| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: লাউমাচা । শুভশ্রী সাহা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
বলি ও মুখপোড়া  উটবি  নাকি গায়ে জল ঢেইলে দুব! দুনিয়ার নোক কাঝে চল যায় তুই নেপের মধ্যে আড়ি খাচ্চিস একুনো! 
সনকা বুড়ি  চেঁচিয়ে উঠল তার বড় নাতিকে
— কী করব কি শুনি সাত সকালে উটে ? সারা রাত তো তোমার ছেলে বউতে  চিল্লেমিল্লে হেগে মুতে একসা করেচে  তকুন তুমিতো  মটকা মেরে পড়েছিলে বুড়ি 
— হ্যাঁ তা তারা তো সারা রাত চিল্লে সাত সকালে উটে মাগ ভাতারে  বেইরে গেল 
 মাগ ভাতারে তেকুন খুব মিল না!  টেশনে দুঝনা দেক গা  গিয়ে কমনে  দুকান গুচোচ্চে   নলে তুই  গিলবে কি! বলদা কুতাকার! 
ঘর থেকে উঠে দাওয়ায় বসে পিচিক করে থুতু ফেলল পাঁচু।  ভালো নাম তার ঠাকমা পঞ্চানন  দিয়েছিল  কবে কমনে কে জানে  একুন ইস্কুল ও নেই নামও  গেচে চুলোর দোরে! 
 
— চা দাউ দিনি মেলা না চিল্লে  বাসি রুটি  থাকলে দিও এট্টা  গুড় আচে না? 
 
— বসে বসে গেলো  খালি  বুড়ি ঝাঁঝিয়ে উঠল
 
— কি বসে বসে গেলো ?  দুদিন আগেই ভুবন ডাক্তারের  নাসসিং হোম  ঝাঁ চকচকে করে এসেচি সেই টাকা তোমার ছেলের বউ হাতিয়ে নেলো  শালী  মা না ছাই! আর বর যে রাতের বেলা প্যাকেট মারচে তার বেলা কিচু না!  শালা একটা পারমেট কাজ পেয়ে গেলে বসে
  থাকপ নাকি একেনে ! 
–যা  যা যমের বাড়ি যা তুই   দাওয়া থেকে ভাঙা গলা ভেসে এলো!  ভয় দেকাচ্চিস কারে? দোরে দোরে ঘুরতি হবেনে!  হু: 
 
বুড়ি কাঠের জ্বালে চা করছিল এরপর ভাত তরকারি  পর পর বসবে।   নিজের শুকনো খড়ি ওঠা শিথিল চামড়ার হাত দুটোও সেঁকে নিচ্ছিল আগুনে  মাঝে মধ্যেই। রেললাইনের ধারে ঘর  নিচু চালার দুটো,  চায়ের ভাঁড়ের  দাওয়ায় রান্না হয়। ভাঁড়ের দাওয়া পেরোলেই  মুখোমুখি  অন্যের ঘর।  এ চালা ও চালার মধ্যে বায়ুত্যাগের  আওয়াজও  শোনা যায় । ঠান্ডা পাবার তেমন জো নেই  তবু  টিনের চাল ঠান্ডা হয় শেষরাতের  ঘন  কুয়াশায়।  ট্রেন যখন তীব্র গতিতে ছুটে বেরিয়ে যায় কাঁপতে থাকে তাদের গোটা সংসারটাই  । গুড়ি মেরে তাক থেকে ডালডার কৌটো নামাল বুড়ি   নেড়ে চেড়ে দেখল কয়েকটা  ডেলা  পড়ে আছে গুড়।  সাহাবাড়ির থে দিচিল। গেল শীতি ওদের মেয়ের আতুরের ঘরে কাঁথাকানি কাচাকাচি করেছেল কিনা! নাতিকে একডেলা দিল  সে পাঁচু  রুটি আর ভেলিগুড়  খেতে খেতে ভাবছিল  কিছু না হোক ভুবন ডাক্তারের নারসিং হোমের  টলেট ক্লিলিনারের কাজটায় ভিড়ে যাবে  পোরো সভার  কাঝে  কোনো চমক নেই নোংরা ঘেটে মরো আর খিস্তি খাও পাটি অপিসে! হোক কম পয়সা তেবু  একেনে ঝা চকচকে নারসিং হোম আর সিস্টার দিদিগুলোকেও হেব্বি দেকতে টকাটক ইংলিস ঝাড়ছে   শালা  মাঝে মাঝে দু:খ হয়  মাইরি  জীবনটা পুরো ফুটো হয়ে গেল । মায়ের গোঙানি আর বাপের হাঁপানি শুনতে শুনতেই লাথখোর জীবনের  বাকি রাতগুলো কেটে যাবে ।  বোনটা কবে রেল কলোনির মোজেক মিস্তিরি সবিতার বরের সঙ্গে পালিয়েছে  ব্যস আর এদিক মারায় না। এলে অবস্য সবিতার দাদা ধড় নামিয়ে নেবে বলে রেখেছে  সে মরে আছে না বেঁচে  বাপ ভগায় জানে!  তাও ভাগ্যি তার মা মারধোর খেলেও নাড়ি বেঁদে নিয়েছিল নয়ত ক গন্ডা এন্ডিগেন্ডি হত কে ঝানে! তবে তার মা টা হেবি নিজেকে ভালোবাসে টেশনের বলাই কাকা সুবল কাকু অটো রামুর সামনে হেসে হেসে গড়িয়ে পরে কেমন বাচ্চা মেয়েদের মতো পাঁচু  হাঁ করে রঙ্গ দেখে তার —  বাপ কম কেলায়   বলে রঙ ঢঙ দেকানো বাজারে মেয়েছেলের কোতাকার!  ঠাকমাও  আড়ালে বলে ঢেমনি কিন্তু সামনে বললে চেঁচিয়ে লোক জড় করে নেবে বেটি! টাকার পিচেশ মা টা  একদম মাইরি  বাপও চেঁচায়    তবে বাপের সব  হিরোগিরি প্যাকেটের ঝাঁঝে  প্যাকেট শেষ  হলে তকন কুঁইকুঁই চলে প্রেম পাবার জন্য! মার লাথি দুটোকেই! 
  বলতে বলতেই ঠাকমার আওয়াজ ভেসে এল
এইবার উটবি না কি ওইভাব পাতরের মত বস থাকপি! ও পাঁচু  
— পাঁচু  মনে মনে খিস্তালো! 
বুড়ি চালার পেছনে লাউদানা ফেলেছিল আপনা আপিনিই ফলফল করে ছুটে গোটা চালা জুড়ে ফেলেছে লাউ ধরেছেও কয়েকটা গাছটার গায়ে  এখনও ভিজে  কুয়াশায়  বুড়ি হাত বুলাচ্ছিল গভীর মায়াতে —  এই শীতে কি নাউ ধরবে ?  সে কি  বাঁঁচবেনে  পরের শীতে  না হোক   ছেলে বউ নাতি ওরা তো আচে ভরা মাচা তার  — সংসারে কোনো শীত কি  বেথা যায়  কত শীত হাঁটা চলার পর   এই চালা সে কত্তে পেরেচে। মায়ে পোয়ে মিলে সেই  ধুচনেখালিতে থে এসে পড়েচিল এর ওর পায়ে ধরে এই টেশনের চালাতে এসে  উটল কত ঘাটের জল খেতে হয়েচে এমুন কত শীতে ভোর বেলা কুড়োনরে  ক্যাতায় মুড়ে নে মাটের কাজে গেচে, ককুনো আবার লোকের দোরে  তাও ভাগ্যে হারামীটা এট্টাই পেটে দিচিল  তাল বুঝে  ছেলে নে বেইরে এসেচিল  নইলে শাউরি ধোপার পাটায় ফেলে আছড়াত নয়  মিন্সেটা  খুন করে রাকত   বুড়ি শ্বাস ছাড়ল।  এই পোষের শীতেই সে পাইলেছেল ভিটে থে এ কতা সে আর তার ব্যাটা ছাড়া কেউ জানেনি একেনকারে।  মায়ে পোয়ে  এলেঝেলে কত কাঝ কাম করেচে বিচের করেনি, খেটেচে  তাপ্পর  পাটিরে ধরে ভুটার কাট রেশন কাট   কুড়নের  ওই  টেশনের পেলাটফরমে চা  রুটি ঘুগনি কচুরির গাড়ি  , সপই করেচে। কম নোকের পায়ে ধত্তে তে হইচে সে ভগমান ঝানে!   একুন  তারা কাগঝ পত্তরও সপ জমা দেচে সরকার থে বাড়ি করার টাকাটুক যা দেচ্চে এই রক্কে। ঝাই দিক মিলি মিশি এককান পাকা ভিটের মতলবে আচে  মায়ে বেটায়!  এই গোবরার জাত নাতিটা হদ্দ কুঁড়ে  গায়ে গতরে এক্টুস খাটলেই হইয়ে যেতো বাব মার পাচায় শুইয়ে কি পরের বাড়ির মেইয়ে আনতি পারবি? মনে পড়তেই বুড়ি চেঁচাল   ও পাঁচু বলি উটবি ? দাওয়ায় না বসে  নাচ্ছিং হোমের দোরে দাঁড়ালেও তো এট্টা কাঝ জুটে যায়  তো নাকি!  বুড়ি আগড় বাগড় কলা ঝোপ পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।  কুয়াশা কেটে রোদের ফিনকি বেরোচ্ছে   এই জায়গাটা আগে কী ছিল!  হদ্দ গেরাম শ্যাল ডাকত রেতে  দিনি মানেতেও  আর একুন দেকো চকমকি আলো  খাওয়ার দুকান  ঝামা কাপড় বাঝার সপ জমজোমাট। এট্টা লয়  মেলা  দোরদালান দেওয়া বাড়ি!  বুড়ি শ্বাস ছাড়ল! 
— ও মাসি  সাত সকালে চিচকার দেচ্চ তুমি আর রেতে  কুড়োন দা আর বউদি মিলে ফাটাচ্চে ভালা শুরু করেচ দেখি তোমরা! ভ্যান হারান ঘর থেকে বেরোলো।  পাঁচুদের মুখোমুখি  ঘর আর দাওয়াটা তাদের,  উঠোন কল আর পায়খানাটা দুঘরই ব্যবহার করে। পাঁচুর বাপ কুড়োন তাও পেছনে একখানা কোনমতে আলাদা পায়খানা করে নিয়েছে জায়গা কই যে হবে! তাও  বউ অলকা অন্যের হাগার উপর নাকি হাগতে পারে না ঘেন্নায়  তাই করতে বাধ্য হয়েছে।  
— তা তুমি বাপু যকুন জুয়ো খেলে ঘরে ঢোকো তোমার মাগ বুজি উলু কাড়ে? বুড়ি  ভেঙিয়ে নিয়ে বলল ।  হারানের বউ চাঁপি তীব্র চোখে তাকালো বটে কিন্তু কিছু বলতে সাহস করল না  পাঁচুর মা অলকা তাকে অভাবের দিনে দু পাঁচ টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করে  টোটো আসার পর ভ্যানের বাজার খারাপ হয়ে গেছে অনেক   ওই মাল টেনে দু চার পয়সা যা হয়  নয়ত সওয়ারি আর কই তেমন?   সে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।  সনকা বুড়ি কী কম বজ্জাত  দেবে লাগিয়ে   ঠিক  অলকার কানে বুড়ির রুখো  চুলগুলো শনের মত উড়ছে কপালে — কপালের উপর দিয়ে চলে গেছে অজস্র  শীতকালের  কড়া ভাঁজ   তামাটে রঙ কবে হয়ত কচি কলপাতা ছিল  তবু   এখনও কাটা চিবুক  তীক্ষ্ণ নাক পানপাতা মুখের আভাস স্পষ্ট। ভোরের গায়ে সরমাখা কুয়াশা দিনে সে ব্যাটারে নিয়ে বকুল বৈরাগীর সঙ্গে শ্বশুরের ভিটে ত্যাগ করেছিল  সে তো বৈরিগি নোক  তাকে বাঁদার  ক্ষ্যামতা সনকা মিদ্যার ছিল না কিন্তু সেই দিনের কথা মনে পড়লেই   বড় হিম লাগে  গায়ে   উদ্দার  করিছিল বটে বৈরাগী নয়ত তার ডাকাতে বর বেবাক  খুনই করে দিত মায়ে ব্যাটারে।  ভুটভুটি পার হয়ে ন্যাঝাট  সেখান থে কত ঝায়গার কতক ঘাটের জল খেয়ে এই বারাসাতের হৃদয়পুর এসে তারা ঠেকেচে  সে কী আজকের কতা   দেক্তি চিকণ ছেল বলে  মিন্সেরা  কম তো ঝালাই নে তারে   অগতে পড়ে এই বেদবার বেস সে নেচে তা  মরুক গা! কী তার সোয়ামি কী তার ব্যাভার সাত গায়ে ডাকাতি করা নোক আহারে! তেবু রক্কে বৈরাগীকে কেটে দুখানা করে নিকো!  বৈরাগী একেনেও আসতো তাদের কাচে  কুড়ান মামা বলেই মানতো  কে ঝানে বচর খানেক তার আর কুনো খবর নেইকো। বুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলল  ভাগ্যে সে বেইরেছিল ছেলেটা ভালো আচে অলকার ম্যাজাজ মতি গরম কিন্তুক কাঝ কত্তে উস্তাদ দিব্য কুড়ানরে মতি কইরে নেচে । নাতিটাও একরকম কাচে আচে  সুদু  নাতনিটা  পচা পাঁকে পা  দুটা বসাইচে  কর্মফল কর্মফল  নাতো  আবাগির বেটি বিয়েত নোকের হাত ধরে মত্তে!  মার খ্যাংরা পেমের মুকে!  ঠাগুর করে ঘরটা উটুক জমি টুকুনে   দেকে শুনে পাঁচুর বে দিতি হপে!  কে ঝানে কমনে সে বাঁঁচবেনে  মেয়েজম্মে সপ কইমাচের পেরান ওইটুক ঝা ভসসা।  বুড়ি খানিক পাতা গুঁজে দিল দাওয়ার উনুনে  ভাত তরকারি  কত্তে কত্তেই  কুড়ান এক ফাঁকে  বাঝার দে চলি যায়!  বড় ভাতের হাড়ি বসাল সে  পাঁচুটার খিদা বেশি ও চাড্ডি  খাবে আবার বাপ মার ঝন্য নে যাপে টেশনে—  অলকা বেটির আবার মুকের তার আচে শাক ভাত সে খাবে নে শীতির  পল্লে তো হলো  মুরগী পাঁটা শুয়োর কাছিম কিচুই বাদ যায় নে ছাট মাট সপ খেয়ে সাবড়ে দেবে!  হবে নে বেটির কী সান্ডিল্য গতর দেকো একাই ভিড়ির মদ্যে নোক সামলে নিতি পারে  মেলা কচুরি বেলে দেবে নে এক ফিরোনে!   ভাত নামানোর জোগাড় হতে বুড়ি পিছন ফিরতেই দেখে ছেলে বাজারের ব্যাগ  হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার পিছে ছেলের  বউ অলকা 
—  বুড়ি চমকে উঠে বলল ওমা তোরা আঝ দুঝনা এয়েচিস যে!  দুকানে কে আচে?   
কুড়োন মিদ্যা বসে পড়ল মায়ের পাশে তার চোখে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি 
— কী হইচে মণি?   নাতনিটার জন্য তার পেরানটা পোড়ে   কুডাক ডেকে উঠল মনে 
— অ কুড়োন আজারের মতুন বসে আচিস বলি কিচু কি হইচে নাকি? অ বউ  কি হলো রে —অলকা  নিচু  হয়ে পিঠে হাত রাখতেই ছেলে বলে উঠল 
মা বৈরেগি মামা এয়েছিল দুকানে  বাপ  মরে গিচে গতকাল 
সহসা কথা বন্ধ হয়ে গেল সনকা বুড়ির 
বাপ’  মানে কুড়ানের মিদ্যার  বাপ?  উঠে দাঁড়িয়ে   চিৎকার করে  উঠল  আকাশ ফাটিয়ে
হারামজাদা!  তোর বাপ বেঁচে ছিল বুজি  এতডাকাল? 
 
অলকা কিছু একটা বলতে যেতেই  বুড়ি  বলল 
কচি নাউডোগা পেরিচি  দ্যাখ দেকি  কুচো চিংড়ি  পাস নাকি এট্টুস!  অলকা চুপ হয়ে গেল 
 
কচি লাউডগাটার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে সে ফিসফিসিয়ে  বলতে লাগল  কে ঝানে কমনে  পরের শীতি হয়ত আমিও  তোর বাপের মতুন  —  গাল বেয়ে নেমে এল শীর্ণ  জলধারা  —
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত