| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

রাজকন্যা ও দস্যুরাজ(পর্ব ২)

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

চিঠিমালা -৪

 

প্রিয়তমা রাজকন্যা,

এখানে আসা অবধি, শেষ কয়েকটা দিনে যত আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছে  তার কতটা লিখে বোঝাতে পারবো জানি না। আর আমি নিশ্চিত আশ্চর্য অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি শেষ হয় নি এখনো। আমি যে ইতিমধ্যেই রাজসভার আস্থাভজন কর্মীদের একজন হয়ে উঠেছি এবং মহামান্য ব্যক্তিদের সাথে নিত্য ওঠা বসা করছি তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য। সেদিন মধ্যরাতে রাজপ্রাসাদের এক প্রহরী মারফৎ সংবাদ এলো আমায় রাত্রি তৃতীয় প্রহরান্তে  রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হতে হবে। আমি যারপরনাই বিস্মিত হলেও বুঝতে পারছিলাম যে ব্যাপারটা বেশ গুরুতর এবং গোপন কিছু। প্রহরীকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ বৃথা, সে আদেশপালক মাত্র। “কালকূট” এই সঙ্কেত শব্দটি জানিয়ে সে বিদায় নিলো। রাজপ্রাসাদ কর্মী আবাসন থেকে ক্রোশ খানেক পথ এবং শেষ অর্ধক্রোশ পাহাড়ের চড়াই। জন্মাবধি সমতলে বসবাস করা বঙ্গসন্তানের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। কাল বিলম্ব না করে বেরোবার প্রস্তুতি নিলাম। কার্ত্তিক মাসের পাহাড়ি হিমেল পরশ বাতাসে। সাধারণ পোশাকের উপর একটি বৃহৎ পশমী শালে আবৃত হলাম এবং তার আড়ালে আত্মরক্ষার জন্য রাখলাম আপনার উপহার দেওয়া সেই খঞ্জরটি। মনে আছে রাজকন্যা, এই ক্ষুদ্রায়তন অথচ সুন্দর খঞ্জরটি  এক কাবুলিওয়ালা পসারীর কাছে দেখে কত ভালো লেগেছিলো আমার! আপনি আমার চোখের মুগ্ধতা দেখতে পেয়ে সেটা সেই অন্যায্য মূল্যেই ক্রয় করে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন “দস্যুরাজ এর পছন্দের যা কিছু তা দস্যুরাজের কাছেই থাকবে।” কথা রাখেননি রাজকন্যা আপনি। আমার পছন্দের মানুষ আজ আমার কাছে নেই। আমি জানি এই কথা রাখা হয়তো আপনার পক্ষে সম্ভবও ছিল না আর আমিও চাইনি আপনি এই কথাটা রাখতে গিয়ে নিজের জীবনে অন্ধকার ডেকে আনুন। কিছু কিছু অঙ্গীকার ভঙ্গ করাই শ্রেয়। মঙ্গল হয় ওতে। 

অন্ধকার নির্জন রাজপথ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার কেবল মনে হচ্ছিল আমি একা নই। আমার সঙ্গে, আমার পশ্চাতে  এক বা একাধিক চামড়ার পাদুকা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। দাঁড়িয়ে পড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেই শব্দও থেমে যাচ্ছিল। অন্ধকারে দূরের কিছু ঠাওর হচ্ছিল না। মনকে আশ্বাস দিলাম যারাই থাকুন তারা নিশ্চয়ই আমার নিরাপদে পথ অতিক্রমের জন্যই নিযুক্ত হয়েছেন। আমার একমাত্র সম্পদ আপনি রাজকন্যা। যাকে আমি শতাধিক ক্রোশ দূরে রেখে এসেছি। এ ছাড়া আমার কাছে কোনো ধন-সম্পদ নেই যে তস্করের নজরে চলে আসবো। সিংহ দুয়ার এর কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমার পিছনে এযাবৎ অদৃশ্য সহযাত্রী প্রহরীদ্বয় প্রকট হলেন। আর সম্মুখে প্রকট হলেন আরও দু’জন দ্বার রক্ষী। সংকেত শব্দ জানতে চাওয়ায়, উত্তেজনায় তিনবারে ঠিক বলতে পেরেছিলাম। সঙ্কেত শব্দে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ শুরু হল। তার আগে আমার দেহ তল্লাশি করে খঞ্জরটি হস্তগত করলো রক্ষীরা। আপনার উপহার দেওয়া যেকোনো বস্তুই আমার কাছে দূর্মূল্যের। তারজন্য আমি রাজ আদেশও অমান্য করতে রাজি। রক্ষীদের বোঝালাম  যে বস্তুটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ,  এটি আমি হাতছাড়া করতে পারবো না।  তার জন্য যেকোনো শাস্তির জন্য আমি প্রস্তুত। নিজেদের মধ্যে কিঞ্চিৎ আলোচনার পর আমায় বলা হল যে ফেরার সময় খঞ্জরটি আমায় ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে। আমার সঙ্গে যে রক্ষী প্রাসাদে প্রবেশ করবেন এবং আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবেন তার কাছেই থাকবে খঞ্জরটি। অভয় পেয়ে প্রবেশ করতে রাজি হলাম।  সিংহ দুয়ার দিয়ে নয়, একটা গুপ্তদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে একটি মধ্যমাকার কক্ষে আমায় উপস্থিত করা হল। যেখানে ইতিপূর্বেই আরো তিনজন উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে একজন আমার পরিচিত। কোষাধক্ষ্য উমাপতি সিংহরায় মহাশয়। দ্বিতীয় ব্যক্তি পৌঢ় এবং দীর্ঘকায়। কঠিন চোয়াল, শ্বেতশুভ্র শশ্রু ও কেশরাশি। ইনি সুন্দরগড়ের মহামন্ত্রী রঘুনাথ সরস্বতী। আর তৃতীয় ব্যক্তি জ্যেষ্ঠ রাজকুমার প্রতাপাদিত্য। কৈশোর পাড় হয়ে সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা,  সৌম্য দর্শন রাজকুমারটি বোধহয় সদ্য রাজ কার্জের দেখাশোনা শুরু করেছেন।  উজ্জ্বলবর্ণ মুখ মণ্ডলটি মৃত প্রদীপের ক্ষীণ আলোতেও উদ্ভাসিত হয়েছে। সকলেরই ভ্রুকুঞ্চিত গম্ভীর মুখ বলে দিচ্ছে বিষয়টি বেশ গুরুতর। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর মহামন্ত্রী সমস্যা বিশদে জানালেন। ইংরেজরা বার্ষিক অনুদান এর দাবী কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। শুধু তাই নয় রাজকোষ এর আয়ব্যয় এর হিসেব ও তলব করেছে। বর্ধিত অনুদান দিতে অপারগ হলে আক্রমনের জন্য প্রস্তুত থাকার হুমকিও দিয়েছে। রাজা রাজ্যের সম্পদ রাজ্যবাসীর কল্যানেই ব্যয় করবেন এবং ইংরেজদের অন্যায্য দাবী কখনোই মেনে নেবেন না তাই কিছু কৌশল অবলম্বন করা হবে। তার একটা হল বিপুল পরিমান ধনরাশি রাজকোষ থেকে কোনো এক গুপ্ত স্থানে স্থানান্তরিত করা। এবং এই কাজ এর তদারকির ভার আমার ওপর দেওয়া হচ্ছে। খুব বিলম্ব করা যাবে না এই কর্মকাণ্ডে, কারণ ইংরেজদের একটি দল কোষাগার পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে আকস্মিক হানা দেবে সুন্দরগড়ে এমনই খবর এনেছে চরেরা। রাজা এখনই তার নির্ঝঞ্ঝাট রাজ্যে ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ চান না তাই নানা রকম কৌশল অবলম্বন করা হবে। সব কাজই অত্যন্ত গোপনে সম্পন্ন করতে হবে,  কারণ ব্রিটিশ চরে ছেয়ে আছে রাজ্য। আমার মত একজন নবাগত কর্মীর উপরেই এই বিশাল কর্মযজ্ঞের দ্বায়িত্ব কেন দেওয়া হল করজোড়ে বিনীত ভাবে মহামন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম। আমি তো ব্রিটিশ চরদের একজনও হতে পারি। মহামন্ত্রী স্মিত হেসে বললেন আমার কর্মে নিযুক্তির পূর্বেই আমার নাড়ি নক্ষত্রের সব খবর সুন্দরগড়ে চলে এসেছে। সুতরাং সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় রাজসভায় নেই। আমার চয়ন এর পিছনে আরেকটি বিশেষ কারণ উমাপতি মহাশয়। আমার কর্মনিপুণতা, সততা ও ন্যায় পরাণয়তার প্রশস্তি রাজসভায় চর্চিত হয়েছে রীতিমত। 

এর পরের কয়েকটি দিন যে কী রকম কর্মব্যস্ততায় কেটেছে আপনাকে কীভাবে বোঝাবো রাজকন্যা! রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সঙ্গে নিত্য ওঠা বসা করেছে আপনার দস্যুরাজ। এরকমও শুনতে পেয়েছি স্বয়ং রাজা খোঁজ খবর নিয়েছেন আমার কাজের। অথচ আমি সর্বক্ষণ এই চিন্তায় মগ্ন থেকেছি যে, আমার রাজকন্যা তার দস্যুরাজকে এরকম গুরুত্বপূর্ণ কাজে লিপ্ত দেখলে কত আনন্দই না পেতেন। আমি কল্পনা করেছি আপনি কোষাগারের একটি কোণে দাঁড়িয়ে গর্ব ভরা চোখে আমার কাজ দেখছেন। আবার অনেক্ষণ আপনার দিকে নজর নাদিলে অভিমানী হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আপনার সঙ্গ ও সাহচার্য ছাড়া আমার কাছে সব কাজই যে অকাজ, তা আপনি জানেন। আপনাকে মনে পড়েছে যখনই, এই রাজকার্যও তুচ্ছ অকাজ মনে হয়েছে। ধনরাশি স্থানান্তর এর প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। দিন নির্দিষ্টও হয়ে গেছে স্থানান্তরের। আজ থেকে তিন দিন পর অমাবস্যা। সেই দিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন রাজ জ্যোতিষী। একটা অজানা উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনায় দিন কাটছে এই ক’দিন। উদ্দেশ্য সফল হবে তো সুন্দরগড় রাজ্যের? নির্বিঘ্নে দ্বায়িত্ব পালন করতে পারবে তো আপনার দস্যুরাজ?  মৃত্যুভয় আমার নেই। কিন্তু যদি নেহাতই কোনো বিপদ ঘটে তাহলে আপনার দস্যুরাজ আপনাকে আরেকবার চোখের দেখা না দেখার জন্য অত্যন্ত বেদনা ভোগ করবে। আজ আসি রাজকন্যা। প্রলম্বিত সময় ‘অকাজে’ নিমজ্জিত থাকার ফলে রাত্রি প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই  ক্লান্তির দাপট শুরু হয়ে যায় শরীরে। আমার এবং সুন্দরগড়ের সাফল্য প্রার্থনা করবেন।আপনার সাত জন্মের শত্রু 

“আপনার দস্যুরাজ”

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

 

চিঠিমালা -৫

দস্যুরাজ,

আজ দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়েছে, আপনি নেই,কোথায় আছেন তাও জানি না। এখানে সব এক রকম আছে জানেন! অন্নদা মাসির দুবেলা উঠোনের আনাচ কানাচ থেকে পাপ ধুয়ে মুছে ফেলা আছে, ভট্টাচার্য মশাইয়ের জলদগম্ভীর সূর্য প্রণাম আছে, চক্রবর্তী কাকুর ভাইপো গঙ্গার ওপর হম্বিতম্বি আছে।সূর্যতপার আহির ভৈরবের চলাচল আছে বাতাসে, বাড়ির হেঁসেলের সুঘ্রাণ আছে, সুরবালা দাসীর বাড়ি বয়ে এসে ‘রাই জাগো রাই জাগো’ আছে, দিঘির ছায়ার সর্বক্ষণ আমার ঘরের বাতাসে ওড়াউড়ি আছে, সব নিজের নিজের জায়গায় ঠিক আগের মতই আছে। আমার পৃথিবীতে কী যেন একটা উথাল-পাতাল ঘটে গেছে। চরাচর থমকে দাঁড়িয়েছে আমার। আমার আশেপাশে সবাই ব্যস্তত্রস্ত, হন্তদন্ত দিন শুরু করে, শেষ হয়, আর এই চলন্ত চরাচরের মাঝে একা স্থির দাঁড়িয়ে আছি চলৎশক্তিরহিত।

আপনার অজানা নয় দস্যুরাজ, আশৈশব সারদা বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী আমি। এমনকি বাড়িতে ভট্টাচার্য মশাইয়ের কাছে যখন সংস্কৃত পড়তে বসে সবাই তটস্থ এই আমি আপনার রাজকন্যা সবসময়ই সাবলীল থেকেছি। সেই আমি একদিন ভর্ৎসনা শুনলাম ভট্টাচার্য মশাইয়ের কাছে।অথচ কাঁধ অব্দি লম্বা শ্বেত কেশসম্ভারের মাঝে ভট্টাচার্য মশাইয়ের মুখটা বিষাদময় হয়ে গেছিল তারপরেই।

“ইয়া কুন্দেন্দু তুষারহার ধবলা

ইয়া শুভ্র বস্ত্রাবৃতা

ইয়া বীণাবরদণ্ডমন্ডিতকরা

ইয়া শ্বেতপদ্মাসনা…”

সরস্বতী বন্দনার সময় আমি একটিবারও সেদিন দুটি ঠোঁট এক করতে পারিনি। স্বর ফোটেনি কণ্ঠে। অঝোরে বৃষ্টিপাত হয়েছে মনের কোণে তারই বহিঃপ্রকাশে দুই কপোল ভিজেছে মাত্র। ভট্টাচার্য মশাইয়ের বিভিন্ন কটূক্তির পরেও সম্বিত আসেনি আমার। যতক্ষণ না পাশে বসা গঙ্গা হাত ধরে ডেকেছে। খুব বিরক্ত লাগলে আমার চোখে তা প্রকাশ পায়। সেদিকে তাকিয়ে গঙ্গা আমার হাত ছেড়ে দিল। গঙ্গা আমার সমবয়সী। একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠতেই পারতো! আপাত ভদ্র এবং অত্যন্ত শান্ত অথচ সব সময় বিষাদাচ্ছন্ন ছেলেটিকে আমার ভালোই লাগে। একথা শুনে আপনার সে কী আস্ফালন মনে আছে দস্যুরাজ? আপনার চোখে সেই প্রথম ইর্ষার ছায়া দেখেছিলাম। আমার সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিল, সে যাই হোক- বর্তমান পরিস্থিতিতে রাগ হল এটা ভেবে ওর এত সাহস হয় কী করে, যে আমার হাত ধরে! এই হাত ছোঁয়ার অধিকার যে একজনেরই। অন্তর্দাহ, ক্রোধ সব মিলিয়ে সময় কতটা অতিবাহিত হয়েছিল জানি না হঠাৎ “বিম্বদাদা কোথায় গেলেন আপনি জানেন না?” প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম ফের গঙ্গা, সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোনদিন সেভাবে কথা হয়নি ছেলেটির সঙ্গে। আমিই বলিনি। আজ যখন আপনার খোঁজে সামনে এসে প্রশ্ন করলো প্রথমেই যেটা মাথায় এলো তা আপনার নাম।প্রতিবিম্ব। এ বাড়ির ছোটদের পড়াবার সৌজন্যে বাড়ির ছোট বড় সকলের জন্যই আপনি ছিলেন মাস্টারমশাই। তবে এই ছেলেটি কেন অন্য নামে ডাকবে! এরকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখলাম ‘বিদ্যাকুটির’ ফাঁকা। দেখুন দস্যুরাজ, আপনি কেমন জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন। এই বিদ্যাকুটির নামটিও যে আপনারই দেওয়া। সেই সারদা মায়ের ঘাটে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন আমার বিদ্যাকুটিরে অনুশাসনের আধিক্য নয়, থাকবে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো শাণিত মস্তিষ্ক সকলের। প্রশ্ন করার স্বাধীনতা থাকবে। কত কিছু যে শিখেছি আপনার থেকে দস্যুরাজ! “বিম্বদাদা কোথায় গেছেন, আপনি নিশ্চিত জানেন?” আবার সামনে গঙ্গা এসে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যাকুটির ফাঁকা, শুধু আমি গভীর অন্যমনস্ক থাকায় বুঝতে পারিনি কখন ছেলেমেয়েরা সব বেড়িয়ে গেছে। আমি ভালো করে তাকালাম গঙ্গার দিকে শীর্ণকায়, লম্বা, কোকড়ানো চুল, ফর্সা, ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফের রেখা, চোখে অনন্ত প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি মাথা নেড়ে নঞর্থক উত্তর দিতেই, আবার ওর চোখে নিঃশব্দ প্রশ্ন ঝুলে রইলো, যার অর্থ দাঁড়ায় “তাহলে?” এবং এই অনন্ত  ‘তাহলে’র উত্তর আমারও জানা নেই ভেবে স্তব্ধবাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। গঙ্গাকে আর তেমন খারাপ লাগছে না তো! আসলে ও যে ততক্ষণে গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিয়েছে গায়ে। আপনার নামের গঙ্গাজল। যখন কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই একজন পারিবারিক বন্ধু বা একজন অনাত্মীয় মাস্টারের থাকা বা চলে যাওয়া নিয়ে, সেই সময় কেউ তাঁর খোঁজ করছে পরমাত্মীয়ের মত চিন্তিত চোখে, বুকের ভেতরে অকাল বোধনের তিরতিরে আনন্দ হতেই আমি ওর হাত চেপে ধরে বললাম “তুমি জানো তিনি কোথায়?” ঘটনার আকস্মিকতায় গঙ্গা একটু যেন হকচকিয়ে গেল, আপনার রাজকন্যার অহঙ্কারের আখ্যান যে সমস্ত উত্তর কলকাতায় ছড়ানো।যে সামান্য কুশল প্রশ্ন করলে উল্টোদিকের মানুষ ধন্য হয়ে যায়। সে তাঁর হাতই চেপে ধরেনি শুধু, ‘তুমি’ সম্বোধনে করে আসন পেতে দিয়েছে বন্ধুত্বের! এই অকল্পনীয় ঘটনায় গঙ্গা যেন অনেকটা সাবলীল হয়ে প্রশ্ন করলো, “সরস্বতী বন্দনার সময় কাঁদছিলে কেন সই?” আহা! কী মধুর সম্ভাষণ। “সরস্বতী বন্দনার অর্থ তোমাকে বিম্বদাদা শিখিয়েছেন, আমি জানি, তুমি বিম্বদাদাকে খুব ভালোবাসো তাইনা?” এর উত্তরে আমি কী বলতে পারি দস্যুরাজ? নিজেকেও এর উত্তর দিতে হয়নি কখনও, শুধু জেনেছি আপনি আমার। উত্তর দিইনি, বা দিতে পারিনি, নিশ্চুপ ছিলাম, অনিমিখে শ্রাবণ এসেছিল শুধু।

গঙ্গার সঙ্গে আমার সুন্দর বন্ধুত্ব হয়ে গেল সেদিন থেকে। আমরা বিদ্যাকুটিরে অনেকটা সময় আজকাল একসঙ্গে কাটাই। জানি আপনার ঈর্ষার কারণ হতে পারতো, অথচ আপনি জানেন না। আমাদের দুই সমবয়সীকে একসূত্রে বেঁধেছেন কিন্তু আপনিই। আপনার কখনও জানা হয়ে উঠবে কিনা জানি না।যাকে আপনি ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখতেন, সে আপনার একান্ত অনুরাগী একজন। ও যে সংস্কৃত পড়তে চায় আপনার কাছে তা কখনও বলে উঠতে পারেনি, অথচ আপনাকে অনুকরণ করতে পারে অবিকল।আপনার একনিষ্ঠ একলব্যটি আমাকে ভুলিয়ে রাখে আজকাল। আপনাকে সামনে দেখে আপনাকে ভুলে থাকি আমি…।

আপনার মনে আছে দস্যুরাজ, সেই দিনটার কথা, আপনি আমাকে সংস্কৃত পড়াতে পড়াতে একটি পদের বিশেষ চরণে এসে আটকে গেছিলেন। নিজে বারবার বিড়বিড় করে বলছিলেন পঙক্তিটা, অথচ অর্থ জানতে চাইলে বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিলেন।বারবার উচ্চারণ করছিলেন 

“স্ফুরদধরসীধবে তব বদন-চন্দ্রমা রোচয়তি লোচন- চকোরম্”… অর্থ জানার বৃথা চেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়ে আমি মুখে শুধু বলেছিলাম “আমি আপনাকে ভালোবাসি না।” মুহূর্তে কী যে হয়ে গেল, আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই আপনি আমার গমনোদ্যত হাতটি ধরে নিজের বুকে টেনে নিলেন। এমন আচমকা কিছু ঘটতে পারে, আমার ভাবনার বাইরে ছিল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। চোখ খুললাম আপনার প্রশ্নে “এবার বলুন ভালোবাসেন না আমাকে।” দেখলাম আপনি আমার মুখের এত কাছে যে আপনার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, বললাম “না বাসিনা”, আর আপনার ওষ্ঠাধর নেমে এলো আমার আজন্ম ক্ষরাময় অধরে। আমি ছটফট করতে করতে আত্মসমর্পণ করলাম।আপনার ওষ্ঠাধর আমাকে রসাতলে ডুবিয়ে নিয়ে গিয়েও আশ্রয় দিল। আপনি আবার আমাকে প্রশ্ন করলেন “এবার বলুন, ভালোবাসেন কিনা?” আমি আপনার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম, তবে মুখে বললাম “উঁহু বাসিনা” আর আপনার ওষ্ঠাধর আবার আমার অধরে ঝাঁপিয়ে পড়লো” কতক্ষণ এভাবেই  ছিলাম জানি না। আপনি আমাকে ছাড়ার আগে আবার উচ্চারণ, করলেন, অমোঘ সেই শব্দসম্ভার “স্ফুরদধরসীধবে তব বদন-চন্দ্রমা রোচয়তি লোচন-চকোরম্ “….

সূর্যতপার সুরদাসের পদের আলাপে সম্বিত ফিরে আসে উভয়ের…।

“পরম গঙ্গো কো,ছাড়ি পিয়াসো 

দুর্মতি কূপ খনাভে,

মেরো মনো আনত 

কাহা সুখ পাভে…

য্যায়সে উড়ি জাহাজ কো পঞ্ছী 

ফির জাহাজ পর্ আভে…মেরো মনো আনত…”

তারপর এতগুলো দিন অতিবাহিত হয়েছে।যেন গতকালের কথা দস্যুরাজ, শুধু সেই পদটির অর্থ আপনি জানিয়ে গেলেন না আমাকে। আপনি জানেন দস্যুরাজ সেদিনের কথা আমি গঙ্গাকে সবটা বলেছি, আর গঙ্গা এর অর্থ ভট্টাচার্য মশাইয়ের থেকে  জেনে এসে আমাকে জানিয়েছে, “চাঁদবদনে উচ্ছ্বলিত তোমার অধরসুধা পানের জন্য আমার নয়নচকোর অত্যন্ত পিপাসিত হয়ে আছে…।”  

আমার দস্যুরাজ, আমার প্রেম আজও আপনাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আপনার কাছে থাকা আর না থাকায় যেমন আপনি ছাড়া কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। এমনকী আমিও না। তেমনি আমার প্রেম, আমার ভালোবাসার ওপরও আপনার হঠাৎ অন্তর্ধানের কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না। আপনার প্রস্থানে আমার মন থেকে  আপনার প্রস্থান হবে না কখনোই। আপনি যতদূরে যাবেন আমার প্রেম ততদূর ধাবিত হবে। 

ভালোবাসা জানবেন দস্যুরাজ।

“আপনার রাজকন্যা” 

 

 

 

 

 

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত