আজ ২৩ এপ্রিল। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্ম ও প্রয়াণ দিবস। ইরাবতী পরিবার এই দিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে তাঁকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় নাট্যকার কে, এ প্রশ্নের জবাবে কাউকেই খুব বেশিক্ষণ ভাবতে হবে না। কারণ উত্তরটা আমাদের সকলেরই জানা। তিনি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। তাঁর যে ৩৭টি নাটক ও ১৫৪টি সনেটের হদিস পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোকে মনে করা হয় সাহিত্যের মূল্যবানতম সম্পদ।
কিন্তু মজার (কিংবা আক্ষেপের) বিষয় হলো, এমন খ্যাতিমান একজন ব্যক্তি, গোটা জগৎ জুড়ে যিনি এক নামে পরিচিত, তাঁর ব্যাপারেই আমাদের জ্ঞানের পরিধি খুবই সীমিত। তাই তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ‘অজ্ঞাত খ্যাতিমান’ ব্যক্তিত্বদের একজন হিসেবে অভিহিত করলেও অত্যুক্তি হবে না। অনেকের মতে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রও বটে।
প্রাথমিক তথ্য
শেক্সপিয়ার ঠিক কবে জন্মগ্রহণ করেছেন, সে বিষয়ে কোনো লিখিত দলিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে চার্চের পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায়, তিনি ১৫৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভনের হলি ট্রিনিটি চার্চে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। সেখান থেকে ধারণা করা হয় যে, তিনি খুব সম্ভবত ১৫৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল কিংবা তার দুই-একদিন আগে-পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঘটনাক্রমে তিনি মৃত্যুবরণও করেছিলেন ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিলই।
শুরুর দিনগুলো
শেক্সপিয়ারের বাবা ছিলেন জন শেক্সপিয়ার, আর মা মেরি আরডেন। নিকটবর্তী এক গ্রাম থেকে তারা স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভনের হেনলে স্ট্রিটে বিশাল এক বাড়িতে উঠে এসেছিলেন, এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শহরের অন্যতম সম্ভ্রান্ত দম্পতিতে পরিণত হয়েছিলেন। জন শেক্সপিয়ার ছিলেন শহরের একজন ধনাঢ্য টাউন অফিসিয়াল, আর মেরি আরডেনও ছিলেন এক বনেদী পরিবারের মেয়ে।
ধারণা করা হয়ে থাকে যে, শেক্সপিয়ার স্থানীয় একটি গ্রামার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, যেখানে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক এবং ধ্রুপদী সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। তাঁর এই প্রাথমিক শিক্ষা নিঃসন্দেহে পরবর্তী জীবনে তাঁর সাহিত্যকর্মে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল, কেননা তিনি তাঁর অনেকগুলো নাটকেরই মূল ভাবনা পেয়েছিলেন ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে।
পরিবার গঠন
একটু যেন আগেভাগেই সংসার জীবনের শুরু করেছিলেন শেক্সপিয়ার। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি বিয়ে করেছিলেন শটারির মেয়ে অ্যানি হ্যাথাওয়েকে। অ্যানিকে বিয়ে করার সময়ই তিনি গর্ভবতী ছিলেন। মূলত বিয়ের আগেই সন্তান হয়ে গেলে লোকলজ্জার মুখে পড়তে হবে, এমন ভয় থেকেই তাড়াহুড়া করে বিয়েটা হয়েছিল তাঁদের।
প্রথম জন্মানো কন্যাসন্তান সুজানাসহ সব মিলিয়ে তিন সন্তানের বাবা হয়েছিলেন শেক্সপিয়ার। সুজানা জন্মেছিল ১৫৮৩ সালের মে মাসে, আর দুই জমজ পুত্র জুডিথ ও হ্যামনেট জন্মেছিল ২৫৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাত্র ১১ বছর বয়সে, ১৫৯৬ সালে মারা যায় হ্যামনেট। পুত্রের এই অকাল মৃত্যুতে মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পান শেক্সপিয়ার। পুত্রবিয়োগের শোক তাঁকে তাড়া করে বেড়াতে থাকে। অনেকের মতে, বছর চারেক বাদে লেখা ‘হ্যামলেট’ নাটকটি মূলত শেক্সপিয়ারের পুত্রশোকেরই প্রমাণ।
থিয়েটার জীবন
১৫৮০’র দশকের শেষ ভাগে নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলেন শেক্সপিয়ার। সেখানে শুরু হয়েছিল তাঁর সংগ্রাম। কয়েক বছর ধরে বহু চেষ্টাচরিত্রের পর, ১৫৯২ সালে তিনি সমর্থ হন নিজেকে একজন নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।
১৫৯৪ সালে ঘটে সেই ঘটনাটি, যা পরবর্তীকালে সাহিত্যের ইতিহাসকে খোলনলচে বদলে দিয়েছিল – শেক্সপিয়ার যোগ দিয়েছিলেন রিচার্ড বারবেজের নাট্যদলে, এবং এখানেই তিনি পরের দুই দশক কাটিয়েছিলেন প্রধান নাট্যকার হিসেবে। এই দলের অংশ হিসেবেই শেক্সপিয়ার প্রথমবারের মতো পেয়েছিলেন নিজের প্রতিভাকে মানুষের সামনে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ। সেই সুযোগকে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাতে শুরু করেছিলেন তিনি।
নাটক লেখার পাশাপাশি নাট্যদলটিতে শেক্সপিয়ার অভিনেতা হিসেবেও কাজ করতেন। অবশ্য মুখ্য ভূমিকায় কোনোদিন অভিনয়ের সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাঁর। কেননা সে পদটি পাকাপাকিভাবে নিজের জন্য বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন বারবেজ।
অবশ্য শেক্সপিয়ার-বারবেজের মধ্যে এ নিয়ে ব্যক্তিগত রেষারেষি থাকুক বা না থাকুক, তাঁদের নাট্যদলটি কিন্তু দারুণ সফলতা অর্জন করেছিলে। প্রায়ই তাঁরা নাটক মঞ্চস্থ করতেন ইংল্যান্ডের রানী, প্রথম এলিজাবেথের সামনে। ১৬০৩ সালে সিংহাসনে বসেন প্রথম জেমস। তিনি ছিলেন নাটকের বড় ভক্ত। তাই শেক্সপিয়ার-রামেজের নাট্যদলটিকে রাজসিক পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন তিনি। সেই সুবাদে নাট্যদলটির নতুন নাম হয় ‘দ্য কিং’স মেন’।
শেক্সপিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি নাটক
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট (১৫৯৪-১৫৯৫)
এ মিডসামার নাইট’স ড্রিম (১৫৯৫-১৫৯৬)
মাচ এডো অ্যাবাউট নাথিং (১৫৯৮-১৫৯৯)
হেনরি ফাইভ (১৫৯৮-১৫৯৯)
টুয়েলফথ নাইট (১৫৯৯-১৬০০)
হ্যামলেট (১৬০০-১৬০১)
মেজার ফর মেজার (১৬০৪-১৬০৫)
কিং লিয়ার (১৬০৫-১৬০৬)
ম্যাকবেথ (১৬০৫-১৬০৬)
দ্য টেম্পেস্ট (১৬১১-১৬১২)
শেক্সপিয়ার: একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব
বাবার মতোই, শেক্সপিয়ারেরও ছিল তুখোড় ব্যবসায়িক বুদ্ধি। ১৫৯৭ সালে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভোনের সবচেয়ে বড় বাড়ি কিনেছিলেন তিনি। এছাড়াও গ্লোব থিয়েটারের আংশিক মালিকানা ছিল তাঁর। ১৬০৫ সালে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভোনের আশেপাশের কিছু জায়গায় রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করেও প্রচুর লাভ করেছিলেন তিনি।
একজন নাট্যকার হওয়া সত্ত্বেও শেক্সপিয়ার ইংল্যান্ডের সভ্য সমাজে একজন ভদ্রলোক হিসেবে গণ্য হতেন। এর পেছনে মূল কারণ ছিল দুইটি। প্রথমত, প্রচুর অর্থের মালিক ছিলেন তিনি। দ্বিতীয়ত, ১৬০১ সালে বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে ‘কোট অব আর্মস’ লাভ করেছিলেন তিনি।
জীবদ্দশায়ই শেক্সপিয়ার ছিলেন দারুণ সম্মানিত একজন ব্যক্তি; Image Source: Britannica
শেষ জীবন
১৬১১ সালে স্ট্র্যাটফোর্ডে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। অবশ্য এতে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। ইতিমধ্যেই যে পরিমাণ সম্পদের মালিক তিনি ছিলেন, তা দিয়ে বাকি জীবনটা বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
মৃত্যুর আগে শেক্সপিয়ার তাঁর সিংহভাগ সম্পত্তিই দান করে গিয়েছিলেন বড় মেয়ে সুজানা এবং দ্য কিং’স মেনের কয়েকজন অভিনেতাকে। স্ত্রীর জন্য তিনি রেখে গিয়েছিলেন বিখ্যাত ‘সেকেন্ড বেস্ট বেড’।
১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য তাঁর মৃত্যু তারিখ নিয়েও যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। কেননা ঠিক কবে তিনি মারা গেছেন, সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু পাওয়া গেছে দুইদিন পরের লাশ দাফনের রেকর্ড।