| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ চিঠি সংখ্যা: কাজী নজরুল ইসলামের তিনটি চিঠি

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

প্রেমিকা নার্গিসকে লেখা .. ‘‘তুমি আমাকে আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না। সাথে সাথে আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতেও পারতাম না।’’ আবার কোথাও লিখেছেন, ‘‘দুনিয়ায় যত রকম আনন্দ আছে তার মধ্যে এই বিচ্ছেদের ব্যথাটাই সব থেকে আনন্দের।’’ এমন সব অমোঘ ভালবাসার চিঠি যিনি লিখেছেন, তিনিই আবার লিখেছেন—
 
‘‘আমি বেদুইন আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’’
 
কিংবা
 
‘‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু
ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।’’
 
নজরুল যখন প্রায় কিশোর, তাঁর সংসারবিমুখ মন যখন একটা মুক্তির পথ খুঁজছিল, সেই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কুমিল্লার মেয়ে সৈয়দা খাতুনের। ভালবেসে কবি তাঁর নাম রেখেছিলেন নার্গিস। ভাবাবেগের বন্যায় নজরুল এমন ভাবে ভেসে গিয়েছিলেন যে বুঝতেই পারেননি নার্গিস সত্যি তাঁকে ভালবেসেছিলেন, নাকি অবস্থার চাপে পড়ে ভালবাসার অভিনয় করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত নার্গিস আর নজরুলের বিয়ে হয়নি। দু’জনের সম্পর্কের মালিন্য এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে বিয়ের আসর থেকে ফিরে আসেন নজরুল।
 
প্রেমিকা নার্গিস, বন্ধু প্রিয় মতিহার এবং তাঁর অনুরাগী মানুষের কাছে নজরুল ইসলামের ৩টি চিঠি পাঠকের সুবিধার্থে হুবুহু তুলে দেয়া হল। যা থেকে উপলব্ধি করা যায় নজরুলের ভালবাসার আবেগ।


কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা কবি নজরুলের একটি চিঠি

১৫ জুলিয়াটোলা স্ট্রিট
কলিকাতা
৮/৩/২৮
সন্ধ্যা
প্রিয় মতিহার,
পরশু বিকালে এসেছি কলকাতা। উপরের ঠিকানায় আছি। ওর আগেই আসবার কথা ছিলো, অসুখ বেড়ে ওঠায় আসতে পারেনি। দু চার দিন এখানেই আছি। মনটা কেবলই পালাই পালাই করছে। কোথায় যাই ঠিক করতে পারছিনে। হঠাৎ কোনোদিন এক জায়গায় চলে যাবো। অবশ্য দু দশ দিনের জন্য। যেখানেই যাই আর কেউ না পাক তুমি খবর পাবে।
বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে সেদিন অন্তত তোমার বুক বিঁধে উঠবে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মতো জড়িয়ে শুয়েছিলে অন্তত এইটুকু শান্তনা নিয়ে যেতে পারবো। এই কি কম সৌভাগ্য আমার ! কেন এ কথা বলছি শুনবে? বন্ধু আমি পেয়েছি, যার সাক্ষাত আমি নিজেই করতে পারবো না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু, ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে উঠেনি কেউ। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ পাতাটির লেখা তোমার কাছে লিখে গেলাম।
আকাশের সবচেয়ে দূরের যে তারাটির দিপ্তি চোখের জলকণার মতো ঝিলমিল করবে, মনে করো সেই তারাটি আমি। আমার নামেই তার নামকরণ করো। কেমন? মৃত্যু এতো করে মনে করছি কেন জানো? ওকে আজ আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হচ্ছে বলে। মনে হচ্ছে, জীবনে যে আমায় ফিরিয়ে দিলে, মরলে সে আমায় বরণ করে নেবে।
সমস্ত বুকটা ব্যথায় দিনরাত টনটন করছে। মনে হচ্ছে সমস্ত বুকটা যেন ঐখানে এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। ওর যদি মুক্তি হয়, বেঁচে যাবো। কিন্তু কি হবে কে জানে? তোমার চিঠি পেয়ে অবধি কেবল ভাবছি আর ভাবছি – কতো কথা, কতো কি, তার কি কূল-কিনারা আছে? ভাবছি আমার ব্যথার রক্তকে রঙ্গীন খেলা বলে উপহাস যে করেন তিনি হয়তো দেবতা। আমার ব্যথার অশ্রুর বহু উর্ধ্বে। কিন্তু আমি মাটির নজরুল হলেও সে দেবতার কাছে অশ্রুর অঞ্জলি আর নিয়ে যাবো না। ফুল ধুলায় ঝড়ে পড়ে, পায়ে পিষ্ট হয়, তাই বলে কি ফুল এতো অনাদরের? ভুল করে সে ফুল যদি কারুর কবরীতেই খসে পড়ে এবং তিনি যদি সেটাকে উপদ্রুব বলে মনে করেন, তাহলে ফুলের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে এক্ষুণি কারুর পায়ের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করা।
সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারি না বন্ধু, তাই এতো জ্বালা। ভিক্ষে যদি কেউ তোমার কাছে চাইতেই আসে অদৃষ্টের বিরম্বনায়, তাহলে তাকে ভিক্ষা নাই দাও, কুকুর লেলিয়ে দিও না। আঘাত করবার একটা সীমা আছে। সেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে। আর তক্ষুণি তার নাম হয় অবমাননা।
ছেলেবেলা থেকে পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে যে প্রেমে বুক ভরে ওঠে কাঁনায় কাঁনায় তা কখনো কোথাও পাই নি আমি। এবার চিঠির উত্তর দিতে বড্ড দেরী হয়ে গেলো। না জানি কতো উদ্বিগ্ব হয়েছো। কি করি বন্ধু, শরীরটা এতো বেশী বেয়াড়া আর হয়নি কখনো। অষুধ খেতে প্রবৃত্তি হয়না।
আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিশুতি রাতের তারা। তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলোকে চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নামকরণ করেছি আমার ইচ্ছেমতো। সেই কতোরকম মিষ্টি মিষ্টি নাম, শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতূতে কোন দিকে উদয় হয় সব বলে দিতে পারি। জেলের ভেতর যখন সলিটারি সেলে বন্ধ ছিলাম তখন গরমে ঘুম হতো না। সারারাত জেগে কেবল তারার উদয়াস্ত দেখতাম। তাদের গতিপথে আমার চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, বন্ধু, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু, আমার এই চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্তপারের পানে। আমি শুধু চুপটি করে দেখি। হাতে থাকতো হাতকড়া। দেয়ালের সঙ্গে বাধা চোখের জলের রেখা আঁকাই থাকতো মুখে, বুকে। আচ্ছা বন্ধু, ক’ফোটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয় তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, যার উত্তর নেই, মিমাংসা নেই, সেইসব জিজ্ঞাসা।
যেদিন আমি ঐ দূরের তারার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি দেখিয়ে, সে যেন দু’ফোটা অশ্রুর দর্পন দেয় শুধু আমার নামে। হয়তো আমি সেদিন খুশীতে উল্কা ফুল হয়ে তার নোটন খোঁপায় ঝড়ে পড়বো। তাকে বলো বন্ধু, তার কাছে আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই। আমি পেয়েছি, তাকে পেয়েছি, আমার বুকের রক্তে, চোখের জলে। আমি তার উদ্দেশ্যে আমার শান্ত স্নিগ্ধ অন্তরের পরিপূর্ণ চিত্তের একটি সশ্রদ্ধ নমস্কার রেখে গেলাম। আমি যেন শুনতে পাই, সে আমারে সর্বান্তকরণে ক্ষমা করেছে। ফুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার উর্ধ্বে ফুলের কথাই যেন সে মনে রাখে।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আবার লিখছি। কিন্তু আর লিখতে পারছি না ভাই। চোখের জল, কলমের কালি, দুই-ই শুকিয়ে গেলো। তোমরা কেমন আছো, জানিও। তার কিছু খবর দাও না কেন? না কি সেটুকুও মানা করেছে? ঠিক সময়মতো সে ওষুধ খায়তো? কেবলই কীটস্‌কে স্বপ্ন দেখছি, তার পাশে দাঁড়িয়ে ফেমিব্রাউন পাথরের মতো। ভালবাসা নাও।
ইতি,
তোমার নজরুল
নার্গিসকে লেখা প্রেমিক কাজী নজরুলের অমর প্রেমপত্র …
নজরুলের জীবনে দু’জন নারীর উপস্থিতি খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করা যায়- একজন নার্গিস আরেকজন হলেন প্রমীলা। নজরুলের হৃদয়ের দুই সারথী- একজন চাঁদ তো অন্যজন নীল সরোবর। প্রিয় কবি নজরুলকে, তার প্রথম স্ত্রী নার্গিস একটি পত্র লিখেছিলেন সেই কুমিল্লা থেকে বিয়ের প্রথম রাতে নজরুলের চলে যাবার অনেক দিন পর। সেই চিঠির উত্তর নজরুল দিয়েছিলেন একটি গানের মাধ্যমে-
“যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই,
কেন মনে রাখ তারে।।
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।।”
– কিন্তু নজরুল কি সত্যিই ভুলতে পেরেছিলেন নার্গিসকে? পনেরো বছর পর একটি আবেগময় চিঠি লিখেন নার্গিসের কাছে- যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়- যে চিঠিখানা বিশ্বের সেরা ভালবাসার তথা প্রেমপত্রের একটি। নজরুল নার্গিসকে কতটুকু ভালবাসতেন- সেটা এই চিঠিতেই সেই ভালবাসার রূপ শাশ্বত হয়ে ফুটে উঠেছে- একজন মানুষ কি তার প্রিয়তমাকে এর চেয়ে বেশি ভালবাসতে পারেন! নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অবেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি- তাই নজরুলের জীবনে যদি নার্গিস না আসতেন তাহলে হয়তো বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে এই অমূল্য সম্পদ থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন- আর নার্গিস চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ম্যানচেস্টার (ইংল্যান্ড) শহরে।
নার্গিস-নজরুল প্রেম-কাহিনী শুধু সাধারণ প্রেম নয়- এটা অমর প্রেম কাহিনী- এযেন কালজয়ী প্রেম-উপাখ্যান। আর এমনি একটি চিঠির জন্য নার্গিস-নজরুলের প্রেমের উপাখ্যান বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে।
“কল্যানীয়াসু, 
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে ।মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল । পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারি ধারায় প্লাবন নেমেছিল– তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো । আষাঢ়ের নবমেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার । এই মেঘদূত বিরোহী যক্ষের বানী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে । এই মেঘ পুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার ।এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গ লোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে । যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই । তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য । লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো,তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা ।
তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি ।আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি আসীম বেদনা ! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি । তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না । তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার আঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে । অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি ।
তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি । অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয় । আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয় ।আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই ।
তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা । আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম,অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম । সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা । পাষান দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি । আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা,ব্যর্থ ; তাই তাকে পেতে চাইনে । জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব,অধিকতর বেদনা পাব,–তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি ।
দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায় । প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান,দগদ্ধ,হতশ্রী ।তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে ।লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি ।আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য । আত্মা অবিনশ্বর,আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারেনা । প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে ? তারি মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে । দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয়না । মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে । যদি কোনো ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন । আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতক্রম করে উর্ধ্ব লোকে—সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায় ।…
হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনর বছর আগের কথা । তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি । তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি । মনে হয় যেন কালকের কথা । মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেননা। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল । সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না ।
যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর । আর তার চেষ্টা করোনা । তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক । যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে । তুমি সুখি হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা । আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই –এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ ।
ইতি—
নিত্য শুভার্থী—
নজরুল ইসলাম
নজরুল ইসলামের শেষ চিঠি
বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রান আজ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে- “আমি ধন্য হলুম”, “আমি ধন্য হলুম”।
আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার ধর্ম। তবু বলছি, আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্তানের পথে তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মুর্তিতে ব্যাথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। কারাগারের অন্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কোনটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান- বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন,”দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ’।” জীবনে সেই ট্র্যাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু, আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত দগ্ধ। মেঘের উর্ধ্বে শূণ্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।
আমার বেশ মনে পড়ছে। একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময় আমার বাড়িতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য, আমার গান আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূণ্য থেকে অসময়ে নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না, আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কী দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পুর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসি নি। আমি নেতা হতে আসি নি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নিরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমী, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী- বিশেষনের পর বিশেষন। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে। বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ কোর। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বলো বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি।
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,

কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।

নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিঁধুর ধূপ।

ইতি,
নজরুল

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত