তন্ময় চক্রবর্তী’র কবিতা

Reading Time: 3 minutes

আজ ২৩ সেপ্টেম্বর কবি,কথাসাহিত্যিক ও আবৃত্তিশিল্পী তন্ময় চক্রবর্তী’র জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

কাউকে বলা যাবে না

এ সমস্ত কথা
কাউকে বলা যাবে না।
জিরে বাটা, হলুদ, পাঁচফোড়নের মতো
এ কথা ঝোলে মিশে গেছে।
ছাদের নীচু পাঁচিল, ভাঙা গ্যারেজ,
হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি, পায়খানার মগ,
এমনকি নিজের মাথার বালিশকেও
এ কথা বলা যাবে না।
কাল রাত্রে হঠাৎ ঝড় উঠেছিল
তারপর আকাশে তারার আলো
ভাবলাম, বলে ফেলি।
ধমকে উঠল হঠাৎ উড়ে আসা মেঘ
কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল – বোলো না।
অন্ধকারে জোনাকিরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে
বিশাল অশ্বত্থ গাছে ঘুমন্ত পাখিরাও কান পেতে
পুকুরের জল চুপ করে আছে
শুধু আমি কথাটা বলি কি না, সেটা শোনার জন্য।

নাহ্‌, আমি কথাটা বলিনি।
কারণ কথাটা কাউকে বলা যায় না।

 

এক সৈনিক কবির পকেটবুক থেকে

(যুদ্ধে তরুণ কবি উইলফ্রেড ওয়েনের অকালমৃত্যুর পর ১৯২০ সালে তাঁর মা সুজান এইচ ওয়েন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি চিঠি লেখেন, তাতে তিনি জানান যে, তাঁর বড় ছেলে উইলফ্রেডের পকেটবুকে একটি কবিতা লেখা ছিল –

What my eyes have seen
What my life received
Are unsurpassable…

নীচে নাম লেখা… রবীন্দ্রনাথ টেগোর

(যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই)

 

 


বেতার বার্তা এসেছে
দু-পক্ষের মধ্যে নাকি চলছে যুদ্ধবিরতির কথা।
ট্রেঞ্চের ভিতরে আবছা অন্ধকার
ট্রিগারে হাত রেখে রেখে দুটো আঙুলে কড়া
জানি না এ হাত দিয়ে আর কবিতা লেখা যাবে কিনা।


দিনের পর দিন কেবল বিস্ফোরণ আর ভারী বুটের শব্দ
নিঃশব্দ শ্বাপদ সরীসৃপ অন্তরাল, ওঁতপাতা
যে-কোন মুহূর্তে সবুজ পাতার আড়াল থেকে
ছুটে আসতে পারে বুলেট।


প্ল্যাটুন পালটালে পালটে যাচ্ছে বন্ধুরাও
বিগত কয়েক মাসে কোন কবিতার বই দূরে থাক
খবরের কাগজও চোখে দেখিনি।
আচ্ছা কবি, বলতে পারো
কেন যুদ্ধ হয়? কেন এত রক্তপাত?


ঘুম আসে না।
মনে পড়ে সমুদ্রের সাথে কথা-বলা নদী
আর নিশ্চুপ পাহাড়।
কেন যে হঠাৎ তোমার কবিতার কথা মনে পড়ল
যুদ্ধে যাবার দিন।


রৌদ্রে ঝলমল করছে সমুদ্রের জল
মায়ের সঙ্গে বোধহয় শেষ দেখা
হঠাৎই মনে পড়ল সেই আশ্চর্য লাইন,
নির্ভয়ে সাঁজোয়া গাড়িতে উঠে পড়লাম।


কুয়াশায় অন্ধকারে
নৈঃশব্দ ভেদ করে মাঝেমধ্যে গুলির শব্দ।
পকেটবই খুলে লিখে রাখছি
সেই আশ্চর্য লাইন।
এবার নিশ্চিন্তে যাব রাত্রিপাহারায়।

 

 

ফ্রাইডে কিন্তু গুড নয়

এ গল্পটা আমার এক নিগ্রো বন্ধুর মুখ থেকে শোনা,
ও, গল্পটা শুনেছিল ওর দাদুর কাছ থেকে।
যিনি নাকি তুলোর চাষ করতেন
যার সারা পিঠে ছিল চাবুকের ঘায়ে
ছিঁড়ে যাওয়া মাংসপেশীর দাগ।
ক্যাবিনেট মিটিং এর মাঝখানেই
কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বলল
আজ রাত্রে কিন্তু নাটক দেখতে যাওয়া,
ফোর্ড থিয়েটারের ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় তখন রাত নটা।
প্রেসিডেন্ট বক্সের যে আবছা আলোয় ঢাকা করিডর
তারই মুখে দেহরক্ষী জন পার্কারের বসে থাকার কথা ।
কিন্তু বড় বিচিত্র চরিত্রের মানুষ এই পার্কার
কাজে গাফিলতি, মদ খেয়ে রাস্তায় মাতলামি।
বেশ্যালয়ে বেলেল্লাপনা, এসব তার কাছে গা সওয়া ।
তাই অল্পক্ষণেই পাহারার কথা বেমালুম ভুলে
হলের মধ্যে ঢুকে থিয়েটারে মজে গেল সে।
আর তার কিছুক্ষণ বাদেই হল থেকে বেরিয়ে
সটান একটা বারে ঢুকে হুইস্কি অর্ডার করল।
অভিনয় চলছে ।
আর একমনে দেখছেন আমাদের গল্পের নায়ক আব্রাহাম।
আমি আমার বন্ধুকে মাঝপথে থামিয়ে, জিজ্ঞেস করলাম
‘কে ? এই আব্রাহাম।’
ও, সামান্য হেসে দূরের দিকে আঙুল দেখাল ।

 

 

ঝাঁকড়া গাছের তলায় নির্জন পথ
হেঁটে চলেছে একাকী একটি মানুষ
দূর থেকে দেখলে মনে হবে
তার দীর্ঘ হাড় সর্বস্ব শরীর যেন দুলতে দুলতে এগোচ্ছে ।
আমি তাকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম
কে আপনি ?
মৃদু গলায় সে উত্তর দিল,
বলার মতো কোনো পরিচয় আমার নেই
আমি একজন পোস্টমাস্টার । আমার নাম আব্রাহাম ।
হঠাৎ যেন অন্ধকার ফুঁড়ে করিডরের সামনে
ভেসে উঠল একটা ছায়ামুখ
এধার ওধার তাকিয়ে সতর্কভাবে ভেতরে ঢুকে
করিডরে দরজার পাল্লায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল ।
আমি চীৎকার করে উঠলাম, ওই লোকটি আততায়ী
আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই আগন্তুক চাপ দিল পিস্তলের ঘোড়ায় ।
রক্তের স্রোত, নদী
তবু ঘোষণাপত্র পড়া যাচ্ছে
এ এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ । এতে লেখা আছে …
‘আদেশ দিচ্ছি, ক্রীতদাস হিসেবে যারা বন্দী আছো
এখন থেকে তাঁরা সবাই মুক্ত ও স্বাধীন’,
তারপর সব অন্ধকার ।
টেন্‌থ স্ট্রিট ৪৫৩ নম্বর বাড়ি
এক মধ্যবিত্ত ভাড়াটের খাটে শুতেই
রাত ভোর হয়ে এলো ।
ক্যালেন্ডারের পাতা ১৫ই এপ্রিল, ১৮৬৪
সকাল সাতটা বেজে একুশ মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ড ।
ধড়মড় করে জেগে উঠলাম ।
কবিতার খাতায় রক্ত লেগে আছে
খাতার মাঝখানে
সেই নিগ্রো বন্ধুর বিষণ্ণ মুখ
একটাই মাত্র লাইন লিখেছি সারারাত ধরে
‘ফ্রাইডে কিন্তু গুড নয়’ ।

 

 

প্রচ্ছদ ছবি: বরুন দেব

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>