গত সংখ্যার পরে…
আগের সংখ্যা পড়তেঃ https://irabotee.com/story-8/
–বউ, বউ.., বউ…..
–এইত্তো আমি ইখানো…
–কই গেছলে?
–ঐত্তো পূবের ঘরো।
–পূবের ঘরো কিতা কাম তোর দিনে–রাইতে?
–সেইদুপুরে ভাত খাইছিল জায়গির, বাসনগুলা এখনো পইরা রইছে। আনতাম গেছলাম।
–বাসন আনতে গেছলে ? না রঙ্গ করতে গেছলে? লোকটা শিক্ষিত, আমার থাইক্কাও সুন্দর, প্যান্ট–র্শাট পরা সাহেব। ঐইখানে মত্ত অইচে তোর মন।
–কিতা কও ইতা!কিতা কও।
–আমি কই? আমি কিচ্চু বুঝিনা? কিচ্চু বুঝিনা আমি? সারাদিন মাঠে বাদারে পইরা থাকি, আমি কামলা, আমারে মনে ধরে না তোমার। জায়গির মাস্টারের পিরিতে মত্ত হইছস তুই। আামি সব বুঝি।
ছয় বছর বয়স তখন আমার, মক্তবে আমপারা পড়ি আর ঘরে জায়গীর স্যারের কাছে বর্ণমালা। আহা! অ,তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে, আ তে আমটি আমি খাবো পেড়ে।……জায়গীর স্যারের কাছে জপতে জপতে, মাতৃকণ্ঠে মৃত্যুর মতো আর্তনাদ শুনতে শুনতে আমি মুখ লুকাই জায়গীর স্যারের কোলে……। জায়গীর স্যার বলেন, আহা! ছেলেটা বড়োই সুবোধ।
পিতামাতার জাহান্নামের দাম্পত্যে শৈশবের অবোধ সারল্য ভুলে আমার নিতান্ত সুবোধ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না আর। সুবোধ আমি। তারপর কী হয় কে জানে, একদিন কাকডাকা ভোরে প্রলম্বিত হয় পিতার হুংকার……..। ঘুমের প্রানহীন ভুবনে তলিয়ে থাকা আমি শুনি চিৎকার।
সব পুড়াইয়া দিমু আমি, সব জ্বালাইয়া দিমু, সব ছারখার কইরা দিমু আমি। দুধ কলা আদর সোহাগে কালসাপ পুষছি আমি। বেঈমান নাগীন ঘরে তুলছিলাম আমি। ঘরে তুলছিলাম কামরুপ–কামাঈখ্যার মায়াবিনী। আমারে ভালেবাসার মায়ায় ভুলাইয়া আমার জীবনডারে তছনছ কইরা ভাগছে সে। ভালোবাসা, ভা..ল..বা..সা। সব তছনছ কইরা দিমু আমি। আমি লাথি মারি ভালোবাসায়।
পিতার শরীরে যেনো অপ্রতিরোধ্য বন্য হাতির উন্মত্ত বল। ধানের গোলা উল্টায়ে ফেলে সে। চুরমারে ভাঙে মায়ের যত্নে গড়া গার্হস্থ্য সিন্দুক। দিনমান গান বাজা রেডিও। কিচ্ছু রাখবে না সে কিচ্ছু না। আপাত আতঙ্কের রেশ অতিক্রম করে আমি দেখি, মা নাই। মা নাই আমার কোথাও নাই………।
আমার মা যদি ঘরের কড়িকাঠের সাথে ঝুলতো প্রানহীন দেহ হয়ে, আমার মা যদি নীল নিষ্প্রাণ শুয়ে থাকতো বিষের নীল ধারণ করে মোমমসৃণ অঙ্গে, আমি জানি মরণের দুঃখে মহতী পুরান হয়ে ওঠতো জীবন তার। কিন্তু আমার মা যে পালিয়েছে জীবনের মোহে জায়গীর মাস্টারের সাথে, বেঁচে থাকার আকণ্ঠ তৃষ্ণায়। হায় পৃথিবী নির্দয় পৃথিবী জন্মের জয়গান গাও তুমি আর মৃত্যুতে খুঁজো মহত্ত্ব মানবের। বেঁচে থাকা জীবনের কতো চুলচেরা হিসাব নিকাশ মনুষ্য সমাজের, রীতির–প্রথা –আচারের–আইনের– বিচারের। সব হিসাব কড়ায়–গন্ডায়, কেবল মূল্যহীন এই বেঁচে থাকার তৃষ্ণার হিসাব।
যখন টর্নেডোর মহাপ্রলয় থেমে গেলে ধ্বংসস্তুপের ওপরে পিতা স্তব্ধ বসে পরেন জায়নামাজে,কাঁধের লাঙল আর পূর্ণ ধানের গোলার বৈষয়িক মোহ ত্যাগ করে আশ্রয় নেন মসজিদে–মসজিদে। যখন তখন চলে যান তাবলিগের কাফেলায়। পিতা কী দগ্ধ হন অনুতাপের আগুনে? শান্তি খুঁজেন কল্পনারও অতীত শক্তিমান শক্তির কাছে? কে জানে? কে জানতো! অজানার বয়স আর অবোধ্যতায় বড়োই নিরাশ্রয় হয়ে পড়ি আমি।
দিনকয় পরে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসি জায়গীর স্যারের ঘরে, মায়ের গন্ধের নেশায়, আশ্রয়ের নেশায়। অতল মাটি থেকে শিকড় ছেঁড়া এক চারাগাছ আমি রোপিত হই তলাবদ্ধ পাত্রে। হই বটে, খেয়ে পরে বর্ধিত হই, স্কুল যাই, ক্লাস ডিঙাই কিন্তু প্রতিদিন প্রতিপদে টের পাই নিয়ম ভাঙা এই অনিয়মের সংসারে বড়ই অনাহুত আমি, বড়োই অনাকাঙ্খিত। গর্ভধারিণী মা বড়ো অচেনা দেখায় এই নিয়মিহীনতায়। স্কুলের ক্লাস ডিঙিয়ে কলেজের গেটে ঢুকতে না ঢুকতেই দেখি জায়গীর স্যারের হাভাতে জীবন,একের পর এক ব্যবসায় অসফল জায়গীর স্যার তখন দুই সহোদরের পিতা। ঋণে জর্জরিত সংসারে ঠিকমতো হাড়ি চাপেনা চুলায়। দেখি তখন ঠিক আমার পিতার এক ছোটখাটো সংস্করণ হয়ে, হাতে চেলি নিয়ে তার যাবতীয় ব্যর্থতার প্রতিতশোধ নেয় মায়ের উপর।
–ঘর ভাঙা নারী তুই, কূলাটা–অলক্ষী, তোর পাপেই আমার এই কষ্টের জীবন ।
–আপনারে ভরসা কইরা ঘর ছাড়ছি আমি, হাত ধরছি আপনারে।
–ভরসা? কূলাটা নারী…. লোভে পইড়া ঘর ছাড়ছস তুই, লোভই ডাইকা আনছে তোর এই হাভাতে পাপের জীবনে।
–বাইচা থাকনের লাইগা ঘর ছাড়ছি আমি।
–একভুল জন্ম দেয় আরেক ভুলের, বাঁচনের আশা তখন মরণ হইয়া উঠে। তুই নিজেও মরছস, সাথে আমারেও মারছস।
মায়ের তীব্র চিৎকার বাঁচাও…..বাঁচাও……কোনো কোনোদিন উত্তপ্ত সীসা হয়ে আমার কর্ণকুহর বেয়ে অন্তর ছুঁয়ে পৌছে যায় শিরায় শিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে…….। আমি, মেরুদন্ডহীন, কেঁচো আমি, মা কে বাঁচাতে যাবার তীব্র বাসনা আর আত্মবিশ্বাসের ভঙুর দুর্বলতায় ক্ষয়ে যাই। পারি না, সহ্য করতে পারি না। আমার মা চিৎকার করে বাঁচাও বাঁচাও………আর সেই চিৎকার সহ্যের অতীত হলে আমি পালাই………..। আমি আবার পালাতে শুরু করি…….।
হায় জীবন, পলায়নপর জীবন আমার। নোঙর ফেলি শহরের জলহীন, ছায়াহীন আবর্জনার জঙ্গলে। জীবন বড়োই নির্মম এই ইট পাথরের প্রাণহীনতায়। তবু দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কেবল অস্তিত্বে টিকে থাকার লড়াইয়ে, এক পা দু পা বাড়াই, হাঁটি। হোঁচট খাই,রক্তাক্ত হই আবার হাঁটি। আবাস হয় গলি–ঘুপচিময় এক কিনু গোয়ালার গলিতে। সেখানে আমি ছাড়া থাকে আরো কয়েক মনুষ্যপ্রাণী, আমার মতোই নানা সংকটে যারা আষ্টেপৃষ্ঠে জর্জর। দিনে কলেজ যাই আর রাতে টিউশানি। সন্ধ্যা থেকে প্রায় মধ্যরাতে ফিরি মাতাল নেশাখোরদের হুল্লোড় ডিঙিয়ে……।
হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেই উপার্জনের বন্ধুর পথ। হাঁটি, টিকে থাকি আর সুবোধ আমি নিজেকে প্রবোধ দেই, এখানে মায়ের আর্তি আমাকে ছিন্নভিন্ন করে না দুবেলা ভাতের বিনিময়ে। দু তিনটে সার্টিফিকেট এক করে দৌড়াই দরজায় দরজায়, চাকরির নামের সোনার হরিণ। এ শহরে কোনোই ডাল নেই আমার,একটু আঁকড়ে ধরি। কোনো পাতা নেই, ক্ষুদ্র পিঁপড়ের মতো বেয়ে বেয়ে সন্ধান করি নিরাপদ আশ্রয়ের…..। দপ্তর থেকে দপ্তরে, তবু কারো দয়া হয়। ডাক পাঠায় সাক্ষাৎকারের। মুখোমুখি কতো বিচিত্র অভিজ্ঞতা অযোগ্যতার বিনিময়ে…..।
–ওমা, এই সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন চাকরি নিতে? এই সার্টিফিকেট দিয়ে কী চাকরি আশা করেন আপনি?
–স্যার খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মতো সামান্য চাকরি একটা।
সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী কর্মকর্তারা তাকায় পরস্পর।
–আচ্ছা, আপনার পরিবারে সদস্যসংখ্যা কতোজন?
–আমি একা স্যার।
তারা আবার তাকায় পরস্পর।
–হাহাহাহা, আপনার মত কতলোক এই দেশে চলে–ফিতে খেতে পায়না, তারা এলেই আমরা চাকরি দিয়ে দেবো?
–জ্বী না মানে, আসলে স্যার।
–আচ্ছা বলুন, আপনি কম্পিউটার স্কিলড? মাইক্রোসফট অফিস, মাইক্রোসফট এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট?
–না স্যার
–কী আশ্চর্য! এই তৃতীয় শ্রেণীর সার্টিফিকেট আর কোনোপ্রকার স্কিলডনেস ছাড়াই আমাদের কাছে চাকুরী নিতে আসেছেন আপনি। বাহঃ বাহঃ বেশ!!
–আমার একটা চাকরির খুব প্রয়োজন স্যার । বেঁচে থাকার জন্যে …
সাক্ষাৎকার গ্রহনকারীদের হতাশ মুখভঙ্গিকে থোরাই পরোয়া করি আমি।
–তাহলে আপনি বলুন, মানে আমাদের কনভিনস করুন। এই চাকরিটা আমরা কেন দিবো আপনাকে।
–স্যার আসলে আমি!
–ঠিক আছে, আপনি কী কোটা প্রত্যাশী? মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, ট্রাইবাল?
–না স্যার
সার্টিফিকেটগুলো মুখ বরাবর ঢিল ছুঁড়ে তারা জানায়
–সাহস তো কম নয় আপনার। এই সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরির বাজারে নামেন……।
বাকী অংশ পরের সংখ্যা…

১৯৭০ সনের ০৭ মে হবিগঞ্জে জন্ম। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে লেখালেখির মাধ্যমেই হাতেখড়ি। শুরুটা আরো অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগতকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ প্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ, একবগগা, খরখরে কিন্তু অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। গল্প লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন বৈশাখী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে সেরা গল্পকারের পুরস্কার, ফেয়ার এন্ড লাভলী সেরা ভালোবাসার গল্প পুরস্কার। ২০১৪ সাথে মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘তনুশ্রী পদক’। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তর্জাল সাহিত্য পোর্টালে লেখালেখিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী অনিরুদ্ধ কুমার ধর ও যমজ সন্তান অদ্বিতীয়া অভীন্সা পদ্য ও অদ্বৈত অভিপ্রায় কাব্যকে নিয়ে হবিগঞ্জে বসবাস করছেন।
মঞ্চে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা থিয়েটার প্রবর্তিত, ফওজিয়া ইয়াসমিন স্মৃতি পদক,থিয়েটার প্রবর্তিত জাকারিয়া পদক।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৫টি। নাটক ২ টি ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস সহ প্রকাশিত গ্রন্থ ৯টি।