| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

‍পুনঃপাঠ গল্প : সুবোধ ঘোষের গল্প ‘আগুন আমার ভাই’

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

বাংলা ছোটগল্পের জগতে এক বিস্ময়ের নাম সুবোধ ঘোষ। জীবনঘনিষ্ঠ নানা স্বাদের গল্প রচনায় তিনি অনন্যসাধারণ। ‘সম্পাদকের পছন্দ’ বিভাগে সুবোধ ঘোষের গল্প ‘আগুন আমার ভাই’ ইরাবতীর নতুন সময়ের পাঠককে গল্প পাঠের ভিন্ন এক স্বাদ ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করবে।


 

বাংলাসাহিত্যের কালজয়ী কথাশিল্পী সুবোধ ঘোষ ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশের হাজারিবাগে। স্কুলের শিক্ষাও সেখানে। সেটি সমাপ্ত করে হাজারিবাগেরই ‘সেন্ট কলম্বাস’ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু আর এগুনো সম্ভব হয় নি। অর্থাভাবে স্কুলে ডবল প্রমোশন পাওয়া এই মেধাবী ছাত্রকে নামতে হয়েছিল জীবিকার সন্ধানে। হাজারিবাগের কুলি বস্তিতে তখন মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে কলেরা। পনেরো বছর বয়সের সুবোধ ঘোষ সেখানে কাজ পেলেন,টিকা দেওয়ার কাজ। এই টিকা দেওয়ার কাজেই তাঁকে এক সময় যেতে হয়েছিল মুম্বাই এবং তারপর সুদূর এডেন বন্দরে। সেই কাজ শেষ হওয়ার পরে সার্কাস পার্টিতে লটবহর-বাক্শো-প্যাটরা বহনের কাজ করেছেন কিছুদিন। মোটর কোম্পানির কনডাক্টর হয়ে রাঁচি-গয়া বাস সার্ভিসে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন বিপদসঙ্কুল অভ্রখনিতে ওভারসিয়ার হিসেবে। বেকারি-পণ্য দোকানে-দোকানে সাপ্লাই করেছেন কিছুদিন। তারপরে হোটেলের ব্যবসা. মুরগি পালন, মিষ্টির দোকান, মাখনের দোকান ইত্যাদি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। এর মাঝে কিছুদিন সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জনপদ থেকে জনপদে। বহু পথ ঘুরে অবশেষে ত্রিশ দশকের শেষে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ক্রমে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

বলা যায়, জীবন ও জীবিকার বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ঝুলিটি পূর্ণ করে একটু বেশি বয়সেই কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন সুবোধ ঘোষ। ‘অনামী সঙ্ঘ’র বৈঠকে পাঠের জন্য বন্ধুদের অনুরোধে হঠাৎ লিখে ফেলেন গল্প ‘অযান্ত্রিক’। আকস্মিক হলেও ‘অযান্ত্রিক’ কোনো পূর্বপ্রস্তুতিহীন রচনা নয়। ‘অযান্ত্রিক’-এর আগে অন্য কোনো সাহিত্য রচনা না-করলেও লেখার প্রস্তুতি তাঁর ভেতরে ভেতরে চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। ছিল বিশাল পাঠপ্রস্তুতি। দার্শনিক মহেশচন্দ্র ঘোষের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি উন্মুক্ত ছিল তাঁর জন্য। সেই বিশাল ভান্ডার থেকে পাঠ করেছেন ইতিহাস-দর্শন-ধর্মতত্ত্ব; নৃতাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র রায়ের সান্নিধ্যলাভ ও তাঁর গবেষণা-কর্মগুলো পাঠ করে ধারণা লাভ করেছেন ভারতবর্ষের আদিবাসী জনজাতি সম্পর্কে ; জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর পার্বতীলাল দত্ত-র কাছে শুনতে পেয়েছেন নদী-পাহাড়-সমুদ্র-পাথর-ফসিলের পাঠোদ্ধারের গল্প ; কৈশোরে সান্নিধ্য পেয়েছেন কবি কামিনী রায়ের। কবির স্বকণ্ঠে আবৃত্তি শুনেছেন তাঁর অনেক কবিতার। সব মিলিয়ে বলা যায়, একদিকে যেমন তার মধ্যে জমা হচ্ছিল জ্ঞানশাস্ত্রের বিভিন্ন অধ্যায়, অন্যদিকে জীবন তাকে শেখাচ্ছিল বেঁচে থাকার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার বা অব্যাহত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কলাকৌশল। লেখকের পূর্বপ্রস্তুতির জন্য এসবের চাইতে বড়ো শিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক আর কী হতে পারে !

১৯৪০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্ষিক দোল সংখ্যায় প্রকাশ হয় ‘অযান্ত্রিক’। লেখকের প্রথম লেখা ও প্রথম প্রকাশিত গল্প। একটি যন্ত্র, একটি গাড়ি যে গল্পের চরিত্র হয়ে উঠতে পারে তা এই প্রথম দেখা গেল বাংলাসাহিত্যে। গাড়িটির একটি নামও আছে জগদ্দল। অতি পুরাতন, লক্করঝক্কর গাড়ি। শ্রী ও শক্তি কোনোটিই তেমন নেই। চলার সময় সবচেয়ে বেশি ধুলো ওড়ায়, বিকট শব্দে পথের মোষ তাড়ায়…।

সুবোধ ঘোষের লেখা দ্বিতীয় গল্প ‘ফসিল’। ঐ একই বছরে অর্থাৎ ১৯৪০ সালেই রচিত। এর পর একে একে তিনি লেখেন জতুগৃহ, থির বিজুরী, আগুন আমার ভাই, ঠগিনী ‘সুন্দরম’, ‘পরশুরামের কুঠার’, ‘গরল অমিয় ভেল’, সমাপিকা, বর্ণচোরা, শেষপ্রহর, সুপ্রিয়া, সাধারণী এমন অনন্যসাধারণ সব গল্প।

সুবোধ ঘোষের ছাটগল্প ‘জতুগৃহ’ অবলম্বনে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তপন সিংহ ওই নামে একটি ছবি করেছিলেন এবং বোম্বেতে ‘ইজাজাত’ নামের একটি হিন্দি ছবি নির্মিত হয়, যেটি পরিচালনা করেছিলেন গুলজার।

শুধু গল্পকার হিসেবেই সুবোধ ঘোষ অন্বেষু শিল্পী ছিলেন না। ছিলেন উপন্যাস রচনাতেও ঋদ্ধহস্ত। তার যথার্থ প্রমাণ ‘তিলাঞ্জলি’ [১৯৪৪]। ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম প্রজ্ঞার স্বাক্ষর এই উপন্যাস। এতে তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শ উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। ‘কংগ্রেস সাহিত্য সঙ্ঘ’র মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে। মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত এ-উপন্যাসে তৎকালীন কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ ‘জাগৃতি সঙ্ঘ’র জাতীয়তাবিরোধী চরিত্রের মতবিরোধের রূপরেখা অঙ্কনে সচেষ্ট হয়েছেন সুবোধ ঘোষ।

সুবোধ ঘোষের অপর উপন্যাস ‘গঙ্গোত্রী’ [১৯৪৭], এটিও রাজনৈতিক পটভূমিকায় রচিত। এ-উপন্যাসে রাজনীতির বাইরের কথাও উঠে এসেছে। রাজনীতির প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ জীবনের অন্তরঙ্গ কথামালা তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন তিনি।

এক সময় তিনি ‘কালপুরুষ’ ছদ্মনামেও কিছু লেখা প্রকাশ করেছিলেন।

১৯৪৪ সালে গড়ে ওঠা ‘কংগ্রেস সাহিত্য সঙ্ঘ’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন সুবোধ ঘোষ। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট দাঙ্গা-উত্তর বিধ্বস্ত নোয়াখালি থেকে তিনি গান্ধীজির সহচর হিসেবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন দাঙ্গা এবং দাঙ্গা-উত্তর কালপর্বে সাম্প্রদায়িকতা হিংস্রতাকে।

সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি-স্বরূপ সুবোধ ঘোষ লাভ করেন ‘আনন্দ পুরস্কার’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী পদক’। অমর এই কথাশিল্পী ১৯৮০ সালের ১০ মার্চ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

“আগুন আমার ভাই” 



সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বৈশাখি বিকালের জ্বালাভরা আক্রোশের আঁচ এখন জুড়িয়ে গিয়েছে, যদিও আকাশের পশ্চিমে এখনও একটু রঙিন আভা দেখা যায়। এমনি এক লগ্নে গরানহাটার সেই গলির বাতাসে এক ভয়াল জ্বালার আভা রঙিন হয়ে ফুটে উঠল। সেই সঙ্গে যেন চাপ-চাপ নিরেট ধোঁয়ার কুন্ডলী প্রকান্ড বাড়িটার তিনতলার যত জানালা,



যত ঘুলঘুলি আর যত রন্ধ্রপথ ভেদ করে ঠেলে উঠতে থাকে। সারা পথের উপর হাজার মানুষের ভিড় চেঁচায়, হায়-হায় করে, আর হঠাৎ যেন এক-একটা দমকা আতঙ্কের ঠেলায় দশ-পা পিছিয়ে যায় ; আবার হৈ-হৈ করে দু-পা এগিয়ে আসে।

আগুনের সঙ্গে লড়াই করে যারা, তারাও এসে গিয়েছে। জোর লড়াই চলছে। গলির বাতাস ঝনঝনিয়ে দমকলের ঘণ্টার শব্দে মরিয়া হয়ে দৌড়ে আসতে থাকে। যেন গভীর আতঙ্ক আর শান্ত উল্লাসের বাজনা। এগিয়ে যায় এক-একটি ফায়ার-ইঞ্জিন, যার বুকের কাছে সুডোল ট্যাঙ্কের ভিতর চারশো গ্যালন জল টলমল করে।

ছুটছে জলের ফোয়ারা। কিন্তু কী ভয়ানক রাগী আগুন ! লকলকে রক্তবরণ শতশত শিখার সেই নাচন যেন বিভোর হয়ে প্রচÐ এক জ্বালার উৎসব মাতিয়ে তুলেছে। তার কাছে পৌঁছবার আগেই গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে জলের ফোয়ারা, কালো ধোঁয়ার কুÐলীর সঙ্গে সাদা বাষ্পের কুন্ডলী জড়াজড়ি করে উপর আকাশের দিকে পালিয়ে যায়।

ফায়ার ব্রিগেডের একদল ক্রু ছুটে ছুটে খাটছে। পাশের বাড়ির তিনতলায় উঠে দশটি হোস-পাইপের মুখ উঁচিয়ে ধরে পোড়া বাড়ির ধোঁয়াভরা জানালাগুলির উপর ওরা জলের ফোয়ারা ছুঁড়ে মারছে। মনে হলো একটা ঘর ভিজেছে ঠান্ডা জলের মার খেয়ে আগুন মরেছে, জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সরু সরু জলের ধারা।

কিন্তু তারপর আবার। কোথা থেকে সেই দুর্মর আগুনের জ্বালা যেন রঙিন হাসি হেসে জানলার বুকটাকে আভাময় করে তোলে। পাশের ঘরের জানালাতেও আগুনের রঙিন আলো ধকধক করে।

আগুন-লাগা বাড়ির দোতলা আর একতলার সব লোক অনেক আগেই নিচে নেমে গিয়েছে। একটা ঘরের ভিতরে তখনও শ্বাস টানছিল এক মরমর রোগী। তাকেও কারা যেন বিছানাসুদ্ধ তুলে নিয়ে দুলতে দুলতে দোতলা থেকে নেমে এলো।

কিন্তু তিনতলাতে যারা থাকে, তারা কোথায় গেল ? তারা সবাই কি নেমে আসতে পেরেছে ? ক্রু-মাস্টার ব্যস্ত হয়ে ভিড়ের লোকের কাছ থেকে জানতে চায়। লোকে বলে তিনতলার সবই হলো বে-আইনী কাপড়ের গুদাম। কেউ কেউ বলে, কোন কোন ঘরে বে-আইনী মেয়েমানুষও থাকে।

যাই হোক, মেয়েমানুষগুলোও নেমে আসতে পেরেছে বলে মনে হয়। নইলে এতক্ষণে কোনো-না-কোনো সাড়া পাওয়া যেত। এই দশ মিনিটের মধ্যে ওই তিন তলার কোনো জানালা থেকে কোনো আর্তস্বর শোনা যায়নি। কোনো জানালায় কোনো আতঙ্কিত মুখ উঁকি দিয়ে কেঁদে ওঠেনি। মনে হয়, তিনতলার আগুনটা কোনো জীবন্তের প্রাণকে ছাই করে দেবার আনন্দে নয়, শুধু বে-আইনী লোকের কতকগুলি বস্তুপিÐকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে হাসছে। আগুনটাকে তেমন নিষ্ঠুর বলে মনে হয় না। গরানহাটার এই কুৎসিত গলিটাকেও কোনোদিন এত সুন্দর আর এত রঙিন দেখায়নি।

ফায়ার বিগ্রেডের ক্রু কাশীনাথও বোধহয় এই কথাটাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, আর তিনতলার রক্তবরণ আগুনের উৎসবের দিকে যেন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল। এখনও অর্ডার হয়নি, কাশীনাথ এখন শুধু স্ট্যান্ড-বাই। হয়তো আর-এক মুহূর্ত পরে হুকুম গর্জে উঠবে, তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি হবে না। আগুনের ওই জ্বালাভরা হাল্কা আর হিংসুক লাফালাফি ঠান্ডা করে দেবার জন্য ছুটে গিয়ে হোস-পাইপ হাতে তুলে নিতে হবে। বোধহয় দু’ ইঞ্চি মনিটর জেট ছাড়তে হবে। জবর মার না মারলে ওই আগুনের দেমাক চূর্ণ হবে না। তৈরি হয়ে আছে কাশীনাথ।

আগুন দেখতে বড় সুন্দর। কত আগুন-লাগা বাড়ির জ্বলন্ত বুকের কাছে কতবার এগিয়ে যেতে হয়েছে। দেখেছে কাশীনাথ, সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। দাউ-দাউ করে জিনিসপত্র পোড়ে ; আগুনের শিখাগুলি লক-লক করে। দেখে মনে হয়, যেন একদল রূপসী মেয়ে-ডাকাত হেসে হেসে আর নেচে নেচে ঘরের জিনিস লুট করে নিচ্ছে।

ভাবতে ভালো লাগে, বুকের ভিতরটা যেন নেশার মতো চনচনে আনন্দে শিউরে ওঠে ! এই রকম রাগী আগুনকে ঘায়েল করতে গিয়ে এই পাঁচ বছরের চাকরির জীবনে দু-দুবার ভয়ানক সাহসের খেলা দেখিয়েছে যে কাশীনাথ, তার চোখেও যেন বিদ্যুতের আগুন চমকে ওঠে। দুবার রুপার মেডেল পেয়েছে কাশীনাথ।

আগুন দেখতে বড় সুন্দর, কিন্তু আগুনকে তাই বলে ক্ষমা করতে ইচ্ছে করে না। গোখরো সাপের ফণাদোলানি নাচের মতো এই আগুনের নাচ দেখতে ভালো লাগলেও ভুলতে পারে না কাশীনাথ, এই আগুনের এক সর্বনেশে কামড়ে তার জীবনের সব আনন্দ বিষিয়ে গিয়েছে। আগুন পোড়া ঘায়ের দাগে কাশীনাথের মুখের একটা দিকের গড়ন ভেঙ্গেচুরে গিয়েছে। দেখলে মনে হয়, মুখের উপর এক খাবলা ঘেয়ো মাংস শুকিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো বেঁচেছে, কিন্তু সারা মুখটা কুৎসিত হয়ে গিয়েছে। নইলে, কাশীনাথের গায়ের রং, চোখের ভুরু আর খাড়া নাকের ধার দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই মুখপোড়া কাশীনাথ সত্যিই দেখতে বেশ সুন্দর ছিল।

মুখের উপর আগুনে-পোড়া ঘায়ের সেই জ্বালা কবেই মিটে গিয়েছে। আগুন-লাগা বস্তির এক ঘরের ভিতর ঢুকে একটা কুষ্ঠ রোগীকে টেনে আনতে গিয়ে ঘরের জ্বলন্ত চালার একটু টুকরো কাশীনাথের মুখের উপর ভেঙে পড়েছিল। সেই কুষ্ঠ লোকটার গায়ে একটা ফোস্কাও পাওয়া গেল, কিন্তু …।

ক্রু মানিকদা বলেন, ‘এইবার একদিন একটা বড়লোকের বাড়ির কোন সুন্দরীকে আগুনের মরণ থেকে টেনে বাঁচিয়ে তোল কাশীনাথ, তারপর একটা সোনার গ্যালান্ট্রি পেয়ে যা।’

কিন্তু কাশীনাথ জানে যে, তার মুখের এই আগুনে-পোড়া ঘায়ের চিহ্ন, তার এই কুশ্রী মুখই তার জীবনের সব সোনা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। তাই তো বুকের ভিতর আগুন জ্বলে, দুঃসহ এক আক্রোশের আগুন। একবার সেই মেয়েকে চোখের কাছে আর হাতের কাছে পেতে চায়, যে তার এই কুরূপ মুখের দিকে তাকিয়ে ঘেন্না সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গিয়েছে।

আজ তিন বছর ধরে, এই শহরের কত ভিড়ের কাছে গিয়ে তন্ন-তন্ন করে খোঁজ করেছে কাশীনাথ, কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায়নি। মাত্র বার চাকের তার ঠিকানা পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু কাশীনাথ ছুটে গিয়ে তার গলা টিপে ধরবার আগেই, কে জানে কেমন করে ঠাহর করতে পেরে, সেই ঠগিনী মেয়ে সব ঠিকানা মিথ্যে করে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে। আজও রেণুকার নাগাল পায়নি কাশীনাথ।

সাতপাক দিয়ে বিয়ে করা, কত আহ্লাদে ফুলশয্যা আর বউ-ভাত করা কাশীনাথের বউ সেই            রেণুকা ! একে তো টলটলে ডাগর ডাগর কালো চোখ, তার উপর বেশ বড় সুর্মার টান, রেণুকার সেই মুখটি শুভদৃষ্টির সময় কেমন করে হেসে উঠেছিল, আজও মনে পড়ে কাশীনাথের। কই, সে হাসি তো ঠাট্টার হাসি ছিল না ? সেই হাসির মধ্যে ঘেন্নাও ছিল না, শুধু একটু আশ্চর্য ছিল। বরং মনে হয়েছিল কাশীনাথের, রেণুকা বোধহয় ভাবছে যে, বরের মুখটাকে যত কুৎসিত বলে পাঁচজনে নানা কথা বলছে, তত কুৎসিত তো নয়। বাসরঘরেও ও-পাড়ার এক মুখকাটা মেয়ে ফিসফিস করে বলে ফেলেছিল, ‘মুখপোড়া বর।’ মনে পড়ে কাশীনাথের, রেণুকা তখন কানে কানে অদ্ভুত একটা কথা বলেছি, ‘পুরুষের আবার রূপ           কী ? টাকাপয়সা থাকলে সব পুরুষ সুন্দর।’

হঠাৎ বিয়ে নয়, বেশ তিনটি মাসের দেখাশুনার পর রেণুকা হাসি মুখে রাজি হয়ে কাশীনাথকে বলেছিল, ‘বেশ তো, যখন তুমি বলছ যে আমাকে সুখে রাখতে পারবে, তখন বউ করে ঘরে নিয়ে যাও।’

এক ঘণ্টা পরপর সিকি-মটর আফিম খায় আর কড়া চা টানে, জিরজিরে চেহারার এক মামা। আর যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ পা ছড়িয়ে বসে দোক্তা চিবোয়, বেশ ভারি গতরের এক মামি। এহেন এক মামা-মামির কাছে কালীঘাটের বস্তির এক কুঁড়েঘরের অন্ধকারে দিন কাটাত যে রেণুকা, তাকে এক শুভদিনে নিজের ঘরে আনবার জন্য সাতশো টাকা খরচও করেছিল কাশীনাথ।

মামা বলছিলেন, ‘দেখ বাবাজীবন, যা কথা দিয়েছ তাই যেন হয়। মেয়েটা যেন সুখে থাকে।’

মামি বলে, ‘যখন নিজের মুখে বলছ যে, তুমি ভালো চাকরি করছ, অনেক সোনা-রুপো নাকি বকশিশ পাও, তখন এই মামা আর মামীর উপর একটু নজর রাখতে ভুলো না।’

সবই মনে পড়ে। কাশীনাথ যেন সত্যিই আশা করেছিল, রেণুকাকে বেশ সুখে রাখা যাবে ! আর, বেচারা মামা আর মামিকেও মাঝে মাঝে কিছু সাহায্য করা যাবে। সেই আশার মধ্যে কোনো ভুল ছিল না। কাশীনাথের মনের ইচ্ছার মধ্যে কোনো ফাঁকি ছিল না।





কী ভয়ঙ্কর রাগী আগুন ! আগুনটা যেন আক্রোশে মরিয়া হয়ে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে নিচের দিকে অনেকখানি গড়িয়েছে। দোতলার ঘরের তিনটে জানালায় ধোঁয়া দেখা যায়। পথের ভিড় আরও জোরে হায়-হায় করে।

আরও সুন্দর হয়ে উটৈছে আগুনটার রূপ। জানালার খড়খড়ি দিয়ে ফুরফুরে পাপড়ির মতো হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে লাল নীল হলদে আর বেগুণি জ্বালার ফুল। আর একটা জানালার ফাঁক দিয়ে এক সারি সাপের বাচ্ছার মতো লিকলিকে আগুনের সরু-সরু ফণা যেন এলোমেলো হয়ে কুঁকড়ে কুঁকড়ে দুলছে। একটা খোলা জানালা দিয়ে দেখা যায়, ভিতরটা হাপরের চুলোর মতো গনগন করছে। ঝটকা হাওয়ায় গরম ছাই লাফিয়ে লাফিয়ে উড়তে থাকে। ভিড়ের মানুষ ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়।

আগুনের রকম দেখে বুঝতে পারে কাশীনাথ, সর্বনাশ অনেক দূর গড়াবে। আর, এক-একটা শক্ত আপদের সঙ্গে মরিয়া হয়ে লড়তেও হবে। ভালোই হলো। এই দশটা দিন শুধু নীল উর্দি চড়িয়ে আর লাল ফায়ার ইঞ্জিনের যত চকচকে পিতলের ঠান্ডা পালিশের গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে, শুধু ঠান্ডা ডিউটি দিতে হয়েছে। দশ দিন পরে এই সন্ধ্যায় আগুনের ডাক শোনা গেল। দাঁতে দাঁত ঘষে কাশীনাথ। নিঃশ্বাসে জ্বালা ধরে যায়।

বোধহয় বুকের ভিতরের একটা ফোস্কা আজও জুড়িয়ে যায়নি, কটকট করে আজও জ্বলছে, তাই আগুন দেখলে কাশীনাথের প্রাণটাই যেন দাঁতে দাঁত ঘষে একটা প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞাকে শান দিয়ে আরও ধারালো করে তোলে। কোথায় লুকিয়ে থাকবে ? কতদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে, রূপের দেমাকে স্বামীর কুলে কালি দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সেই মেয়ে ?

শুধু মানিকদা জানেন, এই পৃথিবীতে আর কেউ জানে না, বিয়ের পর চারটে মাস যেতে না-যেতেই কেন পালিয়ে গেল রেণুকা, কাশীনাথের এত ভালোবেসে বিয়ে-করা সেই বউ ! কাশীনাথের ছোট ঘরের ভিতর ঢুকে প্রথম দিনেই চমকে উঠেছিল রেণুকা। রেণুকার বড় বড় করে সুর্মা-আঁকা চোখের এতদিনের স্বপ্নটা যেন ঠকে গিয়েছে। এমন একটা ঘর বোধহয় আশা করেনি রেণুকা।

উনুনের ধারে-কাছে যায় না, কাশীনাথেরই হাতের রান্না করা ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে সারাদিন মাদুরের উপরে পড়ে থাকে রেণুকা। মাঝে মাঝে মামা-মামি আসে। তিনটে সন্দেহ-ভরা মুখ ঘরের এক কোণে কাছাকাছি হয়ে ফিসফিস করে।

চারগাছি সোনার চুড়ি এনেছিল কাশীনাথ, একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইল রেণুকা। তারপর ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিল, ‘কালীঘাটের ভিকারীকে দান দিচ্ছ নাকি ?’

কাশীনাথ আশ্চর্য হয়, ‘তার মানে ?’

রেণুকা বলে, ‘ওর সঙ্গে গলার একটা চার ভরির জিনিস আর একজোড়া কানপাশা না হলে আমি ওই সরু-সরু চারগাছি ছাই না কচু ছোঁবও না।’

ভয় পেয়েছিল কাশীনাথ। সারারাত জেগে বসেছিল। মনের জ্বালায় ঘুম আসেনি। সে জ্বালায় কিন্তু রেণুকার উপর এক ফোঁটাও রাগের ঝাঁজ ছিল না। নিজের কপালটারই উপর রাগ করেছিল কাশীনাথ। অন্য কেউ তো নয়, সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে তারই ঘর করতে এসেছে যে, সেই রেণুকা। কত সুখের আশা নিয়ে তারই চোখের সামনে অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে আর স্বপ্ন দেখছে। রেণুকার আশার মধ্যে একটুও অন্যায় নেই। অন্যায় করেছে কাশীনাথের দরিদ্র কপালটা।

সকালে ঘুম থেকে বের হয়েই সোজা মানিকদার কাছে গিয়ে পঞ্চাশ টাকা ধার করে নিয়ে রঙিন একটা বেনারসী কিনে রেণুকার হাতের কাছে রেখে দিল কাশীনাথ। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে দেখল, সেই বেনারসী মেঝের উপর পড়ে রয়েছে, আর মামা-মামির সঙ্গে বসে গল্প করছে রেণুকা।

রেণুকাকে একবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চায় মামা ও মামি।

ভাদ্দর মাসটা পার করে দিয়ে আশ্বিনটা পড়তেই ফিরে আসবে রেণুকা।

কাশীনাথ হেসে হেসে বলে, ‘ বেশ তো।’

এই বেশ তো’ই কাশীনাথের জীবনের শেষ হেসে বলা কথা। আর এই তিন বছরের মধ্যে রেণুকার সেই সুন্দর মুখের ছায়াও দেখতে পায়নি কাশীনাথ।

রেণুকাকে আনতে গিয়েছিল কাশীনাথ। বন্ধ দরজার সামনে শক্ত হয়ে বসে মামা-মামি বলে, ‘আমাদের মেয়ে বড়ো ভয় পেয়েছে বাবাজীবন। এই চারটে মাস তোমার ঘরে একদÐ ঘুমোতে পারেনি।’

‘কেন ?’

‘তোমার ওই কুচ্ছিত মুখ কাছে দেখতে পেলে কোন মেয়েই বা ভয় না পাবে বলো ?’

‘রেণুককে একবার ডেকে দিন।’

‘আসবে না রেণু, তুমি যাও।’

‘খবরদার, বাজে কথা বলবেন না।’

মামা-মামি একসঙ্গে গর্জন করে, ‘যা রে যা, খবরদারের বেটা। তোর মতো অমন মুখপোড়া কত সেয়ানার কত খবর করে ছেড়ে দিলাম, আজ এসেছিস তুই দাঁতে দাঁত ঘষে ভয় দেখাতে ?’

ফিরে এল কাশীনাথ। তারপর এক সন্ধ্যায় মানিকদাকে সঙ্গে নিয়ে কালীঘাটের বস্তির সেই ঘরের বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে হাঁক দিল, ‘রেণুকা !’

কোনো সাড়া নেই। গলা ফাটিয়ে হুংকার দেয় কাশীনাথ, ‘বের হয়ে এসো রেণুকা, নইলে দরজা ভেঙে ঘুরে ঢুকব।’

দরজা খুলে গেল, বের হয়ে এলো বুড়ি : ‘তারা এখানে নেই। ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে।’

‘কোথায় গিয়েছে ?’

‘জানি না।’

যেন আগুনের কামড় লেগেছে একেবারে বুকের ভিতর। কটকট করে জ্বলতে শুরু করেছে একটা ফোসকা। কাশীনাথের পোড়া মুখটাকে ঘেন্না করে পালিয়ে গিয়েছে সুন্দর মুখের মেয়ে।

আর অপেক্ষা করেনি কাশীনাথ, শুধু একটা প্রতিজ্ঞাকে মন-প্রাণ দিয়ে তিন বছর ধরে পুষে এসেছে। প্রতিশোধ নিতে হবে, এমন প্রতিশোধ যে, দেখে ভগবানও ভয় পেয়ে যাবে।

ধারালো ছুরি নয়, মিষ্টি বিষও নয়, অ্যাসিড-ভরা একটা শিশি তিন বছর ধরে কাশীনাথের জামার পকেটে প্রতিশোধ নেবার প্রতীক্ষায় যেন ওঁত পেতে আছে। দেখা কি কোনোদিন হবে না ? যে-মুহূর্তে দেখা পাওয়া যাবে, সেই মুহূর্তে তার সুন্দর মুখের উপর অ্যাসিড ছুঁড়ে মারবে, তারপর চেঁচিয়ে হো-হো করে হেসে উঠবে কাশীনাথ। প্রাণে নয়, রূপে মেরে দিয়ে ওই মেয়ের জীবনকে কুকুরের চোখেরও ঘেন্না করে ছেড়ে দিতে হবে।


আরো পড়ুন: সুবোধ ঘোষের গল্প সুন্দরম


ভুলতে পারা যায় না, সেই মেয়ের সেই সুন্দর মুখ। লম্বা বিনুনী দোলে, কানের কাছে চুলগুলি আংটির মতন পাকিয়ে রয়েছে। গাল দুটো একটু ফোলা-ফোলা, সুডোল গলায় শাঁখের মতো পর পর তিনটে খাঁজ, তার মধ্যে সাদা পাউডারের রেখা ফুটে থাকে। সেই মূর্তিকে এই পৃথিবীর কোনো আগুন-লাগা ঘরের মধ্যে কি দেখতে পাওয়া যাবে না ? পাওয়া যেতেও তো পারে। যদি পাওয়া যায়, তবে হাসতে হাসতে দু চোখ ভরে দেখে শান্ত হয়ে যাবে কাশীনাথের প্রাণের সব জ্বালা। অ্যাসিড ছুঁড়ে মারবার দরকার হবে না। পোড়া সাপের মতো ছটফট করে মরে যাবে সেই রূপের অহংকার, রেণুকা নামে একটা ঝলসানো লাশ তুলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির দরজার কাছে ফেলে দেবে কাশীনাথ।

না, ভাবতে ভুল করছে কাশীনাথ। মরতে দেওয়া চলবে না। মরে গেলে তো ঠিক শাস্তি পাওয়া হলো না। বাঁচাতে হবে সেই মেয়েকে। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর হেসে হেসে দেখতে হবে, সেই দেমাক-ভরা রূপের নাক-চোখ আর ফোলা-ফোলা গাল চর্বির বড়ার মতো ঝলসে যাচ্ছে। তারপর টেনে তুলে বাইরে নিয়ে বাঁচিয়ে ফেলতে হবে। তারপর সেই মেয়েকে একটা নতুন আয়না উপহার পাঠিয়ে দেবে কাশীনাথ।

চমকে ওঠে কাশীনাথের চোখ। ক্রু-মাস্টার চমকে উঠেছে। তিন তলার একটি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে একটি মেয়ের মূর্তি। পাশের ঘরের জানলাটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঘরের ভিতরটা লালচে আভায় রঙিন।

‘বাবা গো, বাঁবাচও গো।’

তীব্র আর্তনাদ, যেন পুড়তে পুড়তে ঠিকরে বের হয়ে আসছে একটা আবেদন। ক্রু-মাস্টার হাঁক দিলেন, ‘রেস্কু্যু।’

তবে কি ভগবান সুযোগ পাইয়ে দিলেন ? দাঁতে দাঁত ঘষে কাশীনাথ।

অ্যাসবেসটসের আংরাখা, টাঙি, তারের দড়ি আর অক্সিজেন। এক মুহূর্তের মধ্যে সব সরঞ্জামে পাতলা শরীরটাকে সাজিয়ে নিয়ে চকচকে ইস্পাতের টার্ন টেবিল মইয়ের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়ায় কাশীনাথ।

মইটা যেন একটা অপার্থিব জিরাফের লম্বা গলা। তিনতলার জানালার দিকে লক্ষ্য রেখে টান হয়ে বেড়েই চলেছে। উঠছে নামছে আর দুলছে মই। বেল্টের সঙ্গে বাঁধা হোসের মুখ এক হাতে চেপে ধরে আগুনের হলকার দিকে যেন ভেসে ভেসে এগিয়ে যেতে থাকে কাশীনাথ। ভিড়ের গলা থেকে বিস্ময়ের চমক শিউরে ওঠে, ‘সাবাস ! সাবাস।’

জানালার একেবারে কাছে এগিয়ে এসেছে মইয়ের মাথা। থরথর করে কাঁপতে থাকে কাশীনাথের চোখের আগুন। দু’ ইঞ্চি মনিটর জেট ভয়ঙ্কর তোড়ে আছাড় খেয়ে জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর পড়ছে। জলের সেই প্রচÐ ও পাগলা আঘাতের মার খেয়ে ফিকে হয়ে যাচ্ছে ঘরের লালচে আভা। আগুনের জ্বালার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘরের ভিতর যেন কুয়াশা নেচে বেড়ায়। তারই মধ্যে দেখতে পেয়ে দপ করে হেসে ওঠে কাশীনাথের চোখ। মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ছে, ছটফট করছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে শুধু সায়াপরা একটি মেয়ের মূর্তি। লম্বা বিনুনী দোলে, কানের কাছে আংটি করা চুলের গুচ্ছ নাচে, ফোলা-ফোলা গাল, বড় বড় সুর্মার টানে আঁকা চোখ। আজ আর তোমার পালিয়ে যাবার উপায় নেই রেণুকারানী, সুন্দরী !

মুখোশ পরে নিয়ে অক্সিজেনের টিউব খোলে কাশীনাথ। ‘সাবাস ! সাবাস !’ Ñভিড়ের মানুষ আশ্চর্য হয়ে চিৎকার করে। উড়ন্ত চিতাবাঘের মতো জানলা টপকে ঘরের ভিতর ঢুকে কাঁপতে থাকে কাশীনাথের শরীরটা, সেই সঙ্গে বুকের ভিতর তিন বছর ধরে পোষা প্রতিহিংসাটাও।

‘কেমন ? পুড়ে মরতে বেশ ভালো লাগছে ?’ চেঁচিয়ে ওঠে কাশীনাথ।

‘না গো না, একটুও না। মরতে চাই না। বাঁচাও, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে বাঁচাও, বুক জ্বলে যাচ্ছে, দাঁড়াতে পারছি না, ওগো ভগবান গো !’

‘স্বামীর বুক জ্বালিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় বুক জ্বলেনি ?’

‘ওগো, বড্ডা ভুল করেছি গো। বড্ড শাস্তি হয়ে গিয়েছে গো। আমাকে ক্ষমা কর গো।’

ঘর-ভরা আসবাব, পালঙ্ক মিরর আর কাচের আলমারিতে রকমারি রুপোর ও তামা-কাঁসার জিনিস। রেণুকার গা-ভরা গয়নার স্বপ্নও সফল হয়েছে। গলায় তিনটে সোনার হার, হাতের চার আঙ্গুলে চারটে আংটি। সাচ্চা সোনার জরি দিয়ে জড়ানো বেণী। বাঃ !

‘কিন্তু আমি তোমাকে বাঁচাবো কেন গো ? ভগবানকে ডাক গো ! সে এসে তোমাকে বাঁচাক গো !’

‘তুমি বাঁচাও। তুমি আমার স্বামী, তুমি আমার ভগবান।’

বিনুনীতে আগুন ধরেছে, সায়ার লেসগুলি জ্বলতে শুরু করেছে। দু’হাতে মুখ ঢেকে চেঁচিয়ে ওঠে  কাশীনাথের জীবনের অভিশাপ, সাপিনীর মতো সেই বিষ-ভরা সুন্দরী মেয়ে।

‘ক্ষমা কর গো, আর জীবনে পাপ করব না গো। তোমার পায়ে পড়ি, আজকের মতো প্রাণটা বাঁচিয়ে দাও।’

বাঁচাতে হবে বই কি। এক লাফ দিয়ে এগিয়ে আসে কাশীনাথ। টাঙির এক কোপে জ্বলন্ত বিনুনিটাকে টুকরো করে কেটে ফেলে, এক থাবা দিয়ে সায়াটাকেও ছিঁড়ে দূরে ছুঁড়ে দেয় কাশীনাথ।

আবার চেঁচিয়ে ওঠে কাশীনাথের জীবনের সেই সুন্দর-মুখ দুঃস্বপ্ন : ‘দয়া কর গো, আমার মুখটাকে বাঁচাও গো ! ওরে বাবা রে !’

মুখের রূপ বাঁচাবার জন্য প্রার্থনা করছে রেণুকা।

মুখোশের ভিতর হঠাৎ জ্বলজ্বল করে ওঠে একজোড়া আক্রোশের চোখ। অ্যাসবেটসের ঢাকার আড়ালে টলমল করে ওঠে একটু বুক। কাশীনাথের জীবনের সেই হিংস্র আর জ্বলন্ত প্রতিজ্ঞাটার বুকের উপর যেন দ’ু ইঞ্চি মনিটর জেট আছাড় খেয়ে পড়ছে, ভিজে যাচ্ছে আগুনের জ্বালা।

‘এসো !’- দু হাতে সাপটে সেই ফোটা ফুলের মতো নগ্ন ও নরম আর পাউডারের সুগন্ধ মাখানো একটু সুন্দর শরীরকে বুকের উপর তুলে নেয় কাশীনাথ।

পটপট করে অ্যাসবেসটসের আংরাখার বোতাম ছিঁড়ে চেঁচিয়ে ওঠে কাশীনাথ, ‘আমার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দাও, নইলে হলকার আঁচ থেকে তোমার মুখ বাঁচবে না।’

হ্যাঁ, এতদিনে ফিরে এসেছে রেণুকা, এই আগুনের নিষ্ঠুর উৎসবে একেবারে মিষ্টি করে দিয়ে রেণুকা আজ স্বামীর বুকে মাথা লুটিয়ে মুখ গুঁজে দিয়েছে।

বুকে জড়ানো সেই মূর্তিকে তারের দড়ি দিয়ে চার পাক ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, এক লাফে জানলার কাছে সরে আসে কাশীনাথ। মইয়ের মাথায় পা দেয়। ভিড়ের হাজার মানুষ উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে। জ্বালাভরা রঙিন ধোঁয়া আর ছাই ছড়ানো এক চিতার জগৎ থেকে সেই মুহূর্তে যেন একটা গোঁত্তা দিয়ে সরে যায় ইস্পাতের মই। কৃতার্থভাবে ঠুংঠাং করে বাজতে থাকে নিচের ক্রেনের শিকল।

অ্যাম্বুলেন্স ! কাশীনাথের ফিরে পাওয়া স্বপ্নের মূর্ছাহত শরীরটাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে চলে গেল অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি।



সেদিন ডিউটি থেকে ছুটি। মানিকদা সঙ্গে এসেছেন, কাশীনাথের ছোট ঘরের ভিতর যেন একটা আনন্দের গন্ধ থমথম করে। একটি বোতল, দুটি গেলাস আর মুড়ি-পেঁয়াজ। মানিকদা শুনে আশ্চর্য হন :  ‘সে কি রে ?’

কাশীনাথ শুনে হাসে, ‘হ্যাঁ মানিকদা। ও-মেয়ে রেণুকা নয়। অনেকটা রেণুকারই মতো দেখতে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, এক বাবুমশাই এসে মেয়েটির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবুর গলায় সোনার হার, সঙ্গে গাড়িও আছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, বাবুর মুখটা আমার এই পোড়া-মুখের চেয়েও অনেক কালো আর অনেক কুচ্ছিত।’

মানিকদা  অস্বস্তির হাসি হাসেন : ‘যাচ্ছলে ! এত বড় আশাটা মিথ্যে হয়ে গেল !’

কাশীনাথ হাসে : ‘না মানিকদা, একটুও মিথ্যে হয়নি।’

মানিকদা আশ্চর্য হন : ‘তোর মনে হঠাৎ এত ফুর্তি চমকে উঠল কেন রে ?’

‘আর তো কোন দুঃখ নেই। ওই এক মিনিটের মধ্যে সবই পেয়ে গিয়েছি। আর খোঁজাখুঁজি করে দরকার নেই।’

‘তার মানে ?’

‘তার মানে, ওই তো। প্রতিশোধ নেওয়া যায় না রে দাদা। টপ করে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে হয়। আমি মুখপোড়া হলেও বুকপোড়া তো নই, মানিকদা।’

মানিকদা গম্ভীর হন : ‘তা ঠিকই বলেছিস।’

হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে কাশীনাথ : ‘এই শালা মালের বড় তেজ আছে মানিকদা, দু’চুমুকেই চোখ ধরে গিয়েছে।’

‘বেশি খাসনি।’

আস্তে আস্তে কথা বলে কাশীনাথ, ‘কি যেন সেই গানটা, তুমি মাঝে মাঝে যেটা গাও মানিকদা ?’

মানিকদা হাসেন : ‘আগুন আমার ভাই, আমি তোমারই জয় গাই।’

‘বাঃ, বেড়ে গানটি। সত্যি, মাইরি খুব সত্যি, মানিকদা।’


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত