| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: জনপ্রিয় রক ব্যান্ড দ্য বিটলস । ওসমান জাফর

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে যদি একা থাকতে হয়, আর সঙ্গে যদি রাখতে দেওয়া হয় একটি গানের অ্যালবাম? উত্তরে তিনি বিটলস ব্যান্ডের একটি অ্যালবামের কথা বলেন। অন্যদিকে, জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি একাধিক লেখায় বিটলসের গানের উল্লেখ করেছেন। তার বিখ্যাত ছোট্টগল্প ‘ইয়েসটারডে’ বিটলসের বিখ্যাত গান ‘ইয়েসটারডে’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই লেখা।

গ্রহের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্ল্যাসিক রক ব্যান্ড বিটলস। কিন্তু জানেন কি, সারা পৃথিবীতে আজও তুমুল জনপ্রিয় এই ব্যান্ডটির ব্যাপ্তিকাল ছিল মাত্র নয় বছর—১৯৬০ থেকে ১৯৬৯। বিটলসের গানের লিরিক, মিউজিক, ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহার এবং সদস্যদের ফ্যাশনেবল লাইফস্টাইল সমকালেই তাদের ক্ল্যাসিক ব্যান্ডদলে পরিণত করে। জন লেনন তো এক সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেন, “বিটলস ব্যান্ড যিশু খ্রিস্টের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়।”

তাদের শিল্পসম্মত অর্জন ও বাণিজ্যিক সফলতা আজও একটি মর্যাদাপূর্ণ আসনে স্থির হয়ে আছে। যদিও তাদের প্রাথমিক সাঙ্গীতিক ধরন ১৯৫০-এর রক অ্যান্ড রোলের মূলে প্রোথিত ছিল, তথাপি বিভিন্ন সাঙ্গীতিক ধরন, যেমন—লোকসংগীত, রকাবেলি সাইকেডেলিক এবং ভারতীয় সংগীতের বিভিন্নতাকেও ধারণ করেছিল বিটলস।

তাদের পোশাক-আশাক ও কেশবিন্যাস পৃথিবীকে দিয়েছিল নতুন স্টাইল

বিটলসের প্রভাব সংগীতের বাইরেও ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের পোশাক-আশাক, কেশবিন্যাস, বক্তব্য, এমনকি তাদের পছন্দের যন্ত্রাণুষঙ্গের প্রভাব পুরো ১৯৬০-এর দশকজুড়েই নানাভাবে চর্চিত হতে থাকে। এবং জানুন, আজকে পর্যন্তও বিটলস পৃথিবীর অন্য যে কোনো ব্যান্ডদলের চেয়ে বেশি অ্যালবাম বিক্রিকারী ব্যান্ডদল। যুক্তরাজ্যে তাদের ৪০টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয় এবং সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা পায়। এই বাণিজ্যিক সফলতার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল অন্যান্য দেশেও। ইএমআই-এর অনুমান অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের মধ্যে বিটলসের এক বিলিয়নেরও বেশি ডিস্ক ও টেপ বিক্রি হয়েছিল। আমেরিকাতেও একক গান এবং অ্যালবাম বিক্রির ক্ষেত্রে বিটলস ছিল সর্বকালের সেরা।

২০০৪ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন বিটলসকে সর্বকালের সেরা ১০০ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর তালিকার শীর্ষে স্থান দেয়।

হামবুর্গ এবং যুক্তরাজ্য জনপ্রিয়তা
১৯৫৭ সালের মার্চে লিভারপুলের কুয়েরি ব্যাংক গ্রামার স্কুলে পড়াকালীন জন লেনন ‘দ্য কোয়ারিমেন’ নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৫৭ সালের ৬ জুলাই সেইন্ট পিটার্স চার্চের উল্টন গার্ডেনে লেননের সাথে পল ম্যাককার্টনির সাক্ষাত হয় এবং এর কিছুদিন পর লেনন তাকে ব্যান্ডে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তরুণ গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনকে লিভারপুলের উইন্সটন হলে দলটির শো দেখতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ম্যাককার্টনি ও হ্যারিসন ছিলেন একই এলাকার বাসিন্দা। লিভারপুল ইনস্টিটিউট থেকে ফেরার সময় তারা পরিচিত হন এবং ম্যাককার্টনির অনুরোধে জর্জ হ্যারিসন লিড গিটারিস্ট হিসেবে দ্য কোয়ারিমেন দলে যোগ দেন। লেনন শুরুতে কম বয়স্ক হবার কারণে হ্যারিসনকে নিতে না চাইলেও ১৯৫৮ সালের মার্চে দলের সাথে মহড়ার পর তিনি সন্তুষ্ট হন।

কম বয়স্ক হবার কারণে হ্যারিসনকে দলে নিতে চাননি জন লেনন

সে সময় নিয়মিত সদস্য যোগ দিয়েছে আবার বেরিয়েও গেছে। ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে লেননের ক্লেজ জীবনের বন্ধু স্টুয়ার্ট সাটক্লিফ বেজ গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন। লেনন ও ম্যাককার্টনি উভয়েই রিদম গিটার বাজাতেন। দলে ড্রামারের সংকট ছিল। পরে ১৯৬২ সালে রিঙ্গো স্টার দলটিতে যোগ দান করেন। রিঙ্গোকে সঙ্গে নিয়ে দলটি তাদের নিজস্ব একক গানগুলো বিভিন্ন কনসার্টে পরিবেশন করতে থাকে। ম্যাককার্টনি ও লেনন ম্যাককার্টনি/লেনন গান লেখায় জুটি গড়ে তোলেন। ইতোমধ্যেই তারা বেশ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন।

বিটলস নামকরণ
কোয়ারিমেন ব্যান্ডের নাম বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়—‘জনি অ্যান্ড দ্য মুনডগস’, ‘লং জন অ্যান্ড দ্য বিটলস’, ‘দ্য সিলভার বিটলস’, এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে ‘দ্য বিটলস’ নামটি স্বীকৃতি পায়। ব্যান্ডের নাম ও নামের বানান নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। তবে সাধারণত লেননকেই নামকরণের কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যিনি বলেছিলেন নামটি বিটল (beetle) পোকা (বাডি হলির দ্য ক্রিকেটস নামে ব্যান্ড ছিল) ও বিট (beat) এর মিলনে তৈরি করা হয়েছে। সিনথিয়া লেননের মতে বিটলস নামটি র‌্যাভেনশ হল বারের বিয়ার-পূর্ণ টেবিলে মাথা খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

পল ম্যাককার্টনি ব্যান্ডদলের বিদঘুটের বানানের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করেন

লেনন যিনি একই ঘটনার বিভিন্ন কাহিনী বলার জন্য বিখ্যাত, ১৯৬১ সালে মার্সি বিট ম্যাগাজিনকে বলেন, স্বপ্নে একটি মানুষ জ্বলন্ত পাই নিয়ে তাদের কাছে আসে এবং বলে যে আজকে থেকে তারা এ বানানের বিটল্স। ২০০১ সালে এক সাক্ষাৎকারে পল ম্যাককার্টনি নামের বিদঘুটের বানানের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, জন বিটলস (beetles) নামের প্রস্তাব করেছিল, তখন আমি বলি বিটলস (beatles) হলে কেমন হয়? কারণ আমি ড্রামের বিট পছন্দ করি। তখন সবাই এটি বেশ পছন্দ করে। বিটলস শব্দের অর্থ ঝিঁঝিঁ পোকা। জন লেনন প্রথম নামটি প্রস্তাব করেন এই অর্থে যে, তারা আসলে গানের ঝিঁঝিঁ পোকা।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি
১৯৬৩ সালের ২২ মার্চ দ্য বিটলসের প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম প্লিজ প্লিজ মি মুক্তি পায়। ১৯৬২ সালের জনপ্রিয় একক গানগুলোর পাশাপাশি নতুন কিছু গানসহ মোট ১৪টি গান এ অ্যালবামে স্থান পায়। এ অ্যালবামটি ইংল্যান্ডের সংগীতের শীর্ষতালিকায় প্রথম স্থান দখল করে। ফলে দলটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তারা নিজেদের একটি লোগোও তৈরি করে ফেলে।

দ্য বিটলসের লোগো
দ্য বিটলসের দ্বিতীয় স্টুডিও অ্যালবাম উইদ দ্য বিটলস মুক্তি পায় ২২ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে। এ অ্যালবামটির রেকর্ডিং চলেছে একই বছরের ১৮ জুলাই থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। এতে জর্জ হ্যারিসনের প্রথম কম্পোজিশান করা গানটি রয়েছে। ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দলটি ইংল্যান্ড ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক পরিসরে কনসার্ট করার জন্য। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এক টিভি অনুষ্ঠানে গান গায়। ৭৩ লক্ষ দর্শক অর্থাৎ সে দেশের ৪০% মানুষ শো-টি দেখে। তাদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি আরো বেড়ে যায়।

দ্য বিটলসের লোগো

দলে জন লেনন পরিচিত ছিলেন সুদর্শন বিটল হিসেবে, পল ম্যাককার্টনি মিষ্টি বিটল, জর্জ হ্যারিসন শান্ত বিটল, ও রিঙ্গো স্টার রসাত্নক বিটল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ হার্ড ডে’স নাইট ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এতে ব্যান্ডটি তাদের রক অ্যান্ড রোল ধারা অব্যাহত রাখে। এটি প্রকৃতপক্ষে বিটলসের সদস্যদের অভিনীত কয়েকদিন আগের মুক্তি পাওয়া একই শিরোনামের একটি হাস্যরসাত্নক চলচ্চিত্রের গানের অ্যালবাম। চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। এ গানের অ্যালবামের রেকর্ডিংয়ে জর্জ হ্যারিসন ব্যবহার করেন ১২ তারের রিকেনবেকার গিটারটি। একই বছরের একেবারে শেষভাগে, বড়দিনের আগে বিটলস ফর সেল মুক্তি পায়। তারা সর্বমোট ১২টি স্টুডিও অ্যালবাম প্রকাশ করে। তাদের সর্বশেষ অ্যালবাম লেট ইট বি ১৯৭০ সালের মে মাসে মুক্তি পায়। ১৯৬০ দশকে দ্য বিটলসই বিশ্ব সংগীতজগতে রাজত্ব করেছে।

ভাঙ্গন
দ্য বিটল্স-এর ভাঙ্গনের পেছনে একাধিক কারণ ছিল। মূলত ব্যক্তিগত মতের অমিলের রেশ ধরেই ১৯৬৮ সাল থেকে তাদের দলে ভাঙ্গনের সূত্রপাত হয়। ১৯৭০ সালে ‘দ্য বিটলস’-এর আনুষ্ঠানিক ভাঙ্গন সম্পন্ন হয়। ভাঙ্গনের পর চার বিটল ব্যক্তিগত সঙ্গীত ক্যারিয়ারে প্রবেশ করেন। ১৯৮০ সালে জন লেনন-এর মৃত্যর পর ১৯৯৪ সালে বাকি তিন বিটল একত্রিত হয়েছিলেন।

দীর্ঘকাল ধরে দ্য বিটলসের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার কারণ
যুক্তরাজ্যের ব্যান্ড হয়ে দ্য বিটলস যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবাম সার্টিফিকেশন তালিকায় সর্বপ্রথমে অবস্থান করছে ১৭৮ মিলিয়ন স্কোর নিয়ে। ব্যান্ডটির এত জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে অনেক কারণ। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক প্রধান কিছু কারণ।

১। ট্রেন্ড ক্রিয়েটর
মূলত ১৯৪০ সালের দিকে রক মিউজিকের ট্রেন্ড চালু হয়। তখন ব্লুজ, রিদমের চল বেশি দেখা যায়। ১৯৬০ সালের পর দ্য বিটলস মিউজিক নতুন ট্রেন্ড চালু করে। নতুন ঘরানা ‘পপ রক’। একদমই অন্যরকম সাউন্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণে বিটলসকে মানুষ মনে রাখবে শত শত বছর।

২। অল্প বয়সে অনেক বড় কিছু করে দেখানো
স্কুল পড়ুয়া জন লেনন (১৬) ও পল ম্যাকার্টনি (১৫) ১৯৫৭ সাল থেকে এক সঙ্গে জ্যাজ দলে মিউজিক করেন। সে বছরেই তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ১৪ বছর বয়সী জর্জ হ্যারিসন। পরবর্তীতে টিন এজার রিঙ্গো স্টারকে নিয়ে তারা ব্যান্ড গঠন করে। এত অল্প বয়সে নতুন ঘরানা সৃষ্টি এখনো সংগীত জগতের বিস্ময়।

৩। নিজস্ব স্টাইল
দ্য বিটলসের প্রত্যেক সদস্যের গেটআপ ও স্টাইল ছিল একই রকম। এটি ছিল তাদের ব্যক্তিগত শৈলি। গানের নতুন ট্রেন্ডের সঙ্গে দ্য বিটলস প্রতিষ্ঠিত করেছে ভিন্ন ফ্যাশন। দুয়ে মিলে জনপ্রিয়তাও বেড়েছে দ্বিগুণ গতিতে।

৪। গানের মধ্যে রয়েছে লুকায়িত শক্তিশালী বার্তা
পপ গান কেমন হতে হবে সেই নির্দেশনা পাওয়া যায় দ্য বিটলসের গানে। তাদের প্রত্যেক গানে বিনোদনের পাশাপাশি লুকায়িত আছে শক্তিশালী ও প্রয়োজনীয় বার্তা।

৫। তারা চির ক্লাসিক
মিউজিকাল জনার, লিরিক ও স্টাইল সব কিছুতেই দ্য বিটলস চির ক্লাসিক। ক্লাসিক হওয়ার বড় সুবিধা থাকে দু’ভাবে। প্রথমত, প্রায় সব স্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকে। দ্বিতীয়ত, তা কখনোই হারিয়ে যায় না। মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে রাখে।

জন লেনন হত্যা
Imagine there’s no countries
It isn’t hard to do
Nothing to kill or die for
And no religion too
Imagine all the people
Living life in peace…
– জন লেনন

জন লেনন

‘ইমাজিন’ গান শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে জন লেননের আকর্ষণীয় চুল, চোখ, চশমার সম্মোহিত রকব্যান্ডের দীপ্তিময় চেহারার রক ব্যান্ডের সাধুর সুরত। সেদিন ছিল ৮ ডিসেম্বর। নিজের একক এ্যালবাম ‘Double Fantasy’-র প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন লেনন। স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে স্টুডিওতে যাচ্ছিলেন। যথারীতি এক দঙ্গল ভক্ত দৌড়ে আসে। লেননকে ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে। সে ভিড় ঠেলে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় চ্যাপম্যান। তার হাতে নতুন অ্যালবামের একটা কপি। বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা লেননের দিকে এগিয়ে দেয় চ্যাপম্যান। মুচকি হেসে তাতে অটোগ্রাফ দেন লেনন। তারপর বলেন, “Is this all you want?” চ্যাপম্যান নিশ্চুপ। শুধু একবার মাথা নাড়ে।

গাড়িতে করে চলে যান লেনন। ঘণ্টাখানেক স্টুডিওতে গান রেকর্ড করে আবার ফিরে আসেন। তখন রাত প্রায় এগারোটা। ক্লান্ত লেনন-ওনো এগিয়ে যাচ্ছেন বাসার দিকে। রাস্তার এদিকটা কিছুটা নির্জন। অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে এলো চ্যাপম্যান। তাকে অতিক্রম করে যান লেনন-ওনো। ওভারকোটে লুকানো রিভলবার বের করে চ্যাপম্যান। পেছন থেকে লেননকে ৫টি গুলি করে। একটি বুলেট লেননের মাথার পাশ কেটে চলে যায়, বাকি চারটা আঘাত করে তার বুকে।

জন লেলনকে হত্যাকারী চ্যাপম্যান

মুহূর্তেই লুটিয়ে পরেন লেনন। রক্তে ভেসে যায় তার শার্ট, চশমার কাচেও রক্তের ছোপ। গুলির আওয়াজে আতংকিত মানুষ ছুটে আসে লেননের কাছে। তখনও তিনি জীবিত ছিলেন। মিনিটখানেকের মধ্যে পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স আসে। নিকটস্থ রুজভেল্ট হসপিটালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত ঘোষণা করা হয় সংগীতের এ রাজপুত্রকে।

লেননকে খুন করে রাস্তার অপর পারে গিয়ে ভাবলেশহীন চ্যাপম্যান ফুটপাতে বসে বই পড়া শুরু করে। উপন্যাসের নাম “The Catcher in the Rye”। বইটা তার কোটের ভেতরে ছিল। তার শান্ত অবয়ব দেখে মনেই হবে না এইমাত্র সে একটা মানুষ খুন করেছে। এক পুলিশ অফিসার চ্যাপম্যানের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, “Do you know what you have just done?”
“Yes, I just shot John Lennon,” মৃদুকণ্ঠে চ্যাপম্যান উত্তর দেয়।

হত্যাকারীর ব্যাগে পাওয়া যায় এই বই

জেরোমে ডেভিড স্যালিঙ্গারের লেখা ‘The Catcher in the Rye’। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস। চ্যাপম্যানকে আটক করার সময় বইটিও উদ্ধার করা হয়। প্রথম পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে “This is my statement” লেখা ছিল তার প্রথম পাতায়। “I just sought a way to be someone I wasn’t. To be loved.”—লেননকে হত্যা করার কারণ হিসাবে চ্যাপম্যান বলেছিলেন এ কথা। মাত্র ৪০ বছরের জীবনে জন লেননের ক্যারিয়ার সত্যিই বিস্ময়কর। একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ তাঁর হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু কালজয়ী গানগুলো মানুষ ভালোবেসে যাবে চিরকাল।

চাইলে জন লেননের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বানানো সিনেমা “Chapter 27” দেখতে পারেন। আততায়ী মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেরেড লেটো।

মার্ক চ্যাপম্যানের জন লেনন হত্যার কারণ
জন লেনন হু হু করে জগতজোড়া খ্যাতি মার্ক চ্যাপম্যানকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। যেহেতু মার্ক চ্যাপম্যান ছিলেন বিটলসের প্রাক্তন সদস্য। নিজের সতীর্থের এমন খ্যাতি একেবারে কম চেনা মার্ক চ্যাপম্যানকে ইনফিরিওটি কমপ্লেক্সে ভোগায় অথচ চ্যাপম্যান তখন অবধি বিটলসের টপ ফ্যানদের একজন। পত্রিকার সাক্ষাৎকারে যখন জন লেনন বলেন, বিটলসের যিশু খ্রিস্টের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। মার্ক চ্যাপম্যান ছিলেন খ্রিস্টধর্মের প্রবল বিশ্বাসী। যদিও ধর্মকর্ম পালন করতেন না তেমন। আবার লেনন যখন বলেন, তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, স্বর্গ নরকে বিশ্বাস করেন না। মার্কের হিংসাত্নক আক্রোশে যেন আরো ঘি ঢালে জন লেননের এ কথা। একটা লোক যে যিশু খ্রিস্টের চেয়ে জনপ্রিয় অথচ সে নাস্তিক। এভাবেই একসময় মার্ক চ্যাপম্যান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে জন লেননকে হত্যা করবে, তার স্ত্রীকেও সেই কথা জানায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্যাচার ইন রে ক্ল্যাসিক উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিপ্লবী চরিত্র দ্বারা মার্ক চ্যাপম্যান জন লেননকে খুন করতে উৎসাহিত হন। ২০১২ সালে বিশ বছর জেল খেটে ছাড়া পান মার্ক চ্যাপম্যান।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত