| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ: প্রাসাদ ঘেরা গ্রাম । শুভময় পাল

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

রওনা হয়েছিলাম গাড়ি নিয়েই। কলকাতা থেকে বারাসাত হয়ে বসিরহাট-টাকি রোড ধরে এসে স্বরূপনগর বাজার পেরিয়ে বাঁদিকে ঢুকতেই চলে এলাম ধান্যকুড়িয়া গ্রাম। আমার পরিচিত একটি ছেলে থাকে এখানে। বহুদিন ধরে বলছে ওদের গ্রামে নাকি চমকে যাওয়ার মত জিনিস আছে। গ্রামের মুখেই দাঁড়িয়েছিল ছেলেটি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The Village of Castles in Bengal


গ্রামের রাস্তা ধরে খানিকদূর এগোতে হঠাৎ বাঁদিকে চোখে পড়লো এক বিশাল প্রাসাদ, গোলাপি রংয়ের স্বপ্ন যেন। ঢুকতেই এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলো, লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি, ছোটখাট চেহারা, টাক মাথা; একেবারেই এই রাজপ্রাসাদের সাথে মেলানো যাচ্ছেনা। ছেলেটি পরিচয় করিয়ে দিল, যতীনদা, যতীন্দ্র চন্দ্র গায়েন। নাম বেশ রাজকীয়। এই বাড়ির এক শরিক। চললাম ভেতরে ওর সঙ্গে। বাইরের নতুন রঙ আর জাঁকজমক ভেতরবাড়িতে অদৃশ্য। পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলাম ওর সাথে। দড়িতে লুঙ্গি, নাইটি, শাড়ি… একসময়ের জমকালো লাল মেঝে ফেটে চৌচির। ইউরোপিয়ান স্টাইলের থাম ঘিরে দড়ির বাঁধন। বারান্দায় বেঞ্চ, পুরোনো লোহার, এখন জং ধরা। বিড়ি ধরিয়ে যতীনদা বলতে শুরু করলো, বহু বছর আগের কথা, তখন বসিরহাট অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গাই বাদাবন আর নোনা জলের খাঁড়ি, সুন্দরবনের অংশ। জগন্নাথ দাস বলে একজন করিৎকর্মা মানুষ তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে, জল জঙ্গল সাফ করে ১৭৪২ সালে ধান্যকুড়িয়া গ্রামের গোড়াপত্তন করেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The Village of Castles in Bengal


এরপর আস্তে আস্তে বহু পরিবার এসে বসবাস শুরু করে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই চাষবাস শুরু হয় আশেপাশের অঞ্চলে। গায়েন, সাউ, বল্লভ এই তিনটি পরিবার আস্তে আস্তে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। শুধু ধান্যকুড়িয়া না, গোটা বসিরহাট অঞ্চল জুড়ে এদের প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়ে। সাউরা প্রথমদিককার জমিদার এই অঞ্চলের। পাট, ধান আর আখের চাষাবাদ এদের সমৃদ্ধশালী করে তোলে। সাউদের সাথে বিয়ের সূত্রে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে বল্লভ আর গায়েনদের এবং এরাও আস্তে আস্তে প্রতিপত্তি বাড়াতে শুরু করে। এই তিন পরিবার ধীরে ধীরে ভীষণ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। গায়েনরা সেই সময় ‘বসিরহাট টাউন হল’, বসিরহাট হাসপাতাল তৈরী করেন। গ্রামের উন্নতিতেও এদের অবদান অনেক। এরা অনেক সময়ই তিনটি পরিবার মিলেমিশে অনেকগুলো কাজ করেছেন। ১৮৮৮ তে সাউ’রা গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয় চালু করেন, গায়েনরাও ডিসপেনসারি খোলেন গ্রামে। এত বছর আগে, ১৯৮৫ তে ওই প্রত্যন্ত গ্রামে মহেন্দ্রনাথ গায়েন আর উপেন্দ্রনাথ সাউ ইংরিজি মিডিয়াম স্কুল চালু করেন। ১৮৯৩ সালে মেয়েদের স্কুল খোলেন সাউ’রা। ইংরেজদের আনুকূল্যে এঁদের উন্নতি, ব্যবসা ইংরেজদের সাথে করেই ওনাদের রমরমা। তবে সেই সময়ে সমাজের কথাও ভেবেছিলেন ওনারা। দুর্ভিক্ষর সময়ে ওনারা স্থানীয় মানুষদের বহুদিন খাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদিও করেছিলেন। আমরা ওকে বিদায় জানিয়ে বাড়ি ঘুরে দেখতে শুরু করলাম গায়েনবাড়ি। গোবিন্দ চন্দ্র গায়েন গড়ে তোলেন গায়েন এস্টেট। এই জমিদারির উপার্জনের প্রধান উৎস ছিল পাট আর আখের গুড়। প্রায় ২০০ বছর আগে গড়ে ওঠে এই জমিদারি।

এই রাজবাড়ি তৈরী হয়েছিল ২০০ বছর আগে। ঢুকতেই চোখে পড়ে বাঁদিকে ওনাদের কুলদেবতার মন্দির, ভীষণ সুন্দর। পেরিয়ে এলেই ‘L ‘ শেপের ম্যানসন, একুশটা সুদৃশ্য পিলার দিয়ে তৈরী, আর L এর দুই মাথায় দুটো সুদৃশ্য গম্বুজ, একদম রাজা আর রানীর মুকুটের মতো। ইউরোপিয়ান ঘরানার প্রাসাদ। ভেতরে বাইরের চাকচিক্য না থাকলেও ভেতরের কাঠের কারুকাজ, খিলান, কলকা সবই সেই সময়কে বয়ে নিয়ে চলেছে। পুরো প্রাসাদে মোট তিনটে ব্লক আছে আর প্রতিটার আলাদা উঠোন। দুটো তলা জুড়ে মোট ৬০ টা ঘর, যেগুলো ঝুলবারান্দা আর করিডোর দিয়ে জুড়ে আছে। মূল ব্লকের ডানদিকে দুর্গা দালান। প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো গায়েনদের দুর্গাপুজো, এখনো কোন বছর বন্ধ থাকেনি, গত বছর করোনার জন্য শুধু ঘট পুজো হয়েছে। পুজোর সমস্ত কিছুই বংশপরম্পরায় চলে আসছে। ঢাকি, পুরোহিত সবাইই এই পুজোর অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে। এই বাড়িতেই ১৯৬০ সালে গুরু দত্তের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ এর শুটিং হয়েছিল, আর একেবারে সাম্প্রতিক অতীতে ঋতুপর্ণর ‘সত্যান্বেষী’।

এই প্রাসাদের ঠিক বাইরে ডানদিকে তিনতলা নহবতখানা। গম্বুজ এবং নহবতখানা জড়িয়ে থাকা থামেরা মিলে তৈরী করেছে ভীষণ সুদৃশ্য এক স্থাপত্য। এই নহবতখানায় এক অন্যরকম বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলাম, নিশ্চয়ই সচেতনভাবেই করা; তিনটে তলার স্থাপত্য তিন রকমের। একদম নিচের তলার গোলাকার কলকা করা আর্চ একেবারেই মন্দিরের আদলে, দোতলার যমজ আর্চ মসজিদের স্ট্রাকচার মনে করায় আর তিনতলার কনিকাল আর্চ একেবারেই চার্চের নিজস্ব।

এই গায়েনদের এক পূর্বপুরুষ আশুতোষ গায়েন ব্রিটিশদের থেকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিও পেয়েছিলেন, এ ছিল সম্ভবতঃ বহুদিন ব্রিটিশদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য আর তাদের আনুগত্য মেনে নেওয়ার পুরস্কার। ব্রিটিশদের বিনোদনের জন্য ১৯৩৫ এ ১২ একর জায়গায় বিশাল বাগানবাড়ি গড়ে তুলেছিল জমিদার মহেন্দ্রনাথ গায়েন। একদম টাকি রোডের ওপর এই বিশাল বাগান। ধান্যকুড়িয়া গ্রামে না ঢুকে একটু এগোলেই দেখা যায় এই সুবিশাল কেল্লার মত প্রাসাদ। একেবারে মধ্যযুগের ইউরোপীয় ঘরানার গথিক আর্কিটেকচারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু এই কেল্লাটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় থেকে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার জন্য। ইতালিয়ান মার্বেল আমদানি করে মেঝে তৈরী হয়ে গেছিলো, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের জন্য বেলজিয়ান কাঁচ এসে পৌঁছয়নি, তাই সমস্ত জানালাই কাঁচবিহীন রয়ে যায়। এই বাগানবাড়িতে ঢোকার গেটটিও এক্কেবারে ওই ইউরোপিয়ান ঘরানাতেই তৈরী, দুধারে বিশাল দুই গম্বুজের মাঝে গেট। এখন পুলিশ পোস্টিং করা আছে, কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে পারলামনা। শুনলাম একসময় এখানে মহিলাদের অনাথ আশ্রম চলতো, যেটি কিছু বছর আগে উঠে গেছে কোন অজ্ঞাত কারণে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The Village of Castles in Bengal


গায়েনবাড়ি পেরিয়ে একটু এগোলেই ডানদিকে সাউবাড়ি। গায়েনবাড়ির জাঁকজমকের কাছে বেশ ফ্যাকাসে, বাড়িটা একেবারে মেনটেন করা হয়না। তবে বিস্মিত হলাম একদম গ্রিক ঘরানার লতাপাতা ঘেরা কোরিন্থিয়ান পিলার আর জানালার আর্চে স্টাকো দেখে। কিছু কিছু জানালার আবার রঙিন কাঁচের দারুণ ব্যবহার। গায়েনবাড়ির আগেই তৈরী হয়েছিল সাউবাড়ি, দুটো বাড়িই প্রায় সমসাময়িক, পতিত চন্দ্র সাউ তৈরী করেন এই বাড়িটি। ঠিক ঢোকার মুখেই রঙিন কাঁচের আর্চ দরজার ওপরেই। ভেতরে উঠোন ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রাসাদ। ঘরগুলো পরপর, করিডোর লম্বা, সোজা আর মাঝে মাঝেই অর্ধেক চাঁদের মতো আর্চ দুটো পিলারের মাঝে। ঠাকুরদালান আছে এখানেও, কিন্তু একটা ছোট দরজা দিয়ে ঢুকে লম্বা করিডোর পেরিয়ে যেতে হয়। বাগানবাড়িও আছে সাউদের, কিন্তু তার খুবই বেহাল অবস্থা এখন। আমরা যখন গেলাম, তখন ভেতর দালানের উঠোনে কোন রাজনৈতিক দলের মিটিংয়ের প্রস্তুতি চলছে, বোঝা গেল এখন বেহাত হয়ে গেছে এই প্রাসাদ। বল্লভবাড়ি বা পুতুলবাড়ি, সাউবাড়ি ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম, ঠিক সাউবাড়ির পেছনে একটা পুকুর, শুনলাম এটা সাউদের নিজস্ব পুকুর, কিন্তু এখন আবর্জনার স্তুপ। সেসব ছাড়িয়ে গেলেই বাঁদিকে পেল্লায় সাদা সবুজ রংয়ের প্রাসাদ, বড় লোহার পাঁচিল ঘেরা, এটাই বল্লভবাড়ি। গেটটাও লোহার এবং বিশাল। নতুন রঙ হয়েছে প্রাসাদে, একদম ঝকঝক করছে প্রাসাদ। এই প্রাসাদ তৈরী করেছেন শ্যামাচরণ বল্লভ, যাঁর নামেই কলকাতার শ্যামবাজার। ওনাদের এখনো আরজি কর হাসপাতালের পাশেই প্রাসাদোপম অট্টালিকা আছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,The Village of Castles in Bengal


বিশাল কোরিন্থিয়ান পিলার আর স্টাকো স্টাইল এরও বৈশিষ্ট্য। দোতলা এই অট্টালিকার ওপরের বেশ কিছু অংশ সবুজ কাঠের শেড দিয়ে ঢাকা। প্রাসাদের মাথায় স্টাকো স্টাইলে ময়ূর, শুনলাম শৌর্যের প্রতীক, আর তার মাথায় রোমান স্টাইলের আর্চ, এবং তার কোনায় কোনায় মানুষের মূর্তি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নতুন রঙ ওই মূর্তিগুলোর পুরোনো সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে। ভেতরে উঠোন। একপাশে ঠাকুরদালান আর তাকে ঘিরে লম্বা করিডোর আর পরপর ঘর। এখনো বেশ কিছু ঘরে পুরোনো বিলিয়ার্ড বোর্ড, ইতালিয়ান ভাস্কর্য, পুরোনো বেলজিয়ান আয়না আর প্রচুর পুরোনো সোনার জলে লেখা চামড়া বাঁধাই বই আছে। করিডোরগুলোয় বেশ কিছু পুরোনো বাতি আর সোনার জলের ফ্রেমে বাঁধানো পূর্বপুরুষদের ছবি আছে। এই মূল অংশের ঠিক ডানদিকে ছোট্ট একটা উঠোন এবং তা ঘিরে ঠাকুর চাকরদের থাকার জায়গা। প্রাসাদের পেছনে বিশাল এক পুকুর এবং খুব অবাক কান্ড, প্রাসাদের লাগোয়া একদম নৌকার মতো উঁচু করা একটা অংশ আছে, যা পুকুরের মধ্যে চলে গেছে অনেকখানি। শুনলাম ওখানে বাড়ির মহিলারা স্নান করতেন এবং যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায় তাই এই ব্যবস্থা। বাগানের একদম শেষে গায়েনবাড়ির মতোই নহবতখানা, তবে অতটা সুন্দর নয়। বল্লভবাড়ি পেরিয়ে আরেকটু এগোলে ডানদিকে মাঠের মধ্যে সাদা রংয়ের বিশাল রাসমঞ্চ বল্লভদের, একদম দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদলে। কার্ত্তিক পূর্ণিমায় এখনো বিশাল মেলা হয় এইখানে। পিলার এবং চূড়ায় সুসজ্জিত রাসমঞ্চ সত্যিই দৃষ্টিনন্দন।

সব দেখে যখন ফিরছি, ওই প্রাসাদগুলোর দেখভাল যারা করছে, তাদের কথাগুলো মনে পড়ছিলো। এত বিশাল, স্থাপত্যের দিক থেকে এত সুন্দর নিদর্শন গ্রাম বাংলায় একেবারে বিরল। খুব তাড়াতাড়ি এই অট্টালিকাগুলো যদি না সরকারি হস্তক্ষেপ হয়, এদের বাঁচানো মুশকিল। এ রকম ইউনিক এক গ্রাম হারিয়ে ফেলবে তার বৈশিষ্ট্য, আমরা হারাবো ইতিহাসের এক ছোট্ট সোনালী অধ্যায়।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত