| 25 এপ্রিল 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া সাহিত্য

গুন্টার গ্রাসের ডগইয়ার্স: যে সময় কুকুরের মতো উম্মাদ

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

“তুমি বলো। না, তুমি। ন… না- তুমি। তার চে’ বরং অভিনেতাই শুরু করুক। কাকতাড়–য়ারাও শুরু করতে পারে বৈকি! নাকি কুম্ভের রাশিতে অষ্টগ্রহ মিলিত হওয়ার লগ্ন পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করে যাব? থাক, তুমিই বলো। হাজার হোক, তুমিই ছিলে কুত্তাটার মালিক। কিন্তু, আমার কুকুর হওয়ার আগে সে ছিল তোমার কুকুর- অন্য কোন কুকুরের উত্তরসুরি। সুতরাং আমাদের মধ্য হতেই যে কোন একজনকে শুরু করতে হবে: তুমি বা সে বা তুমি বা আমি। অনেক অনেক সূর্যাস্তের আগে, যখন আমরা ছিলাম না তারও বহুদিন আগে, আমাদের প্রতিসরিত না করেই ভিশ্চুলা প্রবাহিত হতো।”….

এভাবেই শুরু হয় সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিমান কথাশিল্পী গুন্টার গ্রাসের ‘হুনড়ে ইয়ারে’ বা ডগ ইয়ার্স,- এক ক্রুদ্ধ অথচ মহাকাব্যিক উপন্যাসের বয়ান। যে সময় খ্যাপা কুকুরের মতো উন্মত্ত ও বিষাক্ত, যে সময় নাজিবাদী স্পর্ধা ও তারও’পরে ধনতান্ত্রিক লালসার চরম বিন্দুতে বিকশিত, গুন্টার গ্রাস আমাদের সেই সময়ের কাহিনী শোনান। আর তাই এ উপন্যাসে মানুষের পাশাপাশি, অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রস্তুত করা হয়েছে কুকুর এবং কুকুরদের বংশ লতিকা, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য অথবা জাতির ‘volkgeist’ (জাতিসত্তা) বিধৃত হয়েছে কাকতাড়–য়ার অপরূপ ইমেজে। ‘দ্য টিন ড্রাম’ এবং ‘ক্যাট এন্ড মাউসে’-র পর `ডগ ইয়ার্স’ তাঁর ডানৎসিখ ট্রিলজির সর্বশেষ সংযোজন (১৯৬৩)। যদিও এ তিনটি উপন্যাসের প্রত্যেকটিই স্বয়ম্ভু এবং পরস্পর ঘটনা-সম্পর্ক রহিত; তবু যেহেতু তিনটি উপন্যাসেরই পটভূমি জার্মান-পোলিশ সীমান্ত শহর ডানৎসিখ (বর্তমানে পোলিশ শহর গদানস্ক) এবং কাহিনী ও আঙ্গিকের তফাৎ সত্ত্বেও উপন্যাস ত্রয়ীর মূলসূর বেজে ওঠে একই দ্যোতনায়-সেহেতু, সমালোচকরা এদের ট্রিলজি হিসেবে দেখতেই ভালবাসেন। গ্রাসের নিজের ভাষা, “ডগ ইয়ার্স হলো তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানির উপর পেশকৃত এক রিপোর্ট।“

 কিন্তু আমরা পাঠকরা, যারাই এ উপন্যাসটি পড়ব, তাঁদের কাছে বইটিকে মনে হবে গোটা জার্মান জাতির জীবন্ত ইতিহাস, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অনুষঙ্গে সমগ্র মানব জাতির নৈতিক মূল্যবোধের পতনের এক দলিল যা পুঁজি  ও ব্যক্তি সুখের বেদীতে বিসর্জন দেয় ইতিহাস চেতনা ও শিক্ষার সারাৎসার, নির্বিকারচিত্তে ভুলতে শেখায় যুদ্ধাপরাধীদের পাপ। এ উপন্যাস, তাই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য এক অবশ্য পাঠ্য গ্রন্থ। এ উপন্যাসে বিধৃত ইহুদী- জার্মানের বিচিত্র সম্পর্কের আখ্যান পাঠ করতে যেয়ে তাই বারবার মনে পড়েছে স্বদেশের  তথা উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কথা: ঘৃণা, ভালবাসা, অনুকম্পা, উপেক্ষা, ক্রোধ এবং কখনো কখনো নপুংসকত্বের বারিধারায় যে আশ্চর্য বৃক্ষ সিঞ্চিত। অথবা, যুদ্ধোত্তর পশ্চিম জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে পরিচালিত “LEARNING OF THE FORGET FULNESS” (বিস্মরণের শিক্ষা) কি কাকতালীয় উপায়েই না মিলে যায় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মহতী ইতিহাসকে বিস্মৃত করার অপপ্রয়াসের সঙ্গে !

মোট তিনটি অধ্যায়ে এ উপন্যাসখানা বিন্যস্ত: মর্নিং শিফটস বা প্রভাতী আসর, লাভ লেটার্স বা প্রেমপত্র এবং ম্যাটেরেনিয়ার্ডস। উপন্যাসের নায়কও তিনজন। ওয়ান্টার ম্যাটার্ন (জাতিসত্তায় ষোল আনা আর্য জার্মান, স্বভাবে গোঁয়ার-গোবিন্দ ও প্রতিভাহীন, পূর্ব-পুরুষ ডাকাত, আকৃতি-আয়তনে Ôatheletic’ পিতামহীর কাছ হতে বংশগতির ধারায় প্রাপ্ত অভ্যাস সর্বক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করা, উপন্যাসে যে কারণে তার উপাধি ‘ম্যাটার্ন দি গ্রিন্ডার)। এডি আমসেল (অর্থ ইহুদী, সঙ্গীত ও কল্পনা শক্তির দাক্ষিণ্যের আশ্চর্য প্রথিভাধর, ব্যবসায়ী বুদ্ধিও কম নয়, হাস্যকর রকমের মোটা)। এবং হ্যারী লেবেনিউ খুব সম্ভবতঃ লেখকের নিজের চেহারা ও চরিত্রে বিন্যস্ত যার মাতৃধারা কোশনেভীয় হওয়ার দরুন দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুট পাঁচের বেশি নয়। কৈশোরে নাৎসী বাহিনীর সৈন্য হিসাবে জীবনযাপন, পরবর্তী সময়ে জার্মানির অঞ্চল ও গোত্র উপগোত্রসমূহের ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক ও খসড়কারী, মামাতো বোন তুলার অন্ধ প্রেমিক। পুরো উপন্যাসটির কাঠামোই যেন এক জটিল গোলক ধাঁধা। কাহিনী ও চরিত্রসমূহকে সম্যক বুঝতে হলে ক্লক ওয়াইজ এবং এ্যান্টি ক্লক-ওয়াইজ দু ভাবেই পড়তে হবে। চরিত্রসমূহের আচরণ স্পষ্ট হয়েও দুর্বোধ্য, প্রায়ই তারা পোশাকের মতো বদল করছে নাম-পেশা-পরিচয়। মাঝে মাঝে বুঝতে কষ্ট হয় কে আসলে কি। যেমন, বইটির প্রথম পর্ব MORNING SHIFTS শুরু হচ্ছে ব্রাক্সেল নামের এক লেখকের কথনে। যে লেখক হলেও একটি কারখানা চালায়, যদিও সে কারখানা লোহা, কয়লা বা পটাশ কিছুই উত্তোলন করে না। ভিশ্চুলার র-দ্বীপে, শিওয়েনহর্ষ্ট ও নিকলসওয়াল্ডি গ্রামের মর্ধবর্তী স্থানে ব্রাক্সেল বাস করে এবং ঐ এলাকার বাসিন্দাদের জীবন, বাসিন্দাদের পূর্ব পুরুষদের জীবন সম্বন্ধে গবেষণা করে। সে জন্য সে জেলা-লাইব্রেরীর শরণাপন্নও হয়। ভিশ্চুলা নদীর প্রবাহ-পথ, তার তীরে বসবাসরত প্যাগান জার্মানদের দেবদেবীমুর্তি (পেকলস, পারকুনোস, পরতিম্পস…) কিভাবে ধ্বংস হলো খ্রীষ্টান নাইটদের তরবারির আঘাতে, বার শতকে ফ্রেডারিখ দি গ্রেটের ধর্মযুদ্ধ এবং হালের দুই গ্রাম্য বালক এডি আমসেল এবং ওয়াল্টার ম্যাটার্নের বন্ধুত্ব সবই তাঁর লেখার বিষয়। বিশেষত এডি ও ম্যাটার্নের চরিত্র, পারিবারিক ইতিহাস কিংবা ছুরি দিয়ে হাত কেটে, রক্তে রক্ত মিশিয়ে তাদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া (যদিও সেই ছুরিটি ম্যাটার্ন এক সূর্যাস্তে ভিশ্চুলার বুকে নিক্ষেপ করে জোলাক বা পাথরের গুলতির অভাবে-কিংবা, ইহুদীর রক্ত হঠাৎ উত্তেজনায় শরীরে প্রবিষ্ট করিয়ে ওয়াল্টার অনুতাপ-বিদ্ধ হয়েছিলো) ব্রাক্সেলের গভীর পর্যবেক্ষনের বিষয়। অথচ, উপন্যাসের একদম শেষে পৌঁছেই শুধু আমরা জানতে পারব যে, এডিই হলো ব্রাক্সেল।

এডির পিতা আলবার্ট ছিল এক ধনাঢ্য ইহুদী পরিবারের সন্তান। কিন্তু জার্মান রাষ্ট্রে ইহুদীর কোন ভবিষ্যৎ নেই বলে মাত্র ষোল বছর বয়সে সে পরিবার ও নিজস্ব পরিমগুল ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য এক প্রদেশের নিকলসওয়ন্ডি গ্রামে বসতি স্থাপন করে। এক খ্রীষ্টান মহিলাকে বিয়ে করে এবং নিজেও সে নিষ্ঠাবান প্রোটেষ্টান্ট। অগাধ ধন সম্পত্তির মালিক সে তাই গ্রামের বিশিষ্ট, বয়স্ক ব্যক্তিরা জোর দিয়ে বলে, “সে নিশ্চয় ইহুদী নয়।” কিন্তু গ্রামের বাচ্চারা কেউ এডির সাথে খেলে না এবং প্রায়ই তাকে SHEENY (ইদ্দিস শব্দ -এর বিকৃতি রূপ: প্রকৃত অর্থে পবিত্র, শান্ত বা জ্ঞানী বোঝালেও পরবর্তী সময়ে গালি হিসাবে ব্যবহৃত) বলে গাল দেয়। থলথলে মোটা এডিকে রক্ষা করার জন্য ওয়ান্টার একাই আর সব বাচ্চাদের সাথে মারামারি করে, কিন্তু প্রতিভাবান বন্ধুর প্রতি একাধারে মুগ্ধ ও ঈর্ষাগ্রস্ত ম্যাটার্নও মাঝে মাঝে এডিকে  SHEENY বলে।

১৯০৬ সাল থেকে এডির পিতা অটো উইনিঙ্গার নামের এক লেখকের   ‘Sex and Character’ গ্রন্থটি পাঠ করেন এবং লুকিয়ে রাখেন। বইটিতে বলা হয়েছিল:

“ইহুদী আর নারীর মাঝে কোন তফাৎ নেই। .. ইহুদী জানে শুধু ব্যবসা। ক্রীড়া বা সঙ্গীতের মতো সুকুমার বৃত্তির সাথে তার পরিচয় নেই।” আলবার্ট তৎক্ষনাৎ গ্রামে একটি জিমন্যাস্টিকস ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন ও ছেলেকে গির্জার কোরাস দলে ভর্তি করান। এর অল্প ক’দিন পরই তার মৃত্যু হয়। এডির শিল্পবোধের সেই শুরু। তবে তার প্রধান নেশা হলো কাকতাড়–য়া তৈরি করা। কারণ, কাকতাড়ুয়ার মাঝে সে মানুষের বা মানুষের মাঝে সে কাকতাড়ুয়ার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। (বস্তুতঃ কাকতাড়ুয়ার এই প্রতীকের মাঝে গুন্টার গ্রাস যা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছেন, তাহলে আসলে আমরা প্রতিটি মানুষই কি কাকতাড়ুয়ার মতো অভিব্যক্তিসম্পন্ন অথচ নিছক খড়িমাটি সম্বল অস্তিত্ব নেই? যে ব্যক্তি যত বেশি গর্বিত সে তত বড় কাকতাড়ুয়া। জাতিসত্তার ক্ষেত্রেও এই স্বতন্ত্র ইমেজটি খাটে। এক/একটি স্বতন্ত্র জাতিকে এক/একটি নির্দিষ্ট কাকতাড়ুয়ার ইমেজে চেনা যায়। হিটলার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ও জার্মান জাতি শ্রেষ্ঠ জাতি-কাকতাড়ুয়া)। এডি তাই তার চেনা-অচেনা হাজারো চরিত্রের আদলে কাকতাড়–য়া বানায় যাদের মধ্যে প্রাণের বন্ধু ওয়াল্টারের বধির পিতা এ্যান্টন মিলার ম্যাটার্ন (যে উইপোকার গুঞ্জন শুনে রবিশস্যের ফলন থেকে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধেও ভবিষ্যদ্বাণা করতে পারে) হতে স্কুলের শিক্ষক কেউই বাদ পড়ে না। প্রথমদিকে গ্রামের চাষীরা তাদের জমির নিরাপত্তার কথা ভেবে কাকতাড়ুয়াগুলো কিনতো। কিন্তু, যতই দিন যায় গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ্য করে কাকতাড়ুয়ার মধ্যে আত্ম প্রতিকৃতি। গ্রামবাসীর ক্রোধ হতে ছেলেকে বাঁচাতে এডির বিধবা মা তাকে শহরে পড়তে পাঠান। ওয়াল্টারও এডির সাথে এলসেন্ট্রাসি শহরে যায়। সেখানে তাদের শিক্ষক ও বোডিং ইন্সপেক্টর হলেন আধা-পাগলা, ভবঘুরে এক প্রফেসর ডঃ অসওয়াল্ড ব্রুনিস/মাইকা, নীস প্রভৃতি শিলার জগতে যার বিচরণ। এহেন ডঃ ব্রুনিস এক মধ্যরাতে বোডিংয়ের পাশে কবরখানার মাঠে জিপসীদের কাছ হতে একটি কন্যা শিশু দত্তক নেন ও তার নাম রাখেন জেনি। আর এ ঘটনার সাক্ষী থাকে শুধু দুই বন্ধু।

দ্বিতীয় পর্বের ঘটনাচক্র পুরোটাই বর্ণিত হয়েছে মামাতো বোন তুলার কাছে লেখা হ্যারী লেবেনিউয়ের প্রেমপত্র দিয়ে, যা তুলা কোনদিন পড়বে না। এ প্রেমপত্রগুলোর সাহায্যেই জানা যায় হ্যারীর শৈশব-কৈশোরের নানা ঘটনা, কিশোর হ্যারীর চোখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নাজীদের উত্থান, ডঃ ব্রুনিস ও জেনি এবং তাদের মাধ্যমে এডি আর ওয়াল্টারের সাথে হ্যারীর পরিচয় এবং অবশ্যই কুকুরের বংশ লতিকা!!

“পারকুন নামে এক কুকুর ছিল, যার মালিক ছিল জনৈক লিথুয়ানিয়ান সেই লিথুয়ানিয়ান ভিশ্চুলার দ্বীপে নিকলসওয়াল্ডি গ্রামে এক হাওয়া কলের মালিকের অধীনে কাজ নেয় (ম্যাটার্নদের পরিবারের আয়ের উৎস হাওয়া কল) পারকুন মিলিত হয় মাদী নেকড়ে সেন্টার সাথে অদ্ভুত এই মিলনে জন্ম নেয় কুকুরনেকড়ে হ্যারাস এলসেন্ট্রাসি শিহরের এক কাঠমিস্ত্রি একদা নিকলসওয়ল্ডি গ্রামে যেয়ে সেই হাওয়া কল মালিকের কাছ থেকে হ্যারাসকে ক্রয় করেন ১৯৩৩ সালে পৌর কর্তৃপক্ষ হ্যারাসকে নিয়ে যায় উন্নত কুকুর প্রজনন কেন্দ্রে উদ্দেশ্য, ফুয়েরারকে ভাল কুকুর উপহার দেয়া শহরেরই জনৈক হের লিবএর পোষা কুকুরী মেকলার সাথে মিলিত হয়ে হ্যারাস জন্ম দিল প্রিঞ্জ নামের এক অতিকায় বলিষ্ঠ কালো কুকুর।”

কিছুদিন পরই খবর এল, সারা জার্মানি থেকে বিশেষ প্রচেষ্টায় উৎপাদিত সেরা দশটি কুকুরের মধ্য থেকে ফুয়েরার প্রিঞ্জকেই পছন্দ করেছেন। সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথেই হ্যারীর বাবার ছোট্ট ছুতারখানা ভরে গেল সাংবাদিকে। মেয়র থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ‘এস এস’ বাহিনীর কমান্ডার কেউ বাদ পেলেন না। কিছুদিন পর, ওয়াল্টারকে সাথে নিয়ে এডিও উপস্থিত হলো হ্যারীদের কারখানায় প্রিঞ্জ-পিতা হ্যারাসের ছবি আঁকতে। ততদিনে অবশ্য তাদের গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত হয়েছে এবং তারা হ্যারীদের প্রতিবেশী ডঃ ব্রুনিসের বাসার পাশেই একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ওয়াল্টারের কমিউনিষ্ট মনোভাব এ সময় থেকেই ধরা পড়ে। যে নাট্যগোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিলা সে, তার দেয়ালে সে সাঁটত কমিউনিষ্ট ইস্তেহার। এতএব গ্রেফতার এবং প্রাণ বাঁচাতে এসএস দলে যোগদান।

পুরো উপন্যাস জুড়েই এই এক রহস্যঃ আসলে ওয়াল্টার কি ছিল? কমিউনিষ্ট না ফ্যাসিষ্ট, ইহুদীপ্রেমী না ইহুদীবিদ্বেষী?

গ্রাস যেন ইচ্ছা করেই এ রহস্যের কোন সমাধান করেননি।

যা হোক, ১৯৩৩ এর দু’বছর পর, ‘৩৯ এর এক ভয়ানক তুষার ঝড়ের রাতে নয়জন মুখোশধারী SS ম্যান এডিকে তার বাড়ির বাগানে যথাসম্ভব মারধোর করে এবং সেই প্রহারে তার বত্রিশটা দাঁতই খুলে যায়। রক্তাক্ত মুখ, অচেতন এডি ভোররাতে শহর ছেড়ে চলে যায়। পুরো ঘটনার একমাত্র সাক্ষী থাকে দ্বাদশ বর্ষীয় বালক হ্যারী লেবেনিউ। একই রাতে, বনের ভেতর এক ভাঙ্গা কেল্লায় সারারাত বরফ চাপা পড়ে ড: ব্রুনিসের দত্তকন্যা জেনির আজন্ম স্থলত্ব সেরে যায় (সন্দেহ নেই, গ্রাস এখানে সচেতনভাবেই কৌতুক বা হিউমারের সাথে যুক্ত করেছেন ফ্যান্টাসি, যাতে করে উপন্যাসের শিল্পমান সমৃদ্ধতর হয়) এবং সে ব্যালে ক্লাসে আগের চেয়ে অনেক ভাল করতে থাকে। কিন্তু, এর কিছুদিন পরেই খুব তুচ্ছ কারণে ডঃ ব্রুনিসকে বন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। শিবির থেকে তার মৃত্যু সংবাদও আসে। ১৯৪২ এ ব্যালে ক্লাসের এক পিয়ানো শিক্ষক বার্লিনের এক যুবক শিল্প সমঝদারের উদ্যোগে ত্রয়োদশী জেনিকে বার্লিনে নিয়ে যায়। সে যুবকের সব ক’টি দাঁতই সোনায় মোড়ানো।

এলো ১৯৪৪। থার্ড রাইখ পতনের চুড়ায়। সতের বছরের কিশোর হ্যারী লেবেনিউ পূর্ব ফ্রন্টে,  ইতালিতে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। তাকে বিদায় জানাতে এসেছে বাল্যসঙ্গিনী মামাতো বোন তুলা, যে কিনা সেনাবাহিনীর একজন নিয়মিত পতিতা এবং এই ষোল বছর বয়সেই তার একবার গর্ভপাত হয়েছে।

১৯৪৫ এর ৩০ এপ্রিল। সোভিয়েত বাহিনী উপর্যুপরি গোলাবর্ষণ করছে বার্লিনের হেডকোয়ার্টারে। হিটলারের প্রিয় কুকুর প্রিঞ্জ অব্যাহত বোমার শব্দে টিকতে না পেরে সবার অলক্ষ্যে এক সময় মনিবের কেল্লা ছেড়ে হাঁটতে থাকে নতুন মনিবের খোঁজে।

অক্ষশক্তির পতন হয়েছে। জার্মানি বিভক্ত। হিটলারের কুকুর পূর্ব বার্লিন ছেড়ে পশ্চি জার্মানিতে আসে (পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পশ্চিম জার্মানি-ই যে হিটলারের রাজনৈতিক আদর্শিক উত্তরসুরিদের যোগ্য স্থান- গ্রাস সে কথাটি এভাবেই জীবন্ত করে তোলেন)। এবং এক জনাকীর্ণ রেষ্টেশনে কেন জানি ওয়াল্টারের পা-ই সে জড়িয়ে ধরে। ওয়াল্টার তার নতুন নাম রাখে প্লুটো।

দ্বিতীয় পর্ব ‘লাভ লেটার্স’ এভাবেই শেষ হয়। তৃতীয় অধ্যায় ‘ম্যাটেরিনিয়ার্ডসে’র শুরুতেই দেখা যায়, যুদ্ধ শেষে ওয়াল্টার তার পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। খোঁজার এক পর্যায়ে সে তার নাৎসী জীবনের বন্ধু জোশেন সওয়াতস্কির বাসায় উপস্থিত হয়। জোশেনকে সে অভিযুক্ত করে এডিকে প্রহারের জন্য। জোশেন তাকে পুরনো কথা ভুলে যেতে বলে, তার ঘরেই তাকে আশ্রয় দেয় এবং এমনকি রাতে, শিয্যায়, স্ত্রী ইঙ্গেকেও সে ম্যাটার্নের সাথে ভাগ করে নেয়। ইঙ্গের গর্ভে ম্যাটার্নের একটি মেয়ে হয়, পিতৃ-নামের আদ্যাক্ষর বহন করে, যার নাম ওয়াল্লি। তবে জোশেন ওয়াল্লিকে খুব আদর করে বলে ম্যাটার্নকে পিতৃত্বের দাবি থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করে। ওয়াল্লির পদবী হলো সওয়াত্স্কি।

এই ওয়াল্লির বয়স দশ, তখন `ব্রাস্কেল এন্ড কোঃ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাজারে এক ধরনের ম্যাজিক গ্লাস ছাড়ে। এই ম্যাজিক গ্লাসে চোখ রাখলেই দশ হাতে একুশ বছর বয়সী যে কোন ছেলে-মেয়ে তাদের বাবা-মা-অভিভাবকদের যাবতীয় অতীত পাপের ছবি স্পষ্ট দেখতে পায়। বালিকা ওয়াল্লি এমনি একটি যাদুর কাঁচ কিনে ফেলে এবং কাঁচে চোখ দিয়েই আঁতকে ওঠে। সে দ্যাখে, ওয়ান্টার মামা ও তার বাবা আরও সাতটা লোকের সাথে মিলে একটা মোটা লোককে বেধড়ক মারছে। বরফের উপর ছিটকে পড়ল এক এক করে বত্রিশটা দাঁত… ওয়াল্লিকে হাসপাতালে নিতে হলো। ওয়াল্লির মতো একই অবস্থা হলো আরও হাজার হাজার জার্মান ছেলেমেয়েদের। তখন রাষ্ট্র মঞ্চে নামলো। নিষিদ্ধ করা হলো ম্যাজিক গ্লাসের উৎপাদন। তৈরি হলো নতুন শিক্ষাযন্ত্রঃ বিস্মরণের শিক্ষা (LEARNING OF FORGETEFULNESS) -এর প্রতিপাদ্য হলোঃ (Forget! Learn to forget, Forgetfulness is natural. The mind should be occupied by pleasant memories and not by nasty tormenting thoughts. It’s hard to remember constructively. Ergo, people need something they can believe in: God, for instance; or if you can’t manage that, there’s beauty, progress, the good in man, etcetera. We, here in the West, believe implicitly in freedom).

পশ্চিমী দুনিয়ার তথাকথিত স্বাধীনতা ও মানবতাবাদ এভাবেই গ্রাসের তির্যক লেখনীতে পরিণত হয় উপেক্ষা ও ঘৃণার এক ঠুনকো অস্তিত্বে।

এর পরবর্তী ঘটনাবলীতে দেখা যায়, রেডিও কোলনে ওয়াল্টার ম্যাটার্নের সহকর্মী জান্ডের ও হ্যারী লেবেনিউ কিশোর ও তরুণদের জন্য বেতারে প্রচারিতব্য একটি আলোচনা চক্রের আলোচ্য বিষয় হিসাবো ওয়াল্টারকে নির্ধারণ করে। সেই আলোচনা স্ক্রীপ্ট পড়ে, ভয়ে ওয়াল্টার পালিয়ে যায় পশ্চিম হতে পূর্বে (কিছুটা অনুশোচনা ও এডিকে খুঁজবার বাসনাও মিশে ছিল তার সাথে) অসাধারণ এই রেডিও-স্ক্রীপ্ট নির্মাণে গ্রাস কল্পনার কোন নির্দিষ্ট সীমা মানেননি, লোকজ ছড়া আর হেইডওয়েগারের দর্শন-দু’টোই ব্যবহার করেছেন সমানভাবে; কি হয়, তা নয়, বরং ‘কি হওয়া উচিত’ সেটাই গ্রাস ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা তো জানি, যেমন গ্রাস নিজেও জানেন, ভুলে যাওয়া ও ভুলতে দেয়ার সেই পশ্চিম জার্মানিতে এমন মুক্ত আলোচনা কোনদিনই হয়নি- তবু তিনি সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন বিবেককে আত্মতৃপ্তির ঘুম হতে জাগাতে। এমন কি, হিটলালের কুকুরের উপর একটি “Musical Interrogation”- ও প্রয়োগ করা হয়েছে এই আলোচনা স্ক্রীপ্ট। অসাধারণ এই স্ক্রীপ্টের কিছুটা অংশ তুলে না দিয়ে পারছি নাঃ

মুক্ত আলোচনা

প্রযোজক: পশ্চিম জার্মান ব্রডকাষ্টিং ষ্টেশন, কোলন।

আলোচনায় অংশগ্রহণঃ

হ্যারী লেবেনিউ: আলোচনা পরিচালক।

ওয়াল্লি সওয়াতস্কি: যাদুকাঁচ হাতে সহকারিণী।

ওয়ান্টার ম্যাটার্ন: আলোচ্য বিষয়।

সহকারী ভূমিকা: কুকুর প্লুটো।

প্রশ্নকর্তা        : যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের ৩২ জন ছেলে-মেয়ে, সবাই দশ হতে একুশের মধ্যে।

প্রশ্ন (একটি বালক): আপনার জন্ম কোন লগ্নে?

ম্যাটার্ন          : কোন ধারণা নেই। জন্ম তারিখ ১৯ শে এপ্রিল।

ওয়াল্লি           : মিথ্যা কথা বলে কোন লাভ নেই। আমার মামার জন্ম তারিখ হলো ২০ শে এপ্রিল।

ম্যাটার্ন          : আঃ এই মেয়েটা! ওটা পাসপোর্টের হিসাব। কিন্তু, আমার মা সব সময় বলেছেন যে,     আমি উনিশে এপ্রিল রাত বারোটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগে জন্মেছি। ভদ্রমহোদয়গণ,      আপনারা কাকে বিশ্বাস করবেন, পার্সপোর্ট না আমার মায়ের হিসাব?

প্রশ্ন      : ১৯ শে এপ্রিল জন্মান আর ২০ শে এপ্রিল, আপনি মেষ রাশিতে জন্মেছিলেন। আপনি কি            এমন কোন বিখ্যাত ব্যক্তিকে জানেন যে মেষ রাশিতে জন্মেছে?

ম্যাটার্ন          : প্রফেসর ফয়েরবাখ।

একটি বালক : ফুহ! তিনি কর্কট।

ম্যাটার্ন          : জন কেনেডি?

বালক            : পাক্কা মিথুন।

আলোচনা পরিচালক : দয়া করে মনোযোগ দিন, মি: ম্যাটার্ন। খুব  বিখ্যিাত ব্যক্তিদের মধ্যে কে মেষ রাশিতে জন্মেছে?

ম্যাটার্ন          : এটা কি কোন আলোচনা সভা না ডাইনীবিদ্যা চর্চা কেন্দ্র? হ্যাঁ, পাসপোর্টের তারিখ    অনুযায়ী আমার জন্মদিনে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন এ্যাডলফ হিটলার।

শুধু জন্ম তারিখই নয়- একের পর এক নানা বিষয়েই হিটলারের সাথে ওয়াল্টারের আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এক পর্যায়ে সন্দেহ হয়, তবে কি ওয়াল্টারই হিটলার? আসলে ‘ইহুদীপ্রেমী’ ও ‘সমাজতন্ত্রী’ ম্যাটার্ন ছিল খুবই উঁচু স্তরের এক নাজি, যার সাথে হিটলারের প্রত্যক্ষ অনুমোদনে, এভা ব্রাউনের দৈহিক সান্নিধ্য ছিল। ম্যাটার্নের কুকুর প্লুটো যে আসলে হিটলারের কুকুর প্রিঞ্জ- তাও প্রমাণিত হয় Musical Interogation- এর মাধ্যমে। দেখা যায়, প্লেয়ারে বিটোফেন বা মোৎসার্টের ক্যাসেট বাজলে প্লুটোর কোন সাড়া নেই, কিন্তু নাজিবাদী সুরকার ওয়াগনারের ‘ডয়েশল্যান্ড উবার এ্যালেস’ বা ‘গট্ … টের … ডামেরং জাতীয় রণসঙ্গীত বেজে উঠলেই সে সোল্লাসে গর্জন করছে।

উপন্যাসের শেষপ্রান্তে পূর্ব বার্লিনের রেলষ্টেশনে এডির সাথে ওয়াল্টারের সাক্ষাত হয়। এডির চিবুক বলে কোন বস্তু নেই এবং বত্রিশটা দাঁতই সোনায় মোড়ানো। ম্যাটার্নকে এডি নিয়ে যায় একটি সান্ধ্যকালীন কাফেতে, যেখানে জেনি ব্রুনিস একজন ওয়েট্রেস (একদা এক্সারসাইজরত অবস্থায় ব্যালান্স বীমের উপর থেকে পড়ে তার পা ভেঙ্গে সে আর ব্যালেরিনা হতে পারেনি।) কাফেতে সমবেত সুধীজনের অনুরোধে Gold Mouth (তাকে সবাই এ নামেই ডাকে এখন) একটি গল্প শোনায়। সে গল্পে বিধৃত দুই বালকের বন্ধুত্ব, ছুরি দিয়ে হাত কেটে রক্তে রক্ত মিশানো এবং পরবর্তী সময়ে জেলাকের অভাবে সেই ছুরি একটি বালকের দ্বারা ভিশ্চুলার বুকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কাহিনী। কাফে হতে বের হয়ে ব্রিজের উপর হাঁটতে হাঁটতে, এডিকে ম্যাটার্ন জানায়, এ জাতীয় গল্প খুবই মামুলি। যা প্রায় সমস্ত জার্মান পাঠ্য পুস্তকেই পাওয়া যায়। উত্তরে এডি বলে, জার্মান টেক্সটবুককে যতটা সাধারণ মানুষ ভাবে, ততটাই সাধারণ তারা নয়। প্রমাণস্বরূপ, একটি ছুরি বের করে সে পকেট থেকে। এ সেই ছুরি, যা অনেক সূর্যাস্তে আগে ম্যাটার্ন ভিশ্চুলায় নিক্ষেপ করেছিল, যা সম্প্রতি এডি পূর্ব জার্মান ড্রেজিং সমিতিকে বিমেষভাবে বলে-কয়ে, দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর উদ্ধার করেছে। হতবিহ্বল ম্যাটার্ন খানিকক্ষণ পাথরের মতো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে, শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে ওঠে, SHEENY!

আর পরক্ষনেই এডির পায়ে ভাংচুর হয়ে পড়ে যায়:

“আমাকে তুই শাস্তি দে, এডি! যা খুশি তাই কর আমাকে নিয়ে।”

ম্যাটার্ন-চরিত্রের এই যাবতীয় বৈপরীত্য এই আপাত অসংলগ্নতা আমাদের হঠাৎ ভাবিয়ে তুলতে পারে যে, বুঝিবা চরিত্রটি অবস্তব, কৃত্রিম বা উদ্ভট। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয় যে, ম্যাটার্ন তো আমাদের সেই সব বহু চেনা মানুষেরই একজন, যে জাতি বা সম্প্রদায়গত ঘৃণার উর্ধে উঠে অন্য সম্প্রদায় বা জাতির কাউকে ভালবাসছে আবার পারিবারিক, সামাজিক ও সম্প্রদায়গত সূত্রে পাওয়া বহু প্রজন্মের ঘৃণা, সংখ্যাগুরুর প্রবল অহমিকাও ত্যাগ করতে পারছে না-বন্ধুর প্রতি সংঘটন করছে অন্যায়, আবার সে অন্যায়ে পাপবোধ তার বড় কমও নয়।

অতঃপর প্রায়শ্চিত্তের পালা। ফিরে চলা সেই ভিশ্চুলার ব-দ্বীপ, ফিরে চলা সেই নিকলসওয়াল্ডি গ্রাম। যেখানে ব্রাস্কেল এন্ড কোম্পানীর কয়লাখানি, যদিও সে কারখানা লোহা, কয়লা বা পটাশ কিছুই উৎপাদন করে না। সেই কারখানায় কর্মরত রয়েছে আধ-পাগলা প্রফেসর ডাঃ ব্রুনিস ও ম্যাটার্নের বধির পিতা অ্যান্টন মিলার। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়লাখানির আলো ও বায়ুশূন্য প্রতিটি ভয়ানক কুঠরি ম্যাটর্নকে অতিক্রম করতে হয়: শ্বাসকষ্টে ছটফট করে সে। তবু এডি নিরস্ত হয় না। এভাবে ভূগর্ভের সব ক’টি চোরাকুঠুরি অবতরণ করার পরই কেবল ম্যাটার্ন পুনরায় পৃথিবীতে উঠে আসার অনুমতি পায়। এডি ব্রাস্কেল ওয়ান্টারের কুকুরকে নিয়ে নেয় নিজের দখলে। হিটলারের কুকুরের উপর একজন ইহুদীর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হয় এই ঐতিহাসিক কুকুর এবং কুকুরদে ইতিবৃত্ত।

অসম্ভব গতিশীল ভাষা, কল্পনাশক্তির বাধাহীন ও অনিবার্য যাতায়াত, পুরান ও ইতিহাসের সার্থক ব্যবহার, সময়ের প্রথাগত ইমেজ অবিরাম ভাংচুর করে গ্রাস যেন প্রতি মুহুর্তে সরিয়ে দিতে চান আমাদের পায়ের তলার জমি, দুহাতে নাড়া দেন আমাদের আয়েশী জীবনের যাবতীয় স্থিতিস্থাপকতায়, যাতে করে এই কুকুর বা সারমেয় সময়ের প্রতিটি মুহুর্তের গন্ধ আমরা অনুভব করতে পারি। নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর উপরও কোন মায়াদয়া নেই তাঁর। তাদের রূপকথা-সদৃশ অন্তিম পরিণতি বড়ই নিরাবেগ, নির্মোহ ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যান। শেষ দৃশ্যে ম্যাটার্নের কয়লাখনি দর্শনের রূপকের মাধ্যমে তিনি কি পাঠকেও সেই নরক-যন্ত্রণাই দিতে চান, যা না পোহালে যুধিষ্ঠিরের পক্ষেও আত্মোপলব্ধির চরম সীমায় পৌঁছানো অসম্ভব হতো? গুন্টার গ্রাস তাই একালের ব্যাস হয়ে আমাদের বার বার নরক-যন্ত্রণা ভোগ করান সেই মহান লক্ষ্যেই।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত