উৎসব সংখ্যা গল্প: অওরত । স্মৃতি ভদ্র
তেঁতুল তলে উঁচা পিঁড়া ঘিরে ঝলমল করে বাতি
জামাই আমাগের বইসে আছে তো
কইন্যা দান করো গো বাপ লো
কইন্যা দান করো, রাজুবালা রে দান করো
হায় রে, পিতলের কলসী লইয়া যাবো যমুনার জলে যমুনার জল কালো…
সোনাডাঙ্গা বিলের জলে পানসি ভাসিয়ে বিকেল গড়তে না গড়তেই বরযাত্রীর দল পৌঁছে গেছে বিনসারা গ্রামের নিধু মাহাতোর বাড়ি।
এ বছর ধানের ডোল উপচানো দেখেই নিধু মাহাতো ঠিক করে ফেলেছিলো রাজুবালার বিয়ের ঘর। এ গ্রাম সে গ্রাম খুব বেশী ঘুরতে হয়নি তাঁকে মেয়ের জন্য উপযুক্ত শ্বশুরঘর খুঁজে পেতে। খৈগাড়ি বিলের পাড়ে নিমাইচড়া গ্রামে রঘুনাথ রাজভরের বাড়িতে ক’খানা কড়ি, মাছ-মিষ্টি আর একধামা ধান দিয়ে মেয়ের জন্য পাটিপত্র করে এসেছিলো বিলে নতুন জল পড়ার আগেই। কথা ছিলো শ্রাবণ মাসে মথুরাদিঘি মন্দিরে অষ্টপ্রহর শেষ হলেই বিয়ের পানসি ভিড়বে নিধু মাহাতোর বাড়ির দুয়ারে।
রঘুমাথ রাজভর এক কথার মানুষ। আর নিজের ছেলেটিকেও চেনেন খুব ভালো করে। তাই অষ্টপ্রহরের লীলা কীর্তন শেষ না হলে যে ছেলে হরিপদকে থুবড়ার অন্ন খাওয়ানো সম্ভব হবে না, তা তিনি ভালো করে জানতেন। তাই রঘুনাথ রাজভর নিজে পঞ্জিকা ঘেঁটে অষ্টপ্রহর শেষ হবার পরের পূর্ণিমায় বিয়ের দিন ঠিক করেছেন।
হরিপদ রাজভর, একমাত্র সন্তান হবার সকল রকম সুবিধা নিয়ে প্রায়শই বাড়ি ছাড়া থাকেন। বাবা রঘুনাথ অবশ্য এতে খুব একটা বিচলিত হন না। কারণ আচরণ বংশপরিক্রমায় নিম্নমুখী এটা তিনি জানেন। কিন্তু মালতি রাণীর অন্তর মানে না। বিয়ের পর বছর পাঁচেক আঁটকুড়ে থাকার সকল গঞ্জনা ভুলিয়ে দিয়ে হরিপদ তাঁর কোলে এসেছিলো। আমপাতায় পাড়া কাজলের টিপ পড়িয়ে আর ছয়দিনে বাদলবাড়ি পীরের থানে মানতের বাতাসা ছিটিয়ে ছেলের নাম রেখেছিলেন হরিপদ। তাই ছেলে মালতি রানীর অন্তরের টুকরো।
কিন্তু তেল-জল আর দুধ-মাছে বড় করা ছেলেটি যে একটু বড় হতে না হতেই মায়ের হাত ভুলে করতাল হাতে তুলে নেবে, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি মালতি রানী। তাই রাধাগোবিন্দ মন্দিরের বারান্দায় মতি রুহিদাসের কীর্তনের দলের সাথে যখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে হরিপদ সারাদিন পড়ে থাকতো, তখন মায়ের মন বাচ্চা মানুষ বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে ছেলেকে ঘরে নিয়ে আসতো। তবে এই প্রবোধ খুব বেশিদিন মালতি রাণীকে স্বস্তি দিতে পারে নাই। খুব তাড়াতাড়িই কীর্তনের দলের সদস্য হয়ে হরিপদ পালা গাইতে অন্য গ্রামে গিয়ে বুঝিয়ে দিলো নিছক শখের বসে সে রাধাগোবিন্দের মন্দিরে বসে থাকতো না।
তখন কতইবা বয়স হবে হরিপদর আট কিংবা নয়। শৈশবের গন্ধ তখনো ছিলো হরিপদর গা জুড়ে। সেই বয়সে মায়ের কোল ছেড়ে অষ্টপ্রহর হরিনাম গাইতে যে ছেলে পাঁচ গ্রাম দূরে সাতদিন কাটিয়ে আসতে পারে সে যে বড় হতে হতে দিনের গুনতি মাসে নিয়ে ঠেকাবে তাতে মালতি রাণীর সংশয় ছিল না।
আজকাল হরিপদ পালা গাইতে দক্ষিণবঙ্গে যায়। ডিঙ্গি নয়, বজরায় তিন চারদিন জলে ভেসে সে গাইতে যায় হরিনাম সংকীর্তন বড় বড় দলের বায়না পেয়ে। আর দক্ষিণে যাওয়া মানেই দিন-মাসের সব হিসাব ভুলে যাওয়া। শেষবার তো প্রায় চারমাস পর বাড়ি ফিরেছিলো হরিপদ। বাছার এই ঘরছাড়া রোগ মালতি রাণীকে অস্থির করে তোলে, বুঝতে পারেন বাঁধন ছাড়া হরিপদকে ঘরমুখো করা যাবে না।
তাই সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলের জন্য বিয়ের কন্যা খোঁজার আবদারে অটল থাকেন স্বামীর সকল বাঁধা উপেক্ষা করে,
আরেহ্, আমার ছেলে তো মতোই হবি। উঠতি বয়সে আমিও যাত্রাপালায় ঘুড়ি বেড়াতাম। তাতে কি আমার জাত গ্যাছে গা ? সংসারের জোয়াল কাঁধে একবার পড়লি সব হাউস শ্যাষ। ছেলের হাউসে আড়া ক্যান দিতি চাও তুমি?
বাছাধনের হাউসে কেন বাঁধা দিতে যাবে মালতি রাণী? তাঁর শুধু একটাই চাওয়া হরিপদ চোখের সামনে সামনে থাকুক। সংসারে জোয়াল তো নয় মালতি রাণী চায় একটা ফুটফুটে বউ নিয়ে বাছা আনন্দ-সুখে দিন পার করুক। রঘুনাথ রাজভরের বিঘাখানেক মাঠাল জমি, বাজারের জুতা সেলাইয়ের দোকান, তিনখানা দুধেল গাভী, তিনকাঠা মাটির দোচালা বাড়ি আর মালতী রাণীর বারো আনি সোনার মটরদানা হার থাকতে বাছাকে কেন কাঁধে সংসারের জোয়াল নিতে হবে? রঘুনাথ রাজভর খুঁজেপেতে একটা ফুটফুটে কন্যা যোগার করুক বরং হরিপদর জন্য।
মালতী রাণীর ইচ্ছা রঘুনাথ রাজভরকে উতরিয়ে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো বুঝিবা। তাই তো বিলে নতুন জল পড়তেই পূবের গ্রাম থেকে প্রস্তাবখানা প্রায় উড়েই এলো সেদিন। কন্যার গায়ে ফুল পড়েছে সবে। হাতেপায়ে বাড়ন্ত কন্যা বয়সের আগেই বয়স্থা হয়ে ওঠায় তড়িঘড়ি শ্বশুরঘর খুঁজছে বাবা। সেই খোঁজ এ গ্রাম ও গ্রাম হয়ে হরিপদ’র গ্রামে এসে পড়তেই একজন কন্যার বাবাকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মালতি রাণীর উঠোনে,
কুটুম আসিছে বউ…উলুযোগার দাও গো…
সন্তোষ রুহিদাস, মানুষখানা সারাক্ষণ হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। আর গ্রামের বৌগুলোকে দেখলে সে ঠাট্টায় যুক্ত হয় নানারকম ইঙ্গিতপূর্ণ কৌতুক। সেসব কৌতুক শুনে গ্রামের বৌয়েরা ঘোমটায় মুখ লুকিয়ে হাসলেও গলায় কপট শাসনের সুরে বলে,
ঠাকুরপো, ময়-মরুব্বী তো মানতি হয়, নাকী? তোমার চেংরা বুদ্ধি আর পাকবি না…
এসব শাসনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্নেহ যে কেউই আন্দাজ করতে পারে। সন্তোষ রুহিদাস বছরের অর্ধেক সময় নিয়ম করে বাজারের মোড়ে ব্রাশ, ফার্মা, আলপিন, পেরেক, মাততুল, কৌটার রঙ দিয়ে বাক্স সাজিয়ে জুতা সেলাইয়ের জন্য বসলেও বাকী সময় কীর্তন করে বেড়ায়।
এতিম সন্তোষ রুহিদাসের এই সংসারে আপন বলে কোনো স্বজন নেই। এ কারণেই মনে হয় মানুষটি সুযোগ পেলে আত্মীয়তায় বেঁধে দেয় নানাজনকে।তেমন সুযোগের আঁচ সেদিন পেতেই নিধু মাহাতোকে নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলো রঘুনাথ রাজভরের বাড়িতে।
নিধু মাহাতো, ছোটোখাটো গড়নের একজন মানুষ। ধুতির খুটা দু’হাতের মাঝখানে রেখে নমস্কার করার ভঙিতে কথা বলেন সবসময়। ঘাড় ঝুঁকে সামনে একটু কুঁজো হয়ে থাকেন এমনভাবে যে পৃথিবীর সকল ভার কেউ তাকে বয়ে চলার আদেশ দিয়েছে। আর এতসব অনুসঙ্গ পেরিয়ে একবার যদি তাঁর মুখের দিকে তাকানো যায় তবে একটা দারিদ্রের হার জিরজিরে লাবণ্যহীন চেহারা দেখতে পাওয়া যায়। তাই প্রথম দফায় সন্তোষ রুহিদাসের সঙ্গে মানুষটিকে দেখে মালতি রাণী খুব একটা পাত্তা দেননি। আর উলু যোগার দেবার কথাটা নিছক মশকরা ভেবে উঠোনে দু’খান পিঁড়ি পেড়ে দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সন্তোষ রুহিদাস ইশারায় জল-বাতাসা দেবার ইঙ্গিত করে যখন বলে উঠেছিলো,
শাশুড়ী কেমন বৌমা চান গো…কন্যার বাপে জানতি চায়…
নিধু মাহাতো যেন এই কথাটারই অপেক্ষায় ছিলেন। চট করে দাঁড়িয়ে দু’হাতের ভেতর ধুতির খুঁট ধরে বলতে লাগলেন,
মেয়ে আমার সোমত্ত হৈইল কি হৈইল নাই সি কথা না বলি, তয় সংসারের সকল কাজ করতি পারে ইক্কেবারে বড় মাইনষের নাহাল…গ্রামের মাইনষে কয় ভবানী মায়ের মুখখান কাটি বসায়ে দিছে মেয়ের মুখে আর দেড় দিঘত চুলে তাক ডাঙ্গর লাগে খুব…
মালতি রাণী সত্যিই প্রস্তুত ছিলেন না এমন কথার। সন্তোষ রুহিদাসের ঠাট্টা মশকরা ভেবে নতুন মানুষটির দিকে মনোযোগও দিয়েছিলেন না সেভাবে। কিন্তু নিধু মাহাতোর মুখে কন্যা বৃত্তান্ত শুনে মালতি রাণীর আচমকা বোধোদয় হলো। তিনি বারান্দায় চটের আসন পেতে জল বাতাসায় আপ্যায়ন করার ফাঁকে খবর পাঠালেন বাজারে,
বাড়িত যাতি হবি…হরিপদ’র জইন্যি সম্বন্ধ আসিছে…
বেলা তখন গড়ায়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছিলো। দোকানের ঝাঁপ ফেলে দু’খানা সন্দেশ আর পোয়াখানেক লেডিকেনি হাতে ধরে রঘুনাথ রাজভর বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভেবেছিলেন,
উপযুক্ত কন্যার খোঁজ কি আর এমন করি উড়ে আসে নাকী…বিয়ের কথা উঠলি জলমিষ্টি খাইতি আসে সক্কলে এমনিই এমনি…
কিন্তু সেই দু’খানা সন্দেশ আর ক’খানা লেডিকেনির গতি হবার আগেই হরিপদ’র বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলো। কন্যা দেখা নেই, পাটিপত্রের মাছ মিষ্টি নেই—এ কেমনতর পাকা কথা?
আসলে হরিপদ’র বিয়ের জন্য মালতি রাণী যতই আকুলিবিকুলি করুক না কেন রঘুনাথ রাজভরের কোনো সায় ছিল না পুত্রের অকাল পাণিগ্রহণের আয়োজনে। তাই মুখে কিছু না বলিয়া উপযুক্ত কন্যা খোঁজায় ছিল তাঁর মন ছিল নিমরাজি। এজন্য মাস তিনেক ধরে দু’একটা যা উড়ো প্রস্তাব এসেছে সবগুলোই নাকোচের খাতায় ফেলে রঘুনাথ রাজভর সন্তুষ্টিতে ভুগেছেন,
উপযুক্ত কন্যা না পালি কেমন করি বিবাহ দেবো হরিপদর…
কিন্তু কে জানতো আষাঢ়ের এক দুপুরে নিতান্তই সাদামাটা উঠোনটা হরিপদর জীবনকে অকস্মাৎ আড়ম্বরপূর্ণ করে তুলবে। আর আড়ম্বরের ছকটা রঘুনাথ রাজভর সেদিন স্বয়ং নিজেই এঁকেছিলেন মনে মনে,
কইন্যা সুর ধরতি পারে এই কথাখান আগে বলতি হতো নিধু মশায়…আমাগের হরিপদও মতি রুহিদাসের কের্তনের দলে গায়…এইটো তাহলে রাজযোটক হবিনি রে সন্তোষ…
ব্যস্, কন্যা না দেখেই রঘুনাথ রাজভর নিধু মাহাতোকে মোটামুটি কথা দিয়ে ফেললেন,
পনেরই আষাঢ় কন্যা দেখি এক্কেবারে পাকা কথা দিয়ে আসপো আমরা…
মালতি রাণী দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্বামীর এই স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ দেখে বুঝে গেলেন তাঁর হরিপদর জীবন সোনাডাঙ্গা বিলের ঘাটেই বাঁধা পড়লো। আর সেই সঙ্গে বিলের জলে দাপিয়ে বেড়ানো, ডুব দিয়ে শালুক কুড়োনো, ডিঙি ভাসিয়ে ছয়আনি বিলের সাদা বক তাড়িয়ে বেড়ানো এক মেয়ের নিয়তিতে লেখা হয়ে গেলো আসন্ন সময়ের এক দুর্বোধ্য সময়ের গল্প।
বিলের বুকে জল বয়ে যায়। দিন গড়ায় সময়ের নিয়মে। আষাঢ়ের পূর্ণ চাঁদে বিলে আসে ভর জোয়ার। সেই জোয়ারে দিনে হাঁড়ি ভরা রসের মিষ্টি, বারোহাত তাঁতের শাড়ি আর পাঁচ টাকা দিয়ে রাজুবালার মুখ দেখে রঘুনাথ রাজভর। কিশোরী রাজুবালার ছটফটে চাহনির আড়ালে গভীর চোখ আর থুতনির টোলে জমে থাকা লাবণ্য সবকিছু ম্লান হয়ে গেলো বাতাস উজিয়ে আসা তীক্ষ্ণ সুরে,
