Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

রক্তে ভেজা গারো পাহাড়ের কৃষকদের রক্তের ইতিহাস   

Reading Time: 3 minutes

ইতিহাসশব্দটির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই সেখান থেকেই আমরা ইতিহাসের নানা শাখাপ্রশাখা সমূহের সাথে পরিচিত হই। রাজা, মহারাজা, সম্রাট, সাম্রাজ্য, শাসনশোষণ যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি নানান ইতিহাসের ভিড়ে অনেক ইতিহাসই আমাদের অজানা থেকে যায়। যদিও জানা যায় তবুও তার ছিটেফোঁটা মাত্র। বাংলাদেশের তেমনি একটি ইতিহাস কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস। যার অন্যতম আন্দোলনটংক আন্দোলন আর এই আন্দোলন টুকরো টুকরো ইতিহাসকে সম্পূর্ণ সচ্ছভাবে একত্রিত করার জন্য শিশির রাজনরক্তে ভেজা গারো পাহাড়নামে বইটি লিখেছেন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। দ্বিতীয় পরিমার্জিত মুদ্রণ একুশে গ্রন্ত্রমেলা ২০১৯, প্রকাশক বেহুলাবাংলা, মূল্য২০০ টাকা।

টংক আন্দোলন নিয়ে এর আগেও অনেক বইতে টুকরো আলোচনা পাওয়া যায়। কিন্তু শুধুমাত্র টংক আন্দোলন নিয়ে লিখিত রক্তে ভেজা গারো পাহাড় এখন পযর্ন্ত প্রথম বই। শিশির রাজন ৩১ টি সহায়ক গ্রন্থ এবং মাঠ পর্যায়ে তথ্য নিয়ে বইটি লিখেছেন। এই বই সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য হল

কমরেড মনি সিংহ কমিনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন টংক আন্দোলনে কৃষকদের রক্তক্ষয়ী বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস আমাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। বিশেষ করে, আন্দোলনে হাজং কৃষকদের যে মর্মস্পর্শী, বীরত্বগাঁথা আখ্যান রচিত হয়েছিল তা জানার আগ্রহ থেকেই এই বইয়ের যাত্রা শুরু।

১৮৮৫ সালে কৃষকদের সুবিধার জন্য যে, “ প্রজাস্বত্ব আইনপাশ করা হয় সেই আইনের দুর্বলতা থেকেইটংকপ্রথায় ভূমি ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এই প্রথার বিরুদ্ধে ১৯৩৭৫০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দি থানায় টি পর্যায়ে আন্দোলন চলে। এতে নেতৃত্ব দেন মনি সিংহ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার মাসফ্রন্টকৃষক সমিতি এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মূলত দুটি

.    কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি। 

.    জনগণের আস্থা অর্জন করে কমিউনিস্টদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ। 

আর এই আন্দোলনের সংখ্যাগরিষ্ট শক্তি ছিল আদিবাসী হাজং কৃষকেরা।পাগলা পন্থাআন্দোলনের রেশ ধরেই হাতি খেদা আন্দোলন এবং টংক আন্দোলনে হাজংদের সংগ্রামের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা য়ায়।

শিশির রাজন টংক আন্দোলনকে টি পর্যায়ে ভাগ করে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং পর্যায়ের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে পর্যায় গুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ১ম পর্যায়ের প্রেক্ষাপটে টংক প্রথার সূচনার কারণ, টংক প্রথার সাথে আদিবাসী হাজং কৃষকদের সংশ্লিষ্ঠতা পরবর্তীকালে মুসলমান কৃষকদের সাথে সংশ্লিষ্ঠতা তুলে ধরা হয়েছে। মনি সিংহ কীভাবে হাজং কৃষকদের সাথে ঘনিষ্ট হলেন এবং কীভাবে তিনি আন্দোলনের নেতৃত্বে আসলেন তার একটা স্পষ্ট ধারনা পাই এখানে।

প্রথম পর্যায়ে প্রেক্ষাপট আলোচনায় শিশির রাজন উলে­ করেছেন হাজংদের কৃষক সমাজে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি আরো বলেছেন মনি সিংহের পাশাপাশি হাজং নেতা ললিত সরকারের যৌথ উদ্যোগে লেংগুড়া অঞ্চলে আন্দোলনের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এসকল বিবরণ টংক আন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে আমরা মনে করি।

               দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনে প্রেক্ষাপট আন্দোলনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আন্দোলনের ২য় পর্যায়কে ১৯৪৬১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত চিহ্নিত করেছেন।

যা থেকে আমরা জানতে পারি পর্যায়ে আন্দোলনের সাংগঠনিক নেতৃত্ব কমিউনিস্ট পার্টির সাথে একেবারেই মিশে যায়। তিনি এখানে আন্দোলনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্টভাবে উলে­ করেছেন১ম টি হচ্ছে তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন রাশিমনি হাজংএর শহীদ দিবসটি হচ্ছে ১৯৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে কুমুদিনী হাজং হচ্ছেন সেদিনকার ঘটনার শিকার মাত্র। তিনি উল্লেখ করেছেন কুমুদিনী হাজং শুধুমাত্র টংক আন্দোলনের একজন কৃষক কর্মী। যেখানে আমাদের সমাজে প্রচলিত যে, কুমুদিনী হাজং আন্দোলনের নেত্রী সেখানে শিশির রাজন একরকম বক্তব্য টংক আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করলো। তৃতীয় পর্যায়ে তিনি টংক আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের শুরুর প্রেক্ষাপট রক্তক্ষয়ী বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি এখানে এও উলে­ করেছেন যে, কমিউনিস্ট পার্টি শুধুমাত্র তাদের জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে আন্দোলনকে জঙ্গী আন্দোলনের রূপ দেয়। পর্যায়ে অনেক যুদ্ধের বিবরণ আমরা দেখতে পাই। আমরা জানতে পারি  আদিবাসী হাজং কৃষক সহ অনান্য কৃষক   কমিউনিস্টদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী।

বইটিতে তিনটি পর্যায়ের আলোচনার পর শিশির রাজন আন্দোলন প্রত্যাহারের পর হাজং অঞ্চলে সরকারের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন। সেখানে হাজং কৃষকদের উপর নিশংসতার নানা তথ্য অনেক বস্তুুনিষ্ঠভাবে উঠে এসেছে। এসকল অজানা বিষয় টংক আন্দোলনে হাজং কৃষকদের ত্যাগের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এরপর তিনি আন্দোলনের কিছু বিতর্কিত বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। মাঠ পর্যায়ে অনেকের মতামত সংগ্রহ করেছেন। তিনি সমস্ত কিছু পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে সশস্ত্র সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পূর্ণরূপে হাজংদের তাঁদের জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এবং তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ীই আন্দোলনটি থামিয়ে দিয়েছেন। 

তারপর তিনি দেখিয়েছেন টংক আন্দোলন কি কমিউনিস্ট আন্দোলন? না হাজং কৃষক আন্দোলন? নাকি কৃষক আন্দোলন? তিনি সমস্ত কিছু পর্যালোচনা করে বলেছেন– 

টংক আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে একটি কৃষক আন্দোলন। যার পরিচালনার সাংগঠনিক নেতৃত্বে ছিলেন মনি সিংহ কমিউনিস্ট পার্টি এবং এর প্রধান শক্তি ছিলো আদিবাসী হাজং কৃষকরা।” 

শিশির রাজন মাঠ পর্যায়ে গবেষনা বিভিন্ন বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে টংক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিচয় উলে­ করে তালিকা দিয়েছেন এবং আন্দোলনে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের পরিচয় দান করেছেন। 

টংক আন্দোলনের সার্বিক ব্যাপকতা পর্যালোচনা করে শিশির রাজন উলে­ করেছেন

টংক আন্দোলনে কমিউনিস্ট, হাজং কৃষক, অনান্য কৃষকদের যে অবদান তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। সকলের বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস একটি গুররুত্বপূর্ণ আন্দোলন। তিনটি পর্যায়েই সাধারণ জনগণের সাথে ব্যাপক সম্পৃক্ততা, কৃষকদের শোষকশ্রেণির গ্রাস থেকে মুক্তির সংগ্রামের গুরুত্বের দিক বিবেচনা করলে আমি মনেকরি এটি কেবল মাত্র বিশেষ রাজনৈতিক দল বা ¤প্রদায়ের গন্ডিতে আবদ্ধ নয়। যা বাংলাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের কাছে সমান ভাবে গ্রহণ যোগ্য।” 

বইটিতে তথ্য উপাত্তের বলিষ্ঠ উপস্থাপনা বিশ্লেষণ এবং লেখকের টংক আন্দোলনের সম্পূর্ণ ইতিহাসকে তুলে ধরার যে প্রচেষ্ঠা তাতে আমি বলতে পারি শিশির রাজনেররক্তে ভেজা গারো পাহাড়একটি অনবদ্য সৃষ্টি। যা টংক আন্দোলনের ইতিহাসকে এই প্রথমবারের মতো স্বচ্ছ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করলো। 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>