করত। ওর কোলেই মাথা রেখে– আর বলল না তুহিনের দাদা।

বৌদিরা–যারা দোর ধরে দাঁড়ানো–তারা শুকনো ফ্যাকাশে, রেকেটি। অথচ এই বিরাট বাড়ি। বিরাট বিরাট কড়ি-বর্গা। পায়রাদের যথেচ্ছ ওড়াউরি। ভেতর-বাড়ি না জানি আরও কত বড়। এ-বাড়ি ঢোকবার মুখে শরদিন্দু দেখেছেন– দেউড়ি কাকে বলে। আগাম দু’-পাশে হাতের মতো বারান্দা ছড়ানো। তাতে কত লোকের সংসার। হাঁড়িকুড়ি, শুকোতে দেওয়া কাঁথাকানি।

সভার পর শরদিন্দু এক দাদার কাছে জানতে চাইলেন, যাদের কাপড়-চোপড় শুকচ্ছে ওরাও আপনাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী।

না না। ওরা আমাদের কেউ নয়। তিরিশ বছর হলো জবর দখল করে আছে। হতো দাদুর আমল– টের পেত বাছাধনেরা।

কি রকম?

খোদ বড়লাট দাদুকে রাজা উপাধি দিতে চেয়েছিল। আমরা তো ডুমুরিয়ার জমিদার ছিলাম। দেশ ভাগ হয়ে সব ওপারে পড়ে গেল।

আপনাদের বাবা?

গুড-ফর-নাথিং। একের নম্বরের বাবুরাম ছিল। তাই আমরা এখন বেচারাম।

কি বেচে দিচ্ছেন?

জমিজমা তো সরকারি আইনে আইকে গেছে। তাই ইট খুলছি, মার্বেল তুলছি, রেলিং ভাঙছি–সবই বেচে দিচ্ছি। আর এতবড় বাড়িও তো আমাদের লাগে না। আমরা ঠাকুরদার তৃতীয় পক্ষের বংশধর। মোট চার পক্ষের বংশধরদের কথা ভেবেই এতবড় বাড়ি বানান ঠাকুরদা। কত মরে হেজে গেল। কত চলে গেল। এখনো তো অনেক ঘর খোলাই হয় না। ইট খুলতে খুলতে আমাদের এ জীবন চলে যাবে–

এভাবে চালাতে পারবেন?

কী বলছেন আপনি। আপনার কোনো আইডিয়াই নেই। একখানা ইট খুললেই চল্লিশ পয়সা। বারান্দার একখানা চৌকো পাথর খুলে দিলেই আড়াই টাকা। সকালবেলা তো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে ঠিকেদারের। বাড়ির মেয়ে-বউরাও হাতে কাজ না থাকলে ইট খুলতে কিংবা মার্বেল তুলতে লেগে যায়–শাবল, গাঁইটি সবই মজুদ বাড়িতে। কার কখন কিসে পয়সার দরকার হয়– বলাও তো যায় না– বলুন?

বিকেলের ছায়া এসে পড়েছে দেউড়িতে। সেই দাদা জানতে চাইল, আপনার তো অন এক পাবলিশার চেনা। দিন না একজনকে ঠিক করে। দুটো পয়সা পেতাম আগাম।

কার হাতে পয়সা দেবে পাবলিশার? এ কথা বলেও শরদিন্দু মনে মনে ভালো করেই জানেন– তুহিনের কবিতায় বেশ কিছু ব্যাপার আছে–কিন্তু তা থাকলেও কি কোনো পাবলিশার এগিয়ে আসবে?

কেন? আমরা তার ভাই। আমরাই তো ওসব কবিতার ওয়ারিশান।

কিন্তু সাকসেসন সার্টিফিকেট নিয়েছেন কি? না নিলে গভর্নমেন্ট তো ওসব কবিতায় হাত দিতেই দেবে না। মনে করুন ও কবিতা এখন সেফ ডিপোজিটে ব্যাংকের ভল্টে আছে। ইচ্ছে করে ব্যাপারটা কঠিন করে দিয়েও শরদিন্দু বিশ্বাসের আশ মিটছিল না।

ঠিকই তো বলেছেন। সাকসেসন সার্টিফিকেট নেওয়া হয়নি।

শরদিন্দু বিশ্বাস এবার জোর দিয়ে বললেন, তবেই বুঝুন। এ তো আর আপনাদের পূর্বপুরুষের তৈরি শরিকানী বাড়ির বারান্দার মারবেল টালি নয়। এ হলো গিয়ে কবিতা। বিশুদ্ধ কবিতা।

আচ্ছা ও কি খুব ভালো কবিতা লিখত?

হুঁ। খুবই ভালো।

আমরা পড়ে বুঝি না কেন বলুন তো।

নিজের সহোদরকেও কি আপনারা খুব বুঝতেন।

বড্ড জ্বালাত।

কবিরা অমন একটু-আধটু করেই থাকে। আখেরের কথা ভেবে ওসব একটু-আধটু সহ্য করাই উচিত ছিল আপনাদের।

তা কি আর করিনি মশাই। রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরে খুব চেল্লাত। দু’-একদিন ধরে মারও দিতে হয়েছে।

বড় ভাই। তা তো দেবেনই। তবে কিনা কবি তো। যাগ্‌ গিয়ে–আপনাদের শ্মশানটা একটু দেখতে চাই।

শ্মশান কি দেখবেন? সেই গঙ্গা অবধি হেঁটে যেতে হবে।

যাব।

তাহলে সঙ্গে একজন লোক দিচ্ছি। দাঁড়ান–

সঙ্গের লোক মানে তুহিনের কোনো ভাইপো। ষোল-সতেরো বছরের ডাঁটাল ছোকরা। তার সঙ্গে হেঁটে পারবেন কি করে শরদিন্দু। তার সঙ্গে ওপারে টুপ করে খসে পড়বে বলে সূর্য লাল হয়ে ওয়েট করছিল। পঞ্জিকা মিলিয়েই উনি নিয়মিত অস্ত যান। আবার উদয় হয়তো পাঁচটা বেজে সতেরো মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড গতে। নদীটাও খুব পুরনো, শুধু এর ভেতর আকাশের নিচে তুহিনের ঠাকুরদা এখানে দাপাদাপি করে চলে যান। এটাই নাকি মানুষের স্টাইল।

শরদিন্দু পেছন ফিরে হীরক ভিলাকে দেখলেন। আগেকার উঁচু ভিলা। মাথায় পদ্মের পরী। তাতে সূর্যের কিছু লাল আলো। পরীকে দেখেই বুঝলেন হীরক ভিলায় অনেক গান, আনন্দ, ফুর্তি হতো এক সময়। হীরক কার নাম ভাই?

আমাদের প্রথম ঠাকুরমার নাম। এই যে শ্মশানে এসে গেছি।

ছোট্ট একটা বাঁশের বেড়া সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন শরদিন্দু। একটা গিরগিটি লাফিয়ে দূরে সরে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। আগে বোধহয় দেওয়াল ছিল গঙ্গা অবধি। এখন সেখানে চারদিকে ঘুরে অযত্নে গজানো ঢোলকলমির আড়াল। এসব ইট বাড়ির মেয়েরা ম্যাটিনি শো দেখার জন্যে খুলে নিয়ে যায়নি তো!

দূরে গাছগাছালির আড়ালে একটা শ্যাওলাপড়া আবক্ষমূর্তি। নিচে খানিক জায়গা ঘিরে ঘাস আর শেয়ালকাঁটার ফুল।

এ মূর্তি কার?

আমার ঠাকুরদার বাবার। মানে বাবাদের ঠাকুরদার–

সৌম্য মুখশ্রীর একখানা পাথর-মূর্তি–বুক অবধি। শরদিন্দু জানতে চাইলেন, কে বসাল? তোমার ঠাকুরদা?

না। ঠাকুরদার বাবা খুব সেয়ানা লোক ছিলেন। অসুখে পড়েই জয়পুরে অর্ডার দিয়ে এই মূর্তি বানান। সবই বাবাদের কাছে শোনা। তাঁরা শুনেছেন– আমার ঠাকুরদার কাছ থেকে। মৃত্যুর আগেই বেদি সমেত নিজেরও মূর্তি বসান বাবার ঠাকুরদা। খুব ফারসাইট ছিল লোকটার। এসব পাথরও একদিন ঠিকাদারের কাছে চলে যাবে।

তোমার কাকাকে কোথায় দাহ করা হয়?

ওই তো–বেড়ার ধারে।

কাছে গিয়ে শরদিন্দু বিশেষ কিছু দেখতে পেলেন না। খানিক জায়গায় ঘাস নেই। সেখানে সন্ধ্যার অন্ধকারে শরদিন্দু বিশ্বাস দেখলেন– খানিক জায়গা কালো মতো। হয়তো কাঠ আর ঘাস পোড়া ছাই।

এ আস্তাবল– ঘোড়া কাদের?

ছেলেটি বলল, আমাদের একটা বুড়ো ঘোড়া আছে এখানে। জেঠু বেচে দিয়েছে।

তোমাদের নয় ঘোড়াগুলো?

না না। এক ওষুধ কোম্পানির। আস্তাবলটাও তাদের। রোজ রক্ত নিয়ে যায় সিরিঞ্জে ঘোড়ার গা থেকে।

ওঃ। তুমি কি পড়?

সেকেন্ডারি দিতাম এবারে। হেডমাস্টারটা ডাব্বা। টেস্টে অ্যালাউ করল না।

ওঃ।

জানেন– আমাদের ফ্যামিলিতে কাকুর মতো আরো একজন খুব বিখ্যাত। কাকুর চেয়েও বিখ্যাত। তার নামে হাউসফুল হয়ে যায়। বাবাদের দুই নম্বর ঠাকমার নাতনী–

কে?

আপনি মিস রুপোলীর নাচ দেখেননি? উঃ। কি মিস করেছেন। ক্যাবারে ড্যান্সার মিস রুপোলী পিসি একবার এ-বাড়ি এসেছিল। কী ভিড় বাড়ির সামনে। কল্পনা করতে পারবেন না। আমাদের কী গর্ব তখন।

ওঃ। তাই নাকি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত