| 27 এপ্রিল 2024
Categories
নারী

চলচ্চিত্রে নারীদের প্রতিকৃতি ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মঞ্জুরুল ইমরান 

 

‘বউ বন্ধক’ ‘সতী’, ‘কাজের মেয়ে’, ‘এক টাকার বউ’, ‘চাঁদের মতো বউ’⎯ মূলধারার এ ধরনের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের নামকরণ থেকেই জেন্ডার অসংবেদনশীলতার চিত্রটি একনজরে তুলে ধরা যায়। নামগুলো থেকেই অনুধাবন করা যায়, এগুলো নির্বাচন করা হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ হয় অনেক সংগ্রাম, সম্ভাবনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে। কিন্তু যতই দিন অতিবাহিত হয়েছে চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী গণমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। মূলধারা, বিপরীত ধারা নানা ধরনের চলচ্চিত্র এসেছে সময়ের বিবর্তনে। কিন্তু চলচ্চিত্র সমাজেরই প্রতিফলক হিসেবে নারী-পুরুষের প্রথাগত সম্পর্কের বাইরে যেতে পারে নি, বরং নারী-পুরুষের সামাজিক-লৈঙ্গিক পার্থক্যকে করেছে অধিকতর সুসংহত।

বাংলা চলচ্চিত্রে পুরুষ চরিত্রের নির্মাণ হয়েছে ‘দানব, দেবতা ও পতি’রূপে, আর নারী যুগে যুগে স্থান পেয়েছে ‘সতী, নষ্টা ও এক্সস্ট্রা’ হিসেবে । নারী-পুরুষের সামাজিক বৈষম্যকেই টিকিয়ে রেখেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। বাংলা চলচ্চিত্রে নারী-পুরুষের অবস্থান চিত্রায়িত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার হাত ধরেই। চলচ্চিত্র নির্মাণ, সম্পাদনা, প্রযোজনা থেকে সর্বস্তরেই পুরুষপ্রাধান্যের আধিক্য নারীকে একটি ছকে বেঁধে ফেলে। অন্যদিকে পুরুষকে দেয় মহাপরাক্ষমশালীর সম্মান। বিগত দশকগুলোতে নারীপ্রধান চলচ্চিত্র কিছু তৈরি হলেও তাতে শেষপর্যন্ত নারীকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পুরুষকেই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে হয়েছে। আমাদের সমাজের চিত্র বলা হয় চলচ্চিত্রকে, কিন্তু চলচ্চিত্র এক্ষেত্রে প্রায়ই নারী-পুরুষের সম্পর্ককে প্রভু-দাসের সম্পর্কে রূপ দেয়। এমনকি রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। তাই বাংলা চলচ্চিত্রের কেবল নারী বা পুরুষ চরিত্রের স্বরূপ সন্ধান করে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন চলচ্চিত্রের সামগ্রিক জেন্ডার বিশ্লেষণ।

চলচ্চিত্রে নারীদের প্রতিকৃতি বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য :  

  • সমকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের নারী ও পুরুষ লিঙ্গের চরিত্র নির্মাণ ও চিত্রায়নের সামগ্রিক পর্যালোচনা;
  • বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে নির্মিত বিভিনড়ব ধারার চলচ্চিত্রের জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন;
  • চলচ্চিত্রে নির্মিত চরিত্রের সাথে আমাদের সমাজের বাস্তবতাকে মিলিয়ে বিচার করা;
  • সমাজে প্রচলিত পুরুষতন্ত্র কীভাবে চলচ্চিত্রের চরিত্রে জেন্ডারকে স্টেরিওটাইপ করে উপস্থাপন করে তা অনুসন্ধান করা।

চলচ্চিত্রে জেন্ডার বৈষম্য বা নারী চরিত্রের উপস্থাপন :

চলচ্চিত্রে জেন্ডার বৈষম্যের শুরু : বাংলা চলচ্চিত্র শুরু থেকেই পুরুষ চালকের আসনে ছিল। চলচ্চিত্রে অভিনয় করা নারীদ্র জন্য একটি অপমানজনক বৃত্তি ছিল। তাই তথাকথিত ভদ্রঘরের নারীরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কথা চিন্তাও করতেন না। বাংলা চলচ্চিত্রে জেন্ডার বৈষম্যের শুরু সেখান থেকেই। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ এর অভিনেত্রীদের আনতে হয়েছিল পতিতালয় থেকে। কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয় তাদের সন্মানজঙ্ক অবস্থান বা প্রতিভার কদর কিছুই এনে দিতে পারেনি। তাই অভিনয় শেষে তাদের আবার পূর্বের পেশায়ই ফিরে যেতে হয়।

মডেলকন্যা : বাংলা চলচ্চিত্রে নারীদের এ্যাকশন চরিত্র থেকে মডেলকন্যা হিসেবে উপস্থাপন করার কৌশলই বেশি। কোন কোন একশ্যান চরিত্রে নারীদের দেখাতে গিয়েও, সেখানে নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে মডেলকন্যা হিসেবেই উপস্থাপিত হয়। যেমন নারী অ্যাকশননির্ভর অগ্নী যদি বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, তাহলে দেখা যায় সেই চলচ্চিত্রে তানিশার চরিত্রটি অ্যাকশননির্ভর হলেও এটি শুরু হয় তার গাড়ি থেকে নামার দৃশ্য থেকে, যেখানে তার চেহারা দেখা যায় না, কিন্তু তার পা ও শরীরের পেছনভাগ এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তাকে র‌্যাম্পে হাঁটা কোনো মডেলকন্যা বলেই মনে হয়। এখানে নারীর রিপ্রেজেন্টেশন হয়েছে একটি প্রদর্শনবস্তু হিসেবে। আর এখানে ক্যামেরার পেছনের পুরুষতান্ত্রিক চোখটিই নারীকে এভাবে উপস্থাপন করে দর্শক টানতে চেষ্টা করেছে।


আরো পড়ুন: তসলিমা নাসরিনের লিঙ্গ সূত্র

নারী মানেই সুন্দরী : অধিকাংশ চলচ্চিত্রে নারীর মূল চরিত্রের চাইতে তার রুপ মাধুর্য বা সৌন্দর্যের প্রতিই গুরুত্ব দেওয়া বেশি। এবং তা ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন আঙ্গিকে। অর্থাৎ নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে নারী মানেই সুন্দরী হতেই হবে। অসুন্দরী নারী লজ্জার এবং অপমান।

নারীর খন্ডিত রুপ : অনেক সিনেমায় নারীকে শুরুতে বা বিশেষ কোন দৃশ্যে খন্ডিত রুপে দেখানো হয়, যা মূল গল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র দর্শকদের কাছে নারীকে আকর্ষনীয় রুপে উপস্থাপন করা হয়।

বিনোদন সামগ্রী নারী বা পুরুষের হাতের পুতুল : অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই খলনায়কের পাশে নারী চরিত্রগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে নারী হয়ে উঠে বিনোদন সামগ্রী বা পুরুষের হাতের পুতুল।

নারী সহজলভ্য : আমাদের সমাজে নারীকে খুব দূর্বল ও সহজলভ্য মনে করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার উদাহরণই এইসব চলচ্চিত্র।

নারীর পেশা নির্ধারণে বৈষম্য : বেশীরভাগ চলচ্চিত্রেই আমাদের সমাজে প্রচলিত ‘জেন্ডারভিত্তিক শ্রমবিভাজন’ পদ্ধতিই প্রতিফলিত হয়। এ ছাড়া, এ চলচ্চিত্রে দর্শক আকর্ষণে আইটেম গানে নারীর অযৌক্তিক ব্যবহারও লক্ষণীয়।

নারী মানেই যৌনবস্তু : বাংলা চলচ্চিত্রে বেশির ভাগ নারী চরিত্রেই নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিশেষকরে আইটেম গানগুলোতে তা আরো বেশি প্রকাশ পায়।

নারী বিয়ের উপকরণমাত্র, ঘরের লক্ষ্মী : আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেমন মনে করে নারী কেবল পুরুষের স্ত্রী হিসেবে ঘরে থাকলেই ভালো। ঠিক একইভাবে বেশীরভাগ চলচ্চিত্রে নারীর ভূমিকা এমনভাবে উপস্থাপিত হয়।

নারী ভিতু : অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই নারীকে ভীতু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন নারী গুন্ডা দেখলেই ভয়ে পালায়, নারী পিস্তল দেখলে ভয়ে জ্ঞান হারায়, তেলাপোকা দেখে নায়ককে জড়িয়ে ধরে, ইত্যাদি।

অসংবেদনশীল ডায়লগ : নারীকে নিয়ে খলনায়কের মুখ থেকে অনেক সময় এমন কিছু অসংবেদনশীল ডায়লগ বের হয়, যা একজন নারীর জন্য অপমানকর। নারীকে কখনও তারা মুরগীর সাথে তুলনা করে, আবার কখনও জুয়ার সাথে। যা নারীকে অপমান করে উপস্থাপন করা হয়।

নারী একা দুর্বল, অক্ষম : বেশীর ভাগ চলচ্চিত্রেই নারীকে একা দুর্বল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অধিকাংশ সিনেমায় দেখা যায়, নারী বা নায়িকা নায়ককে ছাড়া অসহায়, দুর্বল।

নারীকেই সমঝোতা করতে হয় : আমাদের সমাজের মতো চলচ্চিত্রের নারী চরিত্রগুলোতেও  অন্যান্য সম্পর্কের মতো বৈবাহিক সম্পর্কেও নারীকেই সমঝোতা করতে হয়।    

পুরুষ চরিত্রের উপস্থাপন ও অন্তর্নিহিত বক্তব্য বিশ্লেষণে নারীর প্রতিকৃতি 

ক্যামেরার পেছনে পুরুষের চোখ : জেন্ডার বৈষম্যভিত্তিক সমাজের অধিকাংশ চলচ্চিত্রে ক্যামেরার পেছন থেকে পুরুষতান্ত্রিক চোখই বেশি কাজ করে। সমাজের অধিকাংশ নারী-ই এ পেশায় আসতে অনীহা প্রকাশ করে। এবং অনেকে মনে করে নারীরা এই পেশায় অদক্ষ। ফলে অধিকাংশ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যার কারনে চলচ্চিত্রে সঠিক জেন্ডার বৈষম্য উপস্থাপন হতে ব্যার্থ হয়। তাই চলচ্চিত্র হয়ে উঠে শুধুমাত্র পুরুষের সামগ্রী। তাই অনেক সময়  অ্যাকশননির্ভর চরিত্রে নারীদের দেখা গেলেও, তা হয়ে উঠে পুরুষের বস্তু সামগ্রী। পুরুষের দৃষ্টি লালসা মেটাতে তাই এসব চরিত্রগুলোতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে, নারীর  হাইহিল জুতা, কড়া মেকআপ, উন্মুক্ত শরীর প্রদর্শন ও আপত্তিকর দেহভঙ্গি। আবার অপরদিকে দেখা যায়, নারীদের দেখে খলনায়কের লালসার দৃষ্টিভঙ্গী, পেশিবহুল বাহু, দৃঢ় চোয়াল, গোঁফে নিরন্তর তা দেওয়া ও উদ্যত পিস্তল। এই সব চলচ্চিত্রে নারী ও পুরুষের পার্থক্য স্পষ্টতই লক্ষণীয় ভাবে ধরা দেয়।

নারীর বিপরীতে পুরুষ চরিত্রের উপস্থাপন : পুরুষ সিংহ শুধু নয় বাঘও, নারী শিকার করে তারা। কোন কোন খলনায়কের ডায়লগে বলতে দেখা যায়,’একা একা বসে থেকে বোর হয়ে গেলাম। অনেকদিন শিকার করি না। এভাবে বসে থেকে বাঘও শিকার ভুলে যায়’। তারপর ভিলেন বের হয়ে যায় নারী শিকার করতে। অর্থাৎ পুরুষের শিকার বা মনোরঞ্জনের সামগ্রী হলো নারী। আর পুরুষ হলো প্রতাপশালী বাঘ আর নারী নিরীহ হরিণশাবক মাত্র। পকেটে টাকা থাকলেই পুরুষ নারীকে কিনতে। কিছু নারী আর পুরুষের চরিত্র এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, পুরুষের  টাকা থাকলে সহজেই নারীকে কিনে নেয়া যায়। পুরুষ কান্নার দৃশ্যায়ন, প্রথাগত আচরণের বাইরে। আমাদের সমাজে পুরুষের কান্না করা এক অর্থে নিন্দনীয় মনে করা হয়। তাই আমাদের নাটক, চলচ্চিত্রেও আমরা সচরাচর পুরুষকে কাঁদতে দেখি না।

অধিকাংশ চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, নারীকে সঠিকভাবে জেন্ডার বৈষম্যে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। অনেকেই মনে করেন যে চলচ্চিত্র সমাজের দর্পণ। এই বিবেচনায় চলচ্চিত্রের জেন্ডার অসংবেদনশীলতা সমাজের চিত্রেরই প্রতিফলন। কিন্তু সমাজে যা যেভাবে ঘটে তাই যদি হুবহু দেখানো হয় তাহলে তার জন্য সমাজই আছে, আলাদা করে চলচ্চিত্রের দরকার নেই। যখন চলচ্চিত্রের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমটিতে কেউ কাজ করতে আসবেন তখন তাকে কেবল কারিগরিভাবে দক্ষ হলেই হবে না, সমাজের অসংগতিগুলো দূর করায় কীভাবে ভূমিকা রাখা যায় সে ব্যাপারেও স্পষ্টতা থাকতে হবে। চলচ্চিত্রের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমের ভেতর দিয়ে যা খুব ভালোভাবে করা সম্ভব। কারণ জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার মানুষের প্রতি কোনো সংবেদনশীলতা উপস্থাপিত হলে সমাজে এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে বাধ্য। কাজেই চলচ্চিত্রের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ সংক্রান্ত দায় এড়াবার কোনো সুযোগ নেই।

তথ্যসূত্র :

‘নারী ও প্রগতি’, ‘চন্দ্রাবতী’ নারী বিষয়ক লিটলম্যাগ।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত