| 19 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

প্রবাদ বাগধারা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

উদয় চট্টোপাধ্যায়

এক রেস্তোরাঁয় বসে কয়েকজন বন্ধু চা খাচ্ছে আর ‘রাজাউজির’ মারছে। এমন সময় আর এক বন্ধু ‘গদাই লস্করি’ চালে এসে ঢুকল। তাকে দেখে সবাই হৈহৈ করে উঠল: তুমি তো ‘ডুমুরের ফুল’ হয়ে গেছ হে! যা হোক, আড্ডা যথারীতি চলতে লাগল। কিছু রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এসে পড়লে তর্কাতর্কি, উত্তেজনা। ‘চায়ের পেয়ালায় তুফান’ উঠল। প্রায় একটা ‘কুরুক্ষেত্র কাণ্ড’ বাধার উপক্রম।

এই ছোট্ট বর্ণনাতেই দেখতে পাচ্ছি আমরা কিছু শব্দবন্ধ ব্যবহার করে ফেলেছি, যেগুলোকে ঊর্ধ্বকমার মধ্যে দেখানো হয়েছে, এবং যেগুলো বিশেষ কিছু অর্থবাহী। এগুলোই বাগধারা বলে পরিচিত। সংসদ বাংলা অভিধানে পাচ্ছি, বাগধারা হল বিশিষ্টার্থক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ। ইংরেজিতে যাদের বলা হয় ‘idiom’। অক্সফোর্ড ডিক্‌শনারিতে পাচ্ছি, ‘Idiom is a phrase or sentence whose meaning is not clear from the meaning of its individual words and which must be learnt as a whole unit.’ আর, ‘phrase’ কী? ‘Phrase is a group of words without a verb’। পরিষ্কার সংজ্ঞা। বাংলা বাগধারার কিছু নিদর্শন তো শুরুতেই দেখা গেল। ইংরেজি ইডিয়মের দুচারটে উদাহরণ: French leave, beef up, cold war, green light ইত্যাদি।

প্রবাদ কী? সংসদ অভিধান জানাচ্ছে, ‘পরম্পরাগত বাক্য, জনশ্রুতি, প্রবচন, অপবাদ/নিন্দা’। প্রবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘proverb’। অক্সফোর্ড অভিধান মতে যা হল ‘A Short, well-known saying that states a general truth or general advice’। বাগধারা বা ইডিয়মের সঙ্গে দুটো বড়ো পার্থক্য এখানেই প্রতীয়মান হয়ে গেল: প্রবাদ বা proverb অবশ্যই বাক্য, অর্থাৎ ক্রিয়াপদযুক্ত, আর সত্যপ্রচার বা পরামর্শদান তার অন্যতম উদ্দেশ্য। বাগধারা বা idiom ক্কচিৎ বাক্য, আর সত্য বা নির্দেশ পরিবেশনার দায় থেকে সে মুক্ত। বরং হালকা চালে বড়ো কিছুকে দেখানোর দায়িত্ব তার — অনেকটা বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মতো। প্রবাদের একটা উদাহরণ: এক মাঘে শীত যায় না। Proverb এর একটা উদাহরণ: A stitch in time saves nine.

শুধু বাংলা বা ইংরেজি নয়, সব ভাষাতেই প্রবাদ আর বাগধারার প্রাচুর্য। তারা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, সতেজ রেখেছে। প্রবাদ মূলত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। দেশ, কাল, বর্ণ, সংস্কৃতিভেদের সীমানা লঙ্ঘন করে বিশ্বমানব এক জায়গায় এসে একীভূত – সেটা তার প্রবৃত্তি। তার তাড়নায় আর বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়েছে পরিপার্শ্ব থেকে, এবং তা আশ্চর্যজনকভাবে সমধর্মী। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে আবির্ভূত হয়েছেন কিছু প্রজ্ঞাবান চরিত্র, যাঁরা বেঁচে থাকার এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার কিছু পথনির্দেশ দিয়েছেন। আমজনতার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা আর এইসব প্রজ্ঞাবানদের প্রবচনই প্রবাদের উপজীব্য — সর্বকালে, সর্বদেশে। ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা’। প্রবাদগুলো অন্তত তা-ই প্রমাণ করে। বহুক্ষেত্রে বক্তব্য এবং নির্দেশ আশ্চর্যজনকভাবে এক, শুধু পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব পড়েছে তাদের প্রকাশে। হয়তো এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, এটাই স্বাভাবিক।

সমর্থনে উদাহরণে আসা যাক। আলোচনা সীমিত রাখি বাংলা আর ইংরেজিতে। কারণ, অন্যান্য ভাষায় লেখকের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, আর বর্তমান প্রবন্ধের পরিসরও প্রতিকূল। বাংলা প্রবাদ আর ইংরেজি proverb-এর সমতুল্যতা নিদর্শন হিসাবে অনায়াসে লিপিবদ্ধ করা যায়:

১) অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট
Too many cooks spoil the broth.

২) নেই মামার চেয়ে কানামামা ভালো
Half a loaf is better than no bread.

৩) ফোঁপরা ঢেঁকির শব্দ বেশি / যত গর্জে তত বর্ষে না
Empty vessels sound much.

৪) নাচতে না জানলে উঠোন বেঁকা লাগে
A bad workman blames his tools.

৫) নিজের চরকায় তেল দাও
Oil your own machine.

৬) একহাতে তালি বাজে না
It takes two to make a quarrel.

৭) চকচক করলেই সোনা হয় না
All that glitters is not gold.

৮) কয়লা ধুলেও যায় না ময়লা / অঙ্গারঃ শতধৌতেন মলিনত্বং ন মুঞ্চতি
A coal will take no other hue.

৯) গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না
Familarity breeds contempt.

১০) ভাগের মা গঙ্গা পায় না
Everybody’s business is nobody’s business.

১১) ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়
A burnt child dreads the fire.

১২) যস্মিন্‌ দেশে যদাচারঃ
When in Rome do as Romans do.

১৩) মুলো খেলে মুলোর ঢেঁকুর ওঠে
He that drinks beer, thinks beer.

১৪) ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়
Where there’s a will there’s a way.

১৫) হেলে ধরতে পারে না কেউটে ধরতে যায়
Learn to walk before you run.

১৬) কষ্ট বিনা কেষ্ট মেলে না
There is no gain without pain.

১৭) কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ট্যাঁশ ট্যাঁশ
Strike the iron when it is hot.

১৮) চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে
It’s easy to be wise after the event.

১৯) বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর
When the cat’s away the mice will play.

২০) হাতিঘোড়া গেল তল, গাধা বলে কত জল
Fools rush where angels fear to tread.

২১) চালুনি ছুঁচকে বলে তোর পিছনে কেন ছ্যাঁদা
A pot calling the kettle black.

২২) যত গর্জায় তত বর্ষায় না
A barking dog never bites.

নিদর্শন আরও বাড়ানো যায়। কিন্তু অলমিতি। বরং দেখা যাক কিছু প্রবাদ যাদের ইংরেজি প্রতিরূপ পাচ্ছি না:

১) স্যাকরার ঠুকঠাক কামারের এক ঘা
২) যা রটে তা কিছু বটে
৩) খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল করল এঁড়ে গোরু কিনে
৪) লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন

তেমনি অনেক ইংরেজি proverb-এর বাংলা প্রতিরূপ পাচ্ছি না:

1. All good things come to an end.
2. A bird in hand is worth two in bush.
3. Cut your coat according to your cloth.
4. Necessity is the mother of invention.
5. Rome was not built in a day.
6. A stitch in time saves nine.
7. One swallow does not make a summer.
8. A rolling stone gathers no moss.
9. An idle brain is devil’s workshop.

এক্ষেত্রেও উদাহরণ বাড়ানো যায়। কিন্তু থাক। বরং লক্ষ্য করি যে এইসব বাংলা আর ইংরেজি প্রবাদগুলো জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে জনমানসে, আর পরম্পরাগত হয়ে এখনও বয়ে চলেছে জনজীবনে। প্রবাদের আর উৎস হল ধর্মীয় নীতি নির্দেশিকা মহাজন উক্তি বা জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মও। লক্ষণীয় হল কিছু অর্বাচীন সাহিত্য উদ্ধৃতিও প্রবাদের রূপ নিয়েছে কিংবা নিতে চলেছে। উদাহরণ দেওয়া যাক। ইংরেজিতে —

1. Love thy neighbour as thyself. (The Bible)
2. All’s well that ends well. (Shakespeare)
3. Cowards die manytimes before their death. (Shakespeare)
4. A little learning is a dangerous thing. (Alexander Pope)
5. Fools rush where the angels fear to tread. (Alexander Pope)
6. The child is the father of the men. (Wordsworth)
7. A thing of beauty is a joy forever. (John Keats)
8. United we stand, divided we fall. (John Dickinson)
9. The female of the species is more deadly than the male. (Rudyard Kipling)
10. Soldiers march on their stomach. (Napoleon)

বাংলায় —

১) জাতস্য হি ধ্রুবোর্মৃত্যুঃ (গীতা) / জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? (মধুসূদন দত্ত)
২) সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। (চণ্ডীদাস)
৩) বড়োর পীরিতি বালির বাঁধ / খনে হাতে দড়ি খনেকে চাঁদ। (ভারতচন্দ্র)
৪) চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? (কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার)
৫) সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। (কামিনী রায়)
৬) কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে, কামড় দিয়েছে পায়। (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

এতগুলো বাংলা প্রবাদের মধ্যে শুধু একটিতেই দেখতে পাচ্ছি এক ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব — লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। (অবশ্য কৃষ্ণ বা কেষ্ট বাদ দিচ্ছি, কানু বিনে তো গীত নেই!)। এই গৌরী সেন সপ্তদশ শতাব্দীর লোক, হুগলির বাসিন্দা। কথিত আছে, ব্যবসাসূত্রে তিনি দস্তার পরিবর্তে একজাহাজ রূপো পেয়েছিলেন। সেই লাভের টাকা তিনি সৎকর্মে ব্যয় করবেন বলে সংকল্প করেন। সবার প্রয়োজনে মুক্তহস্তে দান করে তিনি প্রবাদে স্থান করে নিয়েছেন।

এবারে বাগধারায় আসা যাক। বাংলা বাগধারায় ভিড় করে এসেছে রামায়ণ মহাভারত পুরাণের ঘটনা বা চরিত্র। শুরু করা যাক ‘মান্ধাতার আমল’ দিয়ে। সূর্যবংশ অর্থাৎ রামচন্দ্রের বংশের এক অতিপ্রাচীন পূর্বপুরুষ এই মান্ধাতা। বহুপ্রাচীন কাল বোঝাতেই মান্ধাতার কাল বা মান্ধাতার আমল। ওদিকে চন্দ্রবংশের অর্থাৎ মহাভারতের কুরুপাণ্ডবদের এক পূর্বপুরুষ রাজা ভরত মোক্ষলাভের তাড়নায় কাজকর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে জড়ত্ব বরণ করেছিলেন। তাঁর নাম থেকেই নিষ্ক্রিয় লোকদের অভিধা ‘জড়ভরত’। এই ভরত কিন্তু দুষ্মন্ত-শকুন্তলা পুত্র সর্বদমন ভরত নন। তেমনি পৌরাণিক অগস্ত্যমুনির নামে ‘অগস্ত্য যাত্রা’। বিন্ধ্যপর্বত হিমালয়ের মতো উঁচু হতে চাইছিলেন তপস্যার জোরে, এবং তাতে সূর্যের দক্ষিণাবর্ত্ম পরিক্রমা বাধাপ্রাপ্ত হয়। দেবমানব সবাই ধরে বসেন বিন্ধ্যপর্বতের গুরু অগস্ত্যকে এর একটা সুরাহা করার জন্যে। অগস্ত্য দাক্ষিণাত্যে যাত্রা করলেন। বিন্ধ্য তাঁকে দেখে নত হয়ে প্রণাম করলেন। অগস্ত্য বললেন, বৎস, আমি না-ফেরা পর্যন্ত তুমি নত হয়েই থাকো’। তিনি আর ফেরেন নি। ভাদ্রমাসের পয়লা তারিখে তাঁর এই যাত্রার সূচনা হয়েছিল। ওই দিনটাতে এখনও পর্যন্ত অনেকে যাত্রা পরিহার করে থাকেন, পাছে আর ফেরা না-হয় সেই ভয়ে।

পুরাণ থেকে আরও এসেছে ধ্রুব সত্য, ধুন্ধুমার কাণ্ড, রক্তবীজের ঝাড় ইত্যাদি বাগধারা। চরম সত্যের পরাকাষ্ঠা বোঝাতে আমরা বলি ধ্রুব সত্য। পৌরাণিক রাজা উত্থানপাদের দুয়োরানির শিশুপুত্র ধ্রুব সৎভাইদের সঙ্গে সিংহাসনে বাবার কোলে বসতে চাইলে সৎমা গঞ্জনা দেন, পরামর্শ দেন কৃষ্ণ ভজনা করে এই অধিকার লাভ করতে। কঠিন তপস্যায় অবিচলিত থেকে ধ্রুব কৃষ্ণকে অবতরণ করালেন। কৃষ্ণ বর দিতে চাইলে ধ্রুব কামনা করলেন কৃষ্ণের চরণে যেন তিনি আশ্রয় পান। সত্যের জন্য তাঁর এই চরম নিষ্ঠা চরমসত্যকে ধ্রুব সত্য অভিধা দিয়েছে। উত্তর আকাশে অবিচল ধ্রুবতারা এই অবিচল সত্যনিষ্ঠারই দ্যোতক।

ধুন্ধুমার কাণ্ড! ধুন্ধুমার ব্যাপারটা কী? ধুন্ধু ছিল এক দুর্দান্ত দৈত্য। ব্রহ্মার বরে শক্তিশালী হয়ে সে স্বর্গে মর্ত্যে পাতালে অত্যাচার শুরু করেছিল। ঋষি উতঙ্কের সহায়তায় ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা কুবলাশ্ব তাকে সংহার করেছিলেন। তাই কুবলাশ্ব অভিহিত হলেন ধুন্ধুমার নামে। সংহার ব্যাপারটা খুব সহজে ঘটেনি। সব অস্ত্র হজম করে নিয়ে ধুন্ধু মুখ থেকে বার করতে লাগল অজস্র আগুনের হলকা। তাতে পুড়ে মরল কুবলাশ্বের সহস্র পুত্র। শেষমেষ কুবলাশ্ব ধুন্ধুর দেহে জলের ধারা বইয়ে দিয়ে তাকে ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে ভস্ম করে ফেলেছিলেন। ভয়ঙ্কর মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামাকে তাই ধুন্ধুমার কাণ্ড বলা হয়।

রক্তবীজের ঝাড় বাগধারাটির উৎস শ্রী শ্রী চণ্ডী। শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসীম বলশালী দৈত্য দেবতাদের স্বর্গছাড়া করেছিল। দেবতারা কাতর হয়ে দুর্গার শরণাপন্ন হলে দুর্গা শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্য কৃষ্ণবর্ণ কালিকা বা কৌশিকী রূপের সৃষ্টি করলেন। শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ পর্বে দেবী দুর্গা প্রথমে নিধন করলেন শুম্ভ-নিশুম্ভের সেনাপতি ধূম্রলোচন আর চণ্ডমুণ্ডকে। তারপর যুদ্ধ করতে এল রক্তবীজ নামে এক অসুর। দেবতার বরে এই অসুরের গায়ের রক্ত যেখানে পড়বে সেখানেই শত শত একই আকৃতি ও শক্তিধারী রক্তবীজের জন্ম হবে (এটা কি আধুনিক ক্লোনিং-এর পূর্বসূরী?)। দেবী দুর্গা কালীকে বললেন, ‘তুমি মুখের হাঁ বড়ো করো, আমি অস্ত্রাঘাত করলে যখন রক্তবীজের শরীর থেকে রক্তপাত হবে তখন সেই রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তুমি তা পান করে ফেলো।’ এইভাবে রক্তবীজ নিধন হল। কিন্তু যখন নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও মশককুলের বংশবৃদ্ধি ঘটছে কিংবা পার্থেনিয়াম ছেয়ে ফেলছে মাঠঘাট, তখন তাদের রক্তবীজের ঝাড় বলতেই হয়।

রামায়ণ থেকে এসেছে কালনেমির লঙ্কাভাগ, কুম্ভকর্ণের নিদ্রা, রাবণের গুষ্টি, রামরাবণের যুদ্ধ, ঘরের শত্রু বিভীষণ, লক্ষ্ণণভাই, রাবণের চিতা, লঙ্কাকাণ্ড, কুবেরের ধন, অগ্নিপরীক্ষা। প্রথমটা আমরা প্রয়োগ করি কোন ঘটনা বা উদ্যোগ সংঘটিত হবার আগেই তার থেকে লাভের প্রত্যাশা করার ক্ষেত্রে। রাবণের মামা কালনেমি রামচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে সম্মত হয়েছিলেন যুদ্ধজয়ের পরে লঙ্কার ভাগ পাবার জন্য রাবণের সঙ্গে দরাদরি করে। ফলাফল তো আমাদের সকলের জানা। এই বাগধারার আর এক দোসর আছে — গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। রাবণের বীরত্বের কথা অমর করে রাখার জন্যে রামচন্দ্র নাকি বর দিয়েছিলেন রাবণের চিতা অনির্বাণ থাকবে। তাছাড়া, রাক্ষসকুলের কাছে রাবণ নিধন অনন্তকালীন শোকাবহ ঘটনা। নিদারুণ শোকের স্মৃতি তাই রাবণের চিতা হয়ে বাগধারায় বেঁচে আছে। আরও কথিত আছে যে রাবণবধের পর মন্দোদরী রামচন্দ্রকে প্রণাম করলে রামচন্দ্র তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন ‘চির সৌভাগ্যবতী হও’ এই বলে। কিন্তু মন্দোদরী যে সদ্যোবিধবা এই কথা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি রাবণের চিতা অনির্বাণ থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

মহাভারত থেকে পেয়েছি ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, পাণ্ডববর্জিত দেশ, কংস মামা, শকুনি মামা, দাতা কর্ণ, কুরুক্ষেত্র কাণ্ড, বিদুরের খুদ, গজকচ্ছপের লড়াই। পিতা শান্তনুর প্রীত্যর্থে বিমাতা সত্যবতীর পুত্র বা তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের সিংহাসনপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত করতে দেবব্রত ভীষ্ম আজীবন কৌমার্যব্রত পালনের ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’ তাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞার পরিচায়জ্ঞাপক। বনবাস, রাজ্যজয় আর রাজসূয় যজ্ঞের জন্য পাণ্ডবরা কোথায় যান নি, শুধু দুর্গম আর অগম্য স্থান বাদে! জনপদের সঙ্গে সংযোগহীন আর সভ্য জীবনযাত্রার অনুপযোগী জায়গাগুলো তাই ‘পাণ্ডববর্জিত দেশ’। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নিবারণের উদ্দেশ্যে পাণ্ডবদের দৌত্য নিয়ে হস্তিনাপুরে এসে শ্রীকৃষ্ণ দুর্যোধনের রাজভোগ উপেক্ষা করে ধর্মাত্মা বিদুরের কুটিরে গিয়ে সাধারণ অন্নগ্রহণ করেছিলেন। দীনজনের ভক্তির দান তাই বিদুরের খুদ অভিধায় মহিমান্বিত। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন এক অসাধারণ যুগপুরুষ। সাধারণের থেকে উপরতলার প্রতিপত্তিশালী লোকেরা তাই কেষ্টবিষ্টু। আর শ্রীকৃষ্ণের কৈশোর লীলার স্মরণে আধুনিক প্রবল প্রেমিকপ্রবররা কলির কেষ্ট শিরোপায় বিভূষিত।

গজকচ্ছপের লড়াই মহাভারতের আদিপর্বের উপাখ্যান। ঐ একই উপাখ্যানে জড়িয়ে আছেন বালখিল্য মুনিরা। বিমাতা কদ্রুর কাছ থেকে মাতা বিনতার দাসীত্ব মোচনের উদ্দেশ্যে পক্ষীরাজ গরুড় অমৃত আনতে দেবলোকে পাড়ি দিয়েছিলেন। পথে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য পিতা মহর্ষি কশ্যপ তাঁকে এক সরোবরতীরে যুদ্ধমান গজকচ্ছপকে ভক্ষণ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই গজকচ্ছপ কোন সাধারণ জন্তু নয়। কোপনস্বভাব মহর্ষি বিভাবসু ধনবিভাগের জন্য ভাই সুপ্রতীকের পীড়াপীড়িতে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে হাতি হবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। ভাই সুপ্রতীকও অগ্রজকে কচ্ছপ হবার অভিশাপ দিলেন। গজ আর কচ্ছপ অবস্থাতেও তাঁরা অবিরাম লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। গরুড় সেই গজকচ্ছপকে নখে তুলে নিয়ে এক বিশাল বটবৃক্ষের শাখায় বসলেন ভক্ষণ করার মানসে। ডাল ভেঙে পড়ল। গরুড় দেখলেন অসংখ্য ক্ষুদ্রাকার বালখিল্য মুনি সেই ডালে ঝুলে থেকে তপস্যা করছেন। কশ্যপের অনুরোধে বালখিল্য মুনিরা হিমালয়ে গেলেন তপস্যা করতে, আর গরুড় এক তুষারময় পর্বতশিখরে গিয়ে ভোজনপর্ব সম্পন্ন করলেন। ভাই-ভাই-এর বা জ্ঞাতিদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদ তাই গজকচ্ছপের লড়াই নাম নিয়েছে। আর সেই ক্ষুদ্রাকার বালখিল্য মুনিদের স্মরণে খুদে শিশুরা অভিহিত হচ্ছে বালখিল্য নামে।

এইসব পৌরাণিক উৎস ছাড়াও সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বাগধারার যাদের উৎস লোককথা, লোকগাথা, ইতিহাস, পরিপার্শ্ব, এবং অবশ্যই পর্যবেক্ষণগত অভিজ্ঞতা। লোককথা থেকে এসেছে আলাদিনের প্রদীপ, কমলি ছাড়ে না, সাক্ষীগোপাল, ব্যাঙের আধুলি, নিরানব্বই এর ধাক্কা ইত্যাদি বাগধারা। আরব্য উপন্যাসের আলাদিনের গল্প কে না জানে। আলাদিন ছিল গরিবঘরের ছেলে। এক জাদুপ্রদীপ তার হস্তগত হয়েছিল। সেই মসীলিপ্ত প্রদীপ মাটিতে ঘষলেই আবির্ভূত হতো এক জীন, যে তার হুকুমমতো সব কিছু এনে দিত। হঠাৎ কেউ বড়োলোক হয়ে উঠলে বা যথেচ্ছ খরচ করতে শুরু করলে তার আয়ের উৎসের ব্যাপারে পড়শি বা বন্ধুদের এই শ্লেষোক্তি। ‘কমলি ছাড়ে না’-র গল্পটা হলো নদীতে ভাসমান এক ভালুক দেখে এক ব্যক্তি সেটাকে কোন কম্বলজড়ানো মৃতদেহ ভেবে কম্বল উদ্ধারের আশায় জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। কাছে যেতেই ভালুকের আলিঙ্গন। নদীর পাড় থেকে তার বন্ধুরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাকে চিৎকার করে পরামর্শ দেয় কম্বল (কমলি) ছেড়ে চলে আসতে। তার উত্তরে লোকটির এই বিলাপ ‘কমলি যে ছাড়ে না’। অনাবশ্যক ঔৎসুক্যের জন্য কেউ বিপদে জড়িয়ে পড়লে এই বাগধারার প্রয়োগ।

পুরীর সন্নিকটে সমুদ্রতীরে সাক্ষীগোপাল কৃষ্ণের মূর্তি ও মন্দির। কীসের সাক্ষ্য দেবার সাক্ষ্যবহন করছে এই মূর্তি? তার পিছনে রয়েছে এক লোককথা। পুরীতে তীর্থ করতে এসে এক প্রৌঢ় বিপ্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গী এক তরুণ বিপ্র শুশ্রূষায় তাঁকে বাঁচিয়ে তুললেন। কৃতজ্ঞ প্রৌঢ় তাঁর কন্যার সঙ্গে তরুণ বিপ্রের বিবাহ দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। গ্রামে ফিরে কিন্তু ভুলে গেলেন প্রতিজ্ঞার কথা। শ্রীক্ষেত্রে উচ্চারিত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলে প্রৌঢ় অভিশাপগ্রস্ত হবেন, তাই তরুণ বিপ্র তাঁকে প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিতে প্রৌঢ় বললেন তাঁর এই প্রতিজ্ঞা দেবার সাক্ষী আনতে পারলেই তিনি বিবাহ দেবেন। তরুণ বিপ্র জগন্নাথকে অনুনয় করল সাক্ষী হিসাবে তার সঙ্গে গ্রামে যেতে। জগন্নাথদেব রাজি হলেন এক শর্তে: তিনি তরুণ বিপ্রের পিছু পিছু যাবেন, কিন্তু সে পিছন ফিরে দেখলেই তিনি থেমে যাবেন। তরুণ প্রশ্ন করল কী করে সে বুঝবে যে জগন্নাথ তাঁকে অনুসরণ করছেন। জগন্নাথ জানালেন তাঁর চরণের নূপুরধ্বনিতেই সেটা বোঝা যাবে। যাত্রা শুরু হল। পথ চলতে চলতে নটখট নটবর কৃষ্ণের মাথায় দুষ্টুমি চাপল। কয়েক লহমার জন্যে নূপুর চেপে ধরলেন। নূপুরের আওয়াজ না শুনে আতঙ্কিত তরুণ বিপ্র পিছনে ফিরে তাকালেন। কৃষ্ণ সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। কোন অঘটন সামনে ঘটতে দেখেও যে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে তার জন্যেই এই সাক্ষীগোপাল বিশেষণ।

ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে তুঘলকি কাণ্ড, মগের মুলুক, কালাপাহাড়, মীরজাফর, সরফরাজি ইত্যাদি বাগধারা। দিল্লির পাঠান সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন খামখেয়ালি। তাঁর হঠাৎ মনে হল রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে দেশের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত দেবগিরিতে নিয়ে গেলে সাম্রাজ্য পরিচালনায় সুবিধা হবে। যে কথা সেই কাজ। পরিকাঠামোর কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা না-করেই সব সরকারি দফতর, সরকারি কর্মচারী, মায় দিল্লির সব জনগণকে নির্দেশ দেওয়া হল স্থানান্তরণের। হেনস্তা অনুমেয়। কয়েকমাস পর তাঁর মনে হল নতুন জায়গায় কাজকর্ম ঠিকমতো হচ্ছে না। আবার ফরমান জারি হল, চলো দিল্লি। বর্তমান কালের শাসকদের কাজকর্মেও কি আমরা তুঘলকি কাণ্ড দেখতে পাই না? সোচ্চার হয়ে বলতে গেলে হয়তো বিপদের সম্ভাবনা আছে। বরং দেখা যাক মগের মুলুক কোথায়। প্রাচীন ব্রহ্মদেশ, ব্রিটিশ যুগের বার্মা, বর্তমান মায়ানমারের একটি প্রদেশ আরাকান। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের গা-ঘেঁষা। সেখানকার অধিবাসীদের বলা হতো মগ। (পুবে মগ ছিল বলেই কি বাঙালরা পশ্চিমদিকের লোকদের ঘটি নাম দিয়েছিল? ঐতিহাসিকরা সাহায্য করুন!) সেই মগরা বাংলায় নবাবি আমলে প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দক্ষিণবাংলায় লুঠপাট আর অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল। আইন না-মেনে গায়ের জোরে কেউ কিছু করতে গেলে তাকে শুনতে হয়, ‘এটা কি মগের মুলুক পেয়েছ?’

নবাব সিরাজউদ্দৌলার মন্ত্রী মীরজাফর ইংরেজের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নবাবের পতন ও মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন। তাই বিশ্বাসঘাতকের তকমা মীরজাফর। ইংল্যাণ্ডেও অনুরূপ এক বিশ্বাসঘাতকের নামে বাগধারায় এসেছে কুইসলিং (Quisling)। নবাব সরফরাজ ছিলেন বাংলা সুবার এক সুশাসক জবরদস্ত সুবেদার। কোন ইতরজনকে মাতব্বরি করতে দেখলে তাকে বিদ্রুপ শুনতে হয় সরফরাজি করছে বলে। অক্ষম অনুকরণকারী শাসককেও এই বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে। আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন, ‘রেজা খাঁ মনে করিল, সরফরাজ হইব।’ কালাপাহাড় করমানী বংশের সুলতানদের আমলের রাজু নামে এক হিন্দু যোদ্ধা। নবাবের হয়ে যুদ্ধ করে গুরুতর আহত হলে নবাবনন্দিনী সেবা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। সেই কন্যাকে বিয়ে করার জন্যে সমাজপতি ব্রাহ্মণদের কাছে অনুমতি চাইলে তাঁরা রাজুকে সমাজচ্যুত করার হুমকি দেন। রাজু তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নবাবনন্দিনীকে বিয়ে করে। তারপর সমাজচ্যুত হবার আক্রোশে হিন্দুবিদ্বেষী হয়ে পড়ে বহু হিন্দুমন্দির আর দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে, যাদের মধ্যে রয়েছে পুরীর জগন্নাথের মন্দির, কাশীর বিশ্বনাথের মন্দির। হয়তো কৃষ্ণবর্ণ আর বিশাল বপুর সুবাদেই তার কালাপাহাড় নামকরণ। হিন্দুদের মধ্যে যারা ঠাকুরদেবতার কাছে মাথা নোয়ায় না, মন্দিরে যায় না বা পূজাপার্বণে যোগদান করে না, তাদেরই লোকে বলে কালাপাহাড়।

অলস ও নিষ্কর্মা লোকজনের কোলাহলপূর্ণ আড্ডাকে লোকে বলে হরি ঘোষের গোয়াল। হরি ঘোষ অবশ্যই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তবে একজন নয়, দুজন। নদীয়ার গোপ হরি ঘোষের গোশালায় ছিল পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠী। সেখানে সমবেত বহুসংখ্যক ছাত্রের কোলাহল থেকে এই বাগধারার উৎপত্তি। মতান্তরে, কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলের হরি ঘোষের অতিথিশালায় আশ্রিত বহু নিষ্কর্মা ব্যক্তির কোলাহল থেকে বাগধারাটি এসেছে। এই হরি ঘোষের নামে কলকাতার ওই অঞ্চলে একটি রাস্তা বিদ্যমান।

পরিপার্শ্ব, পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে সহস্র বাগধারা। ডুমুরের ফুল, চুনোপুঁটি, রাঘব বোয়াল, এঁচড়ে পাকা, কলুর বলদ, পাকা ধানে মই, কলের পুতুল, কানকাটা, খোদার খাসি, পুকুর চুরি, পুঁটি মাছের প্রাণ, পাথর চাপা কপাল, মাটির মানুষ, ভূতের বেগার, ভিজে বেড়াল, ভেরেণ্ডা ভাজা, রাঞা মুলো, গণ্ডারের চামড়া, শাঁখের করাত, হাঁড়ির খবর, সোনার পাথরবাটি, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার, গভীর জলের মাছ, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো, রথদেখা কলা বেচা, বিড়াল তপস্বী, সোনায় সোহাগা, হরিহর আত্মা ইত্যাদি কত কী! উপমা উৎপ্রেক্ষা শ্লেষ রূপক হাস্যরস শব্দগুচ্ছগুলোকে এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে আর সমৃদ্ধ করেছে বাংলাভাষাকে। আমরা এগুলো ব্যবহার করি পরম্পরাগত ভাবে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো। বেশ কিছু বাগধারা আবার ছেলেভুলানো ছড়ার মতো ‘মানবমনে আপনি জন্মিয়াছে’। যেমন, তোষামুদে ব্যক্তি বোঝাতে খয়ের খাঁ, তোষামোদ করা বোঝাতে আমড়াগাছি, অকাজের কথাবার্তা বোঝাতে খেজুরে আলাপ, সব কিছু পণ্ড করা বোঝাতে ভুষ্টিনাশ করা ইত্যাদি।

এই প্রসঙ্গে দু একটি ইংরেজি বাগধারা বা idiom-এর পশ্চাদ্‌পট আলোচনা করা যাক। না বলে কয়ে অফিস ফাঁকি দেবার নাম French leave, চিরবৈরী প্রতিবেশী ফরাসি জাতিকে একটু অপদস্থ করার জন্যেই। ওই একই কারণে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ফরাসি দেশে ওই অপকর্মের ফরাসি নাম English leave। অক্টোবর-নভেম্বরের ঘিনঘিনে বৃষ্টির দিনগুলোর মধ্যে আবহাওয়া হঠাৎ রৌদ্রোজ্জ্বল হয়ে উঠলে ইংল্যাণ্ডে তা Indian summer. ইংরেজ জাতিকে John Bull নামে অভিহিত করার ধারাটা এসেছে ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত জন আরবুথনটের (John Arbuthnot) সৃষ্ট Bull নামের এক চরিত্র থেকে। পরে উইলিয়াম হোগার্থ ও আরও কয়েকজনের রচনায় Bull-কে এক জন্মস্বাধীন বীরপুঙ্গব ইংরেজের প্রতিভূ হিসেবে বর্ণিত করা হয়। আমেরিকান কার্টুনিস্ট টমাস লাস্টের কার্টুন, আর জর্জ বার্নার্ড শ-র লেখা ‘John Bull’s Other Island’-এর দৌলতে নামটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তেমনি আমেরিকানদের Uncle Sam অভিধার উৎস নিউ ইয়র্কের মাংস ব্যবসায়ী জনৈক স্যামুয়েল উইলসন। তাঁর দোকানের প্যাক-করা মাংসের প্যাকেট সেনাবাহিনীতে সরবরাহ করতেন এলবার্ট অ্যান্ডারসন নামের এক কন্‌ট্রাক্‌টার। প্যাকেটের উপর লেখা থাকত ‘E. A. – US’। এটার কী অর্থ জানতে চাওয়ায় তাঁর এক সহকর্মী মজা করে উত্তর দিয়েছিলেন Elbert Anderson and Uncle Sam, যদিও United States বোঝাতেই US লেখা হয়েছিল। খাবার না-জুটলে অনাহারে রাত্রিযাপন, যেটা বাংলায় হরিমটর চিবানো, ইংরেজিতে তা হল To dine with Duke Humphrey। অনুমান করা যায় ডিউক হ্রামফ্রে কাউকে সান্ধ্যআহারে নিমন্ত্রণ করে পানভোজনে বঞ্চিত করেন নি, তাঁর মতো হোমরাচোমড়ার সঙ্গে সান্ধ্যভোজন আকাশকুসুম ভেবেই এই বাগধারার উৎপত্তি। Hobson’s choice, যার অর্থ হল ‘no choice at all’ তার উৎসস্থল কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। হবসন সাহেবের ছিল ঘোড়া ভাড়া দেবার ব্যবসা। কেউ ঘোড়া ভাড়া নিতে এলে হবসন তাঁর আস্তাবলে বাঁধা প্রথম ঘোড়াটিকেই নিতে বাধ্য করতেন খদ্দেরকে।

গ্রন্থ সহায়তা :

১) সংসদ বাংলা অভিধান
২) Oxford Advanced Learner’s Dictionary
৩) মহাভারত — রাজশেখর বসু
৪) বাগধারা সংগ্রহ — শৈলেন চক্রবর্তী, নিউ বেঙ্গল প্রেস (২০০৪)
৫) প্রবাদের গল্প — বন্দনা গুপ্ত, পৃথ্বীশ গুপ্ত, বেস্ট বুক্‌স্‌ (১৯৯১)
৬) মহাভারতের গল্প শোনো — বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, শিশু সাহিত্য সংসদ (২০১২)
৭) English Idioms and How to use them — J. Seidl and W. McMordie, Oxford University Press (1982)

(পরবাস-৫৬, মার্চ, ২০১৪)

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত