| 27 এপ্রিল 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

জলাভূমির ছোট্ট কচ্ছপ

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

বান্দরবানের সিংপাতে আছে এক বিশাল জলাভূমি। শেওলা আর কাদামাটির মরা ঘাসের ওপর বিবর্ণ হলুদ একটা আস্তরণ পড়েছে। উষ্ণ বাতাসের সঙ্গে পলাশের একটা বীজ পাক খেয়ে নিচে পড়ল। আস্তে করে পড়ল ওটা শেওলার ওপর। সামান্য ভেজা শেওলা একটু কেঁপে আবার স্থির হয়ে গেল। পুরো জলা এলাকাটার কেমন যেন সোঁদা গন্ধ। এলাকার পুরোটা অংশ একেবারে ভেজা ভেজা। হঠাৎ একটা ছোট্ট বাদামি রঙের মাথা জলার ওপর উঠে এলো। রোদ লাগতেই গভীর কালো চোখ দুটো পিটপিট করল। বাহ্, ছোট্ট কচ্ছপ!

অবশেষে ছোট্ট কচ্ছপের শীতনিদ্রা শেষ হলো। শীতের দীর্ঘ সময় সে কাদা মাটির তলায় শীতনিদ্রা দিয়েছে। শেওলা আর কাদামাটির তিন ফুট নিচে গিয়ে ঘুমিয়ে ছিল এই ছোট্ট কচ্ছপটা। পুরো শীতে প্রকৃতির কত রূপ বদল হয়েছে, কিছুই দেখেনি সে। আবহাওয়া যখন একটু উষ্ণ হলো আর ভূমির তাপমাত্রা একটু বাড়তে লাগল, তখনই কচ্ছপ বেরিয়ে এলো। বেশ কিছুদিন ধরে কাদামাটি সরিয়ে সরিয়ে অবশেষে বুড়ো এক হিজলগাছের নিচ থেকে উঠে এলো। আর ওপরে উঠেই পট করে শেওলার ভেতর থেকে মাথাটা বের করল। ছোট্ট কচ্ছপটা প্রথমে ঘাড় এদিক সেদিক নাড়িয়ে স্বাভাবিক হলো। হাঁ করে এপ্রিল মাসের তাজা বাতাস গিলে নিল।

বেশ কষ্ট করে কাদামাটি ঠেলে ওপরে উঠেই সে বেশ উষ্ণ বোধ করল তার গাঢ় বাদামি খোলে। ছোট্ট কচ্ছপ হামাগুড়ি দিয়ে নরম অথচ স্পঞ্জের মতো শেওলায় মৃদু শব্দ তুলে এগিয়ে গেল তার শীতনিদ্রা ছেড়ে। ওরা অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে শীতনিদ্রায় চলে যায়। উঠে আসে এপ্রিল-মে মাসে। সে গিয়ে পৌঁছল অনেকগুলো জল প্রবাহের একটায়। ক্ষীণধারায় প্রবাহিত এই অগভীর জল একটু ঠান্ডা আর পরিষ্কার। ছোট্ট কচ্ছপ ওই জলে মাথাটা সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিল। একটু জলপান করল সে। জলে ধোয়া মাথায় সূর্যের আলো পড়ে উজ্জ্বল কমলা রঙের দাগটা চকচক করে উঠল। ছোট্ট কচ্ছপ একটু নাদুস-নুদুস। চার বছর বয়সি জল-কচ্ছপের ছানা এটি।
শেষবিকেলে রোদ পোহানের জন্য ছোট্ট কচ্ছপ ঘাসের একটা ছোট্ট টিলায় চড়ল। মাথাটা একটু ওপরে তুলে কয়েক সেকেন্ড গরম বাতাস হাঁ করে গিলে নিল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কিছু সোঁদা গন্ধও নিল। এই ধরনের কচ্ছপদের কাছে এমন জলাভ‚মি বেশ উপযোগী আর সুপরিচিত। ছোট্ট কচ্ছপ তার তী² ঘ্রাণশক্তি দিয়ে জল-ঘাসের মিহি গন্ধটা ধরতে পারল। আর এসব জলঘাস এই জলাভূমিতে বেশ তাড়াতাড়ি জন্মে।

অন্ধকার হওয়ার আগেই ছোট্ট কচ্ছপ ওই ঘাসের টিলা থেকে নেমে এলো। শীতনিদ্রা থেকে বেরিয়ে এসে প্রথম রাত সে বাইরে কাটাতে চায় না। চট করে কয়েক ইঞ্চি শেওলা ও কাদামাটি সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। আজকের রাতটা এভাবেই কাটাবে সে। রাতটা বেশ পরিষ্কার আর সুন্দর। একটু আগেই সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। এখন আকাশ বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার। বান্দনবানের দুই পাহাড়ের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এলো হলুদ চাঁদটা। চাঁদের আলোটা পুরো অগভীর জলমগ্ন এলাকায় পড়েছে। ব্যাঙেরা একে অপরকে ডাকার শব্দ জলা এলাকার প্রায় সব দিক থেকে আসছে। ব্যাঙেরা কচ্ছপটির মতো শীতঘুমে ছিল। একটু বৃষ্টি পেয়েই ওরাও জেগে উঠেছে। বাদুড়ের দ্রুত পাখার ঝাপটের শব্দও শোনা যাচ্ছে। তারা সন্ধ্যার শিকারে বেরিয়েছে। উঁচু একটা হিজলগাছে দাড়িওয়ালা প্যাঁচা নিচের জলাভ‚মির প্রতিটি নড়াচড়ায় তীক্ষ্ণ নজরে রেখেছে। সে তার নতুন বাচ্চাদের জন্য ইঁদুরের খোঁজ করছে। যখনই একটা ইঁদুর চিহ্নিত হয়েছে অমনি সে তার শক্তিশালী পাখায় ভর করে ওটাকে ধরে ফেলে তার ক্ষুরধার নখ দিয়ে। হঠাৎ নরম শৈবাল কেঁপে উঠল ডুবে থাকা ছোট্ট কচ্ছপের মাথার ওপর। কিছু একটা বড়ো আর ভারী তার ওপর দিয়ে জলাভূমিতে হেঁটে গেছে। এটা প্যারাবানর। এই ভয়ানক শিকারি প্রাণীটা গাছের গুড়িতে থাকা গর্ত থেকে বের হয়েছে খাবার সংগ্রহ করতে। যদি সে ছোট্ট কচ্ছপকে পেত তাহলে তার ধারালো দাঁত আর নখর দিয়ে তার খোলটা ভেঙে গুড়ো করে ফেলত। হঠাৎ পুরো জলাশয় মৃত্যুপুরীর মতো নীরব হয়ে গেল। তারপর চোখের পলকে একটা ঝাপটা আর একটা ব্যাঙের অন্তিম চিৎকারে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল ক্ষুধার্ত বানর একটা ব্যাঙ ধরেছে। ছোট্ট কচ্ছপের মাথার ওপরের জলাশয়ের সকল শব্দ থেমে গেল। বানরটি সরে গেল সেখান থেকে। ঠান্ডা শেওলার নিচে ছোট্ট কচ্ছপ আরেকটু গভীরে ঢুকে ঘুমে তলিয়ে গেল। পরদিন সকালে ছোট্ট কচ্ছপটি বেরিয়ে এলো। এরপর সে লেকের একটা ক্ষীণধারায় বয়ে যাওয়া জলধারা বরাবর এগিয়ে গেল। সে সবচেয়ে বেশি ভেজা আর নোংরা এলাকার দিকে এগিয়ে গেল। যে ওই জায়গায় গত চারটা বছরের গ্রীষ্মকাল কাটিয়েছে। তার এই ভ্রমণকালে প্রতিদিন ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুট পথ অতিক্রম করতে পারে। প্রতিদিনের ভ্রমণে ছোট্ট কচ্ছপ দিনশেষে কাদায় গর্ত করে সেখানে রাতটা কাটিয়ে দেয়। পরদিন উষ্ণ ও রৌদ্রময় দিনে কাদার গর্ত থেকে বের হয়ে আবার সে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে থাকে। প্রতিদিন ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুট ভ্রমণ করে আবার গর্ত করে রাতকাটানো আর জটপাকানো ঘাস আর শৈবাল ঠেলে ঠেলে যাওয়া এই ছোট্ট কচ্ছপটির জন্য অনেক কষ্টকর। ছোট্ট কচ্ছপ সবসময় অগভীর জল অর্থাৎ কয়েক ইঞ্চি গভীর শান্ত জলেই দিনযাপন করে। একটা ডিম আকৃতির গোলাকার স্বচ্ছ জেলির মতো কি একটা ভাসছে। দেখেই একটু এগিয়ে গেল সে। দেখে, এর ভেতর ঝাঁক ঝাঁক কালো ব্যাঙাচি দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট কচ্ছপ চট করে একটানে ডিমটা ছিঁড়ে ফেলল। এরপর ক্ষুধার্তের মতো পিচ্ছিল ব্যাঙাচি মুখে পুরে খেতে শুরু করল।

ছোট্ট কচ্ছপ সামনে এগিয়ে চলল। জলের উপরিতলটা তার ঠিক মাথার ওপরে। কখনও কাদায় হেঁটে, কখনও অগভীর জলে সাঁতরে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে চলল। শীতনিদ্রা দিয়ে ওঠার পর প্রায় একসপ্তাহ কাটল। ছোট্ট কচ্ছপ এখন জলাভূমির প্রায় মাঝখানে। গ্রীষ্মকালটা কাটানোর জন্য এ জায়গাটা ছোট্ট কচ্ছপটার জন্য নিখুঁত আর নিরাপদ। সে যখন খুব চমকে ওঠে অথবা ভয়ানক কিছু হওয়ার আশংঙ্কা করে তখন সে এখানে তার ধারালো আর শক্ত নখ দিয়ে দ্রুত কাদা সরিয়ে যখন তখন লুকিয়ে যেতে পারে। জলটা একেবারে পরিষ্কার আর ঠান্ডা। পাহাড়-ঝরনার ক্ষীণ একটা ধারা এখানে চলে এসেছে। এই সমতল জলাভূমিটা যেন একটা বিশালাকৃতির গামলা। তার ওপর বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত ঘাসের জঞ্জাল। ছোট্ট কচ্ছপ জলের তলায় ঘাসের শিকড় খুড়তে পারে আবার ঘাসের স্ত‚পের ওপর উঠে রোদ পোহাতে পারে। মরা পাতা ঘাস এই জলাভূমির ওপরে এমনভাবে পড়ে আছে যেন পুরো এলাকাটা একটা ম্যাট বিছিয়ে দিয়েছে। আর এটা হলো শামুক আর কীটের বাসা। আর দুটোই ছোট্ট কচ্ছপের প্রিয় খাবার।

মরা শৈবাল আর পাতা কয়েক বছরেই মাটিতে পরিণত হয়। জলাভূমির চারাগাছগুলো সেখানেই শিকড় ছড়িয়ে দেয়, আর ওতে পাতা গজায়। চারাগাছগুলো বড়ো হয়ে যখন ছোট্ট কচ্ছপের মাথার ওপরে চলে আসে তখন ওই পাতা আর ছোট্ট কচ্ছপের মাথা উভয়ের ছায়া এক ধরনের জটিল রেখা বা গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়। আর ছোট্ট কচ্ছপের কমলা রঙের খোল আর পাতার ছায়া মিলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। এতে শত্রুকে ফাঁকি দেওয়া সহজ হয়। ছোট্ট কচ্ছপ রোদ পোহানোর সময় এটা করে থাকে।
প্যারাবন আর ঘন কাঁটাযুক্ত ঝোপের মধ্যে ছোট্ট কচ্ছপের মারাত্মক শত্রুগুলো লুকিয়ে থাকে। যেমন শেয়াল আর ভোদড়। এরা জলাভূমিতে বেশ দ্রুতগতিতে ঘুরে বেড়ায় শিকারের সন্ধানে।
কলমি ঝোপের রেশমি কোমল গায়ে ঝাপসা সাদা, আবার কোথাও কোথাও বেগুনি ফুল ফোটে। এদের আকর্ষণে মাছি ও প্রজাপতিরা জলাশয়ে আসে। অনেক পোকামাকড় জলে পড়ে যায় আর ক্ষুধার্ত কচ্ছপ টুপ করে ধরে গিয়ে ফেলে। অনেক সময় গেছো-ইঁদুর আর জল-ইঁদুর শৈবালের আস্তরণে লম্বা গর্ত বা টানেলের মতো নালায় ভেতর দিয়ে তারা চলাফেরা করে। ছোট্ট কচ্ছপ সে পথও অনেকসময় অতিক্রম করে।
আবহাওয়ায় উষ্ণতা আরও বেড়েছে গ্রীষ্মের প্রভাবে। ওই দিনগুলো বেশ শান্ত আর নীরব থাকে। মাঝেমধ্যে নীলকণ্ঠ পাখির চ্যাঁচানো আর কাঠঠোকরার ট্যাট-ট্যাট শব্দ শান্তি বিঘ্নিত করে। আর অনেক সময় জলাভূমিতে থাকা কিছু পোকা বা ঝিঁঝি ভনভন করে। এ ছাড়া দুপুরের সময় প্রায়ই বেশ নীরব আর শান্তই থাকে পুরো জলাভূমি। আর জলাভূমি যখন জেগে ওঠে বা জলজ প্রাণীগুলো শিকার করতে তৎপর হয় তখন ছোট্ট কচ্ছপ ঠান্ডা কাদামাটির নিচে নিরাপদে লুকিয়ে পড়ে।
জলাভূমির প্রাণীদের প্রধান কাজ হলো খাবার খোঁজা। প্রাণীটা কত বড়ো বা কত ছোটো সেটা কোনো ব্যাপার নয়। জলাশয়ে এক ধরনের ইঁদুর আছে, যারা বেশ দ্রুত চলাফেরা করে, খোঁজে বীজ বা নতুন চারাগাছ। সে চলার মাঝে চট করে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে নেয় কোনো শত্রু আছে কি না। বাজপাখি জলার প্রান্তে অপেক্ষা করে আর তীক্ষ্ণ চোখে দেখে কোনো সাপ বা ইঁদুর পাওয়া যায় কি না।
অগভীর জলের একটা ভাসমান পাতায় একটা মাকড়সা বিশ্রামরত। তার আটটি পায়ের দুটি পা জল স্পর্শ করে আছে। পা দুটি দিয়ে জলে মৃদু তরঙ্গ তুলে টোপ ফেলে অনুভব করছে যদি কোনো পোকা জলে থাকে। খুব একটা অপেক্ষা করতে হলো না, একটা তৃষ্ণার্ত মাছি এলো জলপান করতে। মাকড়সা মখমলের মতো পায়ে জলের উপরিভাগে টোপ ফেলে। শিকারির মতো দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর। মাকড়সা এক কামড়ে মাছিটার শরীরে বিষ ঢেলে দেয়। এরপর মাকড়সা মাছিটাকে নিয়ে ফিরে গেল আবার পাতার ওপর। শেষে ধীরে ধীরে সে তার খাবার সারল। ছোট্ট কচ্ছপ অগভীর জল থেকে ওঠে পড়ল একটা ঘাসদ্বীপে। সে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ব্যবহার করল, সে দেখতে পেল একটা পোকা অল্প জলে পড়ে গেছে। বিস্ময়কর গতিতে কচ্ছপটা সেই অগভীর জলে ফিরে এলো। সে তার গলাটা বেশ লম্বা করে দিল সেটার কাছে পৌঁছুতে। ছোট্ট কচ্ছপ কেবল নড়ল মাত্র, সে মোচড় খেতে থাকা শুঁয়োপোকাটা ধরে ফেলল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে পুরো শুয়োপোকা একবারে গিলে ফেলল।

লম্বা পাওয়ালা একটা সারস উড়ে এসে কাদায় বসল ছোট্ট কচ্ছপের কাছেই। সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট কচ্ছপ তার মাথাটা টেনে নিল তার খোলের ভেতর। সে তার পাগুলো গুটিয়ে নিল আর লেজটা শরীরের ভেতর নিয়ে এলো। কিন্তু অন্যসব কচ্ছপের মতো পুরো শরীরটা খোলের ভেতর শক্ত করে ফেলল না। সে শুনতে পেল, সারসটা তার লম্বা তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে বর্শার মতো একটা সবুজ ব্যাঙের ওপর আক্রমণ চালাল আলোর ঝলকানির মতো। ছোট্ট কচ্ছপ ব্যাঙটির মতো নয়। সারসটাকে সে মোটেই ভয় পেল না। কেননা, সে এখন অনেক বড়ো হয়েছে। তার তিন ইঞ্চি শক্ত খোল সারসটার ঠোঁটের পক্ষে বেশ বড়ো আর শক্ত।

এক সকালে ছোট্ট কচ্ছপ দেখল অগভীর জলে বড়ো একটা মেঘের প্রতিচ্ছবি। বিকেল হতে হতে পুরো জলাভ‚মিটা গাঢ় ধূসর রং ধারণ করেছে। ঠান্ডা বাতাসে উইলোর পাতাগুলো কাঁপছে। ছোট্ট কচ্ছপ হাঁ করে একটু বাতাস গিলে গন্ধটা নিয়ে সে বুঝল ঠান্ডা তাপমাত্রা, আর বৃষ্টি নামবে। সে কাদার ভেতর ঢুকে পড়ল। অপেক্ষায় থাকবে বাইরের ঝড় চলে যাওয়ার। সে ভয়ানক গুড়–ম গুড়–ম শব্দ শুনতে পেল। পাখিরা তাদের বাসায় বা গাছের গুড়িতে আশ্রয় নিল। একটা সাপ গাছের নিচের ডাল থেকে নিচে এসে পড়ল আর পিছলে ঢুকে পড়ল পড়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ির তলায়। এরপর গাঢ় মেঘ গলে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। শেওলাগুলো বৃষ্টির জলে ভিজছে আর স্পঞ্জের মতো বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শুষে নিচ্ছে। গ্রীষ্মের বৃষ্টিটা সারা বিকেল ঝরল।
একসময় বৃষ্টি থামলে আবার জলাভ‚মিটা আলোকিত হয়ে উঠল। বৃষ্টির শেষে চারপাশ বেশ ঠান্ডা আর শান্ত হয়ে রইল। এরপর যখন সন্ধ্যা নামল তখন সমস্ত জলাভ‚মি যেন জেগে উঠল। হরেক রকমের শব্দ শুরু হয়ে গেল। ব্যাঙ ডাকছে। ঝিঁঝি পোকার চিরিক চিরিক শব্দ জলাভূমির নিস্তব্ধতা ভেঙে ফেলল।

ওই রাতে সবখানে ক্ষুধার্ত গিরগিটিদের সবেগ চলাফেরা দেখা গেল। তারা হামাগুড়ি দিয়ে শিকড় ও গাছের গুঁড়ির নিচে ঢুকছিল। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে তারা পোকামাকড় খুঁজতে লাগল। তাদের পিচ্ছিল শরীর। শেওলার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের ওপর চাঁদের আলো নামছে।

পরদিন সকালে জলাভূমিতে সূর্যের আলো পড়ার সঙ্গে হালকা কুয়াশার মতো জলীয় বাষ্প উড়ে যাচ্ছে। ছোট্ট কচ্ছপ বেশ তাড়াতাড়ি কাদামাটির আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এলো। রোদ আরও বেশি গরম হওয়ার আগে সে একটু রোদ পোহাতে চায়। সে ওপরে উঠে রোদ পোহানোর জন্য উপযুক্ত জায়গায় এসে পাগুলো একটু মেলে দিল কেবল, হঠাৎ সে স্থির হয়ে গেল। কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা শিকারি কচ্ছপ কাদার ওপর স্থির বসে আছে। ওটা এত বড়ো যে তার খোলটাই বিশাল এক থালার মতো। সম্ভবত ওটার ওজন কুড়ি পাউন্ডের কম নয়। ওই শিকারি কচ্ছপটা অনেক ছোটো ছোটো কচ্ছপ গিলেছে একবারেই। ছোট্ট কচ্ছপ ওটার মাথা আর চোয়াল দেখল। বেশ শক্তিশালী ওগুলো। সহজেই তার খোলটা ওগুলো দিয়ে ভেঙে ফেলতে পারবে। শিকারি কচ্ছপটা ছোটো কচ্ছপকে দেখতেই পায়নি। সে লেজ তুলে চট করে নিচে গিয়ে ঢুকে পড়ল নরম কাদায়। ছোট্ট পাগুলোকে কাস্তের মতো চালিয়ে মুহূর্তের মধ্যে নিরাপদে কাদার তলায় পৌঁছে গেল।

কাদার নিচে থাকতে ছোট্ট কচ্ছপের কোনো সমস্যা হয় না। তাকে তখন শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হয় না। জল বা কাদার তলায় শ্বাসকার্য চালানোর একটা বিশেষ ব্যবস্থা আছে। তার লেজের ঠিক নিচে একটা খোলা মুখ আছে, ওটাকে সবাই পায়ুপথ হিসেবে জানে। কিন্তু ওটি আলাদা এক খোলা মুখ। ওই খোলা মুখে তখন জলে ভরতি থাকে। সেই জল থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে চামড়ার সাহায্যে রক্ত চলাচল পথে পাঠানো হয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর সে আবার নিরাপদ কাদার তলা থেকে বেরিয়ে এলো। প্রথমে সে তার মাথা তুলে বেশ সময় নিয়ে চারপাশ নিরীক্ষা করল। শিকারি কচ্ছপটাকে কোথাও দেখা গেল না। এরপর সে বিষকাটালির ঝোপের ভেতর দিয়ে কষ্ট করে পথ তৈরি করে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। লতাপাতার ইঞ্চিখানেক নিচে কাদামাটিতে রোদ পোহাতে লাগল। রোদটা তার খোলের ওপর পড়ছিল। সকালের বৃষ্টিতে যে সকল চারাগাছ কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল এখন সেগুলো আবার লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তামার মতো রঙিন প্রজাপতি ও মৌমাছিগুলো জলাভ‚মির ফুলের সুরভিতে প্রলুব্ধ হয়ে চলে এলো। তারা এসে ফুলের মধু খেতে বেশ উদগ্রীব।

বান্দরবানের সিংপার এই জলাভূমিতে কিছু মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত চারাগাছ আছে। সেগুলো পোকামাকড়ের জন্য বেশ বিপজ্জনক। তারমধ্যে একটি হলো দেখতে কলমির মতো পোকাখেকো গাছ। এদের পাতাগুলো গাঢ় সবুজ রঙের ডোরাকাটা দাগ। দেখতে ভারী সুন্দর। সেগুলো থেকে দারুণ সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট কচ্ছপ একটু সময়ের জন্য ওপরের দিকে তাকাল। দেখল একটা মৌমাছি কলসির মুখ সদৃশ পাতার কাছে এসে মধু সংগ্রহের জন্য মুখের ভেতর ঢুকে পড়ল। পাতার গা একেবারে মোমের মতো পিছল। মাছিটা পাতার গায়ে বসতে গিয়ে পিছলে একেবারে তলার দিতে পড়ে গেল। তলায় ছিল আঠার মতো তরল পদার্থ। মৌমাছি সেখানে পড়ে উঠে আসতে চাইল। কিন্তু সে উঠতে তো পারলই না, সেই তরলে সে ডুবে গেল। আসলে ওটা ছিল সেই পোকাখেকো গাছের একটা ফাঁদ। সেই পোকাখেকো গাছ ধীরে ধীরে ওই তরলের সাহায্যে পোকাটা হজম করে ফেলল। এই গ্রীষ্মকালে ছোট্ট কচ্ছপের জন্য খাবার জোগাড় করা বেশ সহজ। জলাভূমির সবখানে পোকাগুলো কোনোটা উড়ছে, কোনোটা হামাগুড়ি দিচ্ছে আবার কোনোটা জলে ভাসছে আর সাঁতার কাটছে।

এক সকালে ছোট্ট কচ্ছপ দেখল একটা মৌমাছি একটা ঘাসের ওপর বসেছে। সে ওটাকে ধরার জন্য কোনো সুযোগ নিল না। একসময় ওটা উড়ে চলে যায়। সে এগিয়ে গেল আরেকটা মা-কচ্ছপের দিকে, সেটা দেখতে ছোট্ট কচ্ছপের মতোই। অন্য একটি কচ্ছপের সঙ্গে মেলামেশা করেছে। এখন সে ডিম পাড়ার জন্য একটা গর্ত খুঁজছে। জলাভূমির মা-কচ্ছপটা বেশি ভেজা নয় এমন নরম মাটির সন্ধান পেল। সে তার থাবা দিয়ে নরম মাটির একটা বড়ো গামলার মতো গর্ত তৈরি করে সে ওখানে ডিম পাড়ল। তারপর আবার মাটি দিয়ে ডিমগুলো চাপা দিয়ে দিল। এরপর মা-কচ্ছপটি ওখান থেকে সরে গেল। মা-কচ্ছপ কখনও তার ডিমের কাছে ফিরে আসে না। গ্রীষ্মের মধ্যেই সে ডিমগুলো থেকে একদিন বাচ্চা বের হয়ে আসবে। গ্রীষ্মের সময় দিন বড়ো আর বেশ গরম হয়। ছোট্ট কচ্ছপ প্রায় প্রতিদিন ঠান্ডা কাদায় ডুবে থাকে। বাদামি মাকড়সা সূর্য কিরণ থেকে বাঁচতে পাতার নিচে অপেক্ষা করে। সাপগুলো সূর্যাস্তের পর শিকারে বের হয়।

প্রতি সন্ধ্যায় হুতুমপ্যাঁচা জলাভূমির ওপর উড়তে উড়তে ছোটো ছোটো প্রাণীর খোঁজ করে। তার বাচ্চাগুলো বেশ বড়ো আর শক্ত গেছে। ইঁদুর আর পোকামাকড় খায় ওরা। শীঘ্রই তারা বাসা ছেড়ে আলাদা হয়ে থাকবে। ছোট্ট বানরগুলো রাতে মায়ের সঙ্গে খেলে। মাকে অনুসরণ করে। সব তাদের শিকার ধরার কৌশল শেখায়। অবশেষে প্রতিবছরের ন্যায় গ্রীষ্মের শেষের দিকে দিনগুলো ক্রমে ছোটো হয়ে আসে। ছোট্ট কচ্ছপ বুঝতে পারে শীত এগিয়ে আসছে।
বান্দরবানের সিংপার এই জলাভ‚মিতে পরিবর্তনের সময়টা দৃশ্যমান। শীতের সকালে ছোটো ছোটো পাখিরা বেশ উত্তেজিতভাবে চিরিক চিরিক ডাকতে থাকে। এখন পাখিদের উষ্ণ জায়গায় চলে যাওয়ার সময়। বুড়ো শিকারি কচ্ছপ পুরো শীতকাল কাটানোর জন্য কাদার নিচে চলে গেছে। গাছগুলো তাদের রঙিনপাতা ঝরিয়ে ফেলছে, আর সবুজ শিমুলগাছ একেবারে বিবর্ন ও ডালপালাহীন হয়ে গেছে। বিকেলে সূর্য বেশিক্ষণ আকাশে থাকে না। জলাভ‚মিতে এখন বেশ বড়ো ছায়া পড়ে। পাতাদের গন্ধে যে একটু পরিবর্তন এসেছে ছোট্ট কচ্ছপ তা বাতাস গিলে বুঝতে পারে। আবহাওয়া বড়ো বেশি ঠান্ডার হওয়ার আগে ছোট্ট কচ্ছপ তার মাথাটা ঘোরায় আর ফিরে আসে। সেই অগভীর জলের মৃদু স্রোতের কাছে; তার শীতনিদ্রা দেওয়ার জায়গায়। বুড়ো হিজল গাছটির শিকড়ের নিচে তিনফুট গভীরে ঢুকে পড়ে সে।

শীত এসে গেল। আকাশে ঘন মেঘ যথেষ্ট ভারী হয়েছে। মেঘ নয় কুয়াশার আস্তরণ। ছোট্ট কচ্ছপ ভাবে, এসব যেন এই জলাভূমিটাতেই শুধু পড়বে। জলার সমস্ত সবুজ ধবল কুয়াশার নিচে চাপা পড়ে গেছে। একসময় এই শীতের শেষ হবে। তখন বান্দরবানের সিংপার এই জলাভূমি আবার উষ্ণ ও সবুজ হয়ে উঠবে। ওই দিন না আসা পর্যন্ত ছোট্ট কচ্ছপ বুড়ো হিজল গাছটির শিকড়ের নিচে তিনফুট গভীরে বেশ নিরাপদেই থাকবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত