| 26 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

আল মাহমুদ : স্মৃতি ও সৃষ্টির সৌরভ 

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 
আম্মা বলেন পড়রে সোনা 
আব্বা বলেন, মন দে; 
পাঠে আমার মন বসে না 
কাঁঠলচাঁপার গন্ধে। 

অথবা-

আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে 
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে। 

এমন সব অমল-ধবল কিশোরকবিতায় কিনে নিয়েছিলেন আল মাহমুদ আমাদের শৈশব ও কৈশোর। তারপর তাঁকে প্রথম প্রত্যক্ষ দেখা নবম শ্রেণিতে একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। মনে আছে ভরসন্ধ্যায় কুমিল্লা শহরের একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবির হাত থেকে আমিও নিয়েছিলাম একটি পুরস্কার। সে অনুষ্ঠানে এসে তিনি বলছিলেন রাতের ফ্লাইটেই তাঁকে দিল্লি যেতে হবে মির্জা গালিবকে নিয়ে একটি সেমিনারে। আমার মনে হচ্ছিল কবির সঙ্গে সঙ্গে আমিও বোধহয় চললাম দূর দিল্লিতে গালিবের সন্নিধানে। তবে না গিয়েও কি যাইনি? কবির সঙ্গে তো আমরা সবসময়ই চলি ঘুমে কিংবা জাগরণে। আমার অবশ্য ধন্দ লাগছিল কবির একটি কথা শুনে। বলছিলেন তিনি একটি কবিতা লেখার সাফল্য তিনি উদ্যাপন করেন স্রষ্টার কাছে সমর্পনের মধ্য দিয়ে। অবশ্য ধন্দের সাথে ভালোও লাগছিল কারণ সমর্পণ তো দরকার হয়ই, প্রিয় অথবা পরমরে কাছে। সমর্পনের মধ্য দিয়েই তো জন্ম হয় শিল্পের। লিখতে লিখতে মনে আসছে এই প্রত্যক্ষ পরিচয়ের পূর্বেই আমার বেড়ে ওঠার শহর কুমিল্লার ছিমছাম পৌরপার্কে একটি ফলকে উৎকীর্ণ দেখেছি আল মাহমুদ-


এখানে সবুজ দিয়েছে বুক পেতে 
গুল্মলতা আকাশে ওঠে মেতে, 
ছায়ার নাচে তোমার কথা ভাবি, 
তুমিই বুঝি এই বাগানের চাবি। 


যতবার পড়েছি, স্পৃষ্ট হয়েছি। সবুজে সবুজে, শ্যামলে শ্যামল, নীলিমায় নীল। ঐ উদ্যান আর আল মাহমুদের কবিতাজগৎ আমার কাছে একাকার হয়ে আছে সেই থেকে। 
যতদূর মনে পড়ে ঢাকায় এসে তাঁর বক্তব্য শুনেছি একবারই। জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে বলছিলেন তিনি; অস্পষ্ট-জড়ানো কণ্ঠস্বরে বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ক্ষুধা, দারিদ্র্য ইত্যাদি মিলে যে পাথর-পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তখন তার প্রেক্ষিতে এক তরুণ কবির কবিতা উধৃত করে বললেন ‘আমার মা পাথর রান্না করছেন। আমরা ক্ষুধার্ত বসে আছি। পাথর নিশ্চয়ই একদিন সেদ্ধ হবে।’


বিভিন্ন সময়ে গিয়েছি তাঁর মগবাজার কিংবা গুলশানের আবাসে। আমার প্রথম কবিতার বই নাচপ্রতিমার লাশ তাঁর হাতে তুলে দিয়েছি। ভেবেছি চক্ষুপীড়ায় পর্যুদস্ত কবি; বইটি দেয়া বা না দেয়ায় হয়তো ফারাক নেই কোনো। কিন্তু কি আশ্চর্য! আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন ‘সবগুলোই দেখছি গদ্যকবিতা’। অবাক মেনেছি, আবার অবাক হইনিও কারণ দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও কবিতাই তো তাঁর প্রধান দৃষ্টি। তাই কবিতা দেখেই তিনি বলে দিতে পারেন কোনটা টানা গদ্য আর কোনটা অন্যরীতির কবিতা।

 তাঁর পঁচাত্তর জয়ন্তীতে একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে হঠাৎ যখন বললাম ‘আপনার প্রয়াত বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় …’ তিনি তখন পর্যন্ত জানতেন না সন্দীপনের চলে যাওয়ার খবর। আমার কাছ থেকে শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমি কবির কাছ থেকে নৈর্ব্যক্তিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে অনুভব করছিলাম বন্ধুত্বের জন্য কবির হাহাকারের মর্ম ও মাধুর্য; যে বন্ধুত্বই খাঁটি কবিতার এক বড় ভিত্তি।

 তাঁকে পরে দেখেছি একুশে বইমেলার মাঠে অথবা রমনা গ্রিনের কোনো ঘরোয়া আড্ডায়। কবিতা অনুলিখন করতে গেলাম একবার কোনো এক পত্রিকার জন্য। মুখে মুখে বলেগেলেন, আমি লিখে নিলাম। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যখন নামছি সিঁড়ি ভেঙে, হঠাৎ আবার ডাক পাঠালেন। স্মৃতি থেকে নিজেই উচ্চারণ করে সংশোধনী দিলেন কবিতার! বিস্ময়ে বিমূঢ় আমি। প্রায় চেতনালুপ্ত একজন মানুষ কবিতাতে কীভাবে আমূল জেগে থাকেন; সে সত্যের স্বাদ নিচ্ছিলাম। 
আল মাহমুদের সনেটসমগ্র বলে একটি পা-ুলিপি প্রস্তুত করতে গিয়ে আদ্যেপান্ত পড়েছি সনেট নির্মাণের সচেষ্ট কৈবল্যের কালে কি সহজ গভীর অনায়াসে তাঁর করতলে খেলা করে চতুদর্শপদীর মহাদেশ! শুধু কি সনেট? গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-শিশুতোষ রচনায় আল মাহমুদের সম্ভারের তুলনা চলে কেবল স্বর্ণফসলের সঙ্গেই।

আল মাহমুদ নিয়ে তর্কের শেষ নেই যেমন তাঁর সৃষ্টিসৌরভেরও নেই কোনো শেষ। অশেষ আলোর ফুলে ভরা তাঁর শিল্পের জমিন। নদীভিত্তিক লোকবাংলার যে নবনির্মাণ তাঁর পদ্যে ও গদ্যে, তা বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন গতি ও গন্তব্য। মৃত্যুকে মাহমুদ যেভাবে আবাহন করেছেন তাই প্রমাণ করে কবিতা তাঁর রক্তের ভেতর বহতা মাতৃভাষার মতো সহজ ও স্বচ্ছন্দ।


কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে 
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাগিদ, 
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে 
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ। 

[দুই]


আত্মজৈবনিক গ্রন্থ যেভাবে বেড়ে উঠির একেবারে শেষাংশে ঢাকাগামী মেলা ট্রেনের কথা জানান আল মাহমুদ ; যে ট্রেন তাকে আত্মীয়তা ও মানুষের প্রতি নির্ভরতার শেষ স্টেশন থেকে চিরকালের জন তুলে নিয়ে নিরুদ্দেশের দিকে পাড়ি জমায়। এই কথায় কবিত্ব থাকলেও আমরা দেখব লোক লোকান্তর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক তোমার রক্তে তোমার গন্ধে পর্যন্ত দীর্ঘ কবিতাপারক্রমায় এক গৃহত্যাগী বৈষ্ণব-স্বভাব সক্রিয়। দাঙ্গা, দেশভাগ, গণঅভ্যুত্থান, ভাষাসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদির ছায়া-প্রচ্ছায়া তার কবিতায় পড়লেও তিনি মূলত প্রেমিক কবি। পথে পথে নারী তাকে নতুন নতুন গৃহের সন্ধান দেয়। নারীকে কেন্দ্রভূমে রেখেই তার সকল বাগবিস্তার। নারীই তার প্রধান প্রতীক। পূর্বোক্ত যেভাবে বেড়ে উঠির পাতায় পাতায় যে নারীদের উপস্থিতি পাই (যেমন-শৈশবে দেখা গৃহপরিচারিকা আলকি, রাজনীতির পাঠদানকারী শোভা, কবিতার প্রথম শ্রোতা হানু, প্রকৃতির পরিচয়কারিনী রাফিয়া, কামিনকন্যা কাহানী কিংবা বৌদ্ধ রমনী বিশিদি) তারাই যেন উত্তরকালে কবির নারী প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কবি তার ভেতর অনুধাবন করেন শিশু আর পশুর বিরোধ, কবির বাইরের পৃথিবীতে সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ, কবির সামনে সম্ভাব্য সমস্ত গন্তব্যে তালা ঝুলছে, স্বপ্নের আঘাতে সারারাত কবি ঘুমুতে পারেন না; তারপরও কবিত্বের অতিরিক্ত অবলোকনশক্তির বলে কবি দেখেন তার মত পাপীর জন্য নারীর ভেতর তৈরি আছে শাশ্বত ক্ষমার তোরণ। অনাহারী কবি নারীর গা থেকে শুষে নেন শস্যের সুবাস। কখনো বিড়ালিনী রূপে, কখনো জ্বিনের দুহিতা লায়লারূপে নারী পথহারা কবিকে ঠিকঠাক পৌঁছে দেয় তার আত্মার বাদামে। সমুদ্রের কালো তরঙ্গ যেমন কবির কাছে নারীচোখের কাজল বলে প্রতিভাত হয় তেমনি কবি দেখেন শান্তির বার্তাবহ পৃথিবীর সবকটি শাদা কবুতর ইহুদি মেয়েরা রান্না করে পাঠিয়েছে মার্কিন জাহাজে। বোঝা যাচ্ছে, নারী কেবল নির্দ্বান্দ্বিক সৌন্দর্য হয়েই ধরা দেয়না আল মাহমুদের কবিতায় বরং গোটা চরাচরকে তিনি নারীপ্রতীকের মাঝে অনায়াস-প্রতিস্থাপনক্ষম।

‘সোনালি কাবিন’ সনেটমালাতেও ভাটি বাংলার নারীর কসম খেয়ে কবি প্রচার করেন সাম্যের দাওয়াত। নারীর নাকফুলের মত সরল গভীর সুন্দরের জারকরসে তিনি নস্যাৎ করতে চান ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী শ্রেণীবোধ, পুঁজির দাপট আর যত বর্ণচোরা সোনার মেকুর। 
আল মাহমুদ এক জায়গায় থিতু থাকে না। তিনি ভ্রামণিক। বৈষ্ণব-স্বভাবহেতু নারীর ভূগোলকে ওলট-পালট করে দেখেনি। বিশ্বব্যাপী আগ্রাসন, লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসের সর্বগ্রাসী দামামায় কবির নারীমুখও বিপর্যন্ত। বারুদের ঝাপটায় তার লাবণ্য অন্তহির্ত। এমনতর ঈগল আর মানবইতিহাসের লড়াইকালে কবির ভালোবাসা-বেদনার সৃজন-

 
তোমার রক্তে তোমার গন্ধে। 
কী বলে আমাকে ডাকতে তুমিই বলো 
আমার সামনে আঁখি কেন ছলোছলো 
আমি তো যেমন ছিলাম তেমনই আছি-
তোমার রক্তে তোমার গন্ধে বাঁচি। 
(তোমার রক্তে তোমার গন্ধে)

 
এমন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞানে উপনীত আল মাহমুদ যেখানে বেঁচে থাকার সকল পরিসর সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে; চারদিক যখন রুক্ষ-খটখটে তখন কবি সর্বাঙ্গ ভেজাতে চান দয়িতার রক্তে-গন্ধে। হয়তো এই নিমজ্জনেই লেখা আছে তার প্রার্থিত উজ্জীবন।

কবি দ্বিধাদীর্ণ। কোন মোক্ষের খোঁজ তার জানা নেই। যদিও সম্মুখে ভবিষ্যতের দ্বার এবং সে দ্বার খুলতে তাকেই যেতে হবে। তবু তিনি জানেন না সেখানে ‘আলো না অন্ধকার’। কিন্তু সত্তর পেরিয়ে কবির উপলব্ধি, পথের ঠিকানা না জানলেও পথ তাকে চলতেই হয় অনন্য ভয়ঙ্করের মুখচ্ছবি-

 
আমাকে দেখাও আমারই বিনাশ 
আঁধারের কালো কেশ 
খোঁপা খুলে দিয়ে আমাকে দেখাও 
আমি তা পরব কেশে
এখানে বাংলাদেশে। 


এমনটি আল মাহমুদের আগেকার কবিতায় খুব একটা মিলবে না।

সাপের উদ্যত ফণা, বিষের জ্বালার পাশাপাশি সাম্প্রতিক কবিতায় কবি ফিরে বরণডালার কথা বলেন। এই বরণ ডালার রূপকে মৃত্যু আর প্রেম যেন অভেদাত্মা। অস্তাচলের ডাকাডাকির ইঙ্গিত দিলেও কবি আসলে নিজের ভেতরই কোন অদৃশ্য গহ্বরে যাত্রাব্যাকুল-

 
কাল চলে যায় কালের জোয়ারে 
আমি পশ্চাদ্গামী 
আমিই আমাকে ধাওয়া করি তবে 
আমাকেই চাই আমি 
(পশ্চাদ্ধাবন) 


গন্ধক-সীশা ভারাতুর পৃথিবী। ‘আল্লাহর কসম’ কবিতায় তাই কবি এ নিঠুর জীবনচক্রের আশু সমাপ্তি চান। আর ভাসতে চান না পৃথিবীর রক্ত-পুঁজ-ক্লেদের ভেতরে। এখানে সব বিরুদ্ধে চলে গেছে। গানের বিরুদ্ধে গান। বন্দিশের বিরুদ্ধে বন্দিশ। কবি মানেন, সব কিছুরই শেষ আছে। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচের জনপ্রিয় গান ‘পাগলা ঘোড়া রে কই অতি কই লইয়া যাও’ উদ্ধৃত করে রচিত কবিতায়ও দেখা যাবে সাত মহাদেশ আর দশ দিগন্তভেদী পাগলা ঘোড়ার পরিব্রাজনেরও লয় আসন্ন। কবি নিশ্চিত জানেন কোন এক বাগানে গিয়ে পরাক্রমী অশ্বশক্তির পায়েও কাঁপন ধরবে। তাবত হত্যা, রক্ত, জিঘাংসা, বারুদ, ঘূর্ণি, মৃত্যুভয়, দ্বিধা-দোলাচল, বান, খরা, মেঘমেঘালি উজিয়ে কবির মন্ত্রোপম উচ্চারণ-


এখানে সবুজ দিয়েছে বুক পেতে 
গুল্মলতা আকাশে দিয়েছে বুক পেতে 
ছায়ার নিচে তোমার কথা ভাবি 
তুমিই বুঝি এই বাগানের চাবি।
(তুমি) 


এই তো সাম্প্রতিক আল মাহমুদ। এইতো চিরায়ত আল মাহমুদ। নারীর প্রতীকে যাবতীয় রুদ্ধদ্বার খুলে যাবার সংকেত পাচ্ছি আমরা। নারী সব বিরানভূমি ভরে দেবে সবুজনিখিলে। ‘মেলায় হারানো বালক’ নামে এক কবিতায় আল মাহমুদ লিখেছিলেন ‘পৃথিবীতে নারীরা হলো ফুলের নিকটাত্মীয়।’ শুরু থেকে শেষাবধি আল মাহমুদ এভাবে নারীকে অবলম্বন করছেন ধ্বংসগন্ধের বিপ্রতীপে শাশ্বত অপরাজিতার সৌরভসন্ধানে। 

 

 

প্রচ্ছদ: সকাল রয়

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত