Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,south indian food history

ইতিহাস: দক্ষিণ ভারতের খাবার । সুকন্যা দত্ত

Reading Time: 5 minutes
 
 
প্রতি বৃহস্পতিবার আমার বাড়ীর সামনে দিয়ে বিকেল বেলা ঠংঠং শব্দটা মাঝে মাঝেই লোভ বাড়িয়ে দেয়। লোহার চাটুতে খুন্তি পেটাতে পেটাতে ঠেলা গাড়ি নিয়ে হেঁটে যায় প্রদীপদা। আজ প্রায় দশ বছর ধরে এই ঠেলা গাড়ি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ইডলি,  ধোসা বিক্রি করেন। 
“এই রান্নাগুলো  কীভাবে শিখেছো?”
জিজ্ঞাসা করলে হাসি মুখে বলেন,
 “তোমাদের মতো  ইটিউব( ইউটিউব)  থেকে শিখিনি গো।” 
প্রদীপদার ইডলির রহস্যটা অধরাই রয়ে গেলে ও সেই স্বাদ আমায় দক্ষিণ ভারতের অলিগলি পৌঁছে দেয়। গরম গরম নরম তুলতুলে ইডলি পাতে পড়তেই জিভে জল চলে আসে।  ভারতীয়দের কাছে চালের কদর সব সময়। পায়েস, পোলাও, ইডলি, পিঠে, সবেতেই চাল লাগবেই। আর চালের গুঁড়ো দিয়ে নানান খাবার ভোজন বিলাসিতাকে একটু উস্কে দেয়।
 
দক্ষিণ ভারতের ঘরে হোক বা বাইরে প্রাতরাশে এ দুটো খাবার থাকবেই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েরা  হলুদ- চন্দন মেখে স্নান সেরে ঘরের উঠোন ধুয়ে চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেয়। তারপর মাথায় ফুল লাগিয়ে পুজোয় বসে। পুজো সেরে সকালের খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে চলে যায়। ভারী পাথরে চাল, ডাল পেষাই করে ইডলি কিংবা ধোসা রান্নার জোগাড়ে লেগে পড়ে।
 
ইডলির কথা প্রথম জানা যায় ৯২০ খ্রিষ্টাব্দে কন্নড় ভাষায় শিবাকোটি আচার্যের লেখা ‘ ভাদ্দারাদ্ধান’ পুঁথিতে। সেখানে ” ইড্ডলগ” নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওনার লেখা থেকে জানা যায় ” অষ্টাদশ – দান – দ্রব্য” এর মধ্যে ইডলি থাকতো। কোনো মহিলার কাছে ব্রহ্মচারী এলে  এই ” অষ্টাদশ দান দ্রব্য দেওয়া হতো। আবার ১১৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর রচিত সংস্কৃত ” মানসোল্লাস” গ্রন্থে ‘ ইদ্দারিকা’ র কথা জানা যায়।  তবে বর্তমানে দীর্ঘ সময় ধরে  চালের গুঁড়ো, বিউলি ডাল বাটা  ভিজিয়ে রাখার পর ভাপিয়ে ইডলি তৈরির এই পদ্ধতির তেমন কোনো উল্লেখ ” মানসোল্লাস” পাওয়া যায় না। “মানসোল্লাস” এ “ইদ্দারিকার “জন্য  কলাই এর  ডালের সাথে দইয়ের ঘোল মিশিয়ে রান্নার কথা বলা আছে। আঠারো শতকে ” মাক্কাপুরাণম” এ ও ইডলির উল্লেখ পাওয়া যায়।
এখানেই শেষ নয়। খাদ্য ঐতিহাসিক কে.টি আচার্যের মতে ৮০০ শ থেকে ১২০০ শতকের মধ্যে ইডলি  সূদুর ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতের দক্ষিণে  প্রবেশ করে। সেই সময় বর্তমান ইন্দোনেশীয়  রাজাদের রাঁধুনিরা  যে  ” কেডলি” রান্না করতো,তার সাথে ইডলির সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। রাজারা ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতে বেড়াতে আসার সময় তাদের রাঁধুনিদের  সঙ্গে নিয়ে আসতেন। এদের সাথে এসেই ইডলি ভারতে বাস করার ছাড়পত্র পেয়েছে।
 
পরবর্তী সময়ে খাদ্য বিশারদ   লিজি কলিংগ্রাম ইডলির জন্মের ভিন্ন ইতিহাস দাবী করেন।  কায়রোর  আল- আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী তিনি জানান,  আরব ব্যবসায়ীরা বিয়ে করে  মিশরে যখন পাকাপোক্তভাবে বসবাস করতে থাকে,তখন তারাই মিশরে ইডলি নিয়ে আসে।   খাদ্য ইতিহাসের ” এনসাক্লোপিডিয়া ” অনুযায়ী সে সময়ের  ইসলামধর্মী মানুষেরা ইসলামের নিয়ম অনুসারে  হালাল ও হারামের দ্বিধায় কোনো খাবারই ছুঁতো না।
এই বণিকরা সিদ্ধ ভাতের মন্ড তৈরি করতো। সেই গোলাকার মন্ডগুলো চ্যাপ্টা করে তার ভিতর নারকেলের চাটনি পুরে খেতো। এখান থেকে হয়তো ইডলির জন্ম। 
 
কিছু মানুষের মতে, দশম শতকে সৌরাষ্ট্রের রেশম বয়ন শিল্পীদের হাত ধরে ” ইদ্দাদা” দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। হিউ- এন – সাঙ এর বিবরণ থেকে জানা যায়,ভারতীয়রা ভাপে সেদ্ধর প্রচলন জানতো না। 
তামিলনাড়ু র কাঞ্চিপুরম এর ইডলিতে জিরা, গোলমরিচ, দই আর হিং দেওয়া হয়। 
তবে যাই হোক না কেন, ডায়েট চার্ট কিংবা দক্ষিণ ভারতের  মন্দিরের ভোগ ইডলি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কেবল চালের গুঁড়ো নয়, সুজির ইডলি ও রসনা তৃপ্ত করতে পটু।  এমনকি দক্ষিণী নারীরা নিজেদের  রন্ধন পটীয়সী প্রমাণ করার জন্য আত্মবিশ্বাসের সাথে গাইতে পারে,
“ইডলি ধোসা সম্বরম,রান্নাতে আমি উত্তমম..
 
এবার আসি ধোসার গল্পে। ধোসার জন্মের গল্প নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।  ধোসা তৈরি হয় চাল আর বিউলির ডাল দিয়ে। খাদ্য গবেষক পি. থাংকাপ্পনের মতে,  ধোসার আঁতুড়ঘর কর্নাটকের উদুপী। কর্ণাটকের  একজন ব্রাহ্মণ রাঁধুনির হাতে ধোসার জন্ম। অন্যদিকে দ্বাদশ শতকে  চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের লিখিত সংস্কৃত “মানসোল্লাস”  এ ধোসার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে ” ধোসাকা” শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহাসিক কে.টি  আচার্যের মতে,  ষষ্ঠ শতকের   তামিল সাহিত্য “সঙ্গম”  এ ধোসার বিষয়ে উল্লেখ  রয়েছে। সেখানে ” থোসাই”  শব্দের উল্লেখ আছে।  আবার পলা রিচম্যান এর মতে, এক তামিল লোক গান থেকে জানা যায়, দশরথের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীদের খাবার তালিকায় ধোসার উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন,  মহীশুরের এক রাজার, ভোজ আসরের পর অনেক খাবার বেঁচেছিলো। সেই খাবার নষ্ট না করে,তিনি ওনার রাঁধুনিদের নতুন কিছু রান্না করার কথা বললেন। এইভাবে রাজপ্রাসাদে তৈরি হলো ধোসা। গল্প যাই হো,আসল মজা হলো তার স্বাদে,তৃপ্তিতে। 
 
উৎসব হোক বা অনুষ্ঠান,  পুজো কিংবা অতিথি আপ্যায়ন  মিষ্টিমুখ ছাড়া সব অসম্পূর্ণ থেকে যায়। দক্ষিণভারতের মন্দিরে ভগবানকে  মিষ্টান্ন ভোগ নিবেদন করা হয়। এখানকার প্রধান ব্যঞ্জন হলো পায়েসম( পায়েস)। তামিল ভাষায় “পায়েসম” বললে  ও কন্নড় ও তেলেগুতে   বলে “পায়েসা” । দক্ষিণভারতে নারকেলের দুধ ও গুড় দিয়ে পায়েস তৈরি হয়। যদিও   দক্ষিণ ভারতের মাটিতে এর জন্ম হয়নি, তবু ও পায়েস ছাড়া শুভকাজ অসম্ভব । মুগ ডালের পায়েসম ভগবানকে ভোগ নিবেদন করা হয়। এছাড়াও পল পায়েসম, আমন্ড পায়েসম এর জুরি মেলা ভার। পোঙ্গল উৎসব মিষ্টি পোঙ্গল, মিষ্টি কলার পোঙ্গল ছাড়া অসম্পূর্ণ। কেরালার  “এড়া আদা”একটি মিষ্ট পদ। বিকেলের খাবারে এড়া আদা খুবই প্রচলিত।  উন্নি আপ্পাম,  মিষ্টি ইডলি, কজুখাট্টাই এমন নানান সম্ভারে দক্ষিণ ভারতের মিষ্টির ভান্ডার সমৃদ্ধ।
 
এবার আসি “রসম” এর কথায়। নানান রাজ্যে এর  নানান নাম।  তেলেগুতে ” চারু”, কন্নড় এ ” সারু”, তামিলে ” রসম”। সংস্কৃত ” রস” শব্দের অর্থ রসাল,সেখান থেকেই সম্ভবত এমন নামের উৎপত্তি।  তেঁতুলের কাথ মিশিয়ে  রসম তৈরি করা হয়। প্রাচীন কাহিনী অনুযায়ী,  পানদিয়াম সময়ে রসমের জন্ম।  ১৬ শ শতকে সৌরাষ্ট্র বংশের  মাদুরাইয়ে বসবাসকারী  এক রাজারপুত্র গুরুতর অসুস্থ হওয়ায়  কোনো খাবারই মুখে তুলতে চায় না। অসহায় পিতা,সেই রাজা রাজ্যের চারিদিকে বার্তা পাঠান, যে ব্যক্তি কোনো পদ রান্না করে,রাজপুত্র কে খাওয়াতে পারবে তাকে এক থলি স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে।সেই খবর শুনে করুণা নামের এক বিনয়ী  ব্রাহ্মণ রাজার অনুগ্রহ লাভের আশায়  এগিয়ে আসেন। লেবু, আমলকী, আনারস, তেঁতুল, কারি- পাতা,হলুদ,গোলমরিচ দিয়ে সুস্বাদু  একটি পদ তৈরি করেন। সেই পদের স্বাদে রাজপুত্র মোহিত হয়ে যায় এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। রসমের নানান প্রকারভেদ বলে শেষ করার উপায় নেই।টমেটো রসম, রসুন রসম, তেঁতুল রসম, মহীশুর রসম,আনারস রসম,গোলমরিচ – জিরা রসম, অড়হর ডাল রসম,লেবু- ধনে পাতা রসম,পনীর রসম এমন বহু নাম যা বলে শেষ করা যাবে না।
 