আর যে ধৈরত ধরতে নারি
আর যে ধৈরত ধরতে নারি
আমি মুরলীর ধ্বনি শুনি
আহা মরিরে…
দু’টাকা রাজুবালার মাথায় ছুঁইয়ে রঘুনাথ রাজভর কিশোরী কন্যার দায় হতে নিধু মাহাতোকে উদ্ধারের ইঙ্গিত কুলনারীদের উলুযোগারের ধ্বনি হয়ে সোনাডাঙা বিলের বাতাসে ঘুরপাক খেতে লাগলো। পঞ্জিকায় লগ্ন মিলিয়ে বিয়ের দিন ধার্য্য করা হলো জৈষ্ঠ্যের পূর্ণিমায়।
হাতে খানিক সময় পেয়ে নিধু মাহাতো খুশি হয়েছিলো খুব। তাঁর বড় আদরের কন্যা রাজুবালা। কন্যাকে সে আর যাইহোক না সাজিয়ে শ্বশুরঘরে পাঠাতে পারে না। ডোলার ধান হাটে বেঁচে কান্র একজোড়া সোনার ফুল, রুপার রুলি আর জড়িপাড়ের শাড়ি যোগার করতে তার মাসখানেক প্রায় লেগে যাবারই কথা। তারসাথে বরযাত্রীদের আপ্যায়নের অনুসঙ্গও তো ছিল। তাই একমাস সময়ও যে কম পড়ে যেতে পারে ভেবেই পরের সপ্তাহে পৌঁছে গিয়েছিলেন হরিপদ’র বাড়ি। ক’খানা কড়ি, বিলের একটা কালবাউশ আর একধামা ধান দিয়ে পাটিপত্র করে এসেই শুরু করে দিয়েছিলেন বিয়ের সকল যোগারযন্ত।
কিন্তু যার বিয়ের জন্য খৈগাড়ি আর সোনাডাঙার বিলে ডিঙি ভাসছে এদিন-সেদিন সেই হরিপদই কিন্তু তখন পর্যন্ত অজানা ছিল সেই খবরে। মালতী রাণী তাঁর ছেলেকে চিনতেন। যতই ঘরছাড়া মন থাকুক হরিপদর নাড়ি তো পোঁতা সেই ঘরের কোণেই। তাই নিমাইচড়া গ্রামের রঘুনাথ রাজভরের বাড়িতেও শুরু হয়ে গেলো বিয়ের নানারকম মেয়েলি আচার।
বিলের মাটি এনে বাস্তু বানানো হয়, বিন্নি ধানের খই ভাজা হয়, মাটির হাঁড়ি হলুদ গুলে রাঙানো হয়। মালতী রাণীরও একমাত্র পুত্রের বিয়ে। বাছার মন ঘরে বাঁধা পড়বে এতদিন পর। তাই মনের আনন্দে তিনিও স্যাকরার কাছে রুপার মাকড়ি বানাতে দেন নতুন বউয়ের মুখ দেখবে বলে। রঘুনাধ রাজভরও গঞ্জ থেকে গরদের পাঞ্জাবী কেনেন, সোনালি কল্কিতোলা জমিনের শাড়ি কেনেন, পদ্মফুল আঁকা টিনের বাকশো কেনেন হাতের সময় ফুরিয়ে আসার আগেই।
এতোসব আয়োজনের আড়ালে মালতী রাণীর চোখ যার জন্য সকাল-বিকাল বিলের ঢেউয়ে ঘুরে বেড়াতো সে ফিরলো এক সন্ধ্যায় পানসি নৌকায় ভেসে,
মা, দেখরে রে মা তোর জইন্যি হরিবাসরের মেলা থিকি নক্ষ্মীর কৌটৌ আনিছি…
হরিপদ ছেলেটিই এমন। ঘরে থাকলে মা, মা করে সারাবেলা মাতিয়ে রাখে। আবার সুযোগ পেলে এই মাকে ভুলেই দিনের পর দিন ঘরের বাইরে কাটিয়ে দেয় কীর্তনীয়া হয়ে। বাছাধনের এই “ মা “ ডাকহীন দিনগুলো যে মালতী রাণীর কীভাবে কাটে তা একমাত্র জানে তাঁর গোবিন্দ। সেই গোবিন্দই হরিপদর জন্য লক্ষ্মীমন্ত কন্যা যুগিয়ে দিয়েছে মালতী রাণীর ডাকে সারা দিয়ে– এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছিলো লক্ষ্মীর কৌটো দেখে,
ও বাবা, তুমি কি করি জানিলে নক্ষ্মী ঘরে আসিপে? কেমন করি তুমি ওত দূরে বসি ঘরের নক্ষ্মীর জন্য কৌটো কেনার কথা মনে করিলে?
ওমা! সে আবার জানতে হয় নাকী? প্রতি পূর্ণিমায় হরিপদর মা তো ঘরে রাখা লক্ষ্মীঠাকুরের পটে জল-বাতাসা না দিয়ে জল পর্যন্ত খায় না। সেই পটের লক্ষ্মীকে কেন ভুলে যাবে হরিপদ? কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছে মা,
মা, কেমন করি ভাবলি তোর পটের নক্ষ্মী ঠাকুরের কথা আমি ভুলি যাবো? কত শখ করি তুই পতি পূর্ণিমায় তাক সাজাস সে কি আমি খিয়াল করিনি মনে করিছিস?
ছেলের কথায় হাসির হুল্লোড় উঠেছিলো মালতী রাণীর শরীরে। ঘর ছেড়ে দূরে থাকলেও বাছাধন যে বদলায়নি মোটেও এটা দেখে তিনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন সবকিছু নিয়ে। কারণ মা-বাবা অন্তপ্রাণ হরিপদ যে বিনাবাক্যে ছাদনাতলায় মায়ের হাতে দুধ-মিষ্টি খেয়ে পানসিতে উঠবে সোনাডাঙা বিলের পাড়ে অপেক্ষায় থাকা কন্যার জন্য, তা নিয়ে সকল সন্দেহ দূর হয়েছিলো সেইকালে মালতী রানীর।
কিন্তু ব্যাপারটা অতটাও সহজ ছিল না। নতুন বাস্তুতে কাঁচারঙ দেখেই উৎসুক হয়ে উঠেছিলো হরিপদ,
মা, মা রে বাড়িত কুনু অনুষ্ঠান হবি বলি মনি হইতিছে…কী অনুষ্ঠান কী বৃত্তান্ত ক দেখি না…
ছেলেকে বিয়ের বাদ্যি শোনানোর দায়িত্বটা অবশ্য রঘুনাথ রাজভর নিয়েছিলেন মা আর ছেলের কথার ভেতর ঢুকে,
হরিপদ, তোমার মায়ের খুব ইচ্ছা হয়িছে তোমার সংসার দেখার আর সংযোগে কন্যাও পায়িছি বড় উপযুক্ত। জৈষ্ঠ্যের পূর্ণিমায় তোমার গায়ে বিয়ের জল পড়বি…
দীর্ঘদিন বাড়িছাড়া হরিপদ এই আকস্মিক আয়োজনে প্রস্তুত ছিল না। তারঊপর না দেখে না শুনে কারো সঙ্গে ছাদনাতলায় বসতে হবে আজীবন পাশে অঙ্গীকার নিয়ে, এটা যেমন নামঞ্জুর ছিল হরিপদর তেমনি অভিমান জমেছিলো বাবা-মায়ের এই স্বেচ্ছাচারী আচরণে,
বিবাহ…আমার বিবাহ…
হরিপদর চোখে জমে থাকা নিরুৎসাহ দেখে প্রাণ কেঁপে উঠেছিল মালতী রাণীর। তাহলে কি বাছাধনের জন্য পাঁচ ঢাকে হলুদ কোটা হবে না? পেতলের কলসে আয়স্তি বঊদের নিয়ে ঘাটে যাওয়া হবে না জল সইতে? আর ওই যে রুপার মাকড়ি সেটাও কি আসবে না স্যাকরার ঘর থেকে?
প্রশ্নগুলো মালতী রাণীকে অপদস্থ করার আগেই রঘুনাথ রাজভরের কাছে থেকে এসেছিলো কঠিন আদেশ,
হরিপদ, বাপের মান রাখতি যা করতি হয় তাই করো…
হরিপদ রেখেছে বাপের মান। সকল অসন্তোষ সকল অভিমান মনে ভেতর ডুবিয়ে রেখে শোলার টোপর পড়ে চলে এসেছে সোনাডাঙা বিলের ঘাটে। এই ঘাটেই তো বাপ তার জীবনের রশি বেঁধে দিয়েছে। তবে বাপের কথার মান রাখতে চুপচাপ ছাদনাতলায় বসতে রাজী হলেও জীবনের বাকী হিসেবটুকু হরিপদ ঠিকই কষে রেখেছে। তাই বিয়ের দিন পাঁচেক পরেই কাউকে না জানিয়ে উত্তরের হরিবাসরের বায়না নিয়েছে। সে বায়নায় মাস ফুরাতেই অন্য কোথাও থেকে আরেকখানা বায়না যোগার করে ফেলবে হরিপদ।
মোটকথা, বাপ-মায়ের সংসারে আরেকটা মানুষ বাড়লো শুধু তাতে হরিপদর জীবনে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না।
তাই সোনাডাঙা বিলের ঘাটে ধান-দূর্বায় বরণ হয়ে কাঁচা দুধে পা ধুয়ে হাতে কাঁসার দর্পন নিয়ে ছাদনাতলায় বসে থাকলেও জীবনে আসন্ন মানুষটির প্রতি হরিপদর কোনো দায় নেই, কোনো অঙ্গিকার নেই। আনমনা হরিপদ তাই বর দেখতে আসা পাড়ার বউ মেয়েদের নানারকম ঠাট্টা টিপ্পনিতে নিরুত্তর থেকে যায় মনোযোগের অভাবে।
বর কি কানে শুনতি পায় না গো? ঠসা বরের লগি বিয়ে হতিছে রাজুবালার…
অথবা,
আমাগের রাজুবালার কপালে ইরকম বোবা বর ক্যান জুটিলো…
কথাগুলো পাঁচকান হতে হতে পৌঁছে গেলো রাজুবালার কানেও। বাপ নিধু মাহাতোর এনে দেওয়া জড়িপাড়ের লাল শাড়ি পড়ে কপালে চন্দন এঁকে রাজুবালা বসে আছে। এসব কথা শুনে তার বুক কেঁপে ওঠে। এমনিতেই বাপ-মাকে ছেড়ে পাঁচবিল দূরের শ্বশুরঘরে চলে যেতে হবে বলে মনের ভেতর হাহাকার উঠেছে রাজুবালার, তার উপর আবার বরকে নিয়ে নানারকম অসংলগ্ন কথা। কিশোরী রাজুবালা তেরহাত শাড়ির ভেতর যেন আরো গুটিয়ে গেলো খানিকটা।
বানের দিন এখন, যখন তখন আকাশ ভাঙা বৃষ্টির তোড়ে বান ডাকে বিলে। একটানা কয়দিনের বৃষ্টিতে ভেসে যায় বিলের বুকে জেগে থাকা গ্রামগুলোর নিত্যদিন। তাই আকাশের কোণে এক আধটু মেঘ মধ্যরাতের লগ্নের বদলে সন্ধ্যালগ্নেই বেজে উঠলো হরিপদর বিয়ের বাদ্যি। ছাদনাতলায় নিধু মাহাতো হাতে ধুটির খুট জড়িয়ে বসে গিয়েছেন কন্যাদানের মন্ত্র পড়তে।
হাঁটু ছুঁয়ে থাকা নিধু মাহাতোর হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হরিপদ। মনের ভেতর চলতে থাকা ঝড়ের কাছে বাইরে ওঠা বাতাসটুকু নেহাতই নিতান্ত। তবে সে ঝড়ের খবর থেকে অজানা নিধু মাহাতো এক মনে পড়ে যাচ্ছে মন্ত্র,
তুয়ভ্যমহং সম্প্রদদে…
এই মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই এয়োস্ত্রী বঊদের সাথে প্রায় জড়োসড়ো হয়ে এসে দাঁড়ালো রাজুবালা। প্রায় একহাত লম্বা ঘোমটায় ঢাকা তাঁর মুখখানা। বিয়ের বাদ্যি আর উলুযোগারের ধ্বনিতে মুখর নিধু মাহাতোর উঠোনে ছুঁয়ে ফেলা দুরত্বে দাঁড়িয়ে হরিপদর হবু বৌ। অথচ মাটি থেকে চোখ তুলে সেদিকে তাকানোর ইচ্ছেটুকুও বিসর্জন দিয়ে বসে আছে সে। তাই এয়োস্ত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ফোড়ন কাটে,
বরের দেকি শরমই শ্যাষ হয় না…না তাকালি শুভদৃষ্টি হবিনানে কলাম…মেয়েক কি আমরা ফিরোয়ে নিয়ে যাবো নাকী গো বর…
নানারকম শব্দে হরিপদ অপ্রস্তুত হলেও কেন জানি নিজের করা পণ থেকে সরে আসতে পারছে না সে। কেনই বা দৃষ্টির সাথে দৃষ্টির মিলন ঘটাতে হবে যখন মানুষটির প্রতি অনাগ্রহ হরিপদর মন ভরা? কেনই বা এসব আচার অনুষ্ঠানের ঘনঘটায় অজানা কাউকে দৃষ্টিতে জায়গা দিতে হবে?
প্রশ্নগুলো ঘুণপোকার মতো মনটাকে একটু একটু করে কাটার আগেই কোথা থেকে যেন ধেয়ে এলো দমকা বাতাস। সেই বাতাসে ছাদনাতলার রঙিন কাগজে সাজানো কলাগাছগুলো দুলে উঠলো আচমকা। নিভে গেলো কুলায় সাজানো থানের প্রদীপ। উপুর হয়ে পড়ে গেলো দানের কলস ভরা ধান। সামিয়ানার দড়িখানা ছিঁড়ে গেলো পুঁতে রাখা বাঁশের গা থেকে। হৈ চৈ হট্টগোলের গোলকধাঁধায় বরাগমনের যাত্রীরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এ বাড়ির বারান্দা, ও বাড়ির গোয়ালঘর যখন বেছে নিচ্ছে তখন ছাদনাতলায় এক অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছেন কন্যার পিতা নিধু মাহাতো।
বাতাসের সাথে ঝরছে তীরের মতো তীক্ষ্ণ জলের ফোঁটা। সে বৃষ্টিজল এলোমেলোভাবে ভিজিয়ে দিচ্ছে ছাদনাতলা। কাগজের নকশী থেকে গড়িয়ে পড়ছে রঙিন জল। ভেসে মুছে যাচ্ছে ছাদনাতলায় খড়িমাটির আল্পনা। আর এসবকিছু থেকে বেখেয়াল হরিপদ পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে রাজুবালার দিকে।
হ্যাঁ, হাওয়ার দমকে অনেক আগেই উড়ে রাজুবালার ঘোমটা। কপালের চন্দন, জল চুঁইয়ে মুছে গেছে তাও অনেকক্ষণ। শুধু তেরোহাত জড়িপাড়ের লাল শাড়িটা খুব কায়দা করে জড়িয়ে রেখেছে রাজুবালা বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে।
বাতাস নাকী ভয়ে তা জানা নেই হরিপদর,সে শুধু দু’চোখ ভরে দেখছে তিরতির করে কেঁপে চলা রাজুবালাকে। কন্যার লাবণ্যভরা মুখটা দেখে নিজের করা সব প্রতিজ্ঞা ভুলে হরিপদর বুকের ভেতর বেজে উঠলো সুর,
ছাড়িয়া না দিব বন্ধুরে ছাড়িয়া না দিব
তুমি যদি ছাড় বন্ধুরে আমি না ছাড়িব
ওরে সুনারো পুতুলার মত হৃদয়ে রাখিব
তুমি হইবায় কল্পতরু রে বন্ধু আমি হইব লতা…
কন্যার পিতা নিধু মাহাতো কি বুঝিলো কে জানে লাজ- শরমের মাথা খেয়ে সম্প্রদানের মন্ত্র ভুলে ভিজে একসার হয়ে যাওয়া শোলার মালা দুটো হরিপদ আর রাজুবালার হাতে দিয়ে বলে উঠলো,
শুভদৃষ্টির পরে মালাবদল করতি হয় বাবা…
হরিপদ মোহগ্রস্তের মতো শোলার মালা রাজুবালার গলায় পড়িয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালো রাজুবালার সামনে। যেন কন্যার সকল দায় গ্রহণ করে এখনই নত সে রাজুবালার সম্মুখে।
বাতাসের সাথে উড়ে আসা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বিলের বুকে তুলছে রিমঝিম সুর। সে সুরে হরিপদর গলায় শোলার মালা পড়িয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো ঢাকের বাদ্যিহীন এই বিয়ে।
ঝড়ঝঞ্জার এই বিয়ে হরিপদ আর রাজুবালার শান্ত জীবন কতটা উত্তাল করবে, তা জানতে জলের দিন পেরিয়ে শুকনো বিলের গল্প জুড়তে হবে। আশেপাশের সকল বিলের মতোই খৈগাড়ি বিলে জল আসলে সমুদ্রের মতো ফুঁসতে থাকে। আর ফুঁসতে থাকা জলের ভেতর একেকটি গ্রাম একলা দাঁড়িয়ে থাকে অন্যগ্রামের সাথে আত্মীয়তা ছিন্ন করে। এসব সময়ের জন্য খৈগাড়ি গ্রামের সব বাড়ির ঘাটেই বাঁধা থাকে ডিঙ্গি। আবার জল ফুরিয়ে গেলেই বিলের বুক চিরে জেগে ওঠা সবুজ দেখে ক’দিন আগের জলসমুদ্রের গল্পকে রূপকথা মনে হয়।
কথায় আছে, জলের পানা শুকনায় কানা। কিন্তু হরিপদ মানুষটি অন্যধাঁচের। জলের সাথে তাঁর সখ্যতা কোনোকালেই হয়নি। জলের দেশে জন্ম তাই উপায়ন্তরহীন হয়ে ডিঙি ভাসায় ঠিকই, তবে শুকনো বিলের মাটি তাঁর সত্যিকারের সুহৃদ।
এরমধ্যে তাঁদের বিয়ের বয়স হয়েছে সাতমাস। এই সাতমাসে শ্রাবণী পূর্ণিমার ঝুলন উৎসব শেষ হয়েছে, আশ্বিনের বড় পূজা ফুরিয়েছে, অগ্রহায়ণের অন্নপূর্ণার পুজা শেষ হয়েছে। এরকম আরোও কত পার্বণ এসেছে আর চলে গেছে। মালতী রাণী দু’চোখ ভরে দেখেছেন তাঁর বাছাধনের সুখ আর আনন্দ।
রাজুবালা সত্যিই খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে সংসারের সাথে সাথে মালতী রাণীকেও সহজেই আপন করে নিয়েছে রাজুবালা। সকাল-সন্ধ্যায় মালতী রাণীর মাথায় তেল বসিয়ে চুল বেঁধে দেওয়া, বিষ্যুদবারে সিঁদুর-আলতা পড়িয়ে দেওয়া, বিয়েতে উপহার পাওয়া সবচেয়ে ভালো শাড়িখানা মালতী রাণীকে দিয়ে দেওয়া— সবকিছুতেই রাজুবালা একটু একটু করে দখল করে নিয়েছে এ বাড়ির সকলের অন্তর। আর অন্তর দখল করা মেয়েটার রঘুনাথ রাজভর মাটির ঘটে টাকা জমাচ্ছে,একটা হারমোনিয়াম কিনবে বলে। কারণ গলার সুর শুনেই তো রাজুবালাকে এ বাড়ির এয়োস্ত্রী করে নিয়ে এসেছেন তিনি।
তবে যতদিন হারমোনিয়াম না আসবে ততদিন কি রাজুবালার গান গাওয়া বন্ধ থাকবে? তাই প্রতি মঙ্গলবার রাধামাধবের মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির সময় নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যান রাজুবালাকে,
মা জননী, লীলা কীর্তনের সুরখান ধরি দেখাইতো…
দয়া নি রাখবায় বন্ধু অধম জানিয়া
ভাবিয়া রাধারমণ বলে শুন গো ধনী রাই
পাইবায় তোমার ঠাকুর কৃষ্ণে কোনো চিন্তা নাই…
বিলের বাতাসে রাজুবালার তীক্ষ্ন সুর ভাসতে থাকে সন্ধ্যা উতরে যাবার আরও খানিক সময় পরও। আর সেই সুর পথ দেখিয়ে কোথা থেকে যেন নিয়ে আসে হরিপদকেও, সুর মেলায় রাজুবালার সুরের সাথে।
রঘুনাথ রাজভর পুত্র আর পুত্রবধূর এই যুগলমিলন দেখে আড়ালে চোখের জল মোছে,
হা মাধব…আমার বেটা আর বেটার বৌকে ইরকম করিই সুখে রাখিও মাধব…
হরিপদ, যে ছেলেটি ক’দিন আগেও কীর্তনের দলের সঙ্গে ঘরছাড়া হতো অগুনতি দিনের জন্য সেই ছেলেটি গত সাতমাস খৈগাড়ি গ্রামের সীমানা পেরোয়নি—এটা দেখে মালতী রাণীর অন্তর জুড়ায়। এই অন্তর জুড়ানোকে যদি সুখ বলা হয় তাহলে মালতী রাণী খুব সুখী একজন মা।
আবার রাজুবালা, যে কিশোরী পাঁচবিল দূরে নিজের বাবা-মার স্নেহ ফেলে এসেও হরিপদর হুটহাট এনে দেওয়া মোদক মিষ্টান্ন ভান্ডারের রসকদমে পৃথিবীর সব স্নেহ খুঁজে পায়—এই স্নেহ পাওয়াকে যদি সুখ বলে তাহলে রাজুবালা প্রচন্ড সুখী। কিংবা বিলের বুকে জল শুকিয়ে জেগে ওঠা মাটির সর্ষে ক্ষেতে রাজুবালার আকস্মিক চপলতায় স্থান-কাল ভুলে হরিপদর প্রায়ই প্রেমিক হয়ে ওঠা—এই প্রেমকে যদি সুখ বলা যায় তাহলে হরিপদ এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী প্রেমিক।
আদতে খৈগাড়ি বিলের ঘাটে রঘুনাথ রাজভরের বাড়িটার শান্ত-স্নিগ্ধ রূপটার সাথে সুখ শব্দটি যেন চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলো এই ক’মাসের জন্যই। কারণ এরপর যা ঘটলো তাকে কি শুধু অদৃষ্টের লেখা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়?
ফাল্গুন মাস আসতে না আসতেই খৈগাড়ি বিল সবুজের সমুদ্র হয়ে যায়। রঘুনাথ রাজভরের বাড়ি লাগোয়া বিলের ঘাটে যে বিঘাখানেক জমি শীতে জেগে ওঠে তাতে ফাল্গুনে লাঙল দেয়ার প্রথা চলে আসছে পাঁচপুরুষ ধরে। সেই প্রথায় মাটির বুক চিরে নীলকমল ধানের বীজ রুয়ে দেওয়া হতো দিনের আলো মাটিতে পড়ার আগে। এবছর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাঁধে লাঙল তুলে নিয়েছে হরিপদ,
সংসারের জইন্যি সক্কলকে খাটতি হয়…না হলি শ্রী কমি যায় সংসারের…
মুখে আঁচল চাঁপা দিয়ে মালতী রাণী হাসে। তিনি জানেন ছেলের মুখ থেকে বেরোনো শব্দগুলোর হদিস রাজুবালা দিয়েছে, নয়তো হরিপদকে সংসারের পাঠ আর কে পড়াতে পারে।
সেই বীজ থেকে বিলের মাটি সবুজ হতে সময় লাগে না মোটেও। সপ্তাহ দুয়েকের ভেতর মাটির বুকে তিরতিরিয়ে গড়িয়ে যায় সবুজ হাওয়া, ঠিক রাজুবালার উচ্ছ্বল হাসির মতোন। হরিপদ সেই সবুজে হাত বুলায়,
সারাবছর বিলে ক্যান যে মাটি জাগি থাকে না…
আহা, বিলের ছেলে হয়েও জলকে কোনোদিনই আপন করতে পারলো না হরিপদ।
তবে রাজুবালা কিন্তু ঠিক এর উল্টো। তাকে বরং জলকন্যা বলা যায়। বিলের জলে হুটোপুটি করতে খুব ভালো লাগে রাজুবালার। তবে শ্বশুরদেশে জলে হুটোপুটি করা অবশ্য শোভনীয় নয়। তাই জলের দিনগুলোতে কখনো শাশুড়ী কখনো হরিপদকে ঘাটে দাঁড় করিয়ে রেখে রাজুবালা দু’ডুব দিয়ে ওঠে। আর এমনি এক দুপুরে সন্তোষ রুহিদাসের দৃষ্টি আটকেছিলো ভেজা রাজুবালার শরীরে। সম্পর্কে বৌমা তাই নিজের দৃষ্টিকে সংযম করতে করতে ভেবেছিলো,
ও হরি, আনিছিলাম একরত্তি এক বালিকা কিন্তু ক্যামন করি এই কয়দিনে ভরন্ত যমুনা হয়ি উঠিছে দেখো…
সন্তোষ রুহিদাসের কথাগুলো শ্লীল না শোনালেও সত্যি তো বটেই। এই ক’মাসে রাজুবালা যেমন হাতেপায়ে বেড়েছে তেমনি বেড়েছে তার লাবণ্য। খৈগাড়ি বিলের জল গায়ে পড়তেই রাজুবালার শ্রী খুলেছে একদম হরিপদর যত্নে বেড়ে ওঠা নীলকমলের সবুজের মতো। আর এই ভরন্ত যমুনা রাজুবালা হয়ে উঠেছে গ্রামের সকল বৌ মেয়েদের থেকে আলাদা, হয়ে উঠেছে সর্বময়ী।
কিন্তু এই যে অনেকের মধ্যে এক হয়ে ওঠা যে একটা অভিশাপ তা এখনো জানা নেই রাজুবালার।
রাজুবালাকে বিলের এপাশে রেখে আমরা বরং ঘুরে আসি ওপারের শহর থেকে। যে শহরের বুকে ক’দিন আগেই পা পড়েছে কালো বুটের। কালো বুটের তলায় পিষে ফেলা হয়েছে সুজাবত নামের হাইস্কুলের ছাত্রটিকে, কালো বুটের তলায় দুমড়ে ফেলা হয়েছে বাগবাটির শাহ আলী আকন্দের পুরো পরিবারকে, যে বুটের ইশারায় আগুনে পুড়েছে শহরের সকল অলিগলি। আর সে আগুনের একটু আধটু আঁচ বিল পেরিয়ে এ গ্রাম ও গ্রামেও পৌঁছে যাচ্ছে একটু একটু করে।
তবে সদ্য যুগলজীবনের সুখ খুঁজে পাওয়া হরিপদ আর রাজুবালার জীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না এটা তো স্বত:সিদ্ধ। তবে রঘুনাথ রাজভরের মতো জীবনানুভব মানুষটিও যখন এই আঁচের দিশা বুঝে উঠতে না পারে, তখন ভয়ংকর কোনোকিছু ঘটবে— তা মনে হয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই ঘটনার সূত্রপাত হলো রঘুনাথ রাজভরকে দিয়েই,
ক্যা রে সন্তোষ কাজকাম তুলি দিলি নাকি সব? বাজারে তোর কামের জাগাত পাওয়া যায় না ক্যারে?
ক’দিন হলো সন্তোষ রুহিদাসের মন ভালো নেই। ঘর নাই, সংসার নাই, স্বজন নাই তাহলে কি হবে কাজ দিয়ে? গ্রামের সব অর্ধেক বয়সী ছেলেপুলে বিয়েশাদি করে কত সুন্দর সংসার করছে। নিজেই তো কতজনের সংসারের সংযোগ ঘটালো। কিন্তু নিজের বেলায় সন্তোষ রুহিদাস বারবার ফেল করছে। এতিম সন্তোষের সংসার গড়ে দেবার কথা পাড়া পড়শী কেউ কখনো ভাবেনি। আর এখন যখন নিজেই লাজ শরমের মাথা খেয়ে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে কেউ তাঁকে কন্যা সম্প্রদান করতে রাজি হয় না,
গ্রামের বৌ-ঝিগের পেছন সারাক্ষণ ছুঁকছুঁক করি বেড়াই যে তার স্বভাব চরিত্তির কেমুন হবিনি তা আর কতি হবি না…
কম করে হলেও পাঁচখানা কন্যার বাবা এমন বলে দিয়েছে মুখের উপর। তাই আপাতত বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে সন্তোষ রুহিদাস আদারেবাদারে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
সন্তোষ রুহিদাস যখন বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন তাকে নিয়ে রঘুদাস রাজভর শহরে যেতেই পারে।
শহরের বুকে জ্বলে ওঠা আগুন, রক্তাক্ত জেলখানা রোড, হরিণাপুরের লুটতরাজ, হোসেনপুরের ক্যাম্প— সবকিছুকে গন্ডগোল যারা করছে তাদের দায় ঘোষণা করে রঘুনাথ রাজভর সাইকেলের পেছনে সন্তোষ রুহিহাসকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন শহরের উদ্দেশ্যে।
কেন এ সময় শহরে যেতে হবে? শহরে তো গন্ডগোল চলছে? মিলিটারির ক্যাম্প হয়েছে শহরে।
গন্ডগোল থামাতেই তো মিলিটারি এসেছে শহরে। যারা গন্ডগোল করছে তারা ভয়ে পালাবে, এখানে রঘুনাথ রাজভরের তো ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। কারণ তিনি তো গ্রামের এক সাধারণ মানুষ।এসব গন্ডগোল রাজনীতি নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেয়ে স্ত্রী, ছেলে-ছেলের বৌ নিয়ে এরকম সুখের জীবন কাটিয়ে যেতে চান বাকী সময়।
আর সেই সুকজে এক নতুন অনুসঙ্গ যোগ হয়েছে। সেটা হলো রাজুবালার কন্ঠে সন্ধ্যা আরতির সুর। সেই সুরে সঙ্গতের উপকরণের জন্যই সন্তোষ রুহিদাসকে নিয়ে রঘুনাথ রাজভর পৌঁছেছেন শহরে।
কিন্তু এ কেমন শহর দেখছেন তিনি! রঘুনাথ রাজভরের চেনা নয় এ শহর। শহরের মানুষগুলোও কেমন সব অচেনা। চেনাজানা মানুষগুলো গেলো কই? যাওবা দু’একজন চেনা মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে তারাও কেমন যেন চুপচাপ, আড়ষ্ট। বাড়তি কিছু জিজ্ঞাসা করলেই হয় সবাই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নয়তো চোখেমুখে বিরক্তি এনে বলছে,
কইতি পারি না…
কড়ইতলায় বাদ্য-বাজনা’র দোকানে তালা ঝুলতে দেখে কিছুক্ষণ আগেই রঘুনাথ রাজভর কারণ জানতে চেয়েছিলো পাশের চা দোকানির কাছে। খালি চায়ের কাপগুলো এদিকওদিক করার ভান করে ঠিক এই উত্তরটাই পেয়েছেন তিনি।
তবে এখনো শহরের আরেকটা নতুন ব্যাপারের সাথে সংযোগ ঘটেনি রঘুনাথ রাজভরের। থমথমে শহরের মাঝখানে বসা চেকিং পয়েন্ট আরেকটু পরেই তাঁকে জানিয়ে দেবে দেশে চলা গন্ডগোলের হেতু।
ওয়াপদা রেস্ট হাউজ শহরের ঠিক মাঝখানে। সেখানে মিলিটারি ক্যাম্প বসেছে অল্প কিছুদিন। এই ক্যাম্পের গা ঘেঁষা গয়লা হাইস্কুলের মাঠে ক’দিন আগেই একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। একটা কিশোর বয়সী ছেলেকে কয়েকজন মিলে ধাওয়া করছিলো স্কুলের মাঠে,
মালাউনের বাচ্চা…মালাউনের বাচ্চা…
ছেলেটা আতংকে দৌড়াচ্ছিলো আর বলছিলো,
আমি হিন্দু না…হিন্দু না…
কিন্তু সে কথায় কেউ কান না দিয়ে ছেলেটাকে ধরার জন্য শুধু ছুটছিলো। পেছনে পাঁচ/সাতজন যুবক আর মধ্যবয়সী পুরুষদের শকুনি দৃষ্টি নিয়ে দৌঁড়ানো দেখে কিশোরটি হঠাৎ করেই থেমে দাঁড়িয়েছিলো,
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ।আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওহদাহু লা-শারীকালাহু ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাছুলুহু।লা-ইলাহা ইল্লা আনতা ওয়াহেদাল্লা ছানীয়ালাকা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লা ইমামুল…
যে ছেলেটি পাঁচ কলেমা পড়তে পারে সে কীভাবে মালাউন হয়? তাই কেউ কেউ বিশ্বাস করে ছেলেটিকে চলে যেতে দিতে চাইলো। কিন্তু তাহলে মসজিদের কোণায় ওভাবে লুকিয়ে ছিলো কেন ছেলেটি? মসজিদ আল্লাহর ঘর, ইবাদতের ঘর। ওখানে যারা ইবাদতের সময় ইবাদত না করে লুকিয়ে থাকে তারা পাপী, তারা মুসলমান হতে পারে না। তাই দেখা হোক খৎনা করা আছে নাকী ছেলেটির, তাহলেই সব বোঝা যাবে।
কিশোরটি মনে হয় সেসময় একটা শেষ দৌড় দিতে চেয়েছিলো জীবনের দিকে। কিন্তু তার আগেই উলঙ্গ সময় চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছিলো তাকে,
মালাউনের বাচ্চা…শালা নেংটি…মসজিদে ঢুকিছিলি নাপাক শরীরে…
অজস্র কিল ঘুষি আর লাথির সমাপন হয় ক্যাম্প থেকে তেড়ে আসা গুলির আওয়াজে। এইসব মালাউনদের জন্যই দেশে আজ গন্ডগোল বেঁধেছে। মিলিটারির গুলিতে একেকটা নাপাক মালাউন মরবে আর দেশ হবে পাক।
এই পাক ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পের সামনে বসানো হয়েছে চেকিং পয়েন্ট। রাস্তায় চলাচল করা পথচারীদের ভেতর যাকে সন্দেহজনক মনে হবে তাকেই উলঙ্গ করে পরীক্ষা করা হবে মালাউন কীনা।
আর ঠিক এই সন্দেহের বিপাকেই পড়লো রঘুনাথ রাজভর। সঙ্গে সন্তোষ রুহিহাসও। খাকি রঙের পোশাকে মানুষগুলো কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না রঘুনাথ রাজভর। শুধু মাথা নেড়ে সায় দেবার ভঙ্গি করে যাছে। তাছাড়া আর কীই বা করবেন তিনি। কারণ গন্ডগোল তো তিনি করেননি। তাই সাহস নিয়ে মাথাটুকু নাড়ছেন এটা ভেবে যে, তাঁর কিছু হবে না। এরসাথে চলছে সন্তোষ রুহিদাসের ধারা বিবরণী,
ঠিক কতিছে রঘু দা আমরা গন্ডগোল করি নাই। দ্যাশটা আমাগোরেও, কিসের জইন্যি গন্ডগোল করতি যাবো কন…
খাকি পোশাকের মানুষগুলো এবার ধমকের সুরে কিছু বলে উঠলো। থতমত খেয়ে রঘুনাথ হাত জোর করে বলে যাচ্ছে,
বাবুরা, আমগোরে গন্ডগোলের লোক ভাইবেন না…আমরা জুতা সেলাই করি…
এসব বেকুব বাঙালিদের সাথে কথা বলা মানে সময় খরচ। তাই প্রায় হরিপদর বয়সী এক মিলিটারি টান দিয়ে খুলে দিলো রঘুনাথের লুঙ্গি। লজ্জায় সন্তোষ রুহিহাস চোখ বুজে ফেলেছে,
আমরা গন্ডগোল করিনি গো….গন্ডগোল করিনি…
সন্তোষ রুহিদাসের বন্ধ নজরের ওপাড়ে থরথর করে কাঁপছেন রঘুদাস রাজভর। কি হলো, কেন হলো— এসবকিছু না বুঝতে পেরে থপ করে বসে পড়ার সময় অজস্র কথা থেকে কানে টোকা দিলো পরিচিত একটাই শব্দ,
হিন্দু…
শব্দটার গুরুত্ব কতখানি কীভাবে যেন বুঝে ফেললো সন্তোষ রুহিদাস,
আমি হিন্দু না…হিন্দু না…
খাকি পোশাকের ওরা হাসছে। মশকরা করছে সন্তোষ রুহিদাসের সঙ্গে। ভাষা বুঝতে না পারলেও অঙ্গভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে ওরা খৎনা করার কথা বলছে। সন্তোষ রুহিহাস কারো অপেক্ষা না করেই নিজেই লুঙ্গি খুলে দাঁড়িয়ে পড়লো ওদের সামনে,
আমি মুসলমান হবো…খৎনা করি দাও কিন্তু মারি ফেলি দিও না…
খাকি পোশাকধারীদের ভেতর থেকে একজন হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে কিছু বললো। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাতাস কাঁপিয়ে দুটো গুলির শব্দে কানে তালা লেগে গেলো সন্তোষ রুহিদাসের। পায়ের তলায় উষ্ণ তরলের স্পর্শ। সন্তোষ রুহিহাস বন্ধ চোখেই দেখে নিচ্ছে শহরের ধুলোমাটিতে গড়িয়ে পড়া রঘুনাথ রাজভরের দেহকে। উলঙ্গ সন্তোষ রুহিহাস অসার হয়ে বসে পড়লো গড়িয়ে যাওয়া রক্তের ধারার ওপর।
হয়তো পরের গুলি দুটোর নিশানা তার বুকই ছিলো। কিন্তু কিছু একটা হলো ওদের। উলঙ্গ সন্তোষ রুহিদাসকে চেকিং পয়েন্ট থেকে টেনে নিয়ে চললো ক্যাম্পের ভেতর।
খৎনা দেওয়া হবে নাকী কাতিল করা হবে? প্রশ্নটা সন্তোষ রুহিদাসের বুকের ভেতর কি এখন তোলপাড় করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার সুযোগ নেই। কারণ চোখ বন্ধ সন্তোষ রুহিদাসের হাল ছেড়ে দেওয়া শরীরটি দেখে বোঝার উপায় নেই তার বুকের ভেতর তোলপাড় ওঠার জন্য শ্বাসটুকু অবশিষ্ট আছে কি নেই। তাই খাকি পোষাকের দুটো মানুষ বস্তার মতো টেনে নিয়ে ফেললো উলঙ্গ সন্তোষ রুহিহাসকে ক্যাম্পের ভেতর।
আবার শুরু হলো খাঁকি পোশাকধারীদের অবোধ্য কথপোকথন। মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে সন্তোষ রুহিহাস, যেন লুকাতে চাইছে ওদের কাছ থেকে। কিন্তু চোখ বুঝলেই কি দুনিয়া থেমে যায়? তাই সন্তোষ রুহিদাসকে টেনে তুলে দাঁড় করানো হলো। চিৎকার করে কেউ একজন কিছু বললো, সাথে আরো অনেকগুলো মানুষের দম ফাটানো হাসি। আবার চিৎকার করা কিছু শব্দ আর শক্ত হাতের একটা থাপ্পড় এসে পড়লো সন্তোষ রুহিদাসের গালে।
বন্ধ চোখ খুলে গেলো তার। তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বেশকিছু অর্ধ উলঙ্গ মেয়েদের সামনে। এদের কেউ হাঁ করে তাকিয়ে আছে সন্তোষ রুহিদাসের দিকে, আবার কেউ চোখ নামিয়ে রেখেছে মাটির দিকে।
সন্তোষ রুহিহাস হাত দিয়ে নিজেকে ঢাকতে চাইলো। যেন মৃত্যূর চেয়ে সম্মান বড়! কিন্তু এই সম্মানেই তো আঘাত করতে চাইছে ওরা। সন্তোষ রুহিদাসের হাত দুটো দু’দিকে ধরে তার সম্মানকে খিল্লি করে হেসে উঠলো খাকি পোশাকের সবাই।
সন্তোষ রুহিহাস কি আবার চোখ বন্ধ করে লুকিয়ে পড়তে চাইবে? নাকি বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুনয় করবে?
না, কোনোটাই হলো না। বরং সন্তোষ রুহিদাসের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটি শব্দ,
অওরত…সুন্দর অওরত…অনেক সুন্দর অওরত…
কি বলে সন্তোষ রুহিহাস? মৃত্যূভয়ে মাথা খারাপ হলো নাকী তার? খাকি পোশাকের সবাই এই ভয়টাই তো দেখতে চায়। তাই আরেকদফা দফ ফাটানো হাসি,
হাঁ…সুন্দর অওরাৎ
সন্তোষ রুহিহাস এবার যেন আরেকটু জোর পেলো,
হো…আমাগোর গেরামে সুন্দর অওরত আছে…অনেক সুন্দর অওরত…
কান খাড়া হলো এবার খাকি পোশাকধারীদের। সুন্দর অওরাৎ…গেরামে…অনেক— কীভাবে যেন পুরো অর্থ নিয়ে হাজির হলো ওদের সামনে।
কোন গ্রামে আছে অনেক সুন্দর অওরাৎ? কেন তাদের খবর আসেনি খাকি পোশাকধারীদের কাছে? তাহলে সন্তোষ রুহিদাস নিয়ে যাক পথ দেখিয়ে সুন্দর অওরাৎদের গ্রামে।
উলঙ্গ সময়ের অবসান হলো। লুঙ্গির গিট শক্ত করে বেঁধে নিচ্ছে সন্তোষ রুহিহাস,
মেয়েলোকের কথা কলি জীবন ভিক্ষে পাওয়া যায়, এটা জানলি তো রঘুনাথ দা’ক মরতি হতো না…
মনের ভেতর কথা উঁকি দিতেই নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে হলো তার। মাথার ভেতর দ্রুত হিসেব কষে নিলো ক’খানা বাড়ির। উত্তর পশ্চিম মিলিয়ে কম করে হলেও চারখানা মেয়েলোকের সন্ধান দিতে পারবে সে। প্রয়োজনে আশেপাশের গ্রামেও খুঁজতে হবে। নিজেকে মেয়েধরা মনে হচ্ছে সন্তোষ রুহিদাসের,
সুন্দর অওরাৎ…
শব্দদু’টো ঠোঁটের কোণে জমা করতেই সেদিনের জলভেজা রাজুবালার দেহটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো হুট করে। নিজের শরীরের ঝাঁকুনিকে উপেক্ষা করে সন্তোষ রুহিদাসকে বসতে হলো জীপগাড়িতে।
পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তো তারই।
জীপগাড়িতে বসায় অনভ্যস্ত সন্তোষ এরইমধ্যে কয়েকবার সিট থেকে গড়িয়ে নীচে পড়লো। এটা যেন একটা খেলা। প্রতিবার হুট করে শক্ত ব্রেক চাপলেই হুড়মুড়িয়ে সিট থেকে পড়ে যাচ্ছে সে। আর সাথে উঠছে হাসির হুল্লোড়। তবে এতে ভ্যাবাচ্যাকা খাবার বদলে সন্তোষ রুহিহাস হাসছে। হা..হা…করে হাসছে। যেন ওদের সাথে তাল মিলিয়ে কোনোরকমে গ্রামে পৌঁছে গেলেই হলো। এরপর তো গুনে রাখা বাড়িগুলো চিনিয়ে দিয়েই সে পথ ধরবে সাঁতৈল গ্রামের দিকে। গন্ডগোল শেষ না হলে আর এমুখো হবে না।
শুকনো বিলের এপাশে জীপগাড়ি থামিয়ে এবার হাঁটার পালা। পালের গদার মতোন একঝাঁক অজানা মানুষকে পেছনে নিয়ে সন্তোষ রুহিহাস হেঁটে চলেছে। এ চলায় অদ্ভুত এক দম্ভ। এ দম্ভ গুরুত্বের,
ওই যে কলাগাছের ঝোপখান দেখা যায় ওটা পাড় হলিই সুন্দর অওরতের বাড়ি…
নতুন শেখা অওরাৎ শব্দটি এমনভাবে সন্তোষ রুহিদাস বারবার বলছে যেন ওটাই তার জীয়নকাঠি।
কলাগাছের ঝোপের পড়ে আরো তিন বাড়িতে নিয়ে গেলো সন্তোষ রুহিদাস ওদের্কে পথ দেখিয়ে। কোনো বাড়ি সুনসান তো কোনো বাড়িতে এক দু’জন বৃদ্ধ মানুষ। সবাই পালিয়েছে শুকনো বিলের ওপাড়ে মিলিটারির গাড়ি আসার কথা শুনেই। তাই খুব সহজে সুন্দরী অওরত খোঁজার অভিযান নিস্পত্তি হলো না।
সাধনা, ইতি, আসমা, মালা— এদেরকে চালের ডোল, কচুগাছের ঝোপ কিংবা খড়ের গাদার ভেতর থেকে বের করে আনতে বেশকিছু গুলি খরচ হলো। এতে কারো বাবা মরলো কারো মরলো ভাই কারো বা বুড়ো দাদী।
তা হোক, দ্যাশে গন্ডগোল লাগলি ইসব হয়ই…
সন্তোষ রুহিদাস অদ্ভুত আনন্দ পাচ্ছে এই অওরাৎ খোঁজার অভিযানে।
এবার রাজুবালার বাড়ির পথে ওরা। রাজুবালার কথা মনে হলেই সেই দিনের সেই ভেজা শরীর স্পষ্ট হয় সন্তোষ রুহিহাসের সামনে। উদ্যম বাড়ে তার। প্রায় দৌঁড়ে এবার এগিয়ে চলেছে সে।
ওই তো শুকনো ঘাটে এখনো উল্টে রয়েছে রঘুনাথ রাজভরের ডিঙ্গি,
মানুষ চলি যায়…কিন্তু তাঁর সকলকিছু পড়ি থাকে দুনিয়াত…
এখন অবশ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময়টুকুও নেই সন্তোষ রুহিদাসের। সে ডিঙির উপর লাফিয়ে উঠে হাক দেয়,
ক্যারে হরিপদ…আছিস?
যেন এখনি হরিপদ বের হয়ে এসে দাঁড়াবে আঙিনায়,
সন্তোষ কাহা নাকি…বাপ কই…তোমার সাথি গেছিলো তো শহরে…
না, এমন কিছুই হলো না। অন্যসব বাড়ির মতো এ বাড়িও সুনসান। কই পালালো সবাই? ঘরের ভেতর ঢুকে সব তছনছ করে খোঁজা হচ্ছে রাজুবালাকে।
হ্যাঁ শুধুই রাজুবালাকে খোঁজা হচ্ছে। অন্য সবাইকে দিয়ে এদের কি কাজ?
এ ঘরে নেই, ও ঘরে নেই, বাড়ির পেছনে ঝোপ-জঙ্গলে নেই, কোথাও নেই। থাক অনেক সময় অপচয় হয়েছে। তাছাড়া গুনে গুনে চারজন সুন্দর অওরাৎ পাওয়া তো গেছে।
না, তা হবে কেনো? রাজুবালাকে খুঁজে বের করতেই হবে। রাজুবালার নেশা চেপেছে সন্তোষ রুহিদাসের।
কিন্তু কোথাও নেই রাজুবালা। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। খাকি পোশাকধারীদের আর সময় নেই এক রাজুবালার জন্য। ওদিকে চারজন সুন্দর অওরাৎ তো আছেই। ওরা ফিরে যাবে এখন। ওদের ভেতর থেকে একজন কিছু একটা বললো। খপ করে শক্তিশালী একটা হাত এসে পড়লো সন্তোষ রুহিদাসের ঘাড়ে,
চল…
কেন সন্তোষ রুহিহাসকে যেতে হবে আবার? রাজুবালাকে না খুঁজে পেলে ও কি করবে? তাহলে রাজুবালার জন্য মরতে হবে তাকে?
মৃত্যূভয় জেঁকে বসতেই ওর চোখ পড়লো উল্টানো ডিঙিতে। আচ্ছা ডিঙিটা কি শহরে যাবার আগে এমন উল্টোনো ছিল?
চিৎকার করছে সন্তোষ রুহিদাস,
অওরত…অওরত…
তর্জনি তাক করা উল্টানো ডিঙির দিকে।
রাজুবালার মুখখানা তো সাক্ষাৎ ভবানী মায়ের মুখ। কিন্তু খাকি পোশাকধারীরা কেন বারবার বলছে,
নূর-এ-জাহান…
এমন নূরকে কি অচ্ছুৎ রাখা যায়? মালতি রাণী কয়েকবার ছুটে এসেছিলেন,
আয়োস্ত্রী বৌ আমাগের বাবা…সুয়ামী আছে রে বাবা…এমুন কাম পাপ রে বাবারা…
মালতী রাণীকে চাইলেই ওরা থামিয়ে দিতে পারতো একটা গুলি খরচ করেই। কিন্তু রাজুবালার নূরে সবাই মোহগ্রস্ত এখন। কে ছুড়বে গুলি? তাই কেউ একজন এক ঝটকায় মালতী রাণীকেও উঠোনে ফেলে দিলো।
আচ্ছা, মালতী রাণীর বাছাধন কি সব দেখছে আড়াল থেকে? অশ্রুসজল চোখে হরিপদ কি কৃষ্ণপালা গাইছে এখন?
একবস্ত্র পরিহিতা দ্রৌপদী সুন্দরী
দুঃশাসন টানিতেছে বসনেতে ধরি
ছাড় ছাড় বলি কৃষ্ণা ঘন ডাক ছাড়ে
সভামধ্যে ধরি তার অঙ্গ-বস্ত্র কাড়ে
সংকটে পড়িয়া দেবী না দেখি উপায়
আকুল হইয়া কৃষ্ণা স্মরে যদুরায়…
কুলটা মালতী রাণী এই প্রশ্নের উত্তর পাননি কোনোদিন। তাঁর বাছাধন সেই যে লুকোলো আর ফিরলো না কোনোদিন।
যুদ্ধ ফুরালো, শ্রাবণ ফিরলো, বিলের চলে ডিঙি ভাসলো কিন্তু হরিপদ ফেরেনি কোনোদিন কুলটা মালতী রাণীর কাছে। কেউ কেউ বলে যমুনার গলা জলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো হরিপদকে।
যে ছেলেটি চিরকাল জল এড়িয়ে এসেছে সে কেন যমুনার বুকে যাবে? কে জানে কি হয়েছিলো!
আর রাজুবালা? সে বিলের বাতাসে এখনো সুর ভাসায়,
দয়া নি রাখবায় বন্ধু অধম জানিয়া
ভাবিয়া রাধারমণ বলে শুন গো ধনী রাই
পাইবায় তোমার ঠাকুর কৃষ্ণে কোনো চিন্তা নাই…
তবে এই সুরে মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি হওয়া বারণ,
দূর হ কুলটা…কলস বান্ধি বিলের জলে ডুবি মরিস না ক্যান…
চারপাশ থেকে ভেসে আসা শব্দগুলো রাজুবালাকে হত্যা করে বারবার। কিন্তু বিলের বুকে জল ফুরিয়ে জেগে ওঠা সবুজের মতো রাজুবালাও সেই হন্তারক সময়কে নিরস্ত্র করে,
আমি অওরত নই গো…অওরত নই…
সেদিনের সেই নিস্পেসিত সময় থেকে এই কয়টি শব্দ জমিয়ে রেখেছে রাজুবালা মনের ভেতর। শূন্য দেহখানায় তখন যতটুকু বোধ ছিল তা দিয়েই খুঁজে নিয়েছিলো সন্তোষ রুহিদাসের আর্তনাদটুকু।
হ্যাঁ, সেদিন রাজুবালা আর মালতি রাণীকে নি:স্ব করে খাকি পোশাকের মানুষগুলো ফিরে যাবার সময় সন্তোষ রুহিদাসের পালিয়ে যাবার অনুমতি বাতিল করেছিলো যথারীতি। শুকনো বিলের উদ্মাদ বাতাসে শুধুই প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো সুন্দর অওরতের বাজী ধরা মানুষটির একতরফা আত্মচিৎকার,
আমি অওরত নই গো…অওরত নই…
রাজুবালার রুক্ষ্ম ঠোঁটে এই শব্দগুলোর যপ অদ্ভুতভাবে আজও তাঁকে ফিরিয়ে আনে জীবনের কাছে বারবার, অসংখ্যবার।
