ভূতুড়ে ভ্রমণ: চল যাই ভূত শহরে । সংগ্রামী লাহিড়ী

Reading Time: 3 minutes

উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের আরেক নাম গোল্ডেন স্টেট। এ দেশে এসে আমার প্রথম আস্তানা ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়।  প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে লস এঞ্জেলেস কাউন্টিতে ঢেউ খেলিয়ে বিছিয়ে থাকে ছোট ছোট, উঁচুনিচু পাহাড়। বৃষ্টির অভাবে জ্বলে যাওয়া হলুদ ঘাসে ঢাকা। তার ওপর যখন অস্তগামী সূর্যের আভা এসে পড়ে, সোনা রং হেসে ওঠে। মনে হয় গোল্ডেন স্টেট নামটি সত্যিই সার্থক।

সে কথা শুনে একদিন আমার সহকর্মী স্যান্ডি হাসল, “ওয়েল, গোল্ডেন স্টেটের ইতিহাস জানা আছে নিশ্চয়ই? সোনা রঙের ঘাসের জন্যে এ নাম হয়নি কিন্তু।”

কথা হচ্ছিল নেসলি কোম্পানির ক্যাফেটেরিয়াতে। উত্তম কফি, সঙ্গে হরেক রকম স্পেশালিটি চকলেটের সম্ভার, যা একমাত্র সেখানেই পাওয়া যায়, রসনার তৃপ্তিসাধনে সদাই হাজির।

ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাস একেবারে অজানা নয়। সোনার খোঁজে ইঁদুর-দৌড়, গোল্ড রাশএর কাহিনিও জানা। তবে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে স্যান্ডির কাছে খানিক গল্প শোনার ইচ্ছে হল।

জিজ্ঞেস করলাম, “সেই উনিশশো সালের প্রথম দিকে, দলে দলে মানুষ এসেছিল সোনা খুঁজতে, তাই না? তাই তো এমন নাম, গোল্ডেন স্টেট।”       

“তার অনেক আগে।” স্যান্ডি আমায় শুধরে দেয়। “আঠেরোশো সালের মাঝামাঝি এক জানুয়ারির সকালে জেমস মার্শাল এলেন একটা করাতকল বসাবার জন্যে রুটিন ইন্সপেকশন করতে। জায়গাটা ধুলোয় ভর্তি। একটু ধুয়ে দেওয়ার জন্যে খালের জল বইয়ে দিলেন সেখান দিয়ে।”

“তারপর?” গল্পের গন্ধ পেয়েছি আমি। 

“পরদিন সকালে দেখলেন আলগা নুড়িপাথরের খাঁজে রোদের আলোয় চিকচিক করছে উজ্জ্বল হলদে রঙ! সোনা! ব্যাস, সেই শুরু হল পাগলামি, ‘গোল্ড রাশ’।”

“পাগলামি কেন বলছ? সোনা তো ছিল। অঢেলই ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার নদীর জলে নুড়িপাথরেই সোনা মিলত। সে সোনা বার করে নেওয়াও শক্ত ছিল না।” আমি বলি।

“সোনার খোঁজে এত মানুষ ভিড় করল যে ক্যালিফোর্নিয়ায় জনসংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেল। এত মানুষ থাকবে কোথায়? তাই ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠল বসতি।”  

“এই করেই তো এ রাজ্যের শহরগুলোর পত্তন হল, তাই নয় কি?” সুচিন্তিত অভিমত আমার।

“উঁহু, সবই কি আর টিঁকে থাকতে পেরেছে? কত বসতি, বাড়িঘর ফেলে রেখেই মানুষ চলে গেল অন্য জায়গায়। পোড়োবাড়ি হয়ে গেল সেগুলো। ভুতুড়ে শহর, গোস্ট টাউন। চোখের নিমেষে গজিয়ে উঠল জনপদ, আবার চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই মানুষজন হাওয়া। এমন গোস্ট টাউন তুমি ক্যালিফোর্নিয়ায় অনেক পাবে।”

স্যান্ডি উঠে পড়ে কফির দাম মিটিয়ে দিল। আমার ক্ষীণ আপত্তিকে পাত্তাই দিল না। বরং বলল, “সামনেই তো হ্যালোউইন, যাও না, দেখে এস একটা ভুতুড়ে শহর। ট্যুরিস্টরা খুব পছন্দ করে Rhyolite (রায়োলাইট) গোস্ট টাউন। বেশি দূর নয়, এই তো পাশের নেভাডা রাজ্যের বর্ডারে।”

পুত্র তখন সদ্য কিশোর। শুনেই লাফিয়ে উঠল, “ভূত দেখা যাবে?”

দেখাই যাক। তেনাদের দয়া হলে ভাগ্য খুলতেও তো পারে!

Rhyolite শহরের পত্তন হয়েছিল গোল্ড রাশ যুগের শেষের দিকে, মরুভূমির মাঝমধ্যিখানে। মোহাভো ডেজার্ট ক্যালিফোর্নিয়ার পুব দিকে নেভাডা রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আছে। উনিশশো পাঁচ সালে লাস ভেগাসের কাছেই এসে হাজির হলেন ফ্র্যাঙ্ক “শর্টি”হ্যারিস আর আর্নেস্ট “এড”ক্রস। এসে দেখলেন, পুরো অঞ্চলটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সবুজ পাথর, তার ওপর হলুদ রঙের ধাতু। সোনা ছাড়া আর কী? ব্যাস, ঝটপট দুটো তাঁবু ফেলে আস্তানা গড়লেন শর্টি আর এড। পাথর থেকে বেরোল মূল্যবান সব খনিজ আর অবশ্যই সোনা। খবর ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মত। রাতারাতি গজিয়ে উঠল শহর। ছয় মাসের মধ্যেই Rhyolite শহরে পাঁচহাজার লোক। যেখানে সেখানে বাড়ি তৈরি হচ্ছে, দোতলা, তিনতলা। পাল্লা দিয়ে খুলছে ব্যাংক, পোস্ট অফিস, জেনারেল স্টোর, জুয়া খেলার ক্যাসিনো।

মোহাভো মরুভূমিতে প্রচন্ড গরম। গ্রীষ্মে পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে চলে যায়। ঝলসে যায় চারদিক। কষ্ট উপেক্ষা করেও মানুষ আসে, থাকে। হলদে ধাতুটির এমনই টান।

পত্তনের পর তিন বছরের মধ্যেই খোঁড়াখুঁড়ি করে এক মিলিয়ন ডলার পকেটে এল।  কিন্তু প্রকৃতির ভান্ডার তো অফুরন্ত নয়, শিগগিরই মাটির খনিজ পদার্থ ফুরিয়ে গেল, সোনাও শেষ। মানুষ কোন দুঃখে আর থাকবে? যেমন রাতারাতি এসে ভিড় করেছিল, তেমনি দলে দলে শহর ছেড়ে চলেও গেল। পড়ে রইল পরিত্যক্ত বাড়িঘর, ক্যাসিনো, ট্রেনের স্টেশন, স্কুল, চার্চ। সেই ভূতুড়ে শহর দেখতেই লস এঞ্জেলেস থেকে সাত ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে আসা।

মাইলের পর মাইল জনহীন, ফাঁকা রাস্তা। দিগন্তে গিয়ে মেশে রুক্ষ, পাথুরে মাটি। শহরে ঢুকেই চোখে পড়ল ভূতেদের নবরত্ন সভা। ন’টি সাদা কাপড় পরা ভূত পাশাপাশি। দেখে বিমলানন্দ লাভ হল। ভূতের সঙ্গে ছবি তোলার বাসনায় কাছে গেলাম।  ওমা  এ কী? এ তো শুধুই সাদা কাপড়, হাওয়ায় উড়ছে। ভেতরে তো কেউ নেই? পুত্র বিজ্ঞের মত জানাল, “তেনারা তো অদৃশ্যই থাকেন!”

জানা গেল, অদৃশ্য নবরত্ন ভূতের জন্মদাতা এক বেলজিয়ান।  ফাইবারগ্লাস দিয়ে Albert Szukalski এদের  তৈরি করেন ‘দ্য লাস্ট সাপার’এর আদলে। এটি একটি মিউজিয়াম, খোলা আকাশের নিচে।

খানিক দূরে যেতেই কুড়ি ফুট উঁচু এক মানুষের মূর্তি, লোহা দিয়ে তৈরি। সে লোহায় জং ধরে বেশ একটা অতিপ্রাকৃত ব্যাপার তৈরি হয়েছে।  

আরেক ভূত আবার সাইক্লিস্ট। সামনে নিজের বাইসাইকেলটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবটা এমন, এক্ষুনি চড়ে শহরে একটা রাউন্ড দেবেন। তাঁর সামনেও ছবি তোলা হল। ভূতুড়ে বাইসাইকেল কি বাদ দেওয়া যায়?

শেষ দ্রষ্টব্য ‘বোতল বাড়ি’।  

‘বটল হাউস’ নাকি Rhyolite শহরের অন্যতম আকর্ষণ ছিল। হুইস্কি, বিয়ার আর ওষুধের বোতল দিয়ে বানানো বাড়ি। কত হাজার বোতল যে লেগেছে সে বাড়ি বানাতে, সে হিসেব আমি রাখিনে। দেখে চক্ষু সার্থক করে রওনা হলাম লাস ভেগাসের দিকে। সারা পৃথিবীর আনন্দ আর বিনোদনের রাজধানী।

তেনারাও আমাদের সঙ্গেই চললেন বোধহয়। বিনোদন তো সবারই দরকার – তাই না?  

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>