সাম্বার ডালের সাথে জড়িয়ে আছে মারাঠা বংশের রাজা তাঞ্জোর  রাজ্যের    শাসক সাহজীর নাম। তিনি  রান্না করতে ভীষণ ভালোবাসতেন। একদিন  তিনি  আমটি ডাল( মহারাষ্ট্রের) তৈরি করতে গিয়ে বিপদে পড়লেন। ককুম ছাড়া তো আমটি ডাল তৈরি হবে না। অথচ কোথাও ককুম না পাওয়া যাচ্ছে না । শেষ অবধি ককুমের বদলে ডালে   সামান্য তেঁতুল মিশিয়ে দিতেই ডালের স্বাদ বদলে গেলো। সেই সময় ছত্রপতী শিবাজীর পুত্র “সাম্ভাজী”,  সাহজী মহারাজার সাথে তাঞ্জোরে দেখা করতে এসেছিলেন।  সাম্ভাজীর পাতে  প্রথম পরিবেশন করা হলো এই ডাল । ডালের স্বাদে সাম্ভাজী মোহিত হওয়ায় ওনারই নাম অনুসারে এই ডালের নাম হয় ” সাম্বার ডাল”।
 
মহাভারতে পান্ডবদের অজ্ঞাতবাসের গল্প সকলেই জানেন। এই গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে ” আভিয়াল”। সেই সময় দ্বিতীয় পান্ডব ভীম বিরাট রাজার পাচক বল্লভ নাম ধারণ করে  ছদ্মবেশে ছিলেন। রাজা  ভীমকে রান্না করতে বললে তিনি পড়লেন বিপদে। এতদিন ভীম শুধু খেয়েই এসেছে, রান্না করতে তো পারে না। অতএব রান্নাঘরে সেই সময় যে যে সবজি ছিলো,তার সবগুলো মিলিয়ে, নারকেল মিশিয়ে  তৈরি করলেন নতুন এক পদ,যা পরবর্তী সময়ে ” আভিয়াল” নামে পরিচিত হয়। আভিয়ালের কথা কেরালার বীরদের গল্প গাথা কোট্টরথিল সানকুন্নির লেখা শতাধিক কাহিনির সংকলন গ্রন্থ ” আইথিহিয়ামালা” য় উল্লেখ পাওয়া যায়। লেখকের মতানুসারে  ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা ” মুরজাপাম” এর  রান্নাঘরে  আভিয়ালের জন্ম। কোনো এক বছর রাজার ভোজ সভায়  নিমন্ত্রিত  ব্রাহ্মণ অতিথি  ভোজনে সবজি শেষ হয়ে যায়। তখন ফেলে দেওয়া সবজির সাহায্যে রাজার প্রধান পাচক তৈরি করলো আভিয়াল। এরপর রাজা সেই রাঁধুনিকে পুরস্কৃত করে,প্রতিবছর ” আভিয়াল” রান্নার নির্দেশ দেন।
খাদ্য ইতিহাস গবেষক কে. টি আচার্যের মতে, কাঁচা কলা, ডাঁটা, নানান সবজি, সবুজ কাজুবাদাম,নারকেলের দুধ নারকেলে নেড়ে মশলা আর দই মিশিয়ে আভিয়াল তৈরি হয়।  আবার শ্রী বালার মতানুসারে, তামিলনাড়ুর কৃষি উৎসবে সাতটা সবজি মিশিয়ে রান্না হওয়া পদটিই আভিয়াল। ওনাম, বিবাহ, শিশুদের জন্মদিনের মতো শুভ অনুষ্ঠানে আভিয়াল রান্না করা হয়। তামিল ভাষায় ” আভি” শব্দের অর্থ ” বাস্প”, তাই ” আভিয়াল” শব্দে বাস্পের মধ্যে অর্থই বোঝায়।
 
ঘুরে এলাম দক্ষিণের রান্নাঘরে। ভোজন রসিকদের  একবার হলে ও জিভে জল আসবে। ইডলি, ধোসা, সাম্বার,রসম এ আজকের মেনু জমজমাট। 
 
 
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>