ইরাবতী সম্পাদকের পছন্দ পুনর্পাঠ গল্প : সুন্দরম্ । সুবোধ ঘোষ
সমস্যাটা হলো সুকুমারের বিয়ে। কি এমন সমস্যা! শুধু এক মনোমত পাত্রী ঠিক করে শুভলগ্নে শাস্ত্রীয় মতে উদ্বাহ কার্য সমাধা করে দেওয়া; মানুষের একটা জৈব সংস্কারকে সংসারে পত্তন করে দেওয়া। এই তো!
কিন্তু বাধা আছে — সুকুমারের ব্রহ্মচর্য। বার বছর বয়স থেকে নিরামিষ ফোঁটা তিলক ধরেছে সে। আজও পায়ে সেধে তাকে মুসুরির ডাল খাওয়ান যায় না। সাহিত্য কাব্য তার কাছে অস্পৃশ্য। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া জীবনে সে পড়েছে ক’খানি যোগশাস্ত্রের দীপিকা। বাগানের নির্জন পুকুরঘাটে গভীর রাতে একাগ্র প্রাণায়ামে কতবার শিউরে উঠেছে তার সুষুম্ন। প্রতি কুম্ভকে রেচকে সুকুমার অনুভব করেছে এক অদ্ভূত আত্মিক শক্তির তড়িত্স্পর্শ, শ্বাসে প্রশ্বাসে রক্তে ও স্নায়ুতে।
সুকুমার চোখ বুজলেই দেখতে পায় তার অন্তরের নিভৃত কন্দরে সমাসীন এক বিরাগী পুরুষ। আবিষ্ট অবস্থায় কানে আসে, কে যেন বলছে — মুক্তি দে, মুক্তি দে। জপ ছেড়ে চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পায়, কার এক গৈরিক উত্তরীয় ক্ষণিকের দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে।
সুকুমার বন্ধুদের অনেকবার জানিয়েছে — বাস্, এই এগজামিনটা পর্যন্ত, তার পর আর নয়। হিমালয়ের ডাক এসে গেছে আমার।
সুকুমারের বাবা কৈলাসডাক্তার বলতেন — প্রোটিনের অভাব। পেটে দুটো ভালো জিনিস পড়ুক, গায়ে মাংস লাগুক, এসব ব্যামো দু’দিনেই কেটে যাবে। কত পাকামি দেখলাম।
কিন্তু মা, পিসিমা, ছোটোবোন রাণু আর ঝি, তাদের মন প্রবোধ মানে না।
সকলে মিলে চেপে ধরলো কৈলাসডাক্তারকে — যত শীগগির পার পাত্রী ঠিক করে ফেল আর দেরী নয়!
ঝিয়ের কোঁদল তো লেগেই আছে — ছি ছি. সংসারে থেকেও বনবাস। ছোটজাতের ছোটঘরেও কেউ এমন কসাইপনা করেনা বাপু।
সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা হলো। কৈলাসবাবু পাত্রী দেখবেন। ভগ্নীপতি কানাইবাবু সুকুমারের মতিগতির চার্জ নিলেন। যেমন করে পারেন কানাইবাবু সুকুমারকে সংসারমুখো করবেন।
পাশের খবর বেরিয়েছে। কানাইবাবু সুকুমারকে দিয়ে জোর করে দরখাস্তে সই করালেন! নাও, সই কর। মুন্সেফী চাকরি ঠাট্টার নয়! সংসারে থেকেও সাধনা হয়। ঐ যাকে বলে, পাঁকাল মাছের মত থাকবে। জনকরাজা যেমন ছিলেন।
বাড়ির বিষণ্ণ আবহাওয়া ক্রমে উত্ফুল্ল হয়ে আসছে। কৈলাসবাবু পাত্রী দেখে এসেছেন। এখন সমস্যা সুকুমারকে কোন মতে পাত্রী দেখাতে নিয়ে যাওয়া। কানাইবাবু সকলকে আশ্বস্ত করলেন — কিছু ভাববার নেই; সব ঠিক হো যায়েগা।
সংসারের ওপর সুকুমারের এই নির্লেপ, এখনও কে যায়নি ঠিকই! তবু একটা চাঞ্চল্য, আচারে আচরণে রক্তমাংসের মানুষের মেজাজ এক-আধটুকু দেখা দিয়েছে যেন।
তবু একবার পড়ার ঘরে কানাইবাবুর সঙ্গে সুকুমারের একটা বচসা শোনা গেল। বাড়ির সবারই বুক দুরদুর করে উঠলো। ব্যাপার কি ?
কানাইবাবুর কথার ফাঁদে পড়ে সুকুমারকে উপন্যাস পড়তে হয়েছে, জীবনে এই প্রথম। নাভিমূলে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে, অগুরু পুড়িয়ে ঘরের বাতাস পবিত্র করে নিয়ে অতি সাবধানে পড়তে হয়েছে। বলবান ইন্দ্রিয়গ্রাম, কি হয় বলা তো যায় না।
কিন্তু উপন্যাস না নরক। যতসব নীচ রিপুসেবার বর্ণনা। সমস্ত রাত ঘুম হয়নি।, এখনও গা ঘিন ঘিন করছে।
সুকুমার বলে — আপনকে এবার ওয়ার্ণিং দিয়ে ছেড়ে দিলাম কানাইবাবু।
মানে অপমানে পূর্ণ উদাসীন কানাইবাবু বললেন — আজ সন্ধ্যায় সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাব তোমায়। যেতেই হবে ভাই। তোমার আজ্ঞাচক্রের দিব্যি। তা ছাড়া ভাল ছবি, ধ্রুবের তপস্যা। মনটাও তোমার একটু পবিত্র হবে।
কানাইবাবুর এক্সপেরিমেন্ট বোধহয় সার্থক হয়ে উঠলো। ক’দিন পরেই দেখা গেল, সুকুমার কাব্য পড়ছে, কোন্ এক আখড়ায় গিয়ে মাথুর শুনে এসেছে, ঘন ঘন সিনেমায় যাচ্ছে। এদিকে অ্যাপয়েনমেন্ট পত্রও চলে এসেছে।
কিন্তু অনাসক্তির ঘোর পূর্ণ কাটেনি। আজকাল সুকুমারের অতীন্দ্রীয় আবেশ হয়। জ্যোত্স্না রাতে বাগানে একা বসে বসে নেবুফুলের সুগন্ধে মনটা অকারণে উড়ে চলে যায় — ধূলিধূসর সংসারের বন্ধনে ছেড়ে যেন আকাশের নীলিমায় সাঁতার দিয়ে বেড়ায়! একটা বিষণ্ণ সুখকর বেদনা। কিসের অভাব! কাকে যেন চাই! কে সেই না পাওয়া ? দীর্ঘশ্বাস চাপতে গিয়ে লজ্জা পায় সুকুমার।
রাত করে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরবার পথে কানাইবাবু সুকুমারকে জিজ্ঞেস করলেন — নাচটা কেমন লাগলো?
সুকুমার সহসা উত্তর দিল না। একটু চুপ করে থেকে বললো — কানাইবাবু ?
— কি ?
— মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
— নিশ্চয়। কালই চল বারাসত। যাদব ঘোষের মেয়ে বনলতা। তোমার মেজদি যেতে লিখেছে। আর বাবা তো আগেই দেখে এসেছেন।
উকিলের মহুরী যাদব ঘোষ। বংশ ভাল তার মেয়ে বনলতা দেখতে ভালই। যাদব ঘোষ অল্প পণে সত্পাত্র খুঁজছেন।
মেজদি এক বছর পনের বয়েসের মেয়েকে হাত ধরে সামনে টেনে নিয়ে এলেন। — ভাল করে দেখে নে সুকু, মনে যেন শেষে কোন খুঁতখুঁত না থাকে।
যাত্রাদলের রাজকুমারীর মত মেয়েটাকে যতদূর সম্ভব জবরজং করে সাজানো হয়েছে। বিরাট একটা বেনারসী শাড়ী আর পুরু সাটিনের জ্যাকেট। পাড়ার মেয়েদের কাছ থেকে ধার-করা চুড়ি রুলি বালা ও অনন্ত, কনুই পর্যন্ত বোঝাই করা দু হাত। ঘামে চুপসে গেছে কপালের টিপ, পাউডারের মোটা খড়ির স্রোত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গলার ওপর। মেয়ে দম বন্ধ করে, চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যেন যজ্ঞের পশুর মত এসে দাঁড়ালো।
বনলতার শক্ত খোঁপাটা চট করে খুলে, চুলের গোছা দু’হাতে ধরে মেজ বললেন — দেখে নে সুকু। গাঁয়ের মেয়ে হলে হবে কি? তেলচিটে ঘাড় নয়, যা তোমাদের কত কলেজের মেয়েদের দেখেছি। রামোঃ।
মেজদি যেন ফিজিওলজি পড়াচ্ছেন। বনলতার থুতনিটা ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখালেন। চোখ মেলে তাকালে বললেন — ট্যারা কানা নয়। পায়চারি করালেন — খোঁড়া নয়। সুকুমারের মুখের সামনে বনলতার হাতটা টেনে আঙুলগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখালেন — দেখছিস তো, নিন্দে করার জো নেই।
দেখার পালা শেষ হলো। বাড়ি ফিরে কানাইবাবু জিজ্ঞাসা করলেন — কি যোগীবর, পছন্দ তো ?
সুকুমার চুপ করে বসে রইল। মুখের চেহারা প্রসন্ন নয়। কানাইবাবু বুঝলেন, এক্ষেত্রে মৌনং অসম্মতি লক্ষমং!
— সিনেমায় বনানী দেবীর নাচ দেখে চোখ পাকিয়েছে ভায়া, এ সব মেয়ে কি পছন্দ হয়! — কানাইবাবু মনের বিরক্তি মনে চেপে রাখলেন।
পিসিমা বললেন — ছেলের আপত্তি তো হবেই। হা-ঘরের মেয়ে এনে হবে কি ? মহুরী-টুহুরীর সঙ্গে কুটুম্বিতা চলবে না।
সুন্দরী মেয়ে চাই। এইটেই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কৈলাসডাক্তার পাত্রী দেখেছেন আর বিপদের কথা এই যে, তাঁর চোখে অসুন্দর তো কেউ নয়। তাই কৈলাশডাক্তার কাউকে সুন্দরী বলে সার্টিফিকেট দিলেই চলবে না। এ বিষয়ে তাঁর রুচি সম্বন্ধে সকলের যথেষ্ট সংশয় আছে। প্রথম ছেলে, জীবনসঙ্গিনী নিয়ে ঘর করতে হবে যাকে, তারই মতটা গ্রাহ্য। তারপর আর সকলের।
কৈলাসবাবু নিজে কুরূপ। কুত্সা করা যাদের আনন্দ তারা আড়ালে বলে ‘কালো জিভ’ ডাক্তার। ভদ্রলোকের জিভটাও নাকি কালো। যৌবনে এ গঞ্জনা কৈলাস ডাক্তারকে মর্মপীড়া দিয়েছে অনেক। আজ প্রৌঢ়ত্বের শেষ ধাপে এসে সেই পীড়িত মর্মের কোন অভিমান আর নেই।
বাংলোর বারান্দায় সোফায় বসে নির্দিষ্ট মনে কৈলাসডাক্তার এই কথাই ভাবছিলেন। এই রূপতত্ত্ব তাঁর কাছে দুর্বোধ্য। আজ পঁচিশ বছর ধরে যে ঝানু সার্জন ময়নাঘরে মানুষের বুক চিরে দেখে এসেছে, তাকে আর বোঝাতে হবে না, কা’কে সোনার দেহ বলে! মানুষের অন্তরঙ্গ রূপ-এর পরিচয় কৈলাসডাক্তারের মত আর কে জানে! কিন্তু তাঁর এই ভিন জগতের সুন্দরম্, তাকে কদর দেবার মত দ্বিতীয় মানুষ কৈ ? দুঃখ এইটুকু।
হঠাৎ শেকল বাঁধা হাউন্ডটার বিকট চিত্কার আর লাফঝাঁপ। ফটক ঠেলে হুড়মুড় করে ঢুকলো মানুষের ব্যঙ্গমূর্তি কয়েক প্রাণী। যদু ডোম আর নিতাই সহিস দৌড়ে এল লাঠি নিয়ে।
যদু ও নিতাইয়ের গলাধাক্কা গ্রাহ্য না করে ফটকের ওপর জুত করে বসলো একটা ভিখারী পরিবার। নোংরা চটের পোঁটলা, ছেঁড়া মাদুর, উনুন, হাঁড়ি, ক্যানেস্তারা, পিঁপড়ে ও মাছি নিয়ে একটা কদর্য জগতের অংশ। সোরগোল শুনে সবাই বেরিয়ে এল।
কৈলাসবাবু বললেন — কে রে এরা যদু ? চাইছে কি ?
— এ ব্যাটার নাম হাবু বোষ্টম, তাঁতীদের ছেলে। কুষ্ঠ হয়ে ভিক্ষে ধরেছে।
কুষ্ঠী হাবু তার পট্টিবাঁধা হাত দুটো তুলে বললো — কৃপা করো বাবা!
— এই বুড়িটা কে ?
— এ মাগীর নাম হামিদা। জাতে পশ্চিমা বেদিয়া, বসন্তে কানা হবার পর দলছাড়া হয়েছে। ও এখন হাবুরই বৌ।
হামিদা কোলের ভেতর থেকে নেকড়ার জড়ানো দু’মাসের একটা ছেলেকে দু’হাতে তুলে ধরে নকল কান্নায় কঁকিয়ে কঁকিয়ে বললো — বাচ্চাকা জান হুজুর! এক পিয়ালী দুধ হুজুর! এক মুঠঠি দানা হুজুর!
— আর এই ধিঙ্গি ছুঁড়িটা কে? পিসিমা প্রশ্ন করলেন।
— ওর নাম তুলসী। হাবু আর হামিদার মেয়ে।
— আপন মেয়ে।
— হ্যাঁ পিসিমা। যদু উত্তর দিল।
তুলসী একটা কলাই-করা থালা হাতে তুলে চুপ করে বসে আছে। পরিধানে খাটো একটা নোংরা পর্দার- কাপড়, বুকের ওপর থেকে গেরো দিয়ে ঝোলানো। আভরণের মধ্যে একটা কৌড়ির তাবিজ।
দেখবার মতো চেহারা এই তুলসীর! বছর চৌদ্দ বয়স, তবু সর্বাঙ্গে একটা রূঢ় পরিপুষ্টি। ডাকিনীর টেরাকোট্টা মূর্তির মত কালি-মাড়া শরীর। মোটা থ্যাবলা নাক। মাথার বেঢপ খুলিটা যেন একটা চোট লেগে টেরে-বেঁকে গেছে। বড় বড় দাঁত, যেন একটা জন্তুর হিংসে ফুটে রয়েছে। মুখের সমস্ত পেশী ভেঙেচুরে গেছে, ছন্নছাড়া বিক্ষোভে। এ মুখের দিকে তাকিয়ে দাতাকর্ণও দান ভুলে যাবে, গা শিরশির করবে। কিন্তু যদু বললো — তুলসীর ভিক্ষের রোজগারই নাকি এদের পেটভাতের একমাত্র নির্ভর।
হাবু ঠিক ভিক্ষে করতে আসেনি। মিউনিসিপ্যালিটি এদের বস্তি ভেঙে দিয়েছে। নতুন অফিসের গুদাম হবে সেখানে। শহরের এলাকায় এদের থাকবার আর হুকুম নেই।
হাবু কান্নাকাটি করলো — একটা সার্টিফিকেট দিন বাবা। মুচিপাড়ার ভাগাড়ের পেছনে থাকবো। দীননাথের দিব্যি, হাটবাজারে ঘেঁষবো না কখনো। তুলসিই ভিক্ষে খাটবে, ওর তো আর রোগ বালাই নেই।
পিসিমা বললেন — যেতে বল, যেতে বল। গা ঘিন্ ঘিন্ করে। কিছু দিয়ে বিদেয় করে দে রাণু।
রাণু বললো — আমার ছেঁড়া ফ্লানেলের ব্লাউজটা দিয়ে দিই। এই শীতে তবু ছেলেটা বাঁচবে।
— হ্যাঁ দিয়ে দে। থাকে তো একটা ছেঁড়া শাড়িও দিয়ে দে। বয়স হয়েছে মেয়েটার, লজ্জা রাখতে হবে তো।
কৈলাসাডাক্তার বললেন — আচ্ছা যা তোরা। সার্টিফিকেট দেব, কিন্তু খবরদার হাটবাজারে আসিস না।
হাবু তার সংসারপত্র নিয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেলে তুলসীর কথাটাই আলোচনা হলো আর একবার! কৈলাসবাবু হেসে বললেন — দেখলে তো সুন্দরী তুলসীকে! ওরও বিয়ে হয়ে যাবে, জানো ?
ঝি উত্তর দিল — বিয়ে হবে না কেন ? সবই হবে। তবে সেটা আর বিয়ে নয়।
কৈলাসবাবু এক পাত্রী দেখে এসেছেন। নন্দ দত্তের বোন দেবপ্রিয়া। মেয়ে ভালই, তবে সুকুমার একবার দেখে আসুক।
দেখানো হল দেবপ্রিয়াকে। মেদের প্রাচুর্যে বয়স ঠিক ঠাহর হয় না। চওড়া কপাল, ছোট চিবুক, গোল গোল চোখ। গায়ের রঙ মেটে, কিন্তু সুমসৃণ। ভারি ভুরু দু’টোতে যেন তিব্বতী উপত্যকার ধূর্ত একটু ছায়া, প্রচ্ছন্ন এক মঙ্গোলিনীকে ইসারায় ধরিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। সে বোধহয় জানে, তার এই অপ্রাকৃত পৃথুলতা লোক হাসাবার মতোই। দেবপ্রিয়ার গলা মিষ্টি, গান গায় ভাল।
সুকুমার হ্যাঁ না কিছুই বলে না। বলা তার স্বভাব নয়। বোঝা গেল, এ মেয়ে তার পছন্দ নয়।
পিসিমাও বললেন — হবেই না তো পছন্দ। শুধু গলা দিয়েই তো আর সংসার করা যায় না। তা ছাড়া নন্দরা বংশেও খাটো।
কৈলাসডাক্তার দুশ্চিন্তায় পড়লেন। সমস্যা ক্রমেই ঘোরালো হচ্ছে। এ মোটে সহজ ব্যাপার নয়। নানা নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে একে একে। শুধু সুন্দরী হলেই চলবে না। বংশ, বিত্ত, শিক্ষা ও রুচি দেখতে হবে।
মাঝে পড়ে পুরুত ভট্টাচার্য্যি আরও খানিকটা ইন্ধন জুগিয়ে গেছেন। সমস্যাটা ক্রমেই তেতে উঠেছে। ভট্টাচার্য্যি বাড়ির সকলকে বুঝিয়ে গেছেন — নিতান্ত আধ্যাত্মিক এই বিয়ে জিনিসটা। কুলনারীর গুণ-লক্ষণ মিলিয়ে পাত্রী নির্বাচন করতে হবে। গৃহিণী সচিব সখি প্রিয়শিষ্যা, সব যাচাই করে দেখতে হবে। সারাজীবনের ধর্মসাধনার অংশভাগিনী, এ ঠাট্টার ব্যাপার নয়। ধরে বেঁধে একটা নিয়ে এলেই চলবে না। ওসব যাবনিক অনাচার চলবে না।
হ্যাঁ, তবে সুন্দরী হওয়া চাই-ই। কারণ সৌন্দর্য একটা দেবসুলভ গুণ।
এবার যতদূর সম্ভব সাবধানে, খুব ভেবেচিন্তে কৈলাসডাক্তার এক পাত্রী দেখে এলেন। অনাদি সরকারের মেয়ে অনুপমা, সুশিক্ষিতা ও সুন্দরী।
অনুপমার বয়স একটু বেশি। রোগা বা অতিতন্বী দুই-ই বলা যায়। মুখশ্রী আছে কি না আছে তা বিতর্কের বিষয়। তবে চালচলনে সুরুচির আবেদন আছে নিশ্চয়। রূপে যেটুকু ঘাটতি তা পুষিয়ে গেছে সুশিক্ষার হ্লাদিনী গুণে।
প্রতিবাদ করলো রাণু। — না, ম্যাচ হবে না। যা ঝিরকু চেহারা মেয়ের!
ঋষি বালকের মতো কাঁচা মন সুকুমারের। হাঁ — না বলা ধাতে সম্ভব নয়। কিংবা অতিরিক্ত লজ্জা, তাও হতে পারে। তবে তার আচরণেই বোঝা গেল, এ বিয়েতে সে রাজী নয়।
পিসিমা বললেন — ভালই হল। জানি তো, কী কিপটে অনাদি চাষা। বিনাখরচে কাজ সারতে চায়। পাত্র যেন পথে গড়াচ্ছে।
দৈবজ্ঞী মশায় এসে পিসিমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন — পাত্রীর রাশি আর গণ খুব ভাল করে মিলিয়ে দেখবেন পিসিমা। ওসব কোন তুচ্ছ করার জিনিস নয়।
— সবই গ্রহের কৃপা। দৈবাজ্ঞী সুকুমারের কোষ্ঠী বিচার করে বাড়ির সকলকে বড় রকম একটা প্রেরণা দিয়ে চলে গেলেন। — যা দেখেছি তা তো বড়ই ভাল মনে হচ্ছে। পাতকীরিষ্টি আর নেই, এবার কেতুর দশা চলছে। এই বছরের মধ্যেই ইষ্টলাভ। সুন্দরী রামা, রাজপদং, ধনসুখং। আর, আর কত বলবো।
— এই ছুঁড়ি ওখানে কি করছিস ? কৈলাসবাবু ধমকে উঠলেন। সুকুমারের পড়ার ঘরের সামনের বারান্দায় ফুলগাছের টবের কাছে বসে আছে তুলসী। হাতে কলাই-করা থালাটা।
যদু কোত্থেকে এসে একসঙ্গে হুমকি দিল। — ওঠ্ এখান থেকে হারামজাদি! কেমন ঘাপটি মেরে বসে আছে চুরির ফিকিরে।
কৈলাসডাক্তার বললেন — যাক্, গালমন্দ করিস নে। খিড়কির দোরে গিয়ে বসতে বল।
সামনে কানাইবাবুকে পেয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন — কি কানাই ? এবার আমাকে বিড়ম্বনা থেকে একটু রেহাই দেবে কি না ? সুন্দরী পাত্রী জুটলো তোমাদের ?
— আজ্ঞে না! চেষ্টার তো ত্রুটি করছি না।
— চেষ্টা করেও কিছু হবে না। তোমাদের সুন্দরের তো মাথামুণ্ডু কিছু নেই।
— কি রকম ?
— কি রকম আবার ? চুল কালো হলে সুন্দর আর চামড়া কালো হলে কুত্সিত। এই কথাটা কি মহাব্যোমে লেখা আছে, শাশ্বত কালি দিয়ে ?
একটু চুপ করে থেকে কৈলাসডাক্তার বললেন — পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি। ধন্যি বাবা কাশীরাম! একবার ভাব তো কানাই, কোনো ভদ্রলোকের যদি নাক থেকে কান পর্যন্ত ইয়া দুটো চোখ ছড়িয়ে থাকে, কী চীজ হবে সেটা!
কানাইবাবু বললেন — যা বলেছেন। কত যে বাজে সংস্কারের সাত-পাঁচ রয়েছে লোকের। তবে মানুষের রূপের একটা স্টান্ডার্ড অবশ্য আছে। অ্যানথ্রপলজিস্টরা যেমন বলেন….।
— অ্যানথ্রপলজিস্ট না চামড়াওয়ালা। কৈলাসবাবু চড়া মেজাজে বললেন — আসুক একবার আমার সঙ্গে ময়নাঘরে। দুটো লাশের ছাল ছাড়িয়ে দিচ্ছি। চিনে বলুক দেখি, কে ওদের আলপাইন নেগ্রিটো আর কে প্রোটো-অস্ট্রাল। দেখি ওদের বংশ বিদ্যের মুরোদ। মেলা বকো না আমার কাছে।
কানাইবাবু সরে পড়ার পথ দেখলেন।
— জান কানাই, আমাকে আড়ালে সবাই কালোজিভ বলে ডাকে। বর্বর আর গাছে ফলে ? একটা বাজে টাবু ছাড়বার শক্তি নেই, সভ্যতার গর্ব করে! আধুনিক হয়েছে! যত সব ফাজিলের দল!
কৈলাসডাক্তার ক্ষুব্ধ লাল চোখ দুটিকে শান্ত করে চুরুট ধরালেন।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা সত্যদাসের বাড়িতে ভাল এক পাত্রী দেখে খুশি মনে কৈলাসডাক্তার ফিরলেন। ফটকে পা দিয়েই দেখলেন, সুকুমারের পড়ার ঘরের সামনে বসে যদু আর নিতাই তুলসীর সঙ্গে হাসি-মস্করা করছে।
— এই রাস্কেল সব! কি হচ্ছে ওখানে ?
তুলসী ওর থালা হাতে নিয়ে আর দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল। যদু নিতাই আমতা আমতা করে কিছু একটা গুছিয়ে বলতে বৃথা চেষ্টা করে চুপ করে রইল। কৈলাসডাক্তার সুকুমারকে ডেকে বললেন — ঘরের দোর খোলা রাখ কেন ? সেই ভিখিরি ছুঁড়িটা কদিন থকে ঘুরঘুর করছে এদিকে। খুব নজর রাখবে, কখন কি চুরি করে সরে পড়ে, বলা যায় না।
সুকুমারের মা ডেকে কৈলাসবাবু জানালেন — সত্যদাসের মেয়ে মমতাকে দেখে এলাম। একরকম পাকা কথাই দিয়ে এসেছি। এবার সুকুমার আর তোমরা দেখে এস। আমায় আর নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিও না।
যথারীতি মমতাকে দেখে আসা হলো। মমতার রূপে অসাধারণত্ব আছে, সন্দেহ নেই। যেন এক অমাবস্যা কুমারী, ঘুটঘুটে কালো। সমস্ত অবয়বে একটা সুপেশল কাঠিন্য। মণিবদ্ধ ও কনুইয়ের মজবুত হাড় আর হাতপায়ের রোমঘন পারুষ্য পুরুষকে লজ্জা দেয়। চওড়া করোটির ওপর অতিকুঞ্চিত স্থূলতন্তু চুলের ভার, নীলগিরির চূড়ার ওপর মেঘসিতবকের দৃশ্যটা মনে পড়িয়ে দেয়। মূর্তির শিল্পীরা অবশ্য খুশি হয়ে বলবেন, এ যেন এক দৃঢ়া দ্রাবিড়া নায়িকার মূর্তি। মমতার প্রখর দৃষ্টির সামনে সুকুমারই সকুঞ্চিত হল। বরমালা-কাঙাল অবলার দৃষ্টি এ নয়; বরং এক অকুতোলজ্জা স্বয়ংবরার জিজ্ঞাসা যেন জ্বলজ্বল করছে মমতার দুই চোখে।
সত্যবাবু গুণপনার পরিচয় দিলেন — বড় পরিশ্রমী মেয়ে, কারণ স্বাস্থ্য খুব ভাল। ছাত্রীজীবনে প্রতিবছর স্পোর্টসে প্রাইজ পেয়ে এসেছে।
মেয়ে দেখে এসে সুকুমার মুখ ভার করে শুয়ে রইল। রাণু বললো — এ নিশ্চয় রাক্ষসগণ।
পিসিমাও একটু বিমর্ষ হয়ে বললেন — হ্যাঁ, সেই তো কথা। বড় হাট্টাকাট্টা চেহারা। নইলে ভাল বরপণ দিচ্ছিল, দানসামগ্রীও।
তবু কৈলাসডাক্তার তোড়জোড় করছেন। মমতারই সঙ্গে বিয়ে একরকম ঠিক। এবার একটু শক্ত হয়েছেন তিনি। দশজনের দশ কথার চক্রে আর ভূত সাজতে পারবেন না।
কিন্তু যা কখনো হয়নি, তাই হল। সুকুমারের প্রকাশ্য বিদ্রোহ। সুকুমার এবার মুখ খুলেছে। রাণুকে ডেকে নিয়ে জানিয়ে দিয়েছে — সত্যদাসের সঙ্গে গলাগলি দেখেছি বাবার! ওখানে যদি বিয়ে ঠিক হয়, তবে একটু আগেভাগে আমায় জানাবি। আমি যুদ্ধে সার্ভিস নিচ্ছি।
কথাটা শুনে পিসিমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সুকুমারের মা রান্না ছেড়ে বৈঠকখানায় গিয়ে কৈলাসবাবুর সঙ্গে একপ্রস্থ বাকযুদ্ধ সেরে এলেন। কিন্তু ফল হল না কিছুই। কৈলাসবাবু এবার অটল।
সুকুমারের মা কেঁদে ফেললেন — ঐ হদকুচ্ছিত মেয়ের সঙ্গে বিয়ে! তোমার ছেলে ঐ মেয়ের ছায়া মাড়াবে ভেবেছ ? এমন বিয়ে না দিয়ে চিমটে দিয়ে বিদেয় করে দাও না!
কৈলাসবাবুর অটলতার ব্যতিক্রম হল না কিছুই। তিনি শুধু একটা দিন স্থির করার চেষ্টায় রইলেন।
সুকুমার মারমূর্তি হয়ে রাণুকে বললো — সেই দৈবজ্ঞীটা এবার এলে আমায় খবর দিবি তো!
— কোন্ দৈবৈজ্ঞী ?
— ঐ যে বেটা সুন্দরী রামাটামা বলে গিয়েছিল। জিভ উপড়ে ফেলবো ওর।
আড়ালে দাঁড়িয়ে কৈলাসডাক্তার শুনলেন ও বার্তালাপ। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠলো তাঁর! সুকুমারের মাকে ডেকে প্রশ্ন করলেন — কি পেয়েছ ?
শঙ্কিত চোখে কৈলাসবাবুর দিকে তাকিয়ে সুকুমারের মা বললেন — কি হয়েছে ?
— ছেলের বিয়ে দিতে চাও ?
__ কেন দেব না?
— সত্পাত্রী চাও, না সুন্দরী পাত্রী চাও ?
সুকুমারের মা ভেবে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন — সুন্দরী পাত্রী।
— বেশ তবে লিখে দাও আমাকে, সুন্দরী কাকে বলে। তন্বী শ্যামা পক্কবিম্বাধর, আরও যা আছে সব লিখে দাও। আমি সেই ফর্দ মিলিয়ে পাত্রী দেখবো।
এই বিদঘুটে প্রস্তাবে সুকুমারের মা’র মেজাজও ধৈর্য হারাবার উপক্রম করলো। তবু মনের ঝাঁজ চেপে নিয়ে বললেন — তার চেয়ে ভাল, তোমায় পাত্রী দেখতে হবে না, আমরা দেখছি।
— ধন্যবাদ। খুব ভাল কথা। এবার তাহলে আমি দায়মুক্ত।
— হ্যাঁ।
কৈলাসডাক্তার এখন অনেকটা সুস্থির হয়েছেন। হাসপাতালে যান আসেন। রুগী নিয়ে, ময়নাঘরের লাশ নিয়ে দিন কেটে যায়। যেমন আগে কাটতো।
বাগানের দিকে একটা হট্টগোল। কৈলাসডাক্তার এগিয়ে গিয়ে দেখেন, যদুডোম আর নিতাই তুলসীকে ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাগানের ফটক দিয়ে বার করে দিচ্ছে।
— কি ব্যাপার নিতাই ?
— বড় পাজি এই ছুঁড়িটা হুজুর। পয়সা দেয়নি বলে দাদাবাবুর ঘরে ঢিল ছুঁড়ছিল। আর, এই দেখুন আমার হাত কামড়ে দিয়েছে।
কৈলাসডাক্তার বললেন — বড় বাড় বেড়েছে ছুঁড়ির। ভিখিরীর জাত, দয়া করলেই কুকুরের মত মাথায় চড়ে। কেবলই দেখছি মাস তিন চার থেকে শুধু এদিকেই নজর। এবার এলে পুলিশে ধরিয়ে দিবি।
তুলসী ফটকের বাইরে গিয়েও মত্তা বাতুলীর মত আরও কয়েকটা ইটপাকেল ছুঁড়ে চলে গেল। কৈলাসডাক্তার বললেন — সব সময় ফটকে তালা বন্ধ করে রাখবে।
সেদিনই সন্ধ্যেবেলা। অনেক রাতে রুগী দেখে বাড়ি ফিরতেই কৈলাসডাক্তার দেখলেন, ফটক খুলে অন্ধকারে চোরের মত পা টিপে-টিপে সরে পড়ছে তুলসী। কৈলাসবাবুকে দেখে আরও জোরে দৌড়ে পালিয়ে গেল! কৈলাসডাক্তার হাঁক দিতেই যদু ও নিতাই হাজির হল লাঠি হাতে।
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন — এ কি ? ফটক খোলা, বারান্দার আলো জ্বলছে, সুকুমারের ঘরে আলো, আমার বৈঠকখানা খোলা; তোমরা সব জেগেও রয়েছ, অথচ ছুঁড়িটা বেমালুম চুরি করে সরে পড়লো!
কৈলাসডাক্তার সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে দেখলেন। — আমার ঘরটা সব তছনছ করেছে কে ? টেবিল থেকে নতুন বেলেডোনার শিশিটাই বা গেল কোথায় ?
অনেকক্ষণ বকাবকি করে শান্ত হলেন কৈলাসডাক্তার। কিছু চুরি হয়নি বলেই মনে হল।
পরের দিন। দিনটা আজ ভাল নয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আকাশে দুর্যোগ ঘনিয়ে আছে। কানাইবাবু এসে কৈলাসডাক্তারকে জানালেন — সুন্দরী পাত্রী পাওয়া গেছে। জগৎ ঘোষের মেয়ে। সুকুমারের এবং আর সবারই পছন্দ হয়েছে। বংশে শিক্ষায় ও গুণে কোন ত্রুটি নেই।
কৈলাসডাক্তার বললেন — বুঝলাম, তোমার কল্পতরুর সন্ধান পেয়েছ, সুখবর।
— আপনাকে আজ রাত্রে আশীর্বাদ করতে যেতে হবে।
— তা, যাব।
যদুডোম এসে তখুনি খবর দিলে, তিনটে লাশ এসেছে ময়না তদন্তের জন্য। কৈলাসডাক্তার বললেন — চল রে যদু! এখনি সেরে রাখি। রাত্রে আমার নানা কাজ রয়েছে।
ময়নাঘরে এসে কৈলাসডাক্তার বললেন — বড় মেঘলা করেছে রে। পেট্রোমাক্স বাতি দুটো জ্বেলে দে।
যন্ত্রপাতিগুলো গামলায় সাজিয়ে আস্তিন গুটিয়ে নিয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন — রাত হবে নাকি রে যদু ?
— আজ্ঞে না। দুটো আগুনে পোড়া লাশ, পচে পাঁক হয়ে গেছে। ও তো জানা কেস, আমি চিরে ফেড়ে দেব। বাকি একটা শুধু……।
— নে কোনটা দিবি, দে! কৈলাসডাক্তার করাত হাতে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন।
লাশের ঢাকাটা খুলে ফেলতেই কৈলাসডাক্তার চমকে উঠলেন — অ্যাঁ, এ কে রে যদু ?
যদু ততক্ষণে আলগোছে সরে পড়ে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কৈলাসডাক্তারের প্রশ্নে ফিরে এসে বললো — হ্যাঁ হুজুর, তুলসীই, সেই ভিখিরী মেয়েটা।
কৈলাসডাক্তার বোকার মত যদুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। যদু চটপট হাত চালিয়ে তুলসীর নোংরা শাড়ীটা আর গায়ের ছেঁড়া কোটটা খুলে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। আবার বাইরে যাবার চেষ্টা করতেই কৈলাসডাক্তার বললেন — যাচ্ছিস কোথায় ? স্পিরিট দিয়ে লাশ মোছ ভাল করে। ইউক্যালিপটাসের তেলের বোতলটা দে। কিছু কর্পূর পুড়তে দে, আরও একটা বাতি জ্বাল।
— ওয়ান মোর আনফর্চুনেট!
কথাটার মধ্যে যেন একটু বেদনার আভাস ছিল। তুলসীর লাশে হাত দিলেন কৈলাসডাক্তার।
করাতের দু’পোঁচে খুলিটা দুভাগ করা হল। কৈলাসডাক্তারের হাতের ছুরি ফোঁস ফোঁস করে সনিশ্বাসে নেচে কেটে চললো লাশের উপর। গলাটা চিরে দেওয়া হল। সাঁড়াশি দিয়ে পটপট করে পাঁজরাগুলো উল্টে দিলেন কৈলাসডাক্তার।
যেন ঘুমে ঢলে রয়েছে তুলসীর চোখের পাতা। চিমটে দিয়ে ফাঁক করে কৈলাসডাক্তার দেখলেন, নিশ্চল দু কণীনিকা যেন নিদারুণ কোন অভিমানে নিষ্প্রভ হয়ে আছে। শুকিয়ে কুঁচিয়ে গেছে চোখের শ্বেতপটল। সুজলা অশ্রুশীলা নাড়ীগুলো অতিস্রাবে বিষণ্ণ।
— ইস, মরার সময় মেয়েটা কেঁদেছে খুব। কৈলাসডাক্তার বললেন।
যদু বললো — হ্যাঁ হুজুর, কাঁদবেই তো। সুইসাইড কিনা! করে ফেলে তো ঝোঁকের মাথায়। তারপর খাবি খায়, কাঁদে আর মরে!
— গলা টিপে মারেনি তো কেউ ? কৈলাসডাক্তার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। কৈ কোন আঘাতের চিহ্ন নেই! গুচ্ছ গুচ্ছ অম্লান স্বররজ্জু, শ্বাসবহা নালিটাও তেমনি প্রফুল্ল। অজস্র লালায় পিচ্ছিল সুপুষ্ট গ্রসনিকা।
— এত লালা! মরবার আগে মেয়েটা খেয়েছে খুব পেট ভরে।
— হ্যাঁ হুজুর, ভিখিরি তো খেয়েই মরে।
দেহতত্ত্বের পাকা জহুরী কৈলাসডাক্তার। তাঁকে অবাক করেছে আজ কুত্সিতা এই তুলসী। কত রূপসীর কুলবধূর, কত রূপাজীবা নটীর লাশ পার হয়েছে তাঁর হাত দিয়ে। তিনি দেখেছেন তাদের অন্তরঙ্গ রূপ, ফিকে ফ্যাকাশে ঘেয়ো। তুলসী হার মানিয়েছে সকলকে। অদ্ভূত!
বাতিটা কাছে এগিয়ে নিয়ে কৈলাসডাক্তার তাকিয়ে রইলেন — প্রবাল পুষ্পের মালঞ্চের মত বরাঙ্গের এই প্রকট রূপ, অছদ্ম মানুষের রূপ। এই নবনীতপিণ্ড মস্তিষ্ক, জোড়া শতদলের মত উত্ফুল্ল হৃত্কোষের অলিন্দ আর নিলয়। রেশমী ঝালরের মত শত শত মোলায়েম ঝিল্লী। আনাচে কানাচে যেন রহস্যে ডুব দিয়ে আছে সুসূক্ষ্ম কৈশিক জাল।
কৈলাসডাক্তার তেমনই বিমুগ্ধ হয়ে দেখলেন — থরে বিথরে সাজানো সারি সারি রক্তিম পর্শুকা। বরফের কুচির মত অল্প অল্প মেদের ছিটে। মজ্জাস্থি ঘিরে নেমে গেছে প্রাণদা নীলার প্রবাহিকা।
কৈলাসডাক্তার বাতিটাকে আরো কাছে এগিয়ে নিয়ে আর দু’চোখ অপলক করে দেখতে থাকেন — খণ্ডস্ফটিকের মত পীতাভ ছোট বড় কত গ্রন্থির বীথিকা। প্রশান্ত মুকুটধমনী! সন্ধিতে সন্ধিতে সুপ্রচুর লসিকার বুদ্বুদ। গ্রন্থিক্ষীরে নিষিক্ত অতি অভিরাম এই অংশুপেশীর স্তবক আর তরুণাস্থির সজ্জা ঝাঁপিখোলা রত্মমালার মত আলোয় ঝলমল করে উঠলো।
আবিষ্ট হয়ে গেছেন কৈলাসডাক্তার। কুত্সিতা তুলসীর এই রূপের পরিচয় কে রাখে ? তবুও, এ তিমিরদৃষ্টি হয়তো ঘুচে যাবে একদিন। আগামী কালের কোন প্রেমিক বুঝবে এ রূপের মর্যাদা। নতুন অনুরাগের তাজমহল হয়তো গড়ে উঠবে সেদিন! যাক্…..।
কৈলাসডাক্তার আবার হাতের কাজে মন দিলেন। যদু বললো — এ সবে কোন জখম নেই। হুজুর। পেট দেখুন।
ছুরির ফলার এক আঘাতে দু’ভাগ করা হল পাকস্থলী। এইবার কৈলাসডাক্তার দেখলেন, কোথায় মৃত্যুর কামড়। ক্লোমরসে মাখা একটা অজীর্ণ পিণ্ড — সন্দেহ পাউরুটি আর…..বেলেডোনা।
— মার্ডার!
হাতের ছুরি খসে পড়লো মেঝের ওপর। সে শব্দে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কৈলাসডাক্তার।
উত্তেজনায় বুড়ো কৈলাসডাক্তারের ঘাড়ের রগ ফুলে উঠলো দপ দপ করে। পোখরাজের দানার মত বড় বড় ঘামের ফোঁটা কপাল থেকে ঝরে পড়লো মেঝের ওপর।
হঠাৎ ছফ করে টেবিলের কাছে আবার এগিয়ে এলেন কৈলাসডাক্তার। ছোঁ মেরে কাঁচিটা তুলে নিয়ে তুলসীর তলপেটের দুটো বন্ধনী ছেদ করলেন। নিকেলের চিমটের সুচিক্কণ বাহুপুটে চেপে নিয়ে, স্নেহাক্ত আগ্রহে ধীরে ধীরে টেনে তুলে ধরলেন, পরিশুল্কে ঢাকা সুডৌল সুকোমল একটি পেটিকা। মাতৃত্বের রসে উর্বর, মানব জাতির মাংসল ধরিত্রী। সর্পিল নাড়ীর আলিঙ্গনে ক্লিষ্ট ও কুঞ্চিত, বিষিয়ে নীল হয়ে আছে এক শিশু আশা।
আবেগে কৈলাসডাক্তারের ঠোঁটটা কাঁপছিল থরথর করে। যদু এসে ডাকলো — হুজুর।
ডেকে সাড়া না পেয়ে যদু বাইরে গিয়ে নিতাই সহিসের পাশে বসলো।
নিতাই জিজ্ঞেস করে — এত দেরী কেন রে যদু ?
— শালা বুড়ো নাতির মুখ দেখছে।
বিহারের হাজারিবাগে ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আদি নিবাস বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে। হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিশিষ্ট দার্শনিক ও গবেষক মহেশ ঘোষের লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতেন। প্রত্নতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, এমনকি সামরিক বিদ্যায়ও তার যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। গত শতকের চল্লিশ দশকের প্রায় প্রারম্ভিক কাল ঘেঁষা বাংলা সাহিত্যের কাল পর্বের জীবন শিল্পী সুবোধ ঘোষ। আদি নিবাস বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে। তার লেখালেখির কালপর্ব ১৯৪০ থেকে ১৯৮০। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে একটু বেশি বয়সে যোগদান করেও নিজস্ব মেধা মনন চিন্তা চেতনা আর লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে সুবোধ ঘোষ তার অসাধারণ রচনা সম্ভাবের মাধ্যমে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করে হাজারিবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজে ভর্তি হয়েও অভাব অনটনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় তাকে। বিচিত্র জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলো তার জীবন। হেন কাজ নেই তাকে করতে হয়নি সংসারের ঘানি টানার প্রয়োজনে। পড়াশোনা ছেড়ে কলেরা মহামারি আকার নিলে বস্তিতে টিকা দেবার কাজ নেন। কর্মজীবন শুরু করেন বিহারের আদিবাসী অঞ্চলে বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে। এরপর সার্কাসের ক্লাউন, বোম্বাই পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণীর কাজ, চায়ের ব্যবসা, বেকারির ব্যবসা, মালগুদামের স্টোর কিপার ইত্যাদি কাজে তিনি তার প্রথম জীবনের যতটা অংশ ব্যয় করেন। বহু পথ ঘুরে ত্রিশ দশকের শেষে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে সহকারী। ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট উত্তর দাঙ্গা বিধ্বস্ত নোয়াখালী থেকে তিনি গান্ধীজির সহচর থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন দাঙ্গা এবং দাঙ্গাউত্তর কালপর্বে সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতাকে। অনামী সঙ্ঘ (বা চক্র) নামে তরুণ সাহিত্যিকদের বৈঠকে বন্ধুদের অনুরোধে সুবোধ ঘোষ পর পর দুটি গল্প অযান্ত্রিক, এবং ফসিল লেখেন যা বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। সুবোধ ঘোষের প্রথম গল্প অযান্ত্রিক, এরপর ফসিল। তার আর একটি বিখ্যাত গল্প ‘থির বিজুরি’। শুধুমাত্র গল্পকার হিসাবেই সুবোধ ঘোষ অণ্বেষু শিল্পী ছিলেন না। সুবোধ ঘোষ উপন্যাস রচনাও ঋদ্ধ তার যথার্থ প্রমাণ তিলাঞ্জলি (১৯৪৪) সুবোধ ঘোষের ঔপন্যাসিক হিসাবে প্রথম প্রভিভার স্বাক্ষর ’তিলাঞ্জলি’। এ উপন্যাসে তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শকে উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘের মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে। মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত এ উপন্যাসে তৎকালীন কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ ’জাগৃতি সংঘ’র জাতীয়তা বিরোধী চরিত্রের মতবিরোধের রূপরেখা অঙ্কনে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি এই উপন্যাসে।১০ মার্চ, ১৯৮০ সালে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।