ভ্রমণ: দালাই লামার সাথে পথে হল দেখা । ফাতিমা জাহান
আমি আর পেম মূল সড়কের দিকে দৌড়াচ্ছি। দালাই লামা আসবেন সেই রাস্তা দিয়ে। আমি পেমের চেয়েও বেশি এক্সাইটেড কারণ অল্প একটু সময়ের আর আবহাওয়ার এদিক ওদিকের জন্য আমি আজকে স্বচক্ষে দালাই লামাকে দেখতে পাব। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর ভয়ানক ঠান্ডা পড়েছে। পথের দু’ ধারে সব বয়সী ছেলে মেয়ে রঙিন ট্রেডিশনাল পোশাক পরে জড়ো হয়েছে দালাই লামাকে দেখার জন্য৷
গিয়েছিলাম তাওয়াং বেড়াতে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মূল শহর, এক সময়কার দুর্গম শহর। অবশ্য প্রদেশটাই দুর্গম। বছরের বেশিরভাগ সময়ই খুব ঠান্ডা থাকে আর বরফ পড়ে।
অরুণাচল প্রদেশে প্রবেশের পাস নিয়েছি আসামের গৌহাটি থেকে। গৌহাটি থেকে ট্যাক্সিতে করে তাওয়াং পৌঁছাতে সময় লেগেছিল প্রায় সতেরো ঘন্টা৷ শেয়ার ট্যাক্সি ছিল তাই খরচ অনেকটা বেঁচে গিয়েছে।
তাওয়াং যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল মনাস্টেরি দেখা। এত প্রাচীন মঠ আর উপাসনালয় ভারতে আর দুটি নেই। আরও আশ্চর্যের কথা হল এখানে নাকি প্রায় দু হাজার বছরের পুরনো তালপাতার উপর হাতে লেখা পুঁথি সংরক্ষিত আছে।
ভারতের সর্ববৃহৎ আর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভিক্ষু মঠ ও আশ্রম ‘তাওয়াং মনাস্টেরি’।
দালাই লামা (পঞ্চম) এর ইচ্ছে অনুযায়ী ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে এ মঠটি নির্মাণ করা হয়। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বহু প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ সংরক্ষিত আছে।
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান দালাই লামা (চতুর্দশ) যখন তিব্বত থেকে পালিয়ে আসেন তখন কিছুদিন তাওয়াং মনাস্টেরিতে আত্মগোপন করে ছিলেন। একারণে ভারত ও চীনের মধ্যকার রাজনৈতিক উত্তেজনা তখন টান টান ছিল।
১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধে চীন তাওয়াংসহ অরুণাচল প্রদেশের বেশ কিছু স্থান দখল করে নেয়। অবশ্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ছ’মাস পর চীন পরে আবার ভারতকে স্থানগুলো ফেরত দেয়। চীনের দাবী ছিল তাওয়াং তিব্বতের একটি অংশ। এক রাতের মধ্যেই রাস্তা তৈরী করেছিল চীনা সৈন্যরা তাওয়াং যাবার জন্য। এত উচ্চতা আর ঠান্ডার মধ্যে আশেপাশের গাছের গুড়ি আর মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেসময়কার ম্যাকমাহন সীমান্তের রাস্তা। চীন আর ভারতের সীমারেখা। আর অপর পাশে মানসরোবর পার হলেই লাসা৷ এত কাছে! আমি কয়েক বছর ধরে লাসা যাবার প্ল্যান করছি কিন্তু হয়ে উঠছেনা। এই বর্ডার দিয়ে যাওয়া যায় না। হয় চীন থেকে যেতে হবে অথবা নেপাল থেকে। এই আশা বাঁচিয়ে রেখেছে আমায়, কোনো একদিন যাওয়া হবেই। সেই আশায়ই তুলে দিয়েছি বোহেমিয়ান জীবন এই পথের হাতে।
২০০৯ সালে চীনের প্রবল আপত্তি সত্বেও অরুণাচল প্রদেশের মানুষ দালাই লামাকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিল।
দালাই লামা আসছেন বলে পুরো তাওয়াং শহর জুড়ে সাজ সাজ রব। তাওয়াং মনাস্টেরি যেন নতুনভাবে সাজছে। সকল বয়সী লামা বা ভিক্ষু এবং নারী ভিক্ষু আনি খয়েরী বসনে হাত লাগিয়েছেন মঠ সাজাতে, তাঁদের প্রাণপ্রিয় ধর্মগুরুর আগমনবার্তায়। রঙিন কাগজ আর প্লাস্টিক কেটে ঝালর বানানো হচ্ছে, লম্বা লম্বা করে ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে মনাস্টেরির এক ভবন থেকে অন্য ভবনে৷ জড়ো করা হয়েছে প্লাস্টিকের ফুলের মালা। তাজা ফুল খুব কমই মেলে এই বরফে ছাওয়া উপত্যকা শহরে।
শেরিং লাকপা নামে তিব্বতি গায়কের সাথে পরিচয় হল মঠের উঠোনে, তিনি এসেছেন ধরমশালা থেকে, বর্তমানে দালাই লামা যেখানে থাকেন। সেখানে অবশ্য অনেক তিব্বতি রিফুজির বাসস্থান। সারা ভারতেই তিব্বত থেকে নির্বাসিত মানুষজন আর তাদের বংশধরেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। শেরিং নিজেও তিব্বতি রিফুজির বংশদ্ভূত। দালাই লামার আগমন উপলক্ষে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, শেরিং সেখানে গান গাইবেন।
মনাস্টারি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। মূল ভবনটি ছিল কাঠের তৈরী। পরবর্তীতে নির্মিত প্রার্থনা ভবনটিও কাঠের ত্রিতল ভবন। আশপাশ জুড়ে রয়েছে ভিক্ষুদের আবাসস্থল। সকল বয়সী ভিক্ষু চোখে পড়লো। দু/তিন দিন ধরে অনেক ভিক্ষু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আসছেন সারা ভারত ও ভুটান থেকে, দালাই লামাকে এক নজর দেখার জন্য। শেরিং লাকপাকে বললাম, ‘পুরনো পুঁথিগুলো কি এক নজর দেখা যাবে?’
‘অন্য সময় হলে আমিই নিয়ে গিয়ে দেখাতাম কিন্তু এখন তো সবাই ব্যস্ত আর গ্রস্থাগারে যাবার অনেক নিয়ম-কানুন আছে।’
‘আমি বহুদূর থেকে এসেছি, তুমি একটু ব্যবস্থা কর প্লিজ।’
‘তাহলে তুমি আগে লাঞ্চ করে নাও। আমি দেখছি কি করা যায়।’
শেরিং আমাকে ভিক্ষুদের ডাইনিং হলে বসিয়ে দিয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম ভিক্ষুদের সাধারণ খাবার পাব খেতে কিন্তু উৎসবের কারণে একেবারে তিব্বতি রাজভোজ পেয়ে গেলাম। ভাতের সাথে কুড়ি রকমের সবজি, পনির আর ডিমের তরকারি। খাবারের শেষে আইসক্রিম, গাজরের হালুয়া, মিষ্টি।
ততক্ষণে শেরিং এসে গিয়েছেন। নিঃশব্দে যেতে হবে মূল ভবনের দোতলায়, খুব অল্প সময় পাওয়া যাবে দেখার জন্য, কোন ছবি তোলা যাবেনা।
শেরিং যে এত কাজের মাঝে আমাকে সময় দিয়েছে আর পুঁথি দেখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন সেজন্য কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু তার আগেই প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম গ্রন্থাগারের চৌকাঠে। কাঠের দেয়ালে বৌদ্ধ পূরান আর গৌতম বুদ্ধের ছবি আঁকা। দেয়াল জুড়ে বিশাল বিশাল কাঠের শোকেস, শোকেসে কাচের দরজা৷ কাচ ভেদ করে যতখানি দেখা যায়, কাচের অপর পাশে বহুমূল্যবান পুঁথি-পত্র, ভিক্ষুদের হাতে লেখা। পুঁথিগুলো খয়েরি কাপড়ে মোড়া। কাঠের শোকেস খুলে দেখার প্রশ্নই আসে না। আমাকে তাড়িয়ে দেবে। দাঁড়িয়ে হাঁ করে, চোখ বড় করে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
বাইরে থেকে মূল ভবনের আকার বা বর্ণ এখন বোঝা দায়। বিভিন্ন রঙিন নকশাদার লম্বা কাপড়ের ছাউনি আর পর্দায় ঢেকে গিয়েছে। মূল প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশে মানা নেই। দরজার সোজাসুজি গৌতম বুদ্ধ বাসন্তী বসনে আঁখি সজল করে নিশ্চুপ বসে আছেন। ভিক্ষু, ভক্তরা আসছেন, প্রণাম জানাচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন। কেউ কি বুদ্ধের মনের কথা জানতে চেয়েছে! কেউ কি জিজ্ঞেস করেছে, তার মন ভারাক্রান্ত কেন!
বুদ্ধের সামনের কাঠের মেঝেতে বসে থেকে আমি নিজের মনের কথাই ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, আর তিনি তো বিরাজ করছেন এখন দেয়ালের কাঠের চিত্রকলায় বা সিল্কের ঝালরের হাওয়ায় অথবা আরও পুরনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিক্ষুর মন্ত্রের ওঠানামায়।
তাঁর সামনে জ্বলছে ঘিয়ের প্রদীপ। রূপোর পাত্রে জল, খাবার, ফলমূল রাখা আছে। আগরবাতি জ্বলে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাচ্ছে নিজেদের সুগন্ধে নিজেরাই উল্লাসিত হয়ে। চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙের নাচানাচি।
বাইরে চেফান বা ছোট ছোট রঙিন কাপড়ে তিব্বতি ভাষায় মন্ত্র লেখা, দড়ির সাথে জুড়ে দিয়ে হরাইজন্টালি বেশ পত পত করে উড়ছে রাঙা মন্ত্রোচ্চারিত পাখির মতোন।
মনাস্টেরি থেকে বের হয়ে মনে হল মৌনব্রত শেষ হয়েছে আমার৷ শেরিংকে যখন বিদায় জানালাম তখন বিকেল হতে শুরু করেছে। এখানকার আবহাওয়ার কোন ঠিক নেই। এখন বাইরের তাপমাত্রা ৫° সেলসিয়াস। যে কোন সময় বৃষ্টি আরম্ভ হতে পারে বা রাতে বরফ পরতে পারে। স্থানীয় সব বয়সী মানুষজন তখনও শহর রঙিন চেফান সাজানোয় ব্যস্ত৷ হিমশীতল আবহাওয়া কাউকেই ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। আমি এখান থেকে গৌহাটি ফিরে যাব হেলিকপ্টারে। আগামীকাল রওনা হব। খোঁজ নেবার জন্য ওদের অফিসে গিয়ে শুনি আগামীকাল কেন, পরশুও হেলিকপ্টার চলবে না ভারী তুষারপাতের কারণে।
আমি যখন অরুণাচল প্রদেশে আসার প্ল্যান করি তখন জানতাম না যে এখানে দালাই লামা আসছেন, জানলে হোটেল বুকিং দিয়ে রাখতাম আরও কয়েকদিনের জন্য। এখন যেহেতু আমি হেলিকপ্টারে যেতে পারছি না আর আগামী ৩/৪ দিন সারা তাওয়াং শহরে কোন হোটেলে রুম খালি নেই তাই ঠিক করলাম ট্যাক্সি করে প্রথমে বমডিলা যাব। সেখানে একদিন থেকে তারপর আরেক ট্যাক্সি নিয়ে গৌহাটি যাব। আসার সময় প্রচন্ড ঠান্ডায় আশেপাশের কিছুই দেখতে পারিনি।
পথে সেলা পাসে তুষারপাত ঠিকই ছিল কিন্তু ঝড়বাদল ছিল না। এই সেলা পাসেই শুধু বরফ দেখতে পাওয়া যায় এ মৌসুমে মানে এপ্রিল মাসে, বাকি পথ তুষারহীন, যেখানে শুধু হিমশীতল বাতাসেরা গরজায়। পাহাড়ি পথ, সর্পিল, এঁকেবেঁকে চলার রোমাঞ্চ আর জানালা দিয়ে দূর-দূরান্তের পর্বতমালায় মেঘ, তুষারের খেলা। কখনো বাদলে অবগুণ্ঠিত, কখনো শুভ্র চাদরে আচ্ছাদিত। কখনো পাহাড় আর মেঘের ছু কিত কিত খেলা, কখনো বা দুধসাদা টায়রা মাথায় করে পাহাড়ের গম্ভীর রাণীর বেশ।
বমডিলা পৌঁছুলাম ছ’ ঘন্টায়। হোটেলে লাগেজ রেখে খাবার অর্ডার করতে চাইছিলাম কিন্তু রিসিপশন থেকে বলল আজ সব বন্ধ, সবাই ছুটি নিয়েছে, দালাই লামা তাওয়াং না গিয়ে প্রথমে বমডিলা আসছেন। বমডিলায় তাঁর আসার কথা ছিলো না। যেকারণে আমি গৌহাটি যেতে পারিনি সেই একই কারণে মানে হেলিকপ্টার যাত্রা বন্ধ থাকার কারণে দালাই লামা সড়কপথে বমডিলা হয়ে তাওয়াং যাবেন। বাহ! হিজ হাইনেস এর সাথে আমার দেখছি বেশ মিল। স্বভাবেও মিল আছে, তিনি ঘুরে ঘুরে বেড়ান, আমিও।
পরক্ষণেই মনে হল, কি ভাগ্য আমার! দালাই লামাকে দেখতে পাব! দালাই লামাকে দেখেছি শুধু টেলিভিশনে আর পত্রিকার পাতায়। কখনোই ভাবিনি সামনা-সামনি দেখা হয়ে যাবে।
নিকুচি করি খাবারের এখন।
বাইরে বেরিয়ে দেখি ছোট্ট শহরের রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে। দোকানপাট বন্ধ করে সবাই ছুটছে বমডিলা মনাস্টেরি/ গোমপা এর দিকে যেখানে দালাই লামা আসবেন। একটি রেস্তোরাঁ তখনো খোলা ছিল। ঢুকে খাবার অর্ডার করতেই ওয়েটার বলল, ‘আমরা এখন দোকান বন্ধ করছি। দুঃখিত খাবার হবে না।’
পাশের টেবিলে তিনজন স্থানীয় ছেলে খাবার খাচ্ছিল। তারা বলল,
‘যা আছে ঝটপট দিয়ে দিন মেয়েটিকে, বাইরে থেকে এসেছে।’
এভাবেই সেদিন আমি অনাহারের হাত থেকে বেঁচে যাই। এভাবেই পথেঘাটে আমার জন্য মানুষের রূপে পরওয়ারদিগার নেমে আসেন।
যে কোন খাবারে আমার অরুচি নেই। থুকপা হল স্যুপি নুডলস, ভারতে পাহাড়ি এলাকার বিখ্যাত খাবার৷ খেয়েদেয়ে গোমপার দিকে যেতে থাকলাম। রাস্তার দু’পাশে লাইন ধরে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দালাই লামাকে এক নজর দেখার জন্য। আমার পাশে দাঁড়ানো একটি ছেলে বলল তাঁর আসতে এখনো ঘন্টা দেড়েক বাকি আছে। আমি তাই শহরটায় হাঁটতে থাকলাম। শহরজুড়ে টহলরত আর্মি আর পুলিশ অফিসার৷
একটি স্থানে ভীষণ সুন্দরভাবে পাহাড় দেখা যাচ্ছিল আর সবুজ পাহাড়ে তখন গোলাপি চেরি ফুলও ফুটেছিল। সেখানে একজন মাঝ বয়েসি নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। পাশেই তাঁর বাড়ি। তিনি রাজ্য সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। বৃষ্টি পড়ছিল তাই তিনি নিজ গৃহে চা খাবার নিমন্ত্রণ করলেন। তাঁর নাম পেম। চা খেতে খেতে অনেক আলোচনা হল। ভীষণ সরল আর অতিথিপরায়ণ অরুণাচল প্রদেশের মানুষজন। যেহেতু পেম সাথে আছেন তাই দালাই লামাকে দেখা মিস হবে না। পেমের ভাই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাই সময়মত আমরা খবর পেয়ে যাব।
পেম এখানে স্বামী, সন্তান ও শাশুড়ী নিয়ে বেশ আনন্দে আছে। একতলা বাড়ির সামনে পেমের ফুল বাগান। হরেক ফুল টবে ফুটে উঠোন রাঙিয়ে রেখেছে।
পেম আমি আর তাঁর পরিবারের অন্য সকল সদস্য পথে নেমে আসলাম দালাই লামার গাড়িবহর দেখে। পেম শাশুড়িকে খুব ভালোবাসে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে শাশুড়ির মাথায় ছাতা ধরে রেখেছে।
গাড়ি ধীর লয়ে আসছিল। দালাই লামার সামনে খালি হাতে দাঁড়াতে নেই। তাই লম্বা সাদা সিল্কের কাপড় যার নাম খাদা, হাতে করে প্রার্থনার ভঙ্গীতে দাঁড়াতে হয়। পেম লম্বা এক টুকরো খাদা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। তিনি এলেন, আমি তাঁকে দেখলাম গাড়ির ভেতর থেকে হাত নাড়াতে নাড়াতে তিনি সামনে দিয়ে চলেও গেলেন।
পেম বলল, ‘চল গোমপায় যাই, আরো ভালমতো দেখা যাবে।’ আমি আর পেম ছুটলাম গোমপার দিকে শর্টকাট পথ ধরে। মানুষে ছেয়ে গেছে পথ। গোমপার ভেতরে বৃদ্ধদের বসার জন্য ব্যবস্থা করা আছে। আর অন্যরা দাঁড়িয়ে দেখল, তিনি এলেন, হাত নাড়লেন, গাড়ি থেকে নামলেন, কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন, তারপর ভেতরে চলে গেলেন। একই সময় ভিক্ষুরা ধর্মগ্রন্থ থেকে মন্ত্র আউরিয়ে যাচ্ছিলেন আর তিব্বতের ঐতিহ্যময় পোশাক সিনকা আবৃত মেয়েরা তিব্বতীয় ভাষায় সংগীত গাইছিলেন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আশ্রম চত্বরেই। আবার কেউ কেউ তিব্বতীয় ড্রাগন বা অন্যান্য পশুর সাজে ঢোল বাজিয়ে নাচের পোশাকে নেচে যাচ্ছিল।
গোমপা বা মন্দির থেকে দালাই লামা বের হয়ে এলেন। আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন পাশের ভবনে। খুব কাছে থেকে বিরাশি বছর বয়স্ক, পৃথিবীর সবচেয়ে পছন্দনীয় ধর্মযাজককে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
এত ভীড়ের মাঝে কেউ ধাক্কাধাক্কি করছে না, কেউ কারো পা মাড়িয়ে যাচ্ছে না। একটা মানুষের গায়ের সাথে অন্যের গা লাগছে না, কেউ গায়ের উপর হুড়মুড়িয়ে পড়ছে না। সব কী শান্তভাবে নিজ নিজ জায়গা থেকে হিজ হাইনেস দালাই লামাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
তিব্বতীয় রীতি অনুযায়ী পূর্ববর্তী দালাই লামা মৃত্যুর আগে ইঙ্গিত দিয়ে যান পরের দালাই লামাকে কোথায় পাওয়া যাবে। মৃত্যুর পর পূনর্জন্ম হয় দালাই লামার। ত্রয়োদশ দালাই লামা বলে গিয়েছিলেন সে কথাই। তাঁর অনুসারীরা তাই মৃত্যুর দু বছর পর খুঁজে পেয়েছিলেন দু’ বছর বয়সী বর্তমান দালাই লামাকে। কিন্তু চীন আর তিব্বতের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এর কিছুদিন পরই শিশু দালাই লামা অপহৃত হন। চীন মোটা অংকের টাকা দাবী করে দালাই লামার মুক্তিপণ হিসেবে। তিব্বতের ভাবী রাজনৈতিক ও ধর্মগুরুকে ছাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশ এগিয়ে আসে। যখন বালক দালাই লামা ছাড়া পান তখন তাঁর বয়স পাঁচ। এরপর ভিক্ষুর দীক্ষা গ্রহন করেন লাসায়। এবং ধীরে ধীরে বুঝে নেন নিজের দায়িত্ব। চব্বিশ বছর বয়সে রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন এবং ধরমশালায় ভারত সরকার তাঁর আবাসন নির্মাণ করে দেয়। তখন থেকেই শুরু দালাই লামার নির্বাসিত জীবন। ভারত থেকে তিনি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাজ পরিচালনা করেন। রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু ভারত ও অন্যান্য দেশে তাঁর বক্তৃতা শুনতে আজও লাখ লাখ লোকের সমাগম হয়। কি বলেন তিনি বক্তৃতায়? শুধু ধর্মের বাণীই নয় তিনি প্রায় সব বিষয় নিয়ে খোলামেলা ও নৈতিক আলোচনা করেন। পরিবেশ, অর্থনীতি, মানবাধিকার, অহিংসা, বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন।
গোমপা থেকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করা হচ্ছিল। আমি আর পেম বের হয়ে আরো খানিকক্ষণ গালগল্প করলাম। পেম দালাই লামাকে দেখেছে পাঁচ বার, অরুণাচল প্রদেশেই। আগামীকাল দালাই লামা বক্তৃতা দেবেন। পেম আমাকে একটা পাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেখানে প্রবেশের। বাইরে এখন আকাশ কালো করে, হাওয়া ছাপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। পেম পারলে আমাকে নিজের বাড়িতেই রেখে দেয়। রাতের খাবারও ওর বাড়িতেই খেতে হল। পিথো মানে স্যুপি নুডলস আর যিং মম খাজি মানে সালাদ। নুডলসে ছিল এখানকার ইয়াকের দুধ থেকে তৈরি চিজ বা পনির আর সবজি। খেতে অসাধারণ। খাবার সময় পেমের ঘরে আর কাউকে দেখলাম না। দালাই লামাকে দেখতে আসা জনগণও উধাও। আমি আর পেম খেতে খেতে গল্প করছিলাম। এরপরের বার এলে পেম আমাকে ওদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে৷
বাইরে তখন এ দেশের তুলনায় মধ্যরাত। ভাগ্যিস আমার হোটেল পরের রাস্তায়। না হলে পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় শীতে জমে যেতাম। অরুণাচল প্রদেশে সব দোকানপাট বিকেল পাঁচটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ঠাণ্ডা জেঁকে বসে এরপর তাই। আমারও সন্ধ্যে থেকে তাই কিছু করার নেই। হোটেলে ফিরে ঘুম দিলাম।
পরদিন ভোরে স্টেডিয়ামের দিকে রওনা হলাম। কুয়াশার মতো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে পথঘাট। কনকনে ঠান্ডায়ও নারীপুরুষ, শিশুদের মধ্যে উৎসব উৎসব ভাব। সবাই বেশ সেজেগুজে হেঁটে চলছে। বমডিলায় মোট ছয় আদিবাসীদের আবাসস্থল – শেরতুকপেন, আকা, মনপা, সারতাং, বুগুন, মেইজি। এদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাকও আলাদা আলাদা। আমি অবশ্য এই রঙ বাহারের মধ্যে কিছুই আলাদা করতে পারছি না। যাকেই দেখি তাকেই মনে হয় আগেরজনের মতোই তিব্বতি ধরনের কাপড় পরে আছে৷ প্রত্যেককেই আমার ফুটে থাকা গোলাপি রডোডেনড্রন ফুল বলে মনে হচ্ছে। এই হাড় কাপানো ঠান্ডায়, বৃষ্টিতে ভোরবেলা থেকেই মেয়েরা বেশ সাজগোজ করে ছাতা মাথায় মাঠের দিকে এগোচ্ছে।
গেলাম দালাই লামাকে আরো কাছ থেকে দেখার জন্য। দালাই লামা তিব্বতি ভাষায় বক্তৃতা শুরু করেছেন। কিছুই বুঝতে পারছি না৷ পেম কেও খুঁজে পেলাম না আজ।
এই ভয়ানক ঠান্ডায় আমি দুটো টি শার্টের উপর সোয়েটার আর তার উপর জ্যাকেট চাপিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছি, তখন দেখি দালাই লামা দিব্যি একটা হাতকাটা জামা পরে নির্বিকারে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। ঈশ্বর কি তাকে সত্যিই মহামানব বানিয়ে পাঠিয়েছেন!
দালাই লামা এবার খানিকটা ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা দিলেন। সকল নারীপুরুষ মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন সে সময়টায়। তিব্বতি উচ্চারণে ইংরেজি বলছেন, চারিদিক একেবারে নীরব, আর দালাই লামা বলে চলছেন,
‘আমাদের রাগ এবং ভয়কে জয় করতে হবে৷ আমরা আমাদের সময়কে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছি না৷ আমাদের মস্তিষ্ক সঠিকভাবে ব্যালেন্সড নয়, মস্তিষ্কে তাই লুকিয়ে থাকে রাগ, ঈর্ষা, দুশ্চিন্তা। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন বিষয় ঠিকমতো সমন্বয় করা হয়নি, ইনার পিস বিষয়টা সব প্রতিষ্ঠানে শেখাতে হবে। আমাদের জানতে হবে অন্তরের অন্তর্নিহিত সুখ কোথায় লুকিয়ে আছে৷ এই অন্তর্নিহিত সুখ প্রার্থনার মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যাবে না, খুঁজে পাওয়া যাবে প্রজ্ঞার মাধ্যমে, নিজেকে বোঝার মাধ্যমে। সবসময় আত্মপ্রকাশে ব্যস্ত থেকে আমিত্ববোধ জীবন নয়। যখন রাগান্বিত হবে, তখন নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাবে৷ আজকের দিনে বাস্তবতা হল, সমস্ত জাতি যুদ্ধবিগ্রহে ন্যস্ত, মানবিকতায় নয়। আমাদের নিজেদের মাঝে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
পর্যটক, কথাসাহিত্যিক
জন্ম ঢাকায়। বেড়ে উঠা ব্যাঙ্গালোরে, পড়াশোনা ব্যাঙ্গালোর ও সিঙ্গাপুরে।
পেশায় ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিস্ট।