Categories
অনুবাদ প্রবন্ধ: মৃত্যু । কার্লোস ফুয়েন্তেস । অনুবাদক: আবদুস সেলিম
আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
মৃত্যুর সঙ্গে মানুষকে যদি পদচারণা করতেই হয় তবে জীবনের উপযোগী সময় কোনটি? ফ্রয়েড বাণী দিয়েছেন সকল প্রাণীই একসময় প্রাণহীন ছিল। জীবনের অবসান অর্থ মৃত্যু। মৃত্যু এক অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন সম্রাজ্ঞী যিনি একাধারে আমাদের পূর্বসূরী এবং উত্তরসূরী। মৃত্যু কি আমাদের অস্তিত্বের আগেই আমাদের চিহ্নিত করে রেখেছিলো? আমরা গত হলেও কি সে আমাদের স্মরণে রাখবে? অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের অতীতে যে শূন্যতা ছিল সেই একই শূন্যতা কি আমাদের স্থান দখল করে নেবে এবং প্রকৃতির অন্তর্গত এক সচেতন সত্তায় পরিণত করবে– নিজের শূন্যতায় নয় বরং আমাদের জীবনযাত্রার ফলশ্রুতি হিসেবে? বীরশ্রেষ্ঠ, উচ্চণ্ড বিত্তবান এবং সুন্দরতমকে মৃত্যু আলিঙ্গন করে। কিন্তু একথাও সমান সত্য মৃত্যু সবচেয়ে হীনমান, দরিদ্র এবং কদর্য ব্যক্তির জন্যও অনিবার্য– শুধু এ কারণে নয় যে মৃত্যুই পরম সত্য, এ কারণেও নয় যে মৃত্যু মানুষের সচেতনতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। বরং বলা যায় মৃত্যু আমাদের গ্রাস করে কারণ তাকে আমরা উপেক্ষা করি। জানি একদিন মৃত্যু আসবেই যদিও জানি না তার স্মরণ কেমন। অলৌকিক প্রেরণা, দুঃখবোধ, বিভ্রান্তি, বিপদ এবং যেমন মেহিকোর কবি হাবিয়ের বিইয়াররুতিয়া বলেছেন “মৃত্যুর প্রতি স্মৃতিকাতরতা” নিয়ে তার জন্য অপেক্ষমান। আমাদের জীবনকে আমরা নিরুপণ এবং তৌল করতে সক্ষম কিন্তু এও জানি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই হলো আসল অভিযোক্তা এবং রায় প্রদানের আগেই জানা আছে এতে কী লেখা। মৃত্যুই হলো চূড়ান্ত, অনিবার্য সহচর। সেই সহচর কি বন্ধু না শত্রু? শত্রু। আর যখন এই শত্রু আমাদের ভালবাসার জনকে কেড়ে নেয় তখন সে হয়ে যায় প্রতিদ্বন্দ্বী। মৃত্যু যে কী পরিমাণে পক্ষপাতদুষ্ট, প্রতিকুল এবং ঘৃণ্যতম তা বোধগম্য হয় যখন সে আমাদের পরিবর্তে আমাদের ভালবাসার মানুষকে নিয়ে যায়। কিন্তু তবুও শত্রু হিসেবে মৃত্যুকে একক মৃত্যুরূপে আমরা পরাজিত করতে সক্ষম।
মাঝে-মাঝে আমি লন্ডনের ব্রম্পটন সমাধিতে হাঁটতে গিয়ে শুভ্র ক্রুশচিহ্নে পরিপূর্ণ কবর অতিক্রম করি। গোরস্থানের অধিকাংশ সমাধিফলক থেকে এগুলো আলাদা। ওই সাদামাটা ক্রুশগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাওয়া তরুণ যোদ্ধাদের সমাধিফলক। আমি ওদের জন্ম ও মৃত্যু তারিখগুলো পড়ি আর বারবার প্রচণ্ড আঘাত পাই কারণ এদের মধ্যে একজনকেও পাইনি যে ত্রিশ বছর পর্যন্ত বেঁচেছে। এই যে এত তরুণ বয়সে মৃত্যু, সেটাই তো অবিচার। এই চরম নিষ্ঠুরতায় তাড়িত হয়ে আমরা অন্তত তিনটি বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারি। প্রথম হলো, একজন তরুণের মৃত্যু আমাদের স্পষ্ট বলে দেয় যে, মৃত্যু থেকে আমাদের কোনওক্রমেই পরিত্রাণ নেই। দ্বিতীয় হলো, কিছু কিছু তরুণের মৃত্যুতে আমাদের এই উপলব্ধি হয় যে আমাদের কাছ থেকে ওদের আরও বেশি ভালবাসা পাবার অধিকার আছে।
তৃতীয় বিষয়টি হলো এই যে, আমাদের ভালবাসার তরুণ যাদের আমরা হারিয়েছি তারা আসলে বেঁচেই আছে কারণ যে ভালবাসা আমাদের একাত্ম করেছে তা তো চিরঞ্জীব।
এসব কি আসলে এক প্রকারের সান্তনা? এই দিয়ে কি মৃত্যুকে জয় করা সম্ভব? কিংবা এই বিষয়গুলো বিপরীত কিছু করে মৃত্যুর শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়? মৃত্যু আমাদের বলে, তুমি নিজেকেই প্রতারণা করছ– যা ছিল তা এখন আর নেই। আমরা তার উত্তরে বলি, আমরা তোমাকেই বোকা বানাচ্ছি যা ছিল তা থাকবেই, বরং আরও বেশি করে থাকবে। মৃত্যু আসে, অন্যের মৃত্যুর উদাহরণ দিয়ে নয়, বরং এই বিশ্ব থেকে আমাদের অন্তর্ধানের ভয় দেখিয়ে। মৃত্যু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলে যারা আমাদের মৃত্যুর পর বেঁচে থাকবে তাদের স্মৃতিতে স্থায়ী হওয়াই হবে আমাদের আসল জীবন।
এই কথার সত্যতা আমাদের জানা নেই, জানবও না কোনওদিন। শুধু এটুকু জানি যারা আমাদের স্মৃতিধর তারাও একদিন অন্তর্হিত হবে একথা আশা করে যে তাদের স্মরণে রাখার জন্য কেউ না কেউ বেঁচে থাকবে। মৃত্যু আমাদের ব্যাঙ্গোক্তি করে, ভেবে দেখো চার কী পাঁচ প্রজন্মের পর আমরা কাউকে কি আর মনে রাখি? আমাদের কী সীমাহীন পারিবারিক গাথা, পুরুষানুক্রমিক পোর্ট্রেট, চিরস্মরণীয় ঘটনাক্রম আছে যা দিয়ে আমাদের অসংখ্য পূর্বপুরুষের মরণশীল জগত থেকে রক্ষা করে রাখতে পারব? প্রতিটি মানব আত্মার পেছনে কি অন্তত ত্রিশটি করে প্রেতাত্মা নেই?
আমাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই আছেন যারা তাদের আপন বংশানুক্রম থেকে অন্তত, একজন পরাক্রম বা প্রতিভাবান ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে পারবেন। তবে আমাদের সুবিদিত বাচনিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত হিস্পানি স্বর্ণযুগের দুই শ্রেষ্ঠ কবির কথা সবারই জানা। ফ্রান্সেসকো দে কেবেদো এবং লুইস দে গংগোরা। মৃত্যু সম্পর্কে দৃষ্টান্তটা এরকম: “আমার দুই হাতের ভেতর দিয়ে তুমি কীভাবে বেরিয়ে যাও! কীভাবে পেরিয়ে যাও, আমার জীবনের বছরগুলো . . . ওহ্, মানবজীবন, ওহ্ কঠিন-নিয়তি! নিজেরে মৃত্যুর পাওনা চুকিয়ে/ আমার আগামীকালের বেঁচে থাকাও নিশ্চিত নয়!/” কিন্তু সমাধিকে অতিক্রম করে চিরায়ত ভালবাসার সংজ্ঞাও আছে: “ঈশ্বরের কাছে বন্দি যে সম্পূর্ণ জীবন . . ./ দেহকে করবে পরিত্যক্ত ঠিক, কিন্তু ভালবাসাকে নয়; ভস্ম হবে এই দেহ, তবুও রয়ে যাবে অনুভূতি; সব হবে ধূলিকণা, কিন্তু সে তো ভালবাসারই ধুলিকণা”।
জন ডান অকাল মৃত্যুকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। তাঁর “এ ফিউনেরাল এলিজি”তে তরুণীর বয়স মাত্র চৌদ্দ। নিয়তি তাকে ভবিষতের দ্বার অতিক্রম করতে দেয়নি। তাই সে তার নিজ মৃত্যুর স্বাধীনতার পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি বেঁচে থাকা মানুষ সেই অকালমৃত মেয়েটির সম্ভাব্য নিয়তির পরিপূরক হয়ে ওঠার প্রতিনিধিত্ব করছে। আর তাই মৃত্যুকে সে করেছে পরাজিত: “যদিও মৃত্যুর অগ্রযাত্রা সর্বদা অপ্রতিরোধ্য/তবুও তার মৃত্যুর পর মৃত্যু পাবে না কো তারে আর।”
এ হলো সেই মৃত্যু যা আমাদের সবার জন্য প্রযোজ্য। সেই মৃত্যু যার অংশীদারিত্ব ওই শব্দের ভেতরে এবং যা মৃত্যুকেই জয় করে।
সত্য হলো, আগে বা পরে, বিস্মৃত হই কিংবা স্মৃতিতে স্থান পাই, আমাদের মৃত্যু কিন্তু এককভাবেই আসে, বা প্রাগ্রসর চেতনা থেকে বলতে গেলে আমাদের মৃত্যু ব্যক্তিগতভাবে একেবারেই একান্ত। সম্ভবত আমরা সামগ্রিকভাবে অতীত হবার জন্য মৃত্যুবরণ করি না, সম্ভবত ভবিষতের কারণেই মৃত্যুবরণ করি। সম্ভবত আমাদের স্মৃতি মনে থাকবে, কিন্তু আমরা দীর্ঘমেয়াদে মনে রাখব না। পৃথিবীতে যা কিছু জানার আছে তা জেনেই হয়তো আমরা মারা যাব, কিন্তু মৃত্যুর পর থেকে আমরা শুধুই বস্তুতে পরিণত হব। আমরা জন্মেছি, এবং এই বিশ্ব আমাদের অবলোকন করেছে। এখন বিশ্বকেই দেখে যেতে হবে, আমরা হয়ে যাব অস্তিত্বহীন। আমরা সময়নিষ্ঠ হই বা না হই, জীবনের নিয়মতন্ত্রেই আমরা জীবন যাপন করি। কিন্তু মৃত্যু হলো অনিয়মতান্ত্রিক, সময়ের অতীত। আমার মৃত্যু অনন্য এ কথা কল্পনা করার চেয়ে আর কিছু মহান ভাবনা কী আছে, একান্তই আমার, অন্তহীন জীবনের মঞ্চকক্ষে একটি নির্বাচিত আসনে আসীন আমি?
কিছু মানুষ আছে যারা মনে করে মৃত্যু তাদের নিজ স্মৃতি থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম। ফলে অনেকেই আত্মহনন করে। আবার কিছু মানুষ আছে যারা সারাজীবন (কিংবা বাকি জীবন) অনুতপ্ত হয়ে কাটায় এই ভেবে যে তারা প্রয়োজনের সময় বিদেহী একাধিক মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি কিংবা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। এক পুরুষালি ভালবাসার তুল্য নীরবতা যা আমৃত্যু অপেক্ষমান থাকতে বাধ্য করেছে এবং শুধুমাত্র সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ওই মৃত্যু ব্যক্তিকে সব খুলে বলেছে যা সে কখনও বিনম্রভাবে বলতে পারেনি, যখন সে জীবিত ছিল: সে এক বিশাল গুরুভার এবং বিলাপ নকশিকাঁথা যা মৃত ব্যক্তির শরীরে জড়ানো দ্বিতীয় আবরণ। আর মৃত ব্যক্তির কী গোপনীয়তা বজায় রেখে সমাধিতে প্রবেশের অধিকার থাকে? যা আমরা কাউকে কোনওদিন জ্ঞাত করব না তা যে আমরা জানি সেটা জানা কি তার সবচেয়ে বড় অধিকার নয়?
আমাদের মনে অস্বীকৃতি এবং অনিবার্যতার যা কিছুই জন্ম নিক না কেন, মৃত্যুর অব্যাহত যাত্রা যতই প্রামাণিক সাক্ষ্য দিক এবং তার অসম্ভবকে সম্ভব করার অনিবার্যতা আমাদের সামনে তুলে ধরুক, মৃত্যু যে অবস্তুগত সে ধারণা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব না কখনও অথচ মৃত্যু তো বিশাল বস্তু, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একথা আমরা নিজেদের বলি যখন মৃত্যু নিজে অন্যকথা বলতে চায়। আমরা নিজেদের আশ্বস্ত করি এই বলে যে বর্তমানের মৃত্যু অতীতের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেবে। প্যাসকেলের সঙ্গে সুর মেলায়: “কখনও বলো না আমি জীবন হারিয়েছি। বলা উত্তম: আমি জীবন ফিরিয়ে দিয়েছি।” এ কথা আমাদের পরম সত্য বলে মেনে নিতেই হবে। কিছু মানুষ আছে যাদের মৃত্যু হয় আরও বেশি করে ভালবাসা পাবার জন্য। আমাদের ভালবাসার মানুষেরা যারা গত হয়েছে তারা আসলে বেঁচেই আছে কারণ যে ভালবাসা আমাদের একান্ত করেছে তা আমাদের জীবনে এখনও বহমান। একমাত্র জিনিস যা কোনও মূল্যেই সত্য অর্থে উত্তরজীবী হতে চায় না তা হলো বেঁচে থাকার সুযোগ। এবং যে কোনও মূল্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছা আসলে ভ্যাম্পায়ারের মতো জীবনযাপন যার অস্তিত্ব আমাদের সবারই অন্তরের গভীরে।
এ এক যৌনউন্মাদনায় লিপ্ত হবার সুযোগ। ওয়াদারিং হাইটস্-এ ক্যাথি এবং হিথক্লিফ একে অপরের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে একাত্ম হয়েছে যদিও তারা জানত বিষয়টি তাদের মারাত্মক বিপর্যয় বয়ে আনবে। হিথক্লিফ-এর মলিন বিনম্রতার মূল হলো তার সকল দৈনন্দিন কর্মকান্ডে প্রতিহিংসা, অর্থসম্পদ অর্জন, যারা তাকে অবমাননা করেছে তাদের অবমাননা, ক্যাথির সঙ্গে তার শৈশবের দিনগুলো– এসব কোনও কিছুই আর ফিরে আসবে না– এই বিষয়গুলির প্রতি সচেতনতা। ক্যাথিও এটি জানত। এই হলো “আমিই হিথক্লিফ”-এর স্বরূপ আর তা জেনেই সে সেই হারিয়ে যাওয়া আদি ভালবাসার জমিন অদৃশ্য স্থানের দিকে অসময়ে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে: সেই মৃত্যুভূমি। ক্যাথি মৃত্যুকে বেছে নেয় কারণ সে যেন হিথক্লিফকে বলতে পারে, “মৃত্যুই হলো আমাদের ধ্রুব বাসস্থান, আমাকে ওখানেই পাবে।” মৃত্যুই হলো প্রেমরাজ, যেখানে শরীরের অতীত যৌনউত্তেজনার কল্পনা সম্ভব, বিশেষ করে মৃত্যুর কারণে সৃষ্ট বিশাল বিচ্ছেদের পর।
ওয়াদারিং হাইটস্-এর ওপর লেখা এক প্রবন্ধে জর্জ বাতাইয়ে বলেছেন, মৃত্যু হলো ছদ্মবেশের মোড়কে একটি মৌল। ভালবাসার মূল সময়ে যখন ফেরা সম্ভব নয়, প্রেমিক-প্রেমিকার তীব্র অনুরাগ চূড়ান্তভাবে উপভোগ করার স্থান ও কাল হলো চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয় মৃত্যুপারের সময়। মৃত্যু হলো সীমাহীন সময়। কেন? কারণ আদি অর্থে মৃত্যুই হলো সকল লাভ-ক্ষতির হিসাবের উর্দ্ধে। মৃত কোনও ব্যক্তিই বলতে পারবে না, “এটাই আমার জন্য ঠিক”, কিংবা “এটা আমার জন্য ঠিক নয়,” “আমিই জয়ী” কিংবা “আমি পরাজিত”, “আমিই সবাইকে ছাড়িয়ে”, কিংবা “আমি শেষ।” হুয়ান রুলফো-র পেদ্রো পারামো উপন্যাসে দেখা যায় লেখকের চূড়ান্ত বিজয় তারই সৃষ্ট চরিত্রের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। হিথফ্লিফ-এর বিপরীতে এই চরিত্র তার প্রেমিকা সুসানা সান হুয়ান-এর প্রতি প্রতিদানহীন অবিনশ্বর ভালবাসায় দূঢ় থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তার পরাজয়ের মাধ্যমে রুলফো পুরো কোমালা শহরবাসীসহ আমাদেরকে পরিচিত করিয়ে দেয় আমাদের নিজ নিজ মৃত্যুর সঙ্গে। এই ঔপন্যাসিকের মাধ্যমে আমরা আমাদের মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হই। আমরা সম্যক উপলব্ধি করতে পারি যে জীবন-মৃত্যু এই দ্বৈত অবস্থানের কোনও অস্তিত্ত্ব নেই, বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার ইচ্ছা বলে কোনও কিছুকে বেছে নেয়া যায় না। আসলে মৃত্যু জীবনেরই অংশ, সব মিলিয়েই জীবন। আমরা তাই ভাবতে পারি প্রতি মুহূর্তে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুই প্রতি মুহূর্তে মৃত প্রতিটি মানুষের পুনর্জন্ম। কার পুনর্জন্ম হয়েছে বা হয়নি তা বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় কারণ যার পুনর্জন্ম হলো তাকে সনাক্ত করার জন্য কোনও সনাক্তকারী নেই। কিন্তু আমাকে সনাক্ত করার মতো যদি কোনও একটি ব্যক্তি পাওয়া যেত তাহলে কী হতো? সে আমাকে রাস্তায় দেখলে . . . গাড়িতে উঠতে বা রেস্তোরাঁয় ঢোকার সময় আমাকে থামাত, বগলদাবা করে আমার অতীত জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বাধ্য করত। এই লোকটি একজন উত্তরজীবী, একমাত্র লোক যে সম্ভবত জানে আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। একমাত্র লোক যে বলতে পারে, “এক জীবন যথেষ্ট নয়। একটা মানুষের চরিত্র সৃজনে আরও অনেক জীবন প্রয়োজন।”
কিন্তু একজীবন যদি আমাদের চরিত্রের সকল প্রতিশ্রুতি পূরণে যথেষ্ট না হয়, মৃত্যু দ্বারা কর্তিত হয়ে আমাদের কি বিপরীত প্রান্তে চলে যাবার আশঙ্কা থেকে যায় না? কিংবা এ চিন্তা কি মাথায় স্থান পায় না যে আত্মাই আসল, বস্তু কিছু নয়? অথবা একটি অবিনশ্বর অপরটি নশ্বর?
কিংবা, কোনও কিছুরই আসলে সম্পূর্ণ মৃত্যু নেই, তা সে আত্মাই হোক কিংবা বস্তু? এদের কি উৎপত্তি একইভাবে? আমরা জানি চিন্তা মৃত্যুকে অতিক্রম করে। কিন্তু দেহও কি অতিক্রান্ত হতে পারে?
চিন্তাভাবনাগুলোকে পুরোপুরি রূপ দেয়া সম্ভব নয়। এক সময় তারা প্রত্যাহীত হয়, কতিপয় প্রাণীর মতো বিচেতন হয়ে থাকে, অপেক্ষায় থাকে সঠিক সময়ে আবার আবির্ভূত হবার জন্য। চিন্তার মৃত্যু নেই। সে শুধু সময় কাটায়। এক সময়ে যে ধারণাকে মৃত বলে মনে হয় তা অন্য সময়ে আবার আবির্ভূত হয়। আত্মা মরে না। আত্মা গতিময়। আত্মা দ্বিগুণিত হয়। অনেক সময়ে আত্মা রূপান্তরিত হয়, আবার বিনীতও হয়। সময়ে এই অদৃশ্যমান হওয়ায় মনে হয় আত্মার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার পুনরাবির্ভাব ঘটে। বস্তুত আমাদের প্রতিটি শব্দের উচ্চারণে আত্মা তার অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়। একটি শব্দও নেই যা স্মৃতি এবং বিস্মৃত চিন্তাধারা দ্বারা সঞ্চারিত নয়, স্বপ্ন ও ব্যর্থতা দ্বারা পরিপূর্ণ নয়। এ কথাও সত্য যে এমন কোনও বিশ্ব নেই যা মৃত্যুকে জয় করতে সক্ষম কারণ এমন কোনও শব্দের অস্তিত্ব নেই যা তাৎক্ষণিকভাবে শূণ্যতা পূরণ করতে সক্ষম। শব্দ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কারণ শব্দ এবং মৃত্যু অবিভাজ্য– একে অপরকে অপহরণ করে, প্রচার করে, উত্তরাধিকারী রূপে ঘোষণা করে। কোনও শব্দের অস্তিত্ব নেই যা আসন্ন পুনরুত্থানের উপযোগী নয়। যে শব্দই আমরা উচ্চারণ করি না কেন তা একাধারে অপর আর একটি শব্দের অস্তিত্ব ঘোষণা করে যা হয়তো আমরা জানিও না। এটি হয় সম্ভবত এ কারণে যে ওই অন্য শব্দটি আমরা বিস্মৃত হয়েছি এবং অন্য আর একটি শব্দ সম্বন্ধে অজ্ঞ কারণ শব্দটি আমাদের শুধুই কাঙ্খিত। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে শরীরের ব্যাপারে, কারণ শরীর তো মুলত বস্তু। সব বস্তুই তো তার মৌলিকের অলৌকিক আভা এবং অন্য অর্থে অদৃশ্যমান হয়ে যাবার পর মৌলিকেরই অলৌকিক আভা। ঠিক এই কারণে আমরা আমাদের যুগে বাস করি, আবার অতীত যুগেরও প্রেতাত্মা। সেই একই সঙ্গে আমরা ভবিষ্যৎ যুগের প্রতিচ্ছায়া। মৃত্যুর এই সব অভিজ্ঞানের কথা আমরা যেন বিস্মৃত না হই কখনও।
(মৃত্যু বিষয়ক এই প্রবন্ধটি ফুয়েন্তেসের This i believe: An A to Z of a life গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত Death-এর বাংলা অনুবাদ। বইটি ২০০৬ সালের ১৬ মেতে র্যান্ডম হাউজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো।)