কবিতার অতলান্ত বা অতল কবিতা
১
সাদা ঘায়ে
নুনের ছিটে শব্দগুলো
টান আর মোহে নৌকো সাজায় বাক্যের
ভাঙা, বা বদল-বাক-বিন্যাস
দিয়ে পার হতে চাওয়া কবিতা দরিয়া
শুরু-শেষের ধাপ-চাষে গঠন-বিগঠনে
নাহয় মাথাতেই থাকুক, ধরতে না পারা তার স্পন্দন আ-লুকোচুরি
লুডোয় আমার দান দেওয়া আর জরুরি নয় তেমন…
২
তাহলে কী?
একটা স্কেচ কিংবা স্কচের গা বেয়ে ওঠা শিরশিরানি
কেতনছাড়া সংকেতে
সাদা কাগজের মর্জি যতটা ফাগুন চায়, হোক রঙকেলি
করিডোরে তোড়া হেঁটে যাওয়া লক্ষী চিহ্নে
অংক ও বিজ্ঞানের সূত্র মন্ত্র যেন
আর আঁধার কাঁপানো নাদের গ্রাফ
সাদা কাগজে নিয়ম-না-মানা খেলায় স্পার্কিং, ব্লিংকিং
বাকিটা সাদা… যতটা থাকে, থাকুক…
৩
অক্ষরগুলোর ঘুমে যাদুকাঠি ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে এলাটিং বেলাটিং…
শৈল আর জাগে না, যেভাবে জাগাতে চাইছিলে
জাগলেও হয়ত চলে না
অথচ ভঙ্গুর বোঝাতে পেটির ওপরের প্রতীকটি
ভাঙার শব্দ শোনাতে থাকে…
অতএব সুতরাং কিছুই কাজ করে না যখন
যাদুকাঠি সমান্তরালে একটা ইকোয়েশন গাঁথে…
৪
পাখির স্বরে লিপি জেগে থাকে
নগর খায় দায় শোয়
কিন্তু ঘুমায় না
মল-এর গায়ে লতা জড়ানো প্লাস্টিক
কোনও সুর খুঁজে পায় না দোতারায়…
কা-কা থেকে কুহু-কুহু কিংবা রুক রুক রুক রুক কত বহু
তুমি চিহ্নে সাজাও
অলক্ষ্যে চিহ্নই লিপি হতে থাকে…
৫
চালচিত্র জুড়ে চলচ্চিত্র
তারকাভোস্কির চাঁদ মাদুর বিছায় জলে
যেন কবিতার বয়া ভেসে ভেসে
এই ছবি হলো খুব ভাবের পিপাসা ভরা…
ভাব কোথায় যে থাকে!
সোল বদলে বদলে সৌরজগৎ
কখনও বা থমকায়
তেড়ছা রেখা হয়ে বিন্দু বিন্দু পড়ে পাত্র উপচিয়ে
ভাবের শবের ওপর ইচ্ছে-রঙের রেখাগুলো সাদা কাগজে প্রাণ পেয়ে যায়…
৬
ঘুরতে এসেছেন, না খেলতে!
পান না পিপাসা
দেখুন, কুসুম সেদিনও যেমন
গ্রাস এবং আচ্ছাদন জানতো না
জানতো না পয়ার বা পাঁচ-মাত্রা
আজও বোঝে না– ঘুরতে ঘুরতে খেলা
না খেলতে খেলতে ঘোড়া-দৌর, গোল করে
তড়িৎ না তদ্বির
পুংকেশর ফুলিয়ে রাখে টানা, রেণু, বিন্দু বিন্দু…
একটা গ্রাফে আপনিও বিন্দু বিন্দু হতে থাকুন
প্যারাবোলা সূত্রটি নয়া মাত্রা পেতে পারে…
কবিতার অতলান্ত বা অতল কবিতা
এ কবিতায় — ১
এ কবিতায় আমি কোনও মাৎস-ন্যায়ের কথা বলবো না
ন্যায় কিংবা দর্শনের কথাও কিচ্ছু না
হাড়িকাঠে দু-পা সজোরে টেনে ধরেছিলাম যে কচি পাঁঠার
সে কখন শেয়াল বনে গেছে বুঝতে পারিনি…
কোনও নতুন শব্দের চাক বা বাক-বিন্যাসে চিক্যের বাণ ডাকবো না
ভাবনাটাও নতুনই হবে এমনটাও নয়
বাঁধা-মেয়েমানুষ কেমন সহজেই দেখলাম হাত পা ছড়িয়ে চিৎ
ধর্ষিত হওয়ার আগেই…
রাতের পরে দিনই আনবো হাঁটিয়ে বা ছুটিয়ে
সিঁড়ির হোঁচট সিঁড়িতেই মেলাবো সা-এ সা-এ
সিনেমা কিংবা স্পোর্স চ্যানেলে গিয়ে খুঁজবো না
হরিণ মায়ের বাচ্চা হওয়া, বা বাচ্চা বাঘের প্রথম শিকার…
জোলো বাতাসে মেঘ ভেঙে হড়পা বানে ভেসে যাওয়া কলমটি
আর পাওয়া যাবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না
এ-ও বোঝা যাবেনা হয়তো
সাদা পাতা আমার এত বর্ষাতেও কেন ফোঁটা ফোঁটা ভিজছিল না !…
এ কবিতায়—২
এ কবিতায় আমি কোনও আবর্জনায় ফোটাবো না ধুতুরা ফুল
কোনও রাজনীতি-রঙ বা প্রেম-রঙীন ছেটাবো না তাতে
মালো পাড়ার চোলাই-এ মেশাবো না গঙ্গাজল, পানার্থে
বাসনার ঝনঝন, কামনার টনটন ছাড়াই… যা একটু ইচ্ছে…
সমাজিয়ানা বা ওই গোছিয় কিছুর কব্জায় দেওয়া নয় ভাবনা
কোনও বিপ্লব ভূঁইয়া ওরফে বিদ্রোহ কেরো্সিনে কাঠিও নয়
শিল-নোড়া কাটাইয়ে হাতুড়ির সঙ্গে নামিয়ে দেবো না কলম
যৌন জানালাটা মেলে ধরতে মাইরি বলছি ভুলে যাবো
এ কবিতায় সেফ খেলবো বিপদজনক পরিসরে, নিয়ে আসবো যাদু, সম্মোহনের কণা
মেঘের কবন্ধরা যেখানে এসে গরু মোষ সিংহ হতে হতে বিদেহ
ভুত, ও তাদের রিয়েল পরিবা্রের খুনসুটিতে
সজনে গাছের ডাল ভেঙে পড়া, এবং তাতেই ‘হাইট এন্ড ডিস্টেনস্’ সূত্রটি
আঁকবো যাদুঘরে দেখে আসা কচি মমিটির দীর্ঘশ্বাসের লেখচিত্র
মায়ের কোলে শুইয়ে দেব স্নেহ
তার গর্জন তেলে আমার হাতের তেলো
কলমটাকে ফস্কে যেতে বেশ সাহায্যই করেছিল..
কলমের গান আর ঘ্রাণে অর্ধ-ভোজন
যেন বিন্দু বিন্দু ঝরে সাদা কাগজে…
এ কবিতায়—৩
এ কবিতায় আমি কোনও কীট বা কীটনাশকের কথা বলবো না
স্রিজোফ্রেনিক আপেলটির তুমুল তুলবো না ধ্বনিতে
ঘোরের ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার ফেরে বানিয়ে বানিয়ে লাটিমের লাট্টু হয়ে যাওয়া
পাশ ফিরে শুয়ে থাকা ভাস্কর্যে গেঁথে ভেঙে ফেলবো না কলমের নিব
গানেরও হয় পদ্যেরও হয় এমন দেখনাই-এ মজবো না
পালটি খেতে খেতে পাল্টাবো না জামার কাটিং
ঊষা উচ্চারণে যে আলো-তাপের উদ্ভাস মনে,
তাকে ভোর কিংবা নামু-সকাল-এ নামিয়ে আনা নয়
এ কবিতায় আমি সবুজ মাঠের পাশেই রাখবো ফলিডল
তবে কীটনাশক হিসেবে নয়, বিপদের আন্তর্জাতিক সিম্বলের মাঝখানে
গাঁয়ের টিন-এজার বালক-বালিকারা এখনও এতেই যে ভরসা রাখে
মাঝখানের ফাঁকায় শুইয়ে রাখবো কার্ণিশের চাঁদ, তৃতীয়ার
ফিল্মের ‘বই’-টাকে বাতিল করে এক-আধটা স্টিল হ্যাঙারে ঝোলাবো
‘মুখ নড়ে ফুলঝুরি ওড়ে, না-বোঝার ফেরে’-টাকে কিছু চিহ্নে সাজালে
সিনেমা ভাষা হতে থাকে পারাপারের
আলো-অন্ধকারের কষাইখানায় নীলকে সঠিক টীকায় বেশ মানায়
খড়ম-ভরত রামের জন্য কাঁদতে থাকুক উত্তরে
কপি-রাম দোস্তি দক্ষিণে রাখুক কঠিন থাবা রাবনে
আলটিমেট অশোক-সীতার ভেজা আঁচলে…
এ কবিতায়–৪
এ কবিতায় আমি শব্দের পর মৌরসি শব্দ-পাট্টায় পান ঝালবো না
টুকরো, ভাঙা বা গোটা বাক্যের মোহে গুটি পায়ে হাঁটাবো না শব্দের সং
কেন্দ্র কিংবা কেন্দ্রহীনতায় ভুগে, দিকে আর বিপরীতে ছোটাবো না খুটবাঁধা গরুটিকে
ভাবখানার সলাজ কিংবা আড়াল সরাবো না একটু একটু তুলে…
ধান নিয়ে সর্গে যাবো, ভুলে যাবো ঢেঁকিটি আনতে
ডুবে থাকা হাঙরের শ্বাস-বুদবুদ আঁকার ছল শুধু, আঁকতে না পেরে
ট্রেন লাইনের ক্রসিং-পয়েন্টে কোনও ঝান্ডাই শেষাবধি সংঘাত এড়ায় না
গারদের দু-পারে সমান, একে অপরকে যে পাগলই বলে
এ কবিতায় আমি মাথাকে মধ্যমা করব ত্রিভুজের
চকিতগুলোর মিলন-বিন্দুকে বিন্দু করে রাখবো ছক-কাগজের কার্পেটে
আলোবিন্দু হতে চাইলে চোখের মণি মেশাবো তাতে, যেন অর্কিডে রশ্মি এসে পড়লো
কত-যে-দেখেছি-চোখ-এর আলো রাখবো ছবির প্রতিবিম্বে
কতই-না-শুনলাম-কান ড্রাম-বিউগল-স্যাক্সোর কম্পাংকে তরঙ্গ প্রকাশ
চামড়া-স্পর্শি ব্যাপারটার থ্রিল পানকৌড়ি ডুবে ভেসে ওঠায় ডিকোড হবে…
পিচকিরি ভর্তি শব্দের বদলে রঙ, মণি-রশ্মির আলোয়, কর্ণ-মলের বদলে ধ্বনিপ্রাস
আর স্পর্শকাতর হার্ট-বিট বসাতে থাকবো, হোক না ছেঁড়া পাতাতেই…
এ কবিতায়—৫
এ কবিতায় এমন কোনও দশায় মাতাবো না নিজেকে
যেখানে একটিও ট্রাম-কার্ড নেই আমার কলমে
একবার ফেলে দিলে ইরেজারে মোছে না প্রসবের দাগ
কুয়াশা ও কুহকের যমজেপনায় মেশাবো না আলো অন্ধকার
নাভি ফুসলে ফুসলে জংঘার কাছে নিয়ে যাওয়া প্রেম-এ
কী ই বা এসে যায় কবিতার!
এ কবিতায় আমি বিবাহে বিবাহে ভরে দেবো ছবিকুঞ্জের শব্দভ্রমর
চিহ্নকে সাজাবো বরসাজে, সংকেত নিদবর
কাটখোট্টা অংক-সূত্রের মাথায় পড়াবো কনের মুকুট
পরপরই বিজ্ঞানের কোনও সংজ্ঞায় সংজ্ঞা ফেরাবো চেতনার
দু-একটি শব্দ থাক অনুনাদে ধরা, কাঁপা পেনসিলে
স্বরের লিপি শুধু মেধা নয় কাগজে ছোঁয়াবে সমান আহ্লাদ
ধারাপাত নিজেই নিজেকে আঁকে তেরছা রোদে
গাঢ় হয়ে আসা শ্যাডো যেন রামধনু হৃদয়ের
সব মাধ্যম নিয়ে বেড়ানোর খুশি চৌকির দশদিকে
জল-বিভাজিকা থেকে আগ্নেয়গিরির উদ্গার, এবারে ভিজতে ভিজতে পুড়তে হবে…