ঠগের ঘর
ওখানে আলিপুরের আদালতের কাছে পথের উপর একটি বটের ছায়া। আর এখানে বেহালার এক বস্তির মধ্যে একটি মাটির ঘরের দরজার কাছে একটি তুলসীর বেদী।
রোজ যেমন, আজও তেমনিই ওই তুলসীর বেদীতে একবার মাথা ঠেকিয়ে কাজে বের হয়ে গিয়েছে রাইচরণ। কাজের মধ্যে হলো ওই এক কাজ। এতদূর পথ হেঁটে এসে আদালতের কাছে এই বটের ছায়ায় চুপ করে বসে থাকা।
রাইচরণের হাতের কাছে থাকে একটি হস্তরেখা-বিচার, অনেকগুলি কড়ি আর একটি চার আনা দামের পঞ্জিকা। চোখের সামনে মাটির উপর পাতা থাকে দাবার ছক এর মতো একটি ছক। সেই ছকের মধ্যে নানারকম অঙ্ক কিলবিল করে। কোথায় শনি, কোথায় রাহু আর কোথায় মঙ্গল অবস্থান করলে অদৃষ্টচক্রের কোথায় কী যে ঘটে যাবে, তার সব উত্তর ওই একটি ছকের মধ্যে নীরব হয়ে রয়েছে। একবার কেউ এসে রাইচরণের চোখের সামনে তার হাতটা এগিয়ে দিলেই হয় অথবা কেউ এসে শুধু তার রাশিটার নাম বলে দিতে পারলেই হয়। রাইচরণ তখনই একটি স্লেটের উপর খড়ি দিয়ে দেগে অঙ্ক কষে তার জীবনের অবধারিত পরিণাম, আসন্ন পরিণামের আভাস, এবং আরও অনেক কিছু বলে দেবে।
মানুষের কররেখা আর কপালরেখা দেখে, এমন কি স্বপ্নের একটা বর্ণনা শুনেও রাইচরণ ভবিষ্যতের অনেক ভালোমন্দ সম্ভাবনার কথা বলে দিতে পারে। বেতের খাঁচার মধ্যে একটা তোতা আছে। এই তোতার কেরামতিও অসাধারণ। মামলায় জিত হবে কি হবে না–হ্যাঁ কিংবা না? একআনা পয়সা রেখে জিজ্ঞাসু ব্যক্তি রাইচরণের সামনে চুপ করে বসে থাকে। একটি কাগজে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’-কে মিশিয়ে দিয়ে তোতার সামনে ফেলে দেয়। তোতার কানে একটি কড়ি কিছুক্ষণ চুইয়ে রাখে রাইচরণ; তারপর বিড়বিড় করে, “দেবীর আজ্ঞা, দেবতার আজ্ঞা, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের আজ্ঞা। ছুঁয়ে ফেল, নিয়তির পাখি।”
তোতাটি এতগুলি কাগজের পুরিয়া নেড়েচেড়ে ঠিক একটি পুরিয়া ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরে, হঁ্যা কিংবা না। ‘হ্যাঁ’ দেখে খুশি হয় জিজ্ঞাসু, ‘না’ দেখে বিমর্ষ হয়।
স্কুলের ছেলে চুপিচুপি এসে জানতে চায়, পরীক্ষায় পাস আছে না ফেল আছে? রাইচরণ বলে, “তিনটি ফুলের নাম বলো।” ফুলের নাম শুনেই রাইচরণ বলে দেয়, “পাস।” স্কুলের ছেলে খুশি হয়ে দুটো পয়সা রাইচরণের হাতে তুলে দিয়ে চলে যায়।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই শুধু বসে বসে ঝিমোতে হয়। পথের উপর দিয়ে মাঝে মাঝে ভিড় যেন স্রোতের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায়। কিন্তু এই বিপুল জনতার ভেতর থেকে কজনই বা অদৃষ্টের কথা জেনে নেবার জন্য। শ্যত হয়? দু’পয়সা থেকে দু’আনা, এই তো গণনার দক্ষিণা। সন্ধ্যা হলে যখন পয়সা গোনে রাইচরণ, তখন বুকের ভেতরটা ভয়ে সিরসির করে ওঠে। মাত্র তেরো আনা! কী করে দিন চলবে?
বটের ছায়ায় বসে বসে যেমন জীবনটা তেমনই চেহারাটাও ওই বটের ঝুরির মতো শীর্ণ আর রুক্ষ হয়ে গিয়েছে। রাইচরণের চেহারাটা ফরসা, মুখটা সাদা কাগজের মুখোশ বলে মনে হয়। আস্তে আস্তে এক-একবার উঠে শরীরটা টান করে আর হাই তোলে রাইচরণ। সেই সময় ওর ছেঁড়া গেঞ্জি ভেদ করে বুকের পাজরগুলি কাঁটার মতো যেন ফুটে বের হয়।
মাঝে মাঝে দেখা যায়, একটু ফাঁকা পেয়ে আর গণকার রাইচরণকে একলা পেয়ে কেউ কেউ একাই এগিয়ে আসে। এদিক-ওদিক তাকায়। তারপর বলে, “একটা কথা একটু গুনে বলে দেবেন ঠাকুরমশাই?”
“কি?”
“ভালোবাসার মানুষটা ঠকাবে না তো?”
“কতদিনের ভালোবাসা?”
“তা মন্দ দিনের নয়। এই ধরুন এক বছ।”
“সধবা, কুমারী, না বিধবা?”
“বিধবা।”
“নামের প্রথম অক্ষরটা বলুন।”
“প।”
একটু ভেবে নিয়ে রাইচরণ বলে, “যদি দু’আনা দেন তবে নখদর্পণ করে বলে দিতে পারি।”
দু’আনা পয়সা বের করে রাইচরণের হাতের কাছে রেখে দেয় জিজ্ঞাসু লোকটা। রাইচরণও লোকটার হাতটা কাছে টেনে নিয়ে তার একটা আঙুলের নখের উপর কড়ি ঘষে। তারপর নখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর খুশি হয়ে বলে, “হাসছেই তো দেখলাম।”
“তার মানে?”
“তার মানে ঠকাবে না।”
অন্যদিনের মতো আজও বটের ছায়ায় মাঝে মাঝে ব্যস্ত হয়ে ওঠে রাইচরণের গণৎকারিতা। ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝে ছোলা চিবোয়, আর সামনের টিউবওয়েল থেকে জল খেয়ে আসে।
রাইচরণের বয়স মন্দ হয়নি। চল্লিশ বছর তো নিশ্চয়। কিন্তু এত বেশি শুকিয়ে আর পাকিয়ে গিয়েছে বলেই একটু বুড়ো বুড়ো দেখায়। কিন্তু এই বটের ছায়া থেকে অনেক দূরে বেহালার বস্তির মেটে ঘরের দরজার সামনে তুলসীর বেদীর কাছে যে এখন গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই মানুষটির চেহারা কিন্তু আজও তাজা মাধবীলতার মতো ফুরফুর করে।
রাইচরণের বউ পারুলবালা। যে রাইচরণ গণৎকার, আকাশের রাহু-শনি-মঙ্গলের মতিগতির রহস্য হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে, সে আজ এই বটের ছায়ায় বসে কোন তন্দ্রার মধ্যে এখনও চমকে ওঠেনি। কিন্তু এতক্ষণে বেহালার বস্তির মধ্যে সেই মেটে ঘরের ভিতরে গণৎকার রাইচরণের অদৃষ্ট ভয় পেয়ে চমকে উঠেছে।
দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে মণিবাবু নামে এক ব্যক্তি, যে আজ এই তিন মাস ধরে রোজই রাতে একবার এসে রাইচরণের সঙ্গে তাস খেলে চলে যায়। বড় ফিটফাট চেহারা মণিবাবুর, মানুষটিও বেশ শৌখিন। হারমনিয়ম মেরামত্রি কাজ জানে, মন্দ রোজগারও করে না। নইলে একমাস ঘনিষ্ঠতা হতেই পারুলকে এমন সুন্দর একটি রেশমী শাড়ি উপহার দেয় কেমন করে? রাইচরণ নিজেও শাড়ি দেখে খুশি হয়ে বলেছিল, “বাঃ, বেশ চমৎকার!”
সেই মণিবাবু বেশ একটু গম্ভীর এবং বেশ একটু ব্যস্তভাবে বলে, “আর দেরি করে লাভ নেই।”
পারুলবালা বলে, “তুমিই তো আসতে অনেক দেরি করে দিলে। আমি তো ভেবেই মরছিলুম, এ আবার কোন্ এক নতুন ঠগের পাল্লায় পড়লুম।”
রাইচরণকে আজ ঠগ বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে পারছে পারুল, এবং মনে হয়েছে, এই পৃথিবীর মধ্যে মণিবাবুই একমাত্র মানুষ, যে কখনই ঠগ হতে পারে না, এবং কোনদিনও হবে না।
জ্যোতিষবিদ্যার কারবার করি, কত রাজা-মহারাজা আমার খদ্দের, কলকাতার বাসায় ঠাকুর-চাকর আছে, এইরকম একটি অতি স্বচ্ছল অবস্থার মানুষ বলে নিজের। পরিচয় দিয়ে পারুল নামে একটি সুন্দরী মেয়েকে এক গেঁয়ো মামাবাড়ির দাসীপনা থেকে উদ্ধার করেছিল যে, সে হলো ওই রাইচরণ। আজ পারুলবালা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে ভাবে, সেই নির্দয় মামাবাড়ির দাসীপনা বু ভালো ছিল। কিন্তু এ কি নাশ করল লোকটা! মিথ্যে কথা বলে পারুলেরও মন ভিজিয়ে দিয়ে, অনেক ভালোবাসার কথা বকে বকে পারুলের মনের ভিত্রটাকে একেবারে এলোমেলো করে দিয়ে, তারপর সত্যি অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করে নিয়ে এসে আজ ও কোন্ দশার মধ্যে পারুলের জীবনটাকে ঠেলে নিয়ে এসেছে রাইচরণ ঠগ?
রাইচরণকে সহ্য করেছে শুধু, ক্ষমা করতে পারেনি পারুল। সব মিথ্যা, ব মিথ্যা। লোকটার শুধু চেহারাটাই দেখতে ভালো ছিল, আর কথাগুলি মিষ্টি। তাই দেখে পারুলের মন ভুলেছিল নিশ্চয়, স্বীকার করে পারুল, এবং সেই ভুলের জন্যই তো তার আজ এই দশা। আটটা বছর ধরে একেবারে একটানা হাভাতে জীবন সহ্য করতে হয়েছে। কত মুলুকেই না পারুলকে ঘুরিয়ে মেরেছে লোকটা। বর্ধমান, ধাবাদ, রাঁচি, মুঙ্গের। মানুষের ভাগ্য শুনতে শুনতে ছটফট করে দুনিয়ার চারদিকে যেন ছুটে বেড়িয়েছে লোকটা, বু বিয়ে করা বউটাকে পেট ভরে ভাত খাওয়াতে পারেনি। এক আধটা গয়নার সাধ তো দুঃস্বপ্ন। এমন দিন গিয়েছে, যখন শাড়ির অভাবে ঘরের ভিতরে গামছা পরে বন্ধ থাকতে হয়েছে।
ধানবাদে থাকতে একদিন কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ঘরের বাইরে এসে যেচে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে দুরবস্থার কথা বলে টাকা নিয়েছিল পারুল। আজও মনে পড়ে পারুলের, সেই ভদ্রলোক ঠিক সন্ধ্যা হতেই এসে ঘরের দরজায়। কড়া নেড়েছিলেন। চেঁচিয়ে কেঁদে ফেলেছিল পারুল। অনেক মাপ চেয়ে তবে রেহাই পেয়েছিল।
আজ মনে হয়, সেই বাজে কাঁদুনির কোন অর্থ হয় না। সেই ভদ্রলোককে দরজা খুলে দিলে কি এমন খারাপ হতো? রাইচরণকে ঘেন্না করতে করতে এরকম অনেক কথাই অনেকবার মনে হয়েছে। অনেকবার বলেও দিয়েছে ওরকম দুচারটে কথা। কিন্তু রাইচরণ নির্বিকার।
আজও নির্বিকার মনে অদৃষ্টের একগাদা নোরা ঝুলি-ঝোলা নিয়ে কোন এক বটগাছের ছায়ার কাছে গিয়ে বসে আছে লোকটা। মিথ্যে কথা বলে লোক ঠকায়। ঠকিয়ে বিয়ে করে। আজ কিন্তু ওর এতদিনের নির্বিকার ঠগিপনার উপর অদৃষ্টের প্রতিশোধ ঘনিয়ে এসেছে। তাই এসেছে মণিবাবু।
.
এই তিনটে মাস মণিবাবু নামে মানুষটা অনেক মায়া করেছে বলেই পারুলের সাজটা একটু রঙিন হয়েছে। পারুলের মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিন মণিবাবুর চোখ জলে ভরে উঠেছিল। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল পারুল : “আমার কষ্ট দেখলে আপনি কাঁদনে কেন? আপনি তো আমার কেউ নন।”
মণিবাবু বলেছিল, “কেউ নই বলেই তো দুঃখ হচ্ছে পারুল, তাই যতখানি সাধ আছে ততখানি করতে পারছি না।”
সেই একটি সন্ধ্যায় এই তুলসীবেদীর কাছে দাঁড়িয়ে মণিবাবুর কথাগুলি শুনে পারুলবালার বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠেছিল। কিন্তু তারপর আর নয়।
মণিবাবু বলেছিল, “যতদিন বাঁচি ততদিন দুরে থেকেই তোমাকে ভালোবা। থাক, তুমি যেমনটি আছ তেমনটিই থাক। আমি যেন তোমাকে শুধু মাঝে মাঝে দেখতে পাই।”
পারুলবালার গলার স্বরটা বিভোর হয়ে বলে, “মাঝে-মাঝে কেন, রোজই দেখে যেয়ো।”
রোজই এসেছিল মণিবাবু এবং রাইচরণের সঙ্গে তাস খেলেছে। বাজার করে নিজের হাতে বয়ে নিয়ে এসেছে কপি আর চিংড়ি আর মুগের ডাল।
পারুলবালা আশ্চর্য হয়ে দেখেছে, আর মনে মনে ঘেন্নায় জ্বলে গিয়েছে, রাইচরণ নির্বিকার মনে সেই কপি-চিংড়ি আর মুগের ডালের রান্না খেয়েছে। বেহায়াটা যেন নিজের রোজগারের জিনিস গর্ব করে খাচ্ছে।
মন্বিাবুকে ভালো লাগে। খুব ভালো করে সেজে মণিবাবুর চোখের সামনে দাঁড়াতে ভালো লাগে। মুগ্ধ হয়ে যায় মণিবাবু। কিন্তু দেখতে পায় পারুল, রাইচরণ নামে যে লোকটা তার স্বামী হয়ে বসে আছে, সেই লোকটা যেন কিছুই দেখতে পায় না।
“আর এভাবে নয় পারুল,” যেদিন মণিবাবু পারুলের হাত ধরে এই কথাটা বলে ফেললো, সেদিন পারুলের মনটাও যেন গলে গেল।
পারুল বলে, “আমিও বলছি আর এভাবে পড়ে থাকবার কোন মানে হয় না।”
“তা হলে যাবে?”
“যাব।”
সেই যাবার লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে। বেহালার বস্তির ভিতরে একটা মেটে বাড়ির অদৃষ্ট আজ আর কিছুক্ষণ পরেই শূন্য হয়ে যাবে। ব্যস্তভাবে বাক্স সাজাতে থাকে পারুলবালা।।
মণিবাবুই দিয়েছে, সেই রঙিন শাড়িতে বাক্স ঠাসা। মণিবাবুই দিয়েছে দুটো গয়না, কানের আর গলার। সে দুটোও বাক্সের ভিতরে আছে। তবে আর সাজবার ও দেরি করার কী আছে?
বাক্সের ভিতরে ছেঁড়া পুরনো আবর্জনার মতো অনেক জিনিস আছে। সেগুলি ফেলে দিলে বাক্সটা একটু হালকা হয়।
মণিবাবু বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, পুরনো যা কিছু আছে সব ফেলে দাও।”
বাক্স উপুড় করে পারুলবালা। পারুলের দু’হাতে যেন ডাকাতির নেশা পেয়ে বসেছে। চোখ দুটো ছুরির ফলার মতো চকচক করে। নাক আর কান তেতে যেন বলছে, লালচে হয়ে উঠেছে। আট বছরের জীবনের মতো ছেঁড়া নোংরা কুৎসিত স্মৃতিকে এখানে ফেলে রেখে দিয়ে চলে যাবার জন্য ছটফট করছে এক নারীর মৃণাভরা মন।
হাঁপাতে থাকে পারুল। মণিবাবু বলেন, “কী হলো?”
পারুল বলে, “একটা লাল চেলির জোড় রয়েছে দেখছি।”
মণিবাবু চেঁচিয়ে ওঠে, “ছুঁড়ে ফেলে দাও।”
চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে পারুল। তারপর চেলির জোড়টাকে গুছিয়ে পাট করে তাকের উপর রেখে দেয়। হো-হো করে হেসে ওঠে মণিবাবু।
আবার বাক্স সাজায় পারুল। মণিবাবুরই দেওয়া যত উপহারের সম্ভার—আয়না, পাউডার, সুগন্ধ তেল, ঢাকাই, টাঙ্গাইল, বিষ্ণুপুরী আর ধনেখালির রঙিন শাড়ি। কানের দুল আর গলার হার।
“চলো এইবার। আর দেরি করা ভালো নয়।”
পারুলবালার চোখ দুটো নিথর হয়ে শুধু দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরেই চমকে উঠে ঘরের মেঝেটার দিকে তাকায়। মণিবাবু বিরক্ত হয়ে বলে, “কি হলো?”
পারুল বলে, “এইসব ছেঁড়া কাপড়-চোপড় ছড়িয়ে পড়ে ঘরটাকে বড় বিশ্রী করে দিল যে। কেমন নোংরা দেখাচ্ছে যে!”
হ্যাঁ, দেখে মনে হয়, চোর ঢুকে একটা একলা অসহায় ঘরের বুকটাকে যেন তছনছ করেছে। পারুল বলে, “একটু দাঁড়াও, যাচ্ছিই যখন, তখন ঘরটাকে একটু গুছিয়ে রেখে যাই।”
“কী আশ্চর্য!” চেঁচিয়ে ওঠে মণিবাবু।
ঘর গোছায় পারুলবালা। এখানে-ওখানে বাসনগুলি পড়ে আছে। ঘটিটা এরই মধ্যে গড়িয়ে একটা ভাঙা টিনের পেটরার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে। ঘটিটাকে তুলে নিয়ে দরজার পাশে রেখে দেয় পারুল।
মণিবাবু বলে, “যত সব বাজে যাচ্ছেতাই কাজ আবার শুরু করলে কেন পারুল?”
পারুল বলে, “ কিছু নয়, কিছু নয়। লোকটা এসে হাত-মুখ ধোবার জন্য ঘটিটা জে খুঁজে যেন মিছে হয়রান না হয়….তাই…।”
মণিবাবু গম্ভীর হয়, “সন্ধ্যা হয়ে আসছে কিন্তু পারুল।”
পারুল বলে, “এই তো আমি তৈরি। শুধু একটু….।”
আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে থাকে পারুল। একটা ছেঁড়া কামিজ দেয়ালের একটা গোঁজের সঙ্গে ঝুলছে। ময়লা ছেঁড়া কামিজ, তালি ছিল, সেই গলিটাও খুলে গিয়েছে। সেই তালিটাকে সেলাই করে জুড়ে দিতে আর কামিজটাকে একটু ধুয়ে কেচে রাখতে পারেনি পারুল, ভুলেই গিয়েছে। তাই লোকটা কদিন ধরে শুধু ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে দিয়ে কাজে বের হয়ে যায়।
মণিবাবুর দাঁতে দাঁতে শব্দ হয় যেন, “মনে হচ্ছে, তুমি এখন ওই ছেঁড়া কামিজ সেলাই করতে বসবে।”
যেন একটা খেলা পেয়েছে পারুল। মণিবাবুর দিকে তাকিয়ে মিনতি করে বলে, “একটু দিই না কেন? কতক্ষণই বা সময় লাগবে?”
“বাঃ!” ভ্রুকুটি করে মণিবাবু।
“আচ্ছা থাক— “ ভয় পেয়ে আর অপ্রস্তুত হয়ে মণিবাবুর মেজাজ শান্ত করবার জন্য পারুল টেনে টেনে হাসতে থাকে: “আমাকে তুমি যতটা বোকা মনে করছ, ততটা বোকা আমি নই।”
মণিবাবুও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। বাক্সটাকে নিজেই হাতে তুলে নিয়ে বলে, “চলে এসো। বড় রাস্তায় গিয়ে ট্যাক্সি ধরব।”
পারুল বলে, “তুমি গিয়ে বাইরে দাঁড়াও, আমি এক মিনিটের মধ্যেই বের হয়ে আসছি।”
বাক্সটা হাতে নিয়ে দরজা পার হয়ে বাইরের তুলসীর বেদীর কাছে ছায়ান্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে মণিবাবু। পরমুহূর্তেই দেখে চমকে ওঠে, বুঝতে পারে মণিবাবু, ঘরের ভিতর আলো জ্বেলেছে পারুল। উঃ, কত থিয়েটারী টঙ। রাগ চাপতে চেষ্টা করে মণিবাবু।
দাঁড়িয়ে থেকে শুধু ছটফট করে মণিবাবু। অনেকক্ষণ তো হলো। এখনও আসে কেন পারুল?
আবার এগিয়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়ায় মণিবাবু। আবার চমকে ওঠে এবং স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে, কিন্তু দেখেও ঠিক বুঝতে পারে না মণিবাবু, এ কী করছে পারুল? উপুড় হয়ে ঘরের মেঝের মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে যেন প্রণাম করে পড়ে রয়েছে পারুল।
“ও কি হচ্ছে?” গর্জনের মতো স্বরে, আর দাঁতে দাঁত চিবিয়ে ডাক দেয় মণিবাবু।
প্রণাম নয়, প্রণামের মতো একটা ঢঙ। উনুনটার কাছে মেঝের উপর মাথা পেতে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে পারুল। উনুনের উপর একটা কড়া কড়ার মধ্যে শুকনো একটা রুটি আর এক ছিটে রান্না করা শাক।
আস্তে আস্তে মুখ তোলে পারুল। মণিবাবুর দিকে তাকায়। তার পরেই পাগলের মতো চোখ করে যেন একটা প্রলাপ বিড়বিড় করতে থাকে: “তা হলে লোকটা আজ ঘরে ফিরে এসে খাবে কী মণিবাবু? বলতে গেলে কিছুই যে নেই। ওই একটা শুকনো রুটি আর…।”
চিৎকার করে ধমক দেয় মণিবাবু, “তুমি কি এখন তা হলে রান্না আরম্ভ করবে, হতভাগী মেয়েমানুষ?”
কোনও উত্তর দেয় না পারুলবালা।।
মাত্র আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে মণিবাবু। তার পরেই বাক্সটাকে বেশ শক্ত করে ধরে নিয়ে দরজার দিকে সরে যায়।
চলে যাবার আগে আর একবার চেঁচিয়ে ওঠে মণিবাবু: “তোমার ওই ঠগ সোয়ামির চেয়ে তুমি আরও ভয়ানক ঠগ। ছিঃ!”
.

বিহারের হাজারিবাগে ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আদি নিবাস বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে। হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিশিষ্ট দার্শনিক ও গবেষক মহেশ ঘোষের লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতেন। প্রত্নতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, এমনকি সামরিক বিদ্যায়ও তার যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। গত শতকের চল্লিশ দশকের প্রায় প্রারম্ভিক কাল ঘেঁষা বাংলা সাহিত্যের কাল পর্বের জীবন শিল্পী সুবোধ ঘোষ। আদি নিবাস বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বহর গ্রামে। তার লেখালেখির কালপর্ব ১৯৪০ থেকে ১৯৮০। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে একটু বেশি বয়সে যোগদান করেও নিজস্ব মেধা মনন চিন্তা চেতনা আর লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে সুবোধ ঘোষ তার অসাধারণ রচনা সম্ভাবের মাধ্যমে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করে হাজারিবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজে ভর্তি হয়েও অভাব অনটনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় তাকে। বিচিত্র জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলো তার জীবন। হেন কাজ নেই তাকে করতে হয়নি সংসারের ঘানি টানার প্রয়োজনে। পড়াশোনা ছেড়ে কলেরা মহামারি আকার নিলে বস্তিতে টিকা দেবার কাজ নেন। কর্মজীবন শুরু করেন বিহারের আদিবাসী অঞ্চলে বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে। এরপর সার্কাসের ক্লাউন, বোম্বাই পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণীর কাজ, চায়ের ব্যবসা, বেকারির ব্যবসা, মালগুদামের স্টোর কিপার ইত্যাদি কাজে তিনি তার প্রথম জীবনের যতটা অংশ ব্যয় করেন। বহু পথ ঘুরে ত্রিশ দশকের শেষে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে সহকারী। ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট উত্তর দাঙ্গা বিধ্বস্ত নোয়াখালী থেকে তিনি গান্ধীজির সহচর থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন দাঙ্গা এবং দাঙ্গাউত্তর কালপর্বে সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতাকে। অনামী সঙ্ঘ (বা চক্র) নামে তরুণ সাহিত্যিকদের বৈঠকে বন্ধুদের অনুরোধে সুবোধ ঘোষ পর পর দুটি গল্প অযান্ত্রিক, এবং ফসিল লেখেন যা বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। সুবোধ ঘোষের প্রথম গল্প অযান্ত্রিক, এরপর ফসিল। তার আর একটি বিখ্যাত গল্প ‘থির বিজুরি’। শুধুমাত্র গল্পকার হিসাবেই সুবোধ ঘোষ অণ্বেষু শিল্পী ছিলেন না। সুবোধ ঘোষ উপন্যাস রচনাও ঋদ্ধ তার যথার্থ প্রমাণ তিলাঞ্জলি (১৯৪৪) সুবোধ ঘোষের ঔপন্যাসিক হিসাবে প্রথম প্রভিভার স্বাক্ষর ’তিলাঞ্জলি’। এ উপন্যাসে তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শকে উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। কংগ্রেস সাহিত্য সংঘের মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে। মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত এ উপন্যাসে তৎকালীন কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ ’জাগৃতি সংঘ’র জাতীয়তা বিরোধী চরিত্রের মতবিরোধের রূপরেখা অঙ্কনে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি এই উপন্যাসে।১০ মার্চ, ১৯৮০ সালে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।