রূপমের গোয়েন্দাগিরি
রূপম চৌবাড়ি পয়রাডাঙ্গা গ্রামে থাকে। বয়স ১৭-১৯ এর মধ্যে। এস এস সি পাশের পর তার আর পড়ালেখা হয়নি। এ নিয়ে মনে দুঃখ থাকলেও মেনে নিয়েছে কারণ বাবার আয় খুব সীমিত।
২০১৮ সাল। সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। সকালে বাড়ির দাওয়ায় বসে সবাই গল্পগুজব করছিলো আর সাথে চা, মুড়ি খাচ্ছিলো। এ সময় রূপমের বাবা দীলিপ বাবু বললেন, আজ আমার শরীরটা খুব ম্যাজম্যাজ করছে। এ কথা শুনে বাবাকে আজকের সে দিনটা বিশ্রাম নিতে বলেছিলো রূপম। দরিদ্র কৃষক দীলিপ সরকার অন্যের জমি চাষ করে খায়। বয়স ৫৮-৬০ এর মধ্যে। দীলিপ বাবু তখন রূপমকে বলেন, ‘না রে বাবা, কাজে যেতে হবে। আজ যে বৃহস্পতিবার! হাট বার তাই কাজে না গেলে হাটে যাবো টাকা পাবো কোথায়? তিনি জোর করে জমিতে কাজ করতে গেলেন। খানিকক্ষন পর রূপমের বাবার সাথে কাজ করে আক্কাস মিয়া চিৎকার করতে করতে এসে বলে, “দীলিপ দাদা কাজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তোমরা তাড়াতাড়ি চল।” মাকে সাথে নিয়ে রূপম সেখানে গিয়ে দেখে বাবা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ততক্ষণে আশপাশের আরও লোক জমে যায়। সকলে মিলে দীলিপ বাবুকে নাগেশ্বরী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। তাকে ভর্তি করে নেওয়ার পর ডাক্তার দেখলেন। বললেন, “ভয়ের কিছু নেই। ওনার পরিশ্রম যে পরিমান তার তুলনায় বিশ্রাম ও খাবার কম হওয়ার কারণে মনে হচ্ছে এমনটা হয়েছে। আপাতত মাস দেড় দুয়েক বিশ্রাম আর খাবারটা ঠিক মত পড়লেই আশাকরি উনি ভালো হয়ে উঠবেন।” তিনদিন হাসপাতালে থাকার পর রূপম বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। এখন কর্মক্ষম লোক বলতে বাড়িতে একজনই সে রূপম। কিন্তু রূপমের মন চায় না জমিতে কাজ করতে! তার মন চায় অজানাকে জানতে। রূপম মুসা ইব্রাহীমের খুব ভক্ত। তার মন চায় এভারেস্ট জয় করতে। আবার কখনও তার মন চায় জীম করবেটের মত বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে! বিচিত্র প্রাণী সম্পর্কে জানতে। আবার কখনও তার মনে হয় ফেলুদার মত গোয়েন্দা হই। রূপমের প্রচন্ড নেশা হলো বই পড়া। তাদের গ্রামের ধনসম্পদশালী পরিবার হলো চৌবাড়ির নিয়োগী পরিবার। সাত পুরুষের ঐতিহ্য আর সম্পদ নিয়ে বসবাসকরা এই বাড়ির নামেই গ্রামটির নাম হয়ে গেছে চৌবাড়ি পয়রাডাঙ্গা। তাদের বাড়ির একটি পাঠাগার আছে যা তাদের বাবার আমলে ছোট পরিসরে থাকলেও বর্তমানে নিয়োগীরা পাঁচ ভাই মিলে পাঠাগারটিকে অনেক সমৃদ্ধ করেছেন। নিয়োগীদের জমিতেই কাজ করে রূপমের বাবা। দীলিপবাবু খুব বিশ্বাসী লোক হওয়ায় এবং তার ছেলের বই পড়ার খুব আগ্রহ শুনে নিয়োগীদের বড় ভাই সুকান্তি নিয়োগী রূপমকে সেই পাঠাগারে নিয়ে যান। আর সেখানেই তার পরিচয় হয় মুসা ইব্রাহীম, জীম করবেট ও সত্যজিৎ রায়ের লেখা বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার সাথে।
দুই সপ্তাহ পর।
শুক্রবার সকাল।
রূপম আক্কাস মিয়ার কাছে যায়। বলে, “চাচা, বাবা সুস্থ্য না হওয়া পর্যন্ত আপনি আর একজন লোক নিন। আর আপনাদের সাথে আমিও কাজ করি। তাহলে আমি কাজও কিছুটা শিখে যাব। বাবার আর কষ্ট থাকবে না।” আক্কাস মিয়া খুশি হন। বলেন, ‘ঠিক আছে।’
এই করে কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পর রূপমের বাবা আস্তে আস্তে সুস্থ্য হতে থাকেন। তিনি খুশি হন কারণ রূপম কাজ করছে।
আবার বৃহস্পতিবার সকাল।
আক্কাস মিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলেন,‘চৌবাড়িতে কাল রাতে বড় চুরি হয়েছে। তাদের জমির দলিল-পত্র ও টাকা পয়সা চুরি হয়ে গেছে। হঠাৎ রূপমের মনে হয়, এটাই হয়ত আমার গোয়েন্দাগিরি দেখানোর একটা সুযোগ হতে পারে। বেলা আর একটু বাড়লে সে বাবার সাথে চৌবাড়ি যায়। গিয়ে দেখে সবাই বিমর্ষ মুখে বসে আছে।
সেখানে আরও লোকজন জমা হয়েছে । সবার কথা থেকে সে বুঝতে পারে যে, চোর আসলে পরিচিত কেউ , যে বাড়ির প্রায় সব কিছুই জানে। বাড়ির গোয়ালা রামহরি। মানুষ ভালো হলেও তার প্রচন্ড সৌখিনতা। আর একারণেই গ্রামের লোকের কাছে অজ¯্র দেনা হয়েছে তার। রূপমের মনে হয় চুরি করার সম্ভাবনা রামহরিরই সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাড়ির পথে রওনা হয় রূপম। ভাবতে থাকে বাড়ি গিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে ভালো করে ভাবতে হবে।
রুপমের বন্ধু মিলন। সে থাকে রামহরির বাড়ির পাশে। একদিন রুপম সন্ধ্যায় নদীর ধারের আড্ডায় মিলনকে বলে “চৌবাড়ির চুরির পেছনে রামহরিরই হাত আছে। কিন্তু সে নিজে চুরি করলে সে আর এ তল্লাটে থাকত না।” মিলন চলে যাবার পর অনেকক্ষন নদীর ধারে বসে থাকে রুপম। তার মনে হয় মিলনকে এই কথাটা বলা ঠিক হলো না। সে মিলনের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। হঠাৎ অন্ধকারে সামনে থেকে দুজন লোক এলো। দুজনেরই হাতে রড। অন্ধকার হলেও চিনতে ভুল হয় না রূপমের। একজন রামহরি আর অন্যজন তার ভাই কার্তিক। রুপম বুঝল রামহরি মিলনের কাছ থেকেই রূপমের সন্দেহের খবরটা পেয়েছে। এবং বুঝতে পেরেছে রুপম তাদের জন্য হুমকির ব্যাপার। তাই এখন তাদের লক্ষ্য হলো রুপমকে কাৎ করে গ্রাম থেকে পালানো।
প্রথমে রামহরি রড দিয়ে রূপমকে পেটাতে এলে রূপম পা দিয়ে পেঁচিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে দিল আর বেধড়ক মার মারল। কিন্তু সে এর মাঝে কার্তিকের কথা ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎ পিছনেঘুরে সে দেখে কার্তিক তার মাথায় রড দিয়ে মারতে আসছে। কিন্তু মারার আগেই ধরাশায়ী হয়ে গেল কার্তিক। অজ্ঞান হয়ে কার্তিক রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর রূপম দেখল তার বাবা একটা ডান্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। রূপম অবাক হয়ে বলল ‘বাবা’! দীলিপবাবু বললেন,‘আমি সাথে দড়ি এনেছি। আয় তাড়াতাড়ি এগুলোকে বেঁধে চৌবাড়ি নিয়ে যাই।’ তারপর দুই শয়তানকে বেঁধে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে চৌবাড়ি নিয়ে চলল। পথে এক-দুইজন করে গ্রামের বেশকিছু লোক জুটে গেল তাদের সাথে।
রূপম প্রথমেই সুকান্তি নিয়োগীর পায়ের কাছে ফেলল রামহরিকে তারপর কার্তিককে। এত তাড়াতাড়ি চোর ধরা এবং জিনিসপত্র সব ফেরত পাওয়া আর সাথে রূপমের বুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগল সবাই। খুশি হয়ে সুকান্তিবাবু রূপম ও তার বাবাকে দুই বিঘা জমি আর ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দিলেন। তাই দিয়ে রুপমদের ভালোভাবে দিন চলতে লাগল। অবস্থা ঘোরায় আবার মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া শুরু করলো রূপম। আরো ভালো গোয়েন্দা হতে হবে তাকে।
জন্ম ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে রংপুরে। লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ রংপুরের দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বইপড়া, তবলা বাজানো, কবিতা আবৃত্তি, ভিডিও এডিটিং ও ভ্রমন শখ। প্রিয় চরিত্র সত্যজিৎ রায়ের প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা ও সত্যজিৎ রায়ের আরেক চরিত্র প্রফেসর শঙ্কু। প্রিয় মানুষ বাবা ও মা। লক্ষ অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। প্রকাশিত বই আইডিয়া প্রকাশন থেকে একুশে বইমেলা ২০১৯-এ প্রকাশিত পাহাড়ে জঙ্গলে।