শিউলি রোদ্দুর
তখন ক্লাস এইট। বড় হয়ে ওঠা আর ছোট থাকার মাঝামাঝি এক দোলাচল তখন আমার শিরাতে, ভ্রূপল্লবে, চোখের তারায়। একদিকে ছেলেমানুষী ফ্রক ধরে ঝুলে পড়ে আছে, আর বয়ঃসন্ধি প্রবলভাবে বালিকা স্টেটাস অস্বীকার করতে চাইছে।তখন ক্লাস এইট।মায়ের ব্লাউজ টেকে নিয়ে উঁচু করে শাড়ি পরা পৃথিবীর সবচেয়ে লোভনীয় চাহিদা।
তখন চোখের চারপাশে মায়াবী কাজল বোলাতে শিখে নেয় শিহরিত আঙুল।কটাক্ষে ঘায়েল করার ছলাকলা রপ্ত না হলেও হাতেখড়ি হয়েছে।তখন ও লিপস্টিক একটু আধটু ধেবড়ে যায়।সেজে বেরোলে বেশ কয়েকঘন্টা পরে কাজল-লিপস্টিক-ঘামে একাকার হয়ে মুখটা বেশ সঙের মতো দেখতে লাগে।তখন ও স্মাজপ্রুফ চেনেনি এ চোখ।তখন ও স্মোকি আইজ ছাড়াই লোকে নেশায় পড়ছে।তখন ও কোন রকম উদ্ভিন্ন শরীরী আকর্ষণ ছাড়াই ফ্রকে-মিডিতে সরল বিচরণ।পুজো আসা মানে বছরের তিনদিন শাড়ি পরার মধ্যে একদিন এসে পড়া-অষ্টমী।অন্যদুটো দিন সরস্বতী পুজো আর শিবরাত্রি(যদিও আমি শিবরাত্রির উপোস করতাম না, পিসিদের সঙ্গে সেজেগুজে থাকতাম।)
অষ্টমীর দিন ভোর ভোর উঠে সাজো সাজো রব পড়ে যেত।মা, কাকিমা, জেম্মা সবাই চেঁচাচ্ছে…”ওরে , অঞ্জলির সময় চলে যাবে, তাড়াতাড়ি স্নান কর। আমিও একটু সুযোগ পেয়ে ভাইবোনেদের তাড়া লাগাতাম, একটু বকুনির সুর থাকতো তাতে।তারপর স্নান হলো তো,শাড়ি পরা একটা বিশাল পর্ব। হার, কানের দুল-সব রাখা থাকত।এখন শাড়ি পরে, কাজল , লিপস্টিক , ছোট্ট টিপ পরে বেরোতে হবে।তখনো কমপ্যাক্ট আসেনি আর কাছে।বড়ি পাউডার লাগাতাম আমরা মুখে। তারপর হাতে সন্দেশ, ফলের থালা নিয়ে ছুট। দাদু নাম লিখে সন্দেশের প্যাকেটে।তখন ক্লাস এইট।
প্যান্ডেলে ঢুকেই একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া কিশোর সঙ্ঘের কটা ছেলে ব’সে।এমনভাবে চোখ বোলানো যাতে ধরা না পড়ে যাই।”বাবা কী সুন্দর সেজেছিস!
পাড়ার কাকিমাদের কবল থেকে উদ্ধার করে টুম্পামামণিদের ডাক ” এই দিকে এসে বস।” কোনমতে থালাটা ঠাকুর মশাইয়ের কাছে পৌঁছিয়েই চলে যাওয়া বন্ধুদের কাছে।অকারণ হেসে গড়িয়ে পড়া। আজ সেসব আলোচনার টপিক ভাবলে হাসি পায়। তখন ক্লাস এইট। তখন মন বোঝেনি জটিল অঙ্ক আর চোখ শেখেনি কাটাকুটি খেলা।তখন ও গালে গড়িয়ে পড়ে সারল্যের রূপটান, আর মাঝখানের টোল টাতে রাখা কিছু মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ।অষ্টমীর অঞ্জলির ঘোষণা শুরু হয়ে গেল। ” এই চল্ চল্। সামনের দিকটায় দাঁড়াই গিয়ে। পিছনে পরে বড্ড ভিড় হবে।’
‘উফ্। আঁচল টানিসনা। সেফটিপিনে ছিঁড়ে যাবে।”
লাল-নীল-হলুদ শাড়ি এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতি দাঁড়ায় লাইনে।কিছুক্ষণ পরে ভিড় ঠেলে পিছনে এসে দাঁড়ায় দুই হলুদ পাঞ্জাবি, সদ্য ওঠা গোঁফ। অঞ্জলি শুরু হয়। প্রথমবার মাথার উপরে ফুল পড়ে। ভুল ক’রে? দ্বিতীয়বার। তৃতীয় বার ও। তখন ক্লাস এইট অঞ্জলির প্রার্থনামন্ত্র বদলে যেতে থাকে মনে মনে। তখন প্রথম শাড়ি। মাথায় গাঁদা ফুলের পাপড়ি নিয়ে আসে অন্যরকম শরৎ।তখন চুপিসারে ভিড়ের মধ্যে আঁচলে টান, আর ভীষণ বিব্রত দুটো চোখ। তখন আশ্বিন…মনে কৈশোর আর শরীরে বয়ঃসন্ধি।তখন কৈশোর। তখন সব- ভালো, কী ভালো..কী ভালো !
এখন চল্লিশ-মনের মধ্যে এস্রাজে বাজছে ফেলে আসা ক্লাস এইট, কথকতা, অলিগলি, মফস্বলী দুপুর, মখমলী স্মৃতির আশ্বিন। কোন তাড়া নেই প্যান্ডেলে যাবার।

জন্ম ২১ মার্চ,১৯৭৮। নৃবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। ছোট বড় লিটিল ম্যাগাজিন থেকে বিভিন্ন সংবাদপত্র, পত্রিকা ও ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখেন। আবৃত্তি ও উপস্থাপনায় সমান জনপ্রিয়।