| 5 মে 2024
Categories
নারী

খারাপ নারী চরিত্র কি বাস্তবেও খারাপ! » মনিজা রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

জুন আন্টি কি আসলেও খারাপ? তাহলে তার জন্মদিনে কেন দেবলীনা দত্ত বা মনামী ঘোষের মত ডাকসাইটে নায়িকারা আসবেন!

স্টারজলসা চ্যানেলে শ্রীময়ী ধারাবাহিকের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার কথা আমরা অনেকে জানি। সেই নাটকের এক খলচরিত্র হল জুন। যার আসল নাম- উষসী চক্রবর্তী। এক জায়গায় পড়েছিলাম- উষসী চক্রবর্তী সামাজিক কোন অনুষ্ঠানাদিতে গেলে মানুষ তাকে অপমান-অপদস্থ করে। এজন্য কোন অনুষ্ঠানে যেতে পারেননা তিনি। একটা কথাও চালু হয়ে গিয়েছিল- ‘ছি্‌ ছি্‌ তুমি জুন আন্টির চেয়েও খারাপ!’  অথচ লোকে একবারও ভেবে দেখেনা, এই ভদ্রমহিলারও একটি সামাজিক জীবন আছে। তারও পরিবার আছে। তারা একবারও ভাবে না- নাটক-সিনেমার খারাপ চরিত্র তো বাস্তবে খারাপ না!

একই ধরনের কোন চরিত্র যদি পুরুষ করে তবে তাকে এরকম সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় না। বরং অনেক দর্শকদের বলতে শোনা যায়- বস যা দেখাইলেন! মানে খারাপ হওয়াটা পুরুষদের মানায়। অধ:পতনের অধিকার শুধু তাদের জন্য। আর নাটক-সিনেমায় নারীকে হতে হবে সতীসাধ্বী, পতিব্রতা। একমুখী হওয়ার ঘটনাটা ঘটবে শুধু নারীর বেলায়। পুরুষদের জন্য সাত খুন মাফ। কোন নারী দ্বিচারিনী হলে এমন কোন বাজে ভাষা নেই যে সেটা ব্যবহার করা হয় না। তারাই আবার ইউসুফ জুলেখা অথবা রাধা কৃষ্নের প্রেমকাহিনী পড়ে আবেগে কেঁদে ভাসায়।

কখনও সময় কাটাতে ইউটিউবে বাংলাদেশের নাটক দেখি। নাটক দেখা শেষ করে মাঝেমধ্যে ‘কমেন্টস’ও পড়ি। ধরা যাক অভিনেতার নাম মোশাররফ হোসেন কিংবা আফরান নিশো! তারা যদি কোন খারাপ-রাগী চরিত্র করে, দর্শকরা মুগ্ধ-মোহিত-বিগলিত- ‘বস ফাটাইয়া দিছেন!’ একই ধরনের চরিত্র যদি তিশা কিংবা মম করেন, তাহলে দর্শকদের গালির বন্যা বইতে থাকে। বাংলা ভাষায় এমন কোন জঘন্য গালি নেই যে সেখানে দেয়া হয় না। এমনও নয় যে নাটকে তারা কোন বড় অপরাধ করেছে! হয়ত যৌথ পরিবারে থাকতে রাজী হয়নি। স্বামী-সন্তানকে নিয়ে আলাদা বাসা নিতে চেয়েছে। কিংবা শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে কিছু কঠিন কথা বলেছে! ইত্যাদি। এই ধরনের পারিবারিক সংঘাত ধরনের কিছু। তাতেই দর্শকরা যত ক্ষোভ-রাগ ‍উগলে দেয় ছেলের বউয়ের উদ্দেশ্যে।

‘কমেন্টস’ সেকশনে গেলে সেই দেশের মানুষের আমজনতার মানসিক স্তরের কিছু নমুনা পাওয়া যায়। সক্রেটিস-এরিস্টোটলরা কেন যে গনতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন সেটা বোঝা যায়। আসলে একটা জনপদে শতভাগ মানুষ শিক্ষিত-সচেতন না হলে গনতন্ত্র সেখানে কোন সুফল দেয় না। এই উদহারণ ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ অর্থাৎ উপমহাদেশের জন্য প্রযোজ্য। অনেকে তো সেইজন্য কমেন্টস সেকশন বন্ধ করে দেয়। প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে তার স্বামী নিক জোনাসের পাশে মায়ের মত লাগে, মালাইকা অরোরাকে ‘আন্টি’, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা কিংবা নুসরাত জাহান কেন হিন্দু পুরুষকে বিয়ে করল, সোনম কাপুর আর তার পরিবার কেন নেপোটিজম করে- ইত্যাদি নিয়ে কমেন্টস চলতে থাকে প্রতিদিন। এমন কোন নোংরা ভাষা নেই যে সেখানে ব্যবহার হয়না। অথচ জেনিফার লোপেজ কিংবা বিয়ন্সে কবার বিয়ে করল, কি ধরনের পোষাক তাদের পরা উচিত- এই নিয়ে তাদের পোস্টে কোন উপদেশ চোখে পড়ে না।

সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্নহত্যার ঘটনায় অনেকের মত প্রচন্ড বেদনাআক্রান্ত হই আমি। অনেকদিন স্বাভাবিক হতে পারিনি। কিন্তু তখন অবাক হয়ে যেতাম ভারতের কিছু মানুষের উন্মাদনায়। সুশান্ত’র গার্লফ্রেন্ড রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে তারা এমনভাবে লেগেছিল যে বলার মত নয়। এখনও তারা শান্ত হয়নি। অথচ সুশান্তর পরিবারের সদস্যরা কেন জেনেশুনে তাঁর মানসিক রোগকে অবহেলা করেছে, সেটা আমার মাথায় আসেনি। আমার তো মনে হয়েছিল- রিয়া চক্রবর্তী না এই চাপ সামলাতে না পেরে নিজেই আত্নহত্যা করে বসেন। কারণ সাধারণ মানুষের চাপ সামলানো কঠিন নয়। আমরা সামান্য দুই-একজন কাছের মানুষের বৈরী আচরণে ভেঙ্গে পড়ি, আর সেই সংখ্যাটা যখন লাখে লাখে হয়- তখন পরিস্থিতি  ভীতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

প্রত্যেক সচেতন মানুষের উচিত অন্যকে সম্মান দেয়া। তাহলে সে নিজেই সম্মানিত হবে। বাংলা সিনেমায় যারা ভিলেন নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন, যেমন রওশন জামিল, মায়া হাজারিকা, রানী সরকার, রীনা খান- ওনাদের বলা হয় জাঁদরেল অভিনেত্রী। জাঁদরেল শব্দটি কি ইতিবাচক শব্দ? আমার জানা নেই। গোলাম মোস্তফা, এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরিদীর মত অনেক অভিনেতা ভিলেনের চরিত্রের অভিনয় করেছেন, তাদেরকে কেউ কিন্তু নেতিবাচকভাবে বিশ্লেষণ করেননি, বলেছেন শক্তিশালী অভিনেতা। জাঁদরেল অভিনেত্রীরা যখন মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন, সবাই তাদের বলত ‘খান্ডারনি’ মহিলা। আর ভালো মায়েরা হত অতি সহজ-সরল, সাধাসিধা। ‘আহারে আমার জনমদু:খিনী মা’ বলে কেঁদে বুক ভাসাতো নায়ক। যেন মায়েদের সুখী হবার কোন অধিকার নেই।

অনেক আগে সাদাকালো টেলিভিশনের যুগে একটা নাটক দেখেছিলাম, নাটকের নাম- ‘রাহু’। নাটকে ফেরদৌসি মজুমদার এক শিশুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তার মা মারা যাবার পরে বাবা আরেক মহিলাকে বিয়ে করেন। সৎমা তাকে দেখতে পেত না। সৎমা স্বামীর ওপর শোধ নিতে শিশুটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। পরে সে অনেকটা পাগল হয়ে যায়। সারাক্ষণ নিজের হাতে কেরোসিনের গন্ধ পেত। মনে আছে সেই মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যিনি তাকে সেই সময় সবাই ঘৃণা করত। অনেক সময় আমাদের মস্তিস্ক অভিনয় ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা। কিন্তু গভীরভাবে আমাদের নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবতে হবে যে- এসবই অভিনয়। আর অভিনয় আর বাস্তব এক না। খারাপ নারী চরিত্র আসলে নাটক বা সিনেমাতেই খারাপ। বাস্তবে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত