Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,sonagaji-and-sonagacchi-brief-history

একটি নিষিদ্ধ পল্লির গল্প ও সোনাগাজি । অনিতেশ চক্রবর্তী

Reading Time: 3 minutes

‘উত্তর বিভাগে কলিকাতা নগরের।
সোনাগাজি পল্লি লেন এনাম বক্‌সের।।
যথা বারাঙ্গনা কুল সদা করে বাস।
রূপের ছটায় করি তিমির বিনাশ।।’
১২৮২ বঙ্গাব্দে বটতলা  কাঁপিয়ে দিয়েছিল ‘সোনাগাজির খুন’। না না, সোনাগাজি খুন হননি। এটি একটি নিরীহ কাব্য-আখ্যানের নাম। রচয়িতা অখিলচন্দ্র দত্ত। ‘গোলাপ নামে এক আছিল কামিনী’। সেই গোলাপের খুন নিয়েই কাব্যের গপ্প ফাঁদা হয়েছে। কাব্যের শুরুতেই স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটেরও– উত্তর কলকাতার সোনাগাজি তথা সোনাগাছি অঞ্চল। অতএব, ‘সোনাগাজি’ নামটি এখানে ব্যক্তিবাচক নয়, স্থানবাচক।

অথচ, সোনা গাজি দিব্বি একজন রক্তমাংসের ঐতিহাসিক চরিত্র। তাঁর মাজার বা মসজিদটি এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। ‘আলালের ঘরে দুলাল’-এ যে মাজার ও মসজিদের কথা বেশ বিস্তারেই বলেছেন টেকচাঁদ ঠাকুর তথা প্যারীচাঁদ মিত্র। এবং এহেন বিখ্যাত ব্যক্তির নামই কোনো পরিণত হল একটি স্থাননামে। এমনই এক অঞ্চলের নাম, যাকে নিয়ে কলকাতাবাসীর আজো কৌতূহল, ফিসফিসানি, ঢাকঢাক গুড়গুড়, নাক কোঁচকানোর শেষ নেই। যেন এই নাম বললেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। ভারতবর্ষের সবচাইতে বড়ো ‘নিষিদ্ধ পল্লি’ বলে কথা! সবাই চেনে, তবুএই নাম যেন যত্রতত্র নিতে নেই। গণিকাদের কেই বা ভালো চোখে দেখে! ‘সোনাগাজির খুন’-এই দেখুন। গোলাপের খুনি আসামি পুলিশ কর্তা ‘ল্যাম্বার্টের সঙ্গে’ রঙ্গ করতে করতে প্রস্থান করল। মানে জেলে গেল। গোলাপকে খুন করা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। হাবভাব এমন, ভ্রষ্টাকে হত্যায় আর কীসের অপরাধ! কবিরও বোধ করি একই মত। তাই অপরাধীকে কোথাও তিনি ভিলেন হিসেবে দেখাননি। কাহিনির বিপুল কাটতি দেখে কিছুদিন পরে এই কাব্য-আখ্যানের একটি উপসংহারও লিখেছিলেন অখিলচন্দ্র। সে বইয়ের নাম আরো রোমহর্ষক—‘সোনাগাজির খুনির ফাঁসির হুকুম’। সেখানে ফাঁসির হুকুমের পরে—
‘শুনিয়া কয়েদি যেন প্রকাশিয়া শ্লেষ
কহিলেন বার বার বেশ বেশ বেশ।।’

মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাকে যেন ফুৎকার দিল আসামি। যেন অতি পুণ্যের কাজ করেছে। এই মহান অপরাধীর শাস্তির কথা পড়ে নাকি বেশ আকুল হয়েছিলেন তৎকালীন পাঠকেরা। খুনের আসামির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট সেই করুণরসের আবহে দারুণ বিকিয়েছিল বইদুটিও। সোনাগাছি ও বটতলা এমনিতে প্রতিবেশী। এদের বেড়ে ওঠার ইতিহাসও প্রায় পাশাপাশি চলেছে। ফলে, বটতলা থেকে প্রকাশিত অসংখ্য আখ্যানে, বইতে সোনাগাছি এবং সোনাগাছির রহস্যময়ীরা প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে। কখনো কুখ্যাত ‘চোদ্দ আইন’ নিয়ে, কখনো কোনো তোলপাড় ফেলে দেওয়া ঘটনা নিয়ে বই বেরিয়েছে। বিকিয়েওছে হট কেকের মতো। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য যে নিষিদ্ধ পল্লিকে নিয়েও গল্প বলতে কুণ্ঠিত ছিল না, তা দেখে মন্দ লাগে না। কিন্তু, পিতৃতান্ত্রিক নৈতিকতার চোরাস্রোত কিন্তু ছিলই ভিতরে ভিতরে। ফলে, বেশ্যা, পতিতা, গণিকারা আদতে নষ্ট মেয়েমানুষ, এরা প্রতারণাতেও ওস্তাদ—এমন মনোভাবের চাষও হত আখ্যান থেকে আখ্যানে। যে কারণেই গোলাপের খুনির প্রতিও এমন সমবেদনা।
‘রেবেল’-প্রতিম বটতলার লেখকদেরও যদি গণিকাদের নিয়ে এমন মনোভাব হয়, তাহলে ‘শিষ্ট’, ‘ভদ্র’ দুনিয়ার কথা সহজেই অনুমেয়। কলকাতার অনেক তাবড় তাবড় মানুষের গোপন কম্মের হদিশ জানা এই গণিকাপল্লি নিয়ে তাই নিশ্চুপ ছিলেন অনেক পুরোনো কলকাতাবিদই। নিশ্চুপ মানে এক্কেবারে নিশ্চুপ। রাধারমণ মিত্রর ‘কলিকা তা-দর্পণ’-এ তাই সোনাগাছির নামটাই নেই। ১৯১৫ সালে লেখা হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতেও সোনাগাছির হদিশ মিলবে না। প্রাণকৃষ্ণ দত্তর মতো কলকাতাবিদও ছিলেন অবশ্য। সোনাগাজি তথা সোনাগাছির নামকরণের ইতিহাসটির ওপরেও স্পষ্ট আলো ফেলেছেন তিনি। পরে এই অঞ্চল নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। যৌনতা, যৌনপেশা নিয়ে অনেক খোলামেলা কথা বলতে শিখেছে শহর। কিন্তু, ঐ ফিসফিসানিটা যে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে, তা বলা যাবে না। এহেন সোনাগাছির নামকরণের ইতিহাস নিয়ে কিন্তু কোনো দ্বন্দ্বের ফিসফিসানিও নেই। প্রায় সবাই একমত, সোনাগাজির মাজার সন্নিহিত অঞ্চল বলেই এমন নাম। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখছেন, “ঐ স্থানে সোণাউল্লা নামক এক দুর্দান্ত মুসলমান বাস করিতেন। লাঠালাঠি, মারামারি, রাহাজানি-লুঠতরাজই তাঁহার উপজীবিকা ছিল। সোণাউল্লার বাটীর সম্মুখস্থ পুষ্করিণী পাড়ে তাঁহার কবর হইয়াছিল। অবশ্য মৃত্যুর আগেই তিনি পীর বা গাজী হইয়াছিলেন।”
(মূল বানান অপরিবর্তিত)
যদিও, সোনাগাজির চরিত্র নিয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্তর মন্তব্যে অতি আরোপ চোখ এড়ায় না। সে যাহোক, সোনাগাজি থেকেই সোনাগাছি নামোদ্ভবের তত্ত্ব খারিজ করেননি প্রায় কেউই। অসিত দাস অবশ্য বলছেন, ‘সোনা’ শব্দটি ‘শণ’ থেকেও আসতে পারে। শণগাছি ক্রমে শোনাগাছি হয়ে লোকমুখে সোনাগাছি হয়েছে। সোনাগাজির নাম শণগাছি একাকার হয়ে গেছে এই নামে—হতে পারে এমনটাও। তবে, নামকরণের মূলে সোনাগাজির মাজারের অস্তিত্বটাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
সোনাগাজির মাজার ছাড়িয়ে সোনাগাছি পল্লির পরিধি ক্রমে বেড়েছে। এখন তার অবস্থান চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, শোভাবাজার ও বিডন স্ট্রিট ক্রসিং-এর কাছে। এমনিতে, সম্ভ্রান্ত বাইজিদের পাড়া হিসেবে বৌবাজারের খ্যাতিও বেশ পুরোনো। বৌবাজারে বাইজি-কোঠির পাশাপাশি ছিল বেশ্যাপল্লিও। কিন্তু, তারপরেও সোনাগাছি গড়ে উঠল কলকাতার সবচাইতে বড়ো গণিকাপল্লি হিসেবে। অনেকে বলেন, এই অঞ্চল সম্ভ্রান্ত গণিকাদের ঠিকানা ছিল না কোনোদিনই। গরিব, শ্রমজীবী মানুষদের কামনাকেই সে নির্বিচারে গ্রহণ করেছে বরাবর। আর সেটাই নির্মাণ করেছে সোনাগাছির ‘শ্রেণিচরিত্র’। যদিও, এই ইতিহাসেও খানিক সরলীকরণ রয়েছে। আঠারো ও উনিশ শতকের বাঙালি বাবুরা নিজেদের উপপত্নী তথা রক্ষিতাদের থাকার ব্যবস্থা করতেন সোনাগাছিতেই। উচ্চবিত্ত, সম্ভ্রান্ত মানুষদের জন্য পৃথক ঠিকানাও ছিল এই পল্লিতে। সাহেবদের আনাগোনাও ছিল ভালোই। এই অঞ্চলের বেশ কিছু বাড়ির বাহারি স্থাপত্য চোখ এড়ায় না। সেইসব পুরোনো প্রাচুর্যের দলিল। এবং, এরই পাশে ছড়িয়ে রয়েছে অবশিষ্ট বিশাল পল্লি। বাংলার প্রতিটি দুর্ভিক্ষ, মড়ক, প্রাণঘাতী বন্যায় জনসং খ্যা বাড়ে সেখানে। অন্য প্রদেশ থেকেও উজিয়ে আসে অনেকে। শিকড়হীন, অভাবে ধুঁকতে থাকা, পাচার হয়ে যা ওয়া মেয়েগুলি এরপর এই পল্লির ইতিহাসের পাতা বাড়িয়ে তুলতে থাকে। আর ইতিহাসবিদরা সেই পাতা উলটে দেখান, একসময়ে ফ্রান্সের সম্ভ্রান্ত গণিকামহলেও কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সোনাগাছির খ্যাতি।
কলকাতা বাড়তে বাড়তে প্রায় মেগালোপলিস। শহর বাড়লে ক্ষুধাও বাড়ে। ক্ষুধার উল্টোপিঠেই অভাব। ক্ষুধারও রকমফের। এই বেড়ে চলার নামতা বেশ ভালো বোঝে সোনাগাছি।
এই শহরের অনেক গোপন ইতিহাস লিখতে পারে সেও।

তথ্যঋণ: ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, নেমপ্লেট, অসিত দাস, রোববার, প্রতিদিন, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৭।

কৃতজ্ঞতা: বঙ্গদর্শন

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>