| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা: তুষার গায়েন’র কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
রথযাত্রায় গিয়ে কৃষ্ণ পথ হারালেন। 
হাজার হাজার ভক্তের সমাবেশে 
'হরে রাম হরে কৃষ্ণ' বলে মাইকের উচ্চনাদে
প্রকম্পিত মাঠ, মাথার উপরে গনগনে সূর্যের তাপ 
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধরত পাণ্ডব ও কৌরবদের উত্তেজনার 
উত্তাপও দিচ্ছিল ম্লান করে ! 

মঞ্চে রাধিকা নেচে চলেছেন অবিরাম 
বৃন্দাবনের সেই সখি ভাব তার দেহলতা জুড়ে 
চোখে মুখে প্রেমের শিঞ্জন কৃষ্ণের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়; 
হঠাৎ রাধিকা মঞ্চ থেকে নেমে চলে যায় কৃষ্ণের পাশ ঘেঁষে 
চমকে উঠে তাকে ডাকতে গিয়েও কৃষ্ণ স্থানু হয়ে ভাবেন,
'এত ভিড়ে কীভাবে যে ডাকি ওকে !'  
রাধা মঞ্চে উঠে আবার নাচে মনোহর, মুরলি মোহন দেখেন 
অপলক ! বছর কয়েক আগে দেখা হয়েছিল আর বিচ্ছেদ তারপর 
এতদিন পর দেখা, 'কীভাবে এত ভিড় ঠেলে যাই ওর কাছে?' 

রাধা মঞ্চ ছেড়ে এবার মাঠে আসেন নেমে এবং নাচেন 
কিছু ঘনিষ্ঠ সখি পরিবৃত হয়ে। কিন্তু কৃষ্ণের দেহে কোনো 
নাচ নাই, কোনো তরঙ্গ উঠে আসে না তার জড়তা ভাঙাতে। 
কৃষ্ণ অপলক দেখেন রাধার নাচ। 

রাধা ফের মঞ্চে গিয়ে নাচে আর আড়চোখে দেখে কৃষ্ণকে 
কৃষ্ণ মরমে মরে যায় নিজের স্থবিরতায়, ভাবে তার 
পা থেকে কি শিকড় নেমেছে মাটির তলায়?  

এবার সহসা রাধা মঞ্চ থেকে নেমে কৃষ্ণের সম্মুখে 
এসে পড়ে একদম যেন দেখে নাই এরূপ উদাসীনতায় 
দ্রুতগতি পা ফেলে চলে যেতে চায়, কৃষ্ণ মুহূর্তেই 
সপ্রতিভ হয়ে বলে, "হায়, রাধা কত বছর দেখি না তোমায় 
কোথায় হারালে তুমি খুঁজেছি মনে মনে অসীম ব্যথায় !" 

সচকিত হয়ে রাধা বলে, "ওহ, আমি তো নেচে ঘেমে একাকার 
তুমি কেন নাচো না এই রথযাত্রায়?"

কিছু বলতে গিয়ে কৃষ্ণ থেমে যায়, বোঝে না ঠিক 
কী কথা বলা সমীচীন হয় ! পড়ন্ত বিকেলে নেমে আসা 
প্রায়-সন্ধ্যায় রাধা লঘু পায়ে হেঁটে হেঁটে একা প্রান্তরে মিলায় --
কৃষ্ণের অতীত প্রেমগাথা ক্ষুণ্ণ করে তাঁর পা থেকে 
শিকড় আরো মাটির গভীরে ছড়ায়। 

হায় ! কৃষ্ণ তুমি কি আত্মবিস্মৃত, ভুলেছ সকল লীলা 
কলিকালের এই অবেলায়?  
উঠেছি যে-রিক্সায় তার কিশোর চালক দ্রুতবেগে 
আমাকে চালিয়ে নিয়ে আসে বহুতল বাড়ির সামনে
নির্ভুল ঠিকানায়। আমার মনে পড়ে বেশিক্ষণ তো নয় এখানে --
দ্রুতই আমাকে যেতে হবে অন্য আরেক জায়গায় 
আবার খুঁজব কাকে, কোথায় পাব তাড়াতাড়ি ক'রে 
অন্য রিকশা কোনো -- সন্ধ্যা যে নেমেছে গাঢ় হয়ে ...
আমি বলি ওকে অনুচ্চ স্বরে, "কত ভাড়া হলো যেন?" 
'পঞ্চাশ' বলে পিছু ফেরে দেখে আমাকে। 

"আচ্ছা, তুমি কি দাঁড়াবে কিছুক্ষণ? 
এই তো তিনতলায় যাব আর আসব এক্ষুণি, 
অপেক্ষা করো, আমি যাব আরেকটা ঠিকানা
একসাথে যা ভাড়া হয় সেখানে গিয়ে মিটিয়ে দেব তোমায়।" 

মৃদু হেসে সে আস্থায় নাড়ে মাথা। 
উপরে অনেকের সাথে দেখা, কী সব কাজের জটিলতা
এটা সেটা করে সময় যায় চলে ... উদ্বেগে ভাবি, আহা
ছেলেটি যে দাঁড়িয়ে আছে একঠায় !

হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়, একি আমি যে বিছানায় শুয়ে আছি !
হায়, ছেলেটিকে আমি কোথায় পাব? কীভাবে দেব ভাড়া তার 
এ যে বিশ্বাসভঙ্গ হলো, হায়, আমার অপরিশোধ্য ঋণ থেকে যায় !
কী আর আছে একাকী জীবনে? 
সমস্ত দুশ্চিন্তা গুছিয়ে রেখে 
আরাম কেদারায় এলিয়ে দিতেই দেহ 
গ্রীষ্মকালের বৃষ্টি নামে ! 
যেভাবে জমেছিল মেঘ বাষ্পরুদ্ধ 
অস্বস্তির অনেক উপরে;
উৎকণ্ঠিত সপ্তাহের দাবদাহ ভেঙে 
প্রথমে দমকা হাওয়ায় শিস দিয়ে নামে 
তারপর অবিচল ধারাপাত 
সব ভার নেমে যাবার নির্ভার ধারা  
ক্ষান্তি নেই -- রাত ভোর হয়ে আসে 
বৃষ্টির অবকাশে কখন জাগবে পাখি? 
বৃষ্টি অতীত হয়ে বাতাসে ভাসবে মিহি জলকণা
আকাশে নমিত সূর্য রৌদ্রের বিভা ...
মন তুমি নিজেই ভেবেছ নিজের মতো করে
খুঁটিয়ে দেখার সামান্য সেই ক্লেশটুকু না করে 
যে-তথ্য ছিল তোমার পুরোনো ভাণ্ডারে
তার উপর ভর করে চলো গহীন অন্ধকারে?
এ যে অন্তর্ঘাত নিজের সাথে দুরারোগ্য আচরণ
যে-দেহমন চলবে তোমার যত্ন-প্রকৌশলে
তাকেই তুমি দিয়েছ ফেলে ব্যর্থ গহ্বরে;
কী বিধান প্রাপ্য নিতে তোমার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ?
নিজেই চালক না হয়ে যখন চালিত তুমি হবে ! 
ওরে মন ! তোমার ওপর বাস করে যে-অসীম অনন্তর 
তার সাথে কি করমর্দন এতই অসম্ভব? 
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত