চুপকথা

Reading Time: 2 minutes

 

 

 

এদিকটা বেশ নিরিবিলি, শালটা আলতো হাতে জড়িয়ে নিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল জিনিয়া। মাঝে প্রায় একুশটা বছর পেরিয়ে গেছে, তবু আজও তাকে এতোটুকু ভোলা যায়নি, নিজের এই পরাজয় আজ আবার বুঝতে পেরে এক অদ্ভুত লজ্জায়, উত্তেজনায় পা’গুলো যেন অবশ হয়ে আসছে..

একদৃষ্টে জলের দিকে চেয়ে রইলো জিনিয়া। নদী পার হলেই তো সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক মসনদ,  কতো যে ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে প্রতিটি ইঁটের পাঁজরে, ঠিক যেমন জিনিয়ার বুকের খাঁচায় ডানা ঝাপটাচ্ছে অসংখ্য চুপকথা….

-ওমা, আপনি এখানে ? মেয়ে খুঁজছে যে!

-‎তাই নাকি! চলুন যাই।

একটা ঘোরের ভেতরেই  মিসেস মিত্রের সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলল জিনিয়া..

-তারপর, শরীর ঠিক তো? জানি মেয়ের চিন্তাটাই..

-‎সবই সয়ে যায়।  ঠান্ডা গলায় মিত্র গিন্নীর কথার মাঝেই জিনিয়া বলে উঠলো।

-তা ঠিক।কি আর করবেন বলুন, কপাল..

জিনিয়া উত্তর করল না, মুখও তুললো না, নিরুত্তাপ হেঁটে চলল…

 

-আরে ওই তো এসে গেছে, এসো জলদি।

ওদের আসতে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো তন্দ্রা, জুনিয়র অফিসার নিলয় বোসের মিসেস।

 

রনিতা প্রায় ছুটে এলো জিনিয়ার কানের কাছে,

-পারেও , কি ভীষণ গায়ে পড়া, রিজিওনাল হেডের সাথে পুরো চিপকে আছে ওই মিসেস বোস। তবে সত্যি মাইরি, এই বয়েসেও কি হ্যান্ডু দেখতে বলুন লোকটাকে!

 

-হ্যাঁ,  দারুণ হ্যান্ডসাম, মানুষটাও নাকি খুব খোলা মনের, সারাজীবন তো বাইরে বাইরেই কাটিয়েছেন।

কথা শেষ হল না লতিকার, রণিতা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, আরে ব্যাচেলার তো। নির্ঘাত প্রেমে দাগা টাগা পেয়েছিল…

-হবে হয়তো, বাব্বা,অমন প্রেমিককে কে ছাড়লো গো, আমি তো পেলে..

ওদের রসিক অট্টহাসি জিনিয়ার সারা শরীরে যেন বিষদাঁত বসিয়ে দিচ্ছে, ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো অজন্তার পাশে।

গত সেপ্টেম্বরেই কুড়ি পেরিয়েছে অজন্তা, কিন্তু মনের গড়ন এখনও দশও ছোঁয়নি।

প্রথম প্রথম এসব অফিস পিকনিক, সোশ্যাল ফাংশান কিছুতেই অংশ নিতে চাইতো না জিনিয়া, কিন্তু আস্তে আস্তে সময়ই স্বাভাবিক স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে জীবনকে।

 

-দুপুরের ভাতঘুমের  অভ্যেস ভাই, বলতে বলতেই লতিকা দুটো পা সামনে মেলে দিতে যাচ্ছিল এমন সময় দলবল নিয়ে  সবার কর্তারা হাজির, সঙ্গে তমাল চৌধুরী।  সেই বহুচর্চিত ‘রিজিওনাল হেড’।

-এমা, সরি সরি।পা গুটিয়ে টানটান হয়ে বসল লতিকা।

-না না রিল্যাক্স, নো ফর্ম্যালিটি।

গমগমিয়ে উঠলো তমালের কণ্ঠস্বর।

জিনিয়া চমকে তাকাতেই চারচোখ অকারণেই এক হয়ে গেলো আবার।

 

-এই শুরু করা যাক মেমরি গেম।

-উরিব্বাবা আমার মেমরি জিরো, তার চেয়ে তমাল দা আপনি একটা গান করুন।

তন্দ্রার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলে উঠলো রণিতা।

 

-আমি?

-হ্যাঁ প্লিজ, শুনেছি সঞ্জয়ের কাছে আপনি দারুণ গান গেয়েছিলেন প্রেস মিটিং এ, প্লিজ।

সবাই সহমতে চেঁচিয়ে উঠতে না উঠতেই, তমালের স্বর বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, ” তুমি রবে নীরবে..”

“জাগিবে একাকী, এই রে…” তমাল নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল।

“… তব করুণ আঁখি, তব অঞ্চল ছায়া…” দুচোখ বুজে নির্বিকার হাল ধরল অজন্তা..

সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে, তমাল মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে অজন্তার দিকে।

হঠাৎই ” যা:, আবার নিশীথিনী সমই তো, তাই না গো, মা? ভুলে গেলাম!”…,বলেই ঠোঁটটাকে শক্ত করে কামড়ে ধরল অজন্তা।

জিনিয়া মাথা নাড়লো।

 

– চলো আবার একসাথে।

তমালের স্বরে একরাশ স্নেহের উত্তাপ।

 

দুটো স্বর মিশে যাচ্ছে গোধূলীর আকাশে…

সূর্যাস্তের সোনালি ঢেউ এক কামড় থেকে আরেক কামড়ে আছড়ে পড়লে, ক্ষত’র দাগ শুধু ডুবে যায় নিশ্চুপ নদীতে।

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>