সোমেন চন্দঃ জন্ম শত বর্ষের শ্রদ্ধা

Reading Time: 4 minutes

সোমেন চন্দের মৃত্যুর চার বছর পরে আমার জন্ম । তাছাড়া তিনি ঢাকার লোক, বাঙাল । আমি মেদিনীপুরের, ঘটি । তাই তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয়ের কোন প্রশ্ন ওঠে না । কিন্তু কি ছিল বিধাতার মনে, একদিন হয়ে গেল পরিচয় । মিলন হল ঘটি-বাঙালের ।

লেখক ছিলেন সোমেন চন্দ । আমি সাহিত্যের ছাত্র হলেও শুনিনি তাঁর নাম । নামডাক না থাকলে কি কারোর নাম শোনা যায় ! বেলভিডিয়ারের জাতীয় গ্রন্থাগারে এক গ্রীষ্মের দুপুরে আমি চিনলাম সোমেনকে, ‘পরিচয়’ পত্রিকার পাতার ভেতর দিয়ে । পড়লাম ‘ইঁদুর’ নামে একটি গল্প । মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লেদ-গ্লানি-ভন্ডামি-আত্মভরিতা কি চমৎকার ফুটে উঠেছে গল্পে, ফুটে উঠেছে মা-বাবার তিক্ততার পরে মিলনের ছবি। পাকা হাতের লেখা অথচ পাকামো নেই কোথাও ।

যখন জানলাম গল্পটি এক সতেরো-আঠারো বছরের তরুণের লেখা, তখন চমক আরও বেড়ে গেল । এই তরুণের জীবনের কথা জানতে হবে, জানতে হবে আর কি কি লিখেছেন তিনি । কিন্তু কোন জীবনী অভিধানে পাওয়া গেল না কোন সন্ধান । হঠাৎ হাতে এল সতীশ পাকড়াশি মশায়ের একটি লেখা । সোমেন চন্দকে নিয়ে । অন্ধকারের মধ্যে একটা আলোর ফুটকি । জানলাম ঢাকার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সোমেন চন্দ । জন্ম ১৯২০ সালে । ছোটবেলা থেকে সাহিত্যে অনুরাগ । আঞ্চলিক পত্রিকায় তাঁর গল্প-কবিতা প্রকাশিত হয় । কলকাতার বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকাতেও  প্রকাশিত হয়েছে ‘শিশুতপন’ নামে এক গল্প । লাজুক ছেলে । এসব খবর বাড়ির লোকেও জানতে দেয় না । নিজের ঢাক নিজে পেটানোর অভ্যেস নেই এক্কেবারে তার ।

ভালোভাবে পাশ করল ম্যাট্রিকুলেশন । বাড়ির লোকেদের ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ুক সে । ডাক্তারিতে ভর্তিও হল কিন্তু ছেড়ে দিল মাঝপথে । কেউ বলেন রোগভোগের জন্য, কেউ বা বলেন আর্থিক অনটনের জন্য সোমেনের ডাক্তারি পড়া হয় নি । কিন্তু আর একটা মস্ত বড় কারণ ছিল । সেটা হল ইচ্ছার অভাব। সোমেন যে লেখক হতে চান । হতে চান  তিনি মানবাত্মার ইঞ্জিনিয়ার । কলম আর কালি দিয়ে তিনি আঁকবেন মানুষের ছবি ।

এমনি সময়ে সতীশ পাকড়াশির সঙ্গে আলাপ । সতীশৈর মাধ্যমে তাঁর সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ ।

সতীশ সদ্য ফিরেছেন আন্দামান থেকে । বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে ইংরেজ সরকার আরো অনেকের মতো তাঁকে আন্দামানে নির্বাসিত করে । সেখান থেকে তাঁরা দেশে ফেরেন নতুন এক আদর্শে দীক্ষিত হয়ে । সাম্যবাদী আদর্শ । দেশে ফিরে সংগঠন গড়ার কাজে লেগে পড়েন তাঁরা ।

তাঁর মুখে সোমেন শোনেন সেই আদর্শের কথা । রাশিয়ার বিপ্লবের কথা । দেশে দেশে গণজাগরণের কথা । বিদেশি শাসন ছিন্ন করার আন্দোলনের কথা । লেখক-শিল্পীদের নতুন ভূমিকার কথাও শোনেন তিনি । এতদিন সোমেনের ধারনা ছিল ফুল-পাখি-গাছ-নদী-আকাশ-বাতাস-প্রেম-প্রীতি এসব নিয়ে লেখকদের কারবার, কল্পনায় নতুন ভুবন গড়াই তাঁদের একমাত্র কাজ । কিন্তু এখন তিনি জানলেন লেখকরা এই সমাজের অংশ । তাঁদের আছে সামাজিক দায়িত্ব । দেশ যখন বিপন্ন হয়, অত্যাচার চরমে ওঠে যখন, তখন কলম ছেড়ে ধরতে হয় তরবারি । সোমেন শুনলেন স্পেনের কথা । শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সেখানকার লেখকদের আত্মত্যাগের কথা ।

এসব সোমেনের কাছে নিছক তত্ত্বকথা ছিল না । তিনি তো পেশাদার রাজনীতি করতে চান নি । তিনি চাইতেন মানুষের মুক্তি । এই নতুন আদর্শের মধ্যে পেলেন তার ইশারা । তাই তাকে গ্রহণ করলেন প্রাণ দিয়ে । একদিকে প্রগতি পাঠাগার পরিচালনা, প্রগতি লেখক সংঘ গড়ে তোলার কাজ, অন্যদিকে লেখা ।একের পর এক তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল ইঁদুর, সংকেত, মুহুর্ত, মহাপ্রয়াণ, অকল্পিত, রাত্রিশেষ, স্বপ্ন, সত্যবতীর বিদায় প্রভৃতি গল্প । এসব গল্পে তাঁর আদর্শের প্রতিফলন আছে । কিন্তু কোথাও বকবকানি নেই, নেই জোর করে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা । এত কম বয়েসে এরকম শিল্পশৈলী কিভাবে আয়ত্ত করলেন তিনি কে জানে!

তিনি শিখেছিলেন এ যুগের পালাবদলের নায়ক সর্বহারা শ্রমিকরা । তাই তাদের মধ্যে কাজ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন তিনি । কিন্তু সবে প্লুরিসি থেকে উঠেছেন তিনি । রুগ্ন শরীর । তাই নেতারা তাঁকে শ্রমিক ইউনিয়নে কাজ করার অনুমতি দিতে চান না । সোমেন নাছোড়বান্দা । অবশেষে দিতে হল অনুমতি সোমেনকে । রেলওয়ে শ্রমিক সংগঠনে কাজ শুরু করলেন এই তরুণ । সহানুভূতির জোরে, প্রেমের জোরে তিনি অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন । একরাত্রি আর সংকেত গল্পে আছে তার ছাপ ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতায় লিখেছিলেন যে কবির জন্য তিনি কান পেতে আছেন সে শুধু ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলাবে না, সে কর্মে ও কথায় গানে অর্জন করবে হতদরিদ্র মানুষের আত্মীয়তা । আক্ষরিক অর্থে সেই লেখক সোমেন চন্দ ।

মোট ২৬টি গল্প, ৩টি কবিতা, ২টি নাটিকা, ১টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন বলে অনুমান । ‘অনুমান’, কারণ এ পর্যন্ত এই কটি রচনা উদ্ধার করা গেছে । ১৯৪২ সালে নিহত হলেন সোমেন । ১৯৪৭ সালে ভারত দ্বিখণ্ডিত হল ও স্বাধীনতা লাভ করল । এখনকার বাংলাদেশের উপর ছড়ি ঘোরাতে লাগল পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা । তাই সেখানকার সাহিত্যচর্চা ১৯৭২ পর্যন্ত নানা বাধার সম্মুখীন হয় । কিন্তু দেশভাগের আগে-পরে সোমেনের অনেক বন্ধু চলে আসেন কলকাতায় । তাঁরা কিন্তু সোমেন চন্দের স্মৃতি সংরক্ষণে কোন উৎসাহ দেখান নি । সোমেনের মৃত্যুর পরে ঢাকা থেকে যে দুটি গল্পসংকলন প্রকাশিত হয় সেগুলির পুনমুর্দণ বা নানা পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর রচনা উদ্ধারের চেষ্টা করেন নি ।

এ বছর ২৪মে থেকে শুরু হয়েছে সোমেন চন্দের জন্মশতবার্ষিকী । সেই ১৯৭২ থেকে শুরু করেছিলাম তাঁর  রচনা সংগ্রহ । সহজ ছিল না সে কাজ । অস্বীকার করব না সাহাষ্য করেছেন অনেকে । অপ্রত্যাশিত সাহাষ্যও এসেছে । হাওড়ার আইবজীবী নির্মল ঘোয আমার মতো অপরিচিতের হাতে তুলে দিয়েছেন ‘বালিগঞ্জ’  ‘সবুজবাংলার কথা’ পত্রিকার ফাইল ; যার থেকে পাও্য়া গেল সোমেনের একটি উপন্যাস ও বেশ কয়েকটি গল্প ও কিছু চিঠি । নির্মল ঘোষ আজ নেই, নেই মজহারুল ইসলাম যিনি কোন দিক না তাকিয়ে সোমেন রচনাবলি প্রকাশ করেছিলেন । দুর্গাদাস সরকার, হীরেন বসু, ক্ষেত্র গুপ্ত, রবীন্দ্র গুপ্ত—এবং আরও অনেকে,যাঁরা নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই কালের নিয়মে চলে গেছেন । আজ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই বিলুপ্তির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া লেখক তাঁর স্থান ফিরে পেয়েছেন । কিন্তু সোমেন চন্দের পুনরাবিষ্কারক অবহেলিত হয়েছেন নানাভাবে । এতদিনবাদে ‘অহর্নিশ’ পত্রিকার সম্পাদক শুভাশিস চক্রবর্তী ও ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকার মনীশ চক্রবর্তী ও রামেশ্বর ভট্টাচার্য সেই সংগ্রাহককে খুঁজে বের করেছেন, তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করিয়েছেন তাঁদের পত্রিকার সোমেনসংখ্যা ।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>