| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-১০) । হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। সুবালা লেখকের প্রথম উপন্যাস।


(১৫)

 

          বাড়ির উঠোনে না পৌঁছানো পর্যন্ত কোনো দিকে তাকানোর মতো সময় বা ধৈর্য আমার ছিল না ।উঠোনে পা রেখেই একলাফে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে মাত্র উদ্যত হয়েছি, হঠাৎ চোখে পড়ল শেষ রাতের অন্ধকারে দরজার মুখে ঘাপটি মেরে মা বসে আছে। উলঙ্গ দেহে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসা আমার মূর্তিটা নিশ্চয় একটা দেখার মতো দৃশ্য হয়েছিল। এবং তার চোখে মুখে এরকম একটি ভয়ঙ্কর বিস্ময় এবং আতঙ্কের ভাব ফুটে উঠল যে তার  মুখভঙ্গি দেখে আমিও এক নিমেষের জন্য থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাত্র এক নিমেষের জন্য, পরের মুহূর্তে আমি প্রায় তার গায়ের উপর দিয়ে লাফ মেরে ভেতরে ঢুকে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম এবং কাঁথা দিয়ে দ্রুত শরীরটাকে ঢেকে ফেললাম।

           কিছুক্ষণ পরে মা ভেতরে এল। চোখে দেখতে না পেলেও আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, আমার দিকে কিছুক্ষণ  স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে তিনি আমার মাথার দিকে আগুনের পাশে বসে পড়লেন। আমি বিছানায় এক কাত হয়ে শুয়ে রইলাম। মায়ের মনের কথা জানিনা আমি কিন্তু আমি প্রতিমুহূর্তে প্রার্থনা করতে লাগলাম কোনো মানুষের শব্দের আঘাত লেগে যেন স্তব্ধতার এই অন্ধকার আশ্রয় ভেঙ্গে না যায় ,এটা যেন অনন্তকাল স্থায়ী হয়।

           দুপুরবেলা কিছুক্ষণের জন্য মা বাইরে বেরিয়ে গেলেন, বোধহয় স্নান করার জন্য। সেই সুযোগে আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে ওঠে কাপড় পরে নিয়ে পুনরায় গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বলতি পারি না,হঠাৎ একবার জেগে ওঠে মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,’ সুবালা, ও মা ওঠ ভাত খা।’

           আমি মুখে কোনো উত্তর দিলাম না, কিন্তু ভাত যে আমি খাব না, মরে গেলেও ভাত খাব না, সে কথা সমস্ত দেহের আন্দোলনে আমি তাকে জানিয়ে দিলাম। আমাকে বেশি ঘাটাতে নিশ্চয় তার সাহস ছিল না। তথাপি একটু পরে পরে তিনি কাতর মিনতির সুরে ডাকতে লাগলেন সুবালা…  সুবালা…  সুবালা।’

           বেলা কতটা হয়েছে, সংসারের জীবন প্রবাহ চলছেই নাকি চিরকালের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেছে ,এখন দিন না রাত— আমার কাছে সেই সমস্ত কোনো খবর ছিল না। গায়ে মুখে ঢেকে নেওয়া আমার কাঁথার নিচে ছিল কেবল নীরব নিশ্ছিদ্র অন্ধকার,আমার জীবনের একমাত্র সত্য। সেই নির্জন ভয়ংকর অন্ধকারে অনেক যুগ অতিবাহিত করে আমি যখন সেখান থেকে বাইরের পরিচিত জগতে বেরিয়ে এলাম,তখন পরের দিনের সূর্য এসে পূব দিগন্তে দেখা দিয়েছে।


আরো পড়ুন: সুবালা (পর্ব-৯) । হোমেন বরগোহাঞি


 

          দুপুর বেলা ভাত খেয়ে মা গ্রামের দিকে বেরিয়ে গেলেন। আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। জাগ্রত অবস্থা আমার কাছে নরকের বিভীষিকা স্বরূপ হয়ে পড়েছিল, কেবল ঘুমিয়ে থাকার সময়টুকু আমি যা কিছু শান্তি অনুভব করছিলাম ,কিন্তু মানুষের এমনই কপাল— যে সময়ে যে জিনিস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে অনুভব হয়, ঠিক সেই সময়ে তা সবচেয়ে দুর্লভ হয়ে পড়ে। মনের দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাবার জন্য আমি যত চোখে ঘুম আনতে চেষ্টা করলাম,ততই সে ধরা দিই ধরা দিই  বলে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে দূরে সরে যেতে লাগল। অবশেষে ঘুমের আশা ত্যাগ করে আমি দুশ্চিন্তার অন্ধকূপে নিজেকে সমর্থন করলাম।

          হঠাৎ একবার আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে কেড়কেড় শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। আমি চমকে উঠে বিছানায় বসে দেখলাম, দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপরিচিত আধ বয়সী মহিলা। আমাকে কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়ে মহিলাটি বলে ওঠেন,’ তুমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলে মা। আমি বাইরে থেকে কয়েকবার চিৎকার করে ডেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে নিজেই ভেতরে চলে এসেছি।’ 

          বিছানা থেকে উঠে বসার জন্য আমি একটি পিঁড়ি এগিয়ে দিলাম ।কোনোদিন একটিও জনপ্রাণী প্রবেশ না করা বাড়িটিতে হঠাৎ অসময়ে একেবারে অপরিচিত একজন মহিলাকে এসে পড়তে দেখে আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে তাকে কী জিজ্ঞেস করব আমি বুঝতেই পারছিলাম না ।কিন্তু মহিলাটি আমার বিমূঢ় অবস্থার দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে হাত পা মেলে পিঁড়িতে বসে পড়লেন এবং ক্লান্তি দূর করার জন্য লম্বা লম্বা কয়েকটি নিঃশ্বাস  নিলেন। কয়েক মিনিট এভাবে কাটিয়ে তিনি অবশেষে আমার দিকে তাকিয়ে বলে   উঠেন,’ আমাকে এক গ্লাস জল দাও  মা। আমি জল খাবার জন্য তোমার বাড়িতে ঢুকেছি। ‘

          তিনি জল খাবার পরে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,’ আপনাকে তো আমাদের এদিকের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না; কোথা থেকে এসেছেন আপনি?’

          ‘ঠিক ধরেছ মা’— তিনি উত্তর দিলেন—’ আমার বাড়ি গুয়াহাটিতে।তবে এদিকে আমার দুই চার  ঘর আত্মীয়-স্বজন আছে, অনেকদিন পরে তাদের দেখতে এসেছিলাম। বাস ছাড়তে অনেক দেরি আছে শুনে তোমাদের বাড়িতে জল খাবার জন্য ঢুকেছি। তবে মা বাড়িতে দেখছি তোমাকে একা আর কেউ নেই নাকি?’

          ‘মা আছে। তিনি গ্রামের দিকে গেছেন। বাড়িতে আমরা দুজনই থাকি, আর কেউ নেই।’ তার কাছ থেকে এই বিষয়ে আর   বেশি প্রশ্ন যাতে শুনতে না হয় সেই রাস্তাটা একেবারে বন্ধ করে দিলাম। 

          ‘তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা হলে ভালোই লাগত।তিনি কখন আসবেন কে জানে? তোমার নাম কি মা?

          ‘আমি তাকে আমার নাম বললাম।

          তারপরে তিনি আমি কতটা পড়াশোনা করেছি, আমার বিয়ে-শাদির কথা হচ্ছে কিনা, পিতার কবে মৃত্যু হয়েছে, আমাদের সংসার কীভাবে চলে— ইত্যাদি নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলেন প্রথমে আমি তার প্রশ্ন গুলি শুনে বিরক্ত হয়েছিলাম, তার সঙ্গে কথাবার্তা মন খুলে অংশগ্রহণ করতে পারছিলাম না কিন্তু ধীরে ধীরে নানা সহানুভূতির কথায় তিনি আমার মনটাকে  কখন গলিয়ে ফেললেন আমি বুঝতে পারলাম না। জীবনে প্রথমবারের জন্য আমার মনের কথা আগ্রহ এবং সহানুভূতি নিয়ে শুনতে চাওয়া একজন মহিলার সাক্ষাৎ পেয়ে আমি অন্তর উজাড় করে তাকে সমস্ত কথা বলে ফেললাম। মোটকথা তিনি এসে আমার বাড়ি প্রবেশ করার এক ঘন্টার ভেতরে আমার বিষয়ে তার জানতে আর কিছু বাকি রইল না।

          সমস্ত কথা শুনে শেষ করে তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,’ মা সুবালা আমার যাবার সময় হয়েছে। তবে তোর কথাগুলি শুনে আমার বুকটা কেমন করছে— সেটা আমিই বুঝতে পারছি।তোর মনের জোর  দেখেও আমি আশ্চর্য হয়েছি ।তুই সাধারন মেয়ে নস।  কিন্তু এভাবে তুই কতদিন লড়াই করবি?  হাজার হলেও তুই মেয়ে মানুষ।  তোর ভবিষ্যতে কী আছে সেটা কেবল ভগবানই জানেন।’

           তার কণ্ঠস্বর বেদনায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা এবং চোখ ছলছল হয়ে উঠল।

           কিছুক্ষণের পরিচিত একজন মহিলার থেকে এতটা সহানুভূতি আমি আশা করতে পারিনি। অভিভূত হয়ে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম,’ আপনার কথা শুনে এখন আমার আসল ভয় হচ্ছে। আপনি আমার কোনো একটা উপায় করে দিতে পারেন না কি?’

          আমার কথা শুনে গভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে তিনি অনেকক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। তারপরে কিছু একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মতো মুখভঙ্গি করে তিনি বলে উঠেন,’ মানুষ কার জন্য কী করতে পারে মা, সবকিছু করার মালিক হলেন ঈশ্বর। কিন্তু কে জানে ঈশ্বরই হয়তো আমাকে আজ তোর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে? শোন, তোকে একটা কথা বলে যাই, তুই ভেবে দেখবি ।গুয়াহাটিতে অনাথ এবং সমাজহীন বিধবা মহিলাদের লেখাপড়া এবং সেলাই শিখিয়ে স্বাবলম্বী করার জন্য একটি আশ্রম আছে। অনেকে সেখানে কিছুদিন থেকে পড়ে ভালোভাবে বিয়ে-শাদি করে ঘর সংসারও করছে। আমি নিজেই কয়েকজন তোর মতো দুঃখে ভরা মেয়েকে সেখানে নিয়ে ভর্তি করে দিয়েছি।ওরা এখন নতুন জীবন লাভ করেছে। তুই মাইনর পাশ করা লেখাপড়া জানা মেয়ে, নিজের যত্নে এবং চেষ্টায় তুই অনেক উপরে উঠতে পারবি। তোকে আমি সেখানে ভর্তি করে দিতে পারি। কিন্তু তুই কি মাকে একা ফেলে রেখে যেতে পারবি? বা মা তোকে একা যেতে দেবে?’

          মহিলাটির কথা শুনে আমি যেন হাতে স্বর্গ পেলাম, উতলা হয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম ,মায়ের কথা আপনি একদম ভাববেন না,আপনার পায়ে ধরছি, আপনি আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। মায়ের সঙ্গে থেকেও আমি তাকে কাজ করে খাওয়াতে পারব না, আর আমাকে দিয়ে মা যে কাজটা  করাতে চান, সেটা করতে হলে আমাকে আত্মঘাতী হয়ে মরতে হবে ।মোটকথা মায়ের সঙ্গে থাকলে আমার একুল ওকুল দুকূল অন্ধকার। কিন্তু বাইরে গিয়ে এভাবে কিছু লেখাপড়া বা কাজকর্ম শিখতে পারলে হয়তো মাকে আমার  কাছে নিয়ে যেতে পারব।’

          আমার কথা শেষ না হতেই মহিলাটি মাঝখানে বলে উঠলেন,’ কিন্তু মা কি তোকে যেতে দেবে?’

          ‘ওহো, সেই আশা নেই’, আমি উত্তর দিলাম, যেতে হলে আমাকে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমি তো পথঘাট চিনি না; হাতে একটি ফুটো পয়সাও নেই,গুয়াহাটিতে আপনাকে কীভাবে খুঁজে বার করব ?না না ঈশ্বর যখন আজ আপনার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিয়েছেন, আপনাকে কোনো একটা উপায় বের করতেই হবে। আপনাকে আমি মা বলে ডেকেছি, আমাকে উদ্ধার করুন’— আমি ব্যাকুল ভাবে তার পা দুটি জড়িয়ে ধরলাম।

গভীর স্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বলে উঠলেন,’ আমার নিজের কোনো ছেলে মেয়ে নেই, আজ থেকে তোকে আমি নিজের মেয়ে বলে মানলাম। তুই কোনো চিন্তা করিস না মা। শোন,আগামী সপ্তাহের বুধবার তুই শেষ রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে বাস স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করবি। আমাকে সেখানে পাবি। সকাল ছয়টার সময় আমরা গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে রওনা হব। মা তোকে ঘরে না দেখলেও বাইরে  শৌচ  করতে গিয়েছিস বলে ভাববে বা অন্য কিছু ভাবলেও সোজাসুজি বাস স্টেশনে খবর করতে নিশ্চয় যাবে না। আসল খবর তিনি যখন জানতে পারবেন— তখন তুই কোথায় আছিস, সেকথা তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তল্লাশ করেও বের করতে পারবে না। তাহলে এই কথাই রইল। আমি এখন যাই, তোর মা এসে পড়লে  কথাটা খারাপ হবে।’

 

 

 

       

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত