Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

বৃত্ত

Reading Time: 3 minutes

এই মাত্র প্রচণ্ড একটা শব্দ হলো। জানালা দিয়ে দেখলাম সামনের বিল্ডিংগুলো দুলছে। ঘরভর্তি আমার বই আর স্ক্রিপ্ট ছড়ানো। হটাত অন্ধকার হয়ে গেল সবটা। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও তো দিনের আলো ছিল। তাহলে দিন গেল কোথায় ? অন্ধকারে চশমাটা খুঁজে নিলাম আর আমার কয়েকটা স্ক্রিপ্ট নিলাম। চাবি খুঁজছি, চাবিটা না পেয়ে মরিয়া হয়ে খুঁজছি বুক সেলফে, টেবিলে। যখন সব কিছু ভেঙ্গে পড়ছে বাইরের পৃথিবীর আর আমি তখন চাবি খুঁজছি ? আমার কি পারম্পর্য ক্ষমতা সবটুকু লোপ পেয়েছে ? যখন দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, সিড়ির অংশ আরা বাড়ি অংশ একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আবার দোল খেয়ে একে অপরের কাছে ঘেঁষছে। সাততলা আর ছ’তলার মাঝের সিড়িঘরের জানালায় দেখলাম একটা ছোট শিশু চার কি পাঁচ হবে, জানালার ভাঙা অংশ দিয়ে লাফিয়ে পড়ে গেল। এই সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়লো ! কী হচ্ছে এসব! আমি ভাঙ্গা সিড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। একবার সিড়িগুলো সরে যাচ্ছে আবার কাছে আসছে। বাড়িটার ঠিক মাঝখান দিয়ে ফেটে গেছে। গ্যাস বিদ্যুতের লাইন গেছে মাটির তলা দিয়ে। সেখানেই হয়তো আগুন ধরে গেছে। সিড়িট যখন দূরে চলে যাচ্ছে আগুনের হল্কা এসে আমার মুখে লাগছে। একটু সামলে নিতে না পারলেই আমার স্ক্রিপ্টগুলো আগুনে পড়ে যাবে। আর আমি ? আমার সত্যিই সব যুক্তি সংলগ্নতা লোপ পেয়েছ ! না ভেবে আবার নামতে শুরু করলাম। যত নিচে নামছি বিল্ডিংটা ক্রমাগত দুলে চলছে। আগুনে মানুষ পোড়া গন্ধ। হয়তো কোন ফ্ল্যাটের কাঠের আসবাব পুড়ছে তার শব্দ, কাঁচ ফাটার শব্দ সব কানে আসতে লাগলো। আমার সামনে দিয়ে একজন ষাট কি সত্তর বছরের বৃদ্ধা ,যার শরীরের অর্ধেকটাই আগুনে পুড়ে গেছে, তিনি গড়িয়ে গড়িয়ে সিড়ির ফাঁক দিয়ে আগুনে পড়ে গেলেন। আমি তাকে ধরতে পারলাম না। ধরতে গেলেই যদি আমার স্ক্রিপ্ট পড়ে যায় ? চারতলা থেকে যখন তিনতলাতে তখন মনে হলো আমি খালি পায়ে আছি। আমার পা দুটো পুড়ে পুড়ে উঠছে। আমি স্যান্ডেল আনার জন্য আবার সাততলার দিকে ছুটলাম। যখন ছ’তলায় পৌঁছলাম দেখলাম সাততলা তখন আর নেই। সাত তলা সিড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁকে আছে। আমার ঘরটা হা হয়ে আছে। চোখের সামনে দেখলাম আমার সমস্ত বইয়ে আগুন লেগে গেছে, সব বইগুলো পুড়ছে। আমি নির্বিকার। দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম না। হাত থেকে চাবিটা ছুড়ে দিলাম আগুনে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম সেই ছোট শিশুটা , যাকে আগেরবার সিড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে দেখেছিলাম। ও ঠিক একইভাবে জানালার ভাঙ্গা অংশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আছে । আমার দিকে তাকালো। একটু হাসলো। তারপর লাফিয়ে পড়লো নিচে। আমি ওর পড়ে যাওয়ার সমস্ত দৃশ্যটুকু দেখলাম। আবার সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। পাঁচতলা তে এসে সেই বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলাম যার অর্ধেক শরীর পুড়ে গেছে। তিনি চোখের সামনে দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলেন আগুনে। আশ্চর্য হলাম এখন কোথাও কোন শব্দ নেই শুধু আগুনপোড়া শব্দ ছাড়া। মানুষের চিৎকার নেই কোথাও। কেমন সব নিস্তব্ধ! চার তলায় এসে আমার এবার মনে পড়লো আমি স্ক্রিপ্টগুলো ছ’তলায় ফেলে এসেছি। কখন ফেললাম ? আবার দৌড়ে উপরে উঠছি। তখন আমার ও প্রায় অর্ধেক শরীর আগুনের হল্কায় তেতে গেছে। বিল্ডীংটা তখনো ক্রমাগত দুলে যাচ্ছে। ছ’তলাতে যেতেই দেখতে পেলাম সেই ছোট শিশু জানালায় চড়ে বসে আছে আমি পৌছাতেই ও লাফ দিল জানালা থেকে। দেখলাম স্ক্রিপ্টগুলো পড়ে আছে। দু একটায় আগুন ধরে গেছে। আমি সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বুকে ঠেসে প্রানপনে দৌড় শুরু করলাম। এবার আমি দৌড়াচ্ছি কখোনো চোখ খুলে কখোনো চোখ বন্ধ করে। একেবারেই নিচতলায় এসে যখন পৌছালাম তখন সেখানে একেবারে ঘন কালো অন্ধকার। সেই অন্ধকার চিড়ে একটা ক্ষীণ আলো আসছে। বোধহয় গেটের বাইরে থেকে। আমি এগিয়ে গেলাম। দেখলাম গেটের প্রায় তিনভাগের পৌনে তিনভাগই মাটির নিচে চলে গেছে। এখনো একটু অবশিষ্ট আছে। স্ক্রিপ্টগুলো বুকের সাথে চেপে ধরে হামাগুড়ি নয় একেবারে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম। বাইরে তখন রোদ , আলো আর আলো আমি ভালো করে তাকাতে পারছিলামনা। যখন একটু ধাতস্থ হয়ে আমি দৃষ্টি স্থির করলাম, দেখলাম মানুষজন যে যার মতো করে হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম তারা প্রায় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কেউতো দৌড়চ্ছে না ? তবে আমি যে সাততলা থেকে দেখলম বাইরের পৃথিবীটা দুলছে! মানুষগুলো দৌড়াচ্ছে না কেন? আমার দিকে এভাবে কেন তাকিয়ে আছে? বুকের সাথে স্ক্রিপ্টগুলো আরো চেপে ধরলাম। এবার নিজের দিকে তাকালাম। দেখলাম আমার শরীরে এতটুকু ও কাপড় নেই। সমস্ত শরীরের কোথাও কোথাও কালি আর কোথাও আগুনের তাপে লাল লাল ছোপ। মানুষগুলো এবার যেন একটু দ্রুতই ছুটে আসছে আমার দিকে। আমি তখনো নিশ্চল, নিথর দাঁড়িয়ে। শেষ বিকেলের গোধুলীর যে তীব্র লাল ছটা সেটা আমার শরীর জুড়ে। আমি তখন অস্তরাগের সূর্যের মতোই লাল হয়ে উঠেছি। তবে শীতল নই উত্তপ্ত। সামনে আর মানুষ দেখতে পেলাম না। দেখলাম অসংখ্য পতঙ্গ তীব্র গতিতে ছুটে আসছে আমার দিকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>