টাপুরদির গোয়েন্দাগিরির গ্রন্থসমালোচনাঃ ফেলুদা আর মিতিনমাসির মিশেল
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
বিশ্বসাহিত্যে গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা কে বলা কঠিন। অপ্রাকৃত ও উদ্ভট রসের স্রষ্টা মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো-র লেখা “দি মার্ডার ইন দি রু মর্গ”-এ (১৮৪১) প্রথম গোয়েন্দা কাহিনির স্বতন্ত্র রূপরেখাটা গড়ে ওঠে। একশো বছর আগে বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির শৈশব অবস্থা ছিল। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর‘এর নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সে তার সাহিত্যগুণের জন্য নয়, প্রাচীনত্বের জন্য। পাঁচকড়ি দে এক শ্রেণির পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তাঁর বহু গ্রন্থ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। তবে সেই জনপ্রিয়তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সবচেয়ে বেশি তরুণ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। তাঁর সৃষ্ট রবার্ট ব্লেক সিরিজ ছিল বহুপঠিত।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগে বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা সম্ভবত বেশ সহিষ্ণু ছিলেন, সহজে বিচলিত হতেন না। সেই সময়ের একটি উপন্যাসে আছে, একজন গোয়েন্দা হাওড়া স্টেশন ছাড়বার এক ঘন্টা পরেই ট্রেন থেকে পর্বতমালা ও ঝরনার শুভ্র রেখা দেখতে পেলেন। অন্য এক প্রাচীন লেখকের একটি উপন্যাসে আছে একজন গোয়েন্দা ‘বৃক্ষকোটরে অনুবীক্ষণ লাগাইয়া’ দূরের একটি বাড়িতে ডাকাতদের দুষ্কৃতি দেখতে পেলেন। আজকালকার পাঠকরা হলে এসব মার্জনা করতেন না।
এই সময়ের পাঠকের হাতে বিনোদনের উপকরণ অনেক। তাঁদের চোখ যদি বইয়ের পাতায় সেঁটে রাখতে হয়, তাহলে সেই বই হতে হবে ‘আনপুটডাউনেবল’, একবার পুট আপ করলে শেষ না করা অবধি পুট ডাউন করার যো যাতে না থাকে। পাঠক সর্বভুক। করুণ, মধুর, হাস্য, বিভৎস যে কোনও রসের গল্প মন দিয়ে পড়েন, যদি তার মধ্যে প্রসাদগুণ থাকে। গোয়েন্দা কাহিনির পাঠক কম নেই। ইংরেজি তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও গোয়েন্দার অভাব নেই। দুর্ভেদ্য কিংবা দুঃসাহসিক যেকোনও রহস্য উদঘাটনে তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। অপরাধ ও তার অপরাধিকে আবিষ্কার করার জন্য কয়েকটি অস্পষ্ট ও অসংলগ্ন সন্ধানসূত্রকে কাজে লাগিয়ে তারা যতক্ষণ পর্যন্ত রহস্য উন্মোচন না করেন, ততক্ষণ উৎকণ্ঠায় থাকেন পাঠক।
সম্প্রতি হাতে এসেছে সোমজা দাসের লেখা টাপুরদির গোয়েন্দাগিরি বইটি। দুশো চোদ্দ পাতার পেপারব্যাক এই বইটিতে রয়েছে পাঁচটি উপন্যাসিকা। কেমন এই টাপুরদি? সোমজা আমাদের জানাচ্ছেন ‘টাপুরদি দিব্যি রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ে, আবার কুংফুর প্যাঁচে দুষ্টু লোককে ধরাশায়ীও করতে পারে অনায়াসে। …টাপুরদি এ যুগের মেয়ে। শিক্ষিতা, সপ্রতিভ, আধুনিকা। মিতুল যত না তার সহকারী, তার চেয়েও টাপুরদির কাছে তার স্নেহের ছোট বোনটি। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার মিতুল প্রতিটি তদন্তে টাপুরদির ছায়াসঙ্গী।’ পাঁচটি টাপুরদি কাহিনি পড়ার পর পাঠকের যদি মনে হয় সোমজাসৃষ্ট টাপুরদি গোয়েন্দা ফেলুদা ও মিতিনমাসির মিশেল, তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
এই বইটির প্রথম কাহিনি ‘উত্তরবঙ্গে টাপুরদি’। উত্তরবঙ্গের সবুজ প্রকৃতির পটভূমি প্রাণসঞ্চার করেছে উপন্যাসটিতে। কার্শিয়াংএর চৌধুরি টি এস্টেটে ঘন হয়েছে রহস্য। চায়ের কনসাইনমেন্টে ভাল গুণগত মানের চা সরিয়ে খারাপ মানের চা পাতা মিশিয়ে দিচ্ছে কেউ। এই আপাত-সাধারণ কাহিনি থেকে দানা বাঁধছিল কাহিনি, যত এগিয়েছে এই উপন্যাস তত বেড়েছে জটিলতা। এসেছে রহস্যমৃত্যু। অবশেষে রহস্যের জট ছাড়িয়েছে টাপুরদি।
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মৃত্যুর গন্ধ’। অম্বরীশ বাবু দেখা করতে এসেছেন টাপুরদির সাথে। তাঁর গাট ফীলিং বলছে তাকে কেউ মারতে চায়। তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেই কেস তিনি দিতে চান টাপুরদিকে। দিচ্ছেন মোটা অঙ্কের চেক। এমন ঘটনা দিয়ে শুরু অনেক গল্প উপন্যাস পাঠক আগে পড়েছেন। তবে এই উপন্যাস বাঁক নিয়েছে সম্পূর্ণ অন্যদিকে।
তৃতীয় উপন্যাস পাঁচালির ধাঁধা। পটভূমি মুর্শিদাবাদ। হলুদ রঙের বহু পুরনো সিল্কের হলদে কাপড়ে লাল কালিতে লেখা আছে পাঁচালির মত কিছু একটা। এই কাহিনি শুরু হচ্ছে সেখান থেকে। এই কাহিনির রহস্য সমাধানে ধরা পড়েছে টাপুরদির মেধার ঝলমলে দীপ্তি। ঝরঝরে স্মার্ট ন্যারেটিভ। ফেলুদার কথা মনে পড়তে পারে পাঠকের।
চতুর্থ উপন্যাস ঈশ্বরের হাত। বিনোদ মজুমদারের রহস্যমৃত্যুর পর তাঁর প্রক্তন স্ত্রী মনামীর সাথে টাপুরদির কথোপকথন দিয়ে শুরু হচ্ছে এই উপন্যাস। বিনোদের ফুসফুসে পাওয়া গেছে রাইসিন বিষ। মদ্যপান করলেও তিনি ধূমপান করতেন না। তাহলে কীভাবে তাঁর ফুসফুসে পাওয়া গেল এই বিষের অস্তিত্ব? এই জায়গা থেকে এগিয়েছে রহস্যকাহিনি যার জট সোমজা ছাড়িয়েছেন নিপুণভাবে।
পঞ্চম উপন্যাস রিপুর আবর্তে। রিয়াল এস্টেট ম্যাগনেট বিজন চট্টরাজ মিসিং। তাঁর স্ত্রী সৌরভী এসেছেন টাপুরদির কাছে। তাঁর সন্দেহ বিজন বিয়ের বাইরে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, অভিসারে গেছেন কোথাও। সৌরভীর তথ্যপ্রমাণ চাই যাতে তিনি কোর্টে তা দাখিল করতে পারেন। এটি সম্ভবত এই বইয়ের সেরা রহস্যকাহিনি।
ঝরঝরে স্মার্ট গদ্য সোমজার আয়ত্ত। রহস্য দানা বাঁধা ও জট ছাড়ানোর কাজটি তিনি করেছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে। এই বইটির প্রকাশক খোয়াই পাবলিশিং হাউস। ছাপা ও বাঁধাই চমৎকার। তবে পড়তে গিয়ে মনে হল ছাপাখানার ভূত এই বইটিকে ছাড়েনি। বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ চোখকে কষ্ট দিয়েছে। আর যেটা বলার, বইটর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদটি এঁকেছেন কৃষ্ণেন্দু মন্ডল।
জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে পাশ করা সোমজা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর তা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সোমজা প্রতিশ্রুতিবান লেখক। তাঁর জন্য অনেক শুভকামনা রইল।