| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বিশ্ব কবিতা দিবস: ফিলিস্তিন: প্রতিরোধ, শাহাদত এবং কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
‘কাকে বলে কবিতা, যদি তা না বাঁচায়
দেশ কিংবা মানুষকে?’
চেশোয়াভ মিউশের মতো কবি লিখেছিলেন পংক্তিটি। নিঃসন্দেহে তাঁর জানা ছিল গ্রীক সমাজে ক্রীতদাস প্রথার মাধ্যমে মনুষ্যজন্মের অপমান, জানা ছিল এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশবাদী নৃশংসতা ও নির্বিচার জাতিহত্যার কথা। তিনি এটাও জানতেন, পশ্চিমী শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতা কেড়ে নিয়েছে উপনিবেশের বহু জাতি-গোষ্ঠী-গোত্রের কথা মানুষের ভাষা-সংস্কৃত-ধর্ম। একজীবনেই তো তিনি দেখেছেন দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, মাইলাই, একাত্তরের বাংলাদেশ; দেখেছেন নগরে-বন্দরে দেশত্যাগী উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর ঢল। ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটির প্রয়োগই বাহুল্য, যে ক্ষেত্রে চেশোয়াভ মিউশ নিজেই দেশত্যাগী উদ্বাস্তু। তাঁরই স্বদেশী প্রধান কবিদের অন্যতম তাদেউশ রুজেভিচ যখন আক্ষেপে ফেটে পড়েন– ‘কবিতা আসলে মস্ত এক ধাপ্পা। তা না হলে কেন হলো, এত সব মহান-মহিয়ান কবিতা সত্ত্বেও, যুদ্ধ আর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, শোষণ-নিপীড়ন-জাতিহত্যা?’ তখনও কিন্তু চেশোয়াভ মিউশ স্থির বিশ্বাসে বলীয়ান কবিতার অঙ্গীকার নিয়ে। কেননা, তাঁর কাছে এবং আরও বৃহত্তর অর্থে কোনো নিষ্পেষিত মানবাত্মার কাছে কবিতা নিছক কব্জির কলাকৌশল দেখানোর উপায়, আত্মরতির মাধ্যম, দেশ-কাল-উদাসীন নিস্পৃহ শব্দচর্চা মাত্র নয়; বরং সংগ্রামী মানুষের জীবনসংলগ্ন সহযোদ্ধা। মিউশ এখনও বিশ্বাস করেন, কবিতা যদি দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার পালন করত, যদি কবিতাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হতো মানুষের মনে সংক্রমিত করতে স্বাধীনতা ও সাম্যের বোধ– তবে তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস, ইতিহাস এ রকম হতো না। এই বোধ এখনও সমানভাবে কাজ করে বলেই তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে আজও বঞ্চিত মানুষ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আগ্নেয়াস্ত্র-কূটনীতি-জাতিসংঘের মতোই সমান গুরুত্বে বুকে তুলে নেয় কবিতাকে। বস্তুত একটি সংগ্রামশীল জাতিগোষ্ঠী যেভাবে সময়োপযোগী রূপান্তরের ভিতর দিয়ে নিয়ে যায় নিজেদের, তেমনিভাবে রূপান্তরিত হতে থাকে তাদের কবিতাও। এভাবেই কবিতা ও ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠী পরস্পরকে চিহ্নিত করতে গেলে এই সূত্র মনে রেখেই আমাদের এগুতে হবে।
০২.
একদিকে দশকের পর দশক ধরে বিশ্ব ইহুদী সংস্থার সুনিপুণ অমোঘ কুটজাল, বিশ্বের প্রত্যন্ত প্রান্তে বসবাসরত ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন গাত্রবর্ণের ইহুদীদের অবিশ্বাস্য পারস্পরিক মৌলবাদী সহানুভূতি এবং সেই সঙ্গে ব্রিটিশ, ফরাসী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত; অন্যদিকে গোষ্ঠীবিভক্ত-ঐক্যসূত্রহীন, অশিক্ষা-অবক্ষয়ী চিন্তাধারার পূজক আরবদের লজ্জাকর সচেতনহীনতার ফলাফল হচ্ছে আজকের ইসরাইলের উত্থান এবং ফিলিস্তিন-ট্রাজেডির সৃষ্টি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শুধু ইসরাইল নয়, ফিলিস্তিনিদের আলাদা জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রসত্তা ১৯৬৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত আরব রাষ্ট্রগুলোই স্বীকার করে নেয়নি। তাই ইসরাইলী এক প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মায়ারও বলতে সাহস পেয়েছিলেন যে ’শুধুমাত্র আজই নয়, ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্র ও জাতিসত্তা কোনোকালেই ছিল না।’
সত্য বটে, আরব রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত মিসর, সিরিয়া, জর্দান ও লেবানন একাধিকবার ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের যুদ্ধের মূল কারণ ছিল নিজেদের জমি পুনরুদ্ধার। স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র কায়েম করা নয়। তাই আমরা মোটেও অবাক হই না, যখন দেখি আরব রাষ্ট্রগুলোর অবিশ্বাস্য সামরিক ব্যয় অভিন্ন লক্ষ্যবস্তুকে (ইসরাইল) আঘাত না করে পরস্পরকে আঘাত হানতে ব্যস্ত এবং সেই কারণেই ফিলিস্তিনি আরবরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করে চলেছে, গাজা ও জেরিকোর এক টুকরো ভূমিখণ্ডের মধ্যে অভিশপ্ত দরিদ্র জীবনযাপন করছে, তখন ধনাঢ্য আরব রাষ্ট্রগুলোর শাহজাদা-আমীর-শেখদের হারেম-কিংবদন্তি সৃষ্টির প্রতিযোগিতা দেখেও আমরা এতটুকু আশ্চর্য হই না। এসব কারণেই একজন ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ লিখেছিলেন ‘ফিলিস্তিনিরা দুর্ভোগ এবং সংগ্রামের আগুনে পোড় খাওয়া একটি জাতি। তারা সুশৃংখল, সংগ্রামী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন, আধুনিক শিক্ষা-প্রযুক্তি-দর্শনের আলোকে আলোকিত। পক্ষান্তরে মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্র ও প্রাগ্রসরতার চিহ্নমাত্র নেই। এসব রাষ্ট্রের দুর্নীতিবাজ, একনায়ক, অপব্যয়ী, বিলাসী শাসকবর্গ কখনোই চায় না একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ফিলিস্তিনি রাাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। কেননা তাতে তাদের নিজেদের দেশের জনমানসেও ফিলিস্তিনিদের প্রভাব পড়তে বাধ্য। আর এর ফলে নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসব শেখ এবং আমীর গোষ্ঠীর টিকে থাকাও সম্ভব হবে না। তাই স্বাধীন ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে ইসরাইলের পাশাপাশি আরব রাষ্ট্রনেতারাও ভীতির চোখে দেখে।’
এই জটিল রাজনৈতিক-সামাজিক-ভৌগলিক পটভূমি, এই আশ্বাস ও বঞ্চনা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা– সবকিছুই খেয়াল রাখতে হবে ফিলিস্তিনী কবিতা পাঠ ও পর্যালোচনার সময়।
 
০৩.
ফিলিস্তিনি কবিতা দু’টি প্রধান ধারায় বহমান। একদিকে রয়েছে নির্বাসিত কবিতা। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনের ব্যাপক সংখ্যক কবি দেশত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এবং ইউরোপ-আমেরিকায় আশ্রয় নেন। তাঁদের নির্বাসিত জীবনে লেখা কবিতা ও অন্যান্য শিল্পচর্চা মূলত নস্টালজিয়া ও ঘরে ফেরার স্বপ্নদিবসকেন্দ্রিক। এঁরা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই অবস্থানে বাধ্য হন না কেন, ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামের বুদ্ধিবৃত্তিক কণ্ঠস্বর হিসেবে সবসময়ই সোচ্চার। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের সকল মানবিক কণ্ঠকে সম্মিলিত করতে চান। কেউ কেউ সাহিত্যতত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য মৌলিক কাজও করেছেন।
দ্বিতীয় ধারায় রয়েছেন অধিকৃত (ইসরাইলী দখলিকৃত) ফিলিস্তিনের মাটিতে বসবাসরত কবিবৃন্দ। কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যাঁদের প্রত্যক্ষের অভিঘাতে সৃষ্ট। এই নিবন্ধের মূল আলোচনা তাঁদের নিয়েই।
 
০৪.
ভোরের আলোর মতো হাসি/ কেমন করে হাসো
যখন জানি বুকের গভীরে/ রয়েছে জমা শতাব্দীর
ক্রোধ!/ কেমন করে তোমাদের মুখ
এত মসৃণ/ যখন জানি আঘাতে আঘাতে ও-মুখ
থেঁতলে দেয়া হয়েছে বারবার!
কবিতাটির শিরোনাম ‘শুধু তোমরাই পারো।’ কোনো ফিলিস্তিনি কবির লেখা নয়। ফিলিস্তিনে স্বেচ্ছাশ্রমদানরত জনৈকা ডেনিশ নার্সের লেখা কবিতা এটি।
 
সারাবিশ্বের সকল সংবাদ মাধ্যমে দীর্ঘকাল যাবত হেডলাইন দখল করে রাখা ফিলিস্তিনিদের অদম্য প্রাণশক্তি আর সংগ্রামশীলতার প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে কবিতাটি। যে দুটি সম্বলহীনতার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি কবিতা ও ইনতিফাদার উত্থান, তার সম্যক চরিত্র বুঝতে পারা যায়, যে বিপুল বাধা অতিক্রম করে ফিলিস্তিনি কবি ও কবিতাকে এগুতে হয়, তার পর্বতসদৃশতা দেখে। অসংখ্য বাধার মধ্যে চারটি বিষয়ের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপই যথেষ্ট। প্রথমত, যে ন্যূনতম সাংস্কৃতিক পরিবেশ লেখক-শিল্পীর জন্ম ও বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন তার কিছুমাত্র উপস্থিতি ছিল না (আজও নেই) অধিকৃত ভূখণ্ডে।
দ্বিতীয়ত, অধিকৃত এলাকায় সকল দেশী-বিদেশী কালজয়ী সমকালীন ধারার সাহিত্যের প্রচার, প্রকাশনা ও অনুপ্রবেশ ইহুহীবাদ কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছিল। এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনি কবি ও জনগণকে সাহিত্যের এবং চিন্তার আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
 
তৃতীয়ত, ইহুদী দখলদাররা তাদের স্বার্থানুগ এমন এক ধারার সাহিত্য ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চাপিয়ে দিল, যে সাহিত্য অধিকৃত এলাকার ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনোভাবেই প্রতিফলিত করে না। তদুপরি জন্মগতভাবে সাহিত্যপিপাসু ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিপথে পরিচালিত করার মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসাবে ইহুদী লেখকদের লেখা আরবি ভাষায় অজস্র সস্তা-মামুলি, পলায়নী জীবনবিমুখ সাহিত্য বাজারে ছাড়া হলো।
চতুর্থত, ফিলিস্তিনিদের লিখিত আরবি ভাষার সমস্ত প্রচার নিষিদ্ধ করেছিল ইহুদী দখলদার গোষ্ঠী।
এই ধরনের আপাত অনতিক্রম্য বাধার বিপরীতে অধিকৃত ফিলিস্তিনে জন্ম নিয়েছে কবিতা ও সংগ্রাম। ‘কবিতাকে রোখা যায় না প্রতিরোধের পাথর চাপা দিয়ে’– ইতিহাসের এই শিক্ষাই পুনর্জন্ম নিয়েছে ফিলিস্তিনে। কবিতা সেখানে শুধু জন্মই নেয়নি বরং নিজের পুনর্জন্ম উৎসব পালন করেছে অধিকৃত এলাকায় প্রথম প্রতিরোধের ডাক দিয়ে।
যেহেতু মুদ্রণের অধিকার ছিল না, তাই ফিলিস্তিনি কবিরা অবলম্বন করেছিলেন প্রাক-মুদ্রণযুগের পদ্ধতি– ‘মুখে মুখে রচনা, মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয়া ও বুকে বুকে গেঁথে দেয়া।’ বিবাহ আসর ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানগুলি হয়ে উঠল কবিতার মঞ্চ। কবিতা উচ্চারিত হতে থাকল সমবেত জনতার কণ্ঠে এবং ক্রমশ এই প্রতিরোধের কবিতাগুলোই হয়ে উঠল ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ের পতাকা। কবিতার এই ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা অপরিসীম। অনেক কবিতা আছে, যেগুলো ফিলিস্তিনিদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়, কিন্তু কেউ জানে না কে তার আসল রচয়িতা। অর্থাৎ কবি নয়, কবিতাই হয়ে উঠেছিল মুখ্য। অজ্ঞাতনামা এক শহীদ সংগ্রামী ফিলিস্তিনি যুবক রচনা করেছিলেন একটি কবিতা। সেই কবিতা কণ্ঠস্থ নেই এমন ফিলিস্তিনি আজও দুর্লভ। কবিতাটি ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি ফিলিস্তিনীর বুকে এবং কবিতাটি সর্বত্র উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধাপ্লুত প্রার্থণার মতো–
‘হে রাত্রি/ বন্দীকে শেষ করতে দাও তার বিলাপ/
কারণ যখন ঝটপট করে উঠবে ভোরের সতেজ ডানা/ তখন তার দেহ বাতাসে।/
বন্ধুরা বিচ্ছিন্ন এখন/ টুকরো হয়ে গেছে পাত্রগুলো।/
হে রাত্রি, থেমে থাকোÑ যতক্ষণ না শেষ হয় আমার শোকগাথা।/
তুমি কি ভুলে যাবে আমার কথা/ ভুলবে কি আমার দীর্ঘশ্বাস?/
হে অবিচার, ভুলো না/ কেমন করে এই দুর্বহ সময় কাটালাম/ তোমার হেফাজতে/
ভেবো না আমার অশ্রু ঝরছে ভয়ে!/
ঝরছে আমার মাতৃভূমির দুঃখে/ আর বাড়ির ক’টি ভূখা বাচ্চার মুখের এক মুঠো অন্নের কথা ভেবে,/
আমি চলে গেলে তাদের খাওয়াবে কে?/ আমার তরুণ ভাই দু’টিকেও ফাঁসিতে লটকালে?/
কেমন করে আমার স্ত্রী দিন গুজরাবে?
আমার আর তার কোলের বাচ্চার জন্য চোখের জল ফেলে?/
তবুও কি আমি তার কঙ্কণ তার বাহুতেই/ যাব রেখে/
যখন পিতৃভূমি উদ্ধারের যুদ্ধ দিয়েছে ডাক/ বন্দুক কেনার।’
 
০৫.
খণ্ড খণ্ড প্রতিরোধ যেমন দিনে দিনে জমাট বেঁধে জন্ম দিল ইনতিফাদার, তেমনি অজ্ঞাতনামা চারণ কবিদের উত্তরসূরি হিসাবে জন্ম নিলেন আজকের বিশ্বকবিতার অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ফিলিস্তিনি কবিরা। তাৎক্ষণিক বিহ্বল কবিতা-পঙক্তি তাঁদের হাতে রূপ নিল সত্যিকারের বিপ্লবী কবিতামন্ত্রে। কলম আর বন্দুক হাতে বিশ্ব কবিতার সারিতে উঠে এলেন ফাওয়াজ তুর্কি, সালেম জুবরান, ফাদোয়া তুকান, আজতোয়াই জারা, ইজাজ হাম্মাদ, শামী আল কাসেম, আবু সালমা, তোয়াফিক জায়াদ, মাহমুহ দারবিশের মতো অনুপম শৈলীর বিপ্লবী কবি।
স্বাধীন মানচিত্রের দাবি, সংগ্রামের ডাক, জায়নবাদ-সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা, ইহুদী অত্যাচারী শাসকদের প্রতি সুতীব্র বিদ্রুপের হুল, নিজভূমে পরবাসী এবং উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনীদের দুরবস্থার কাব্যচিত্র– এই নিয়েই আজ অবধি আবর্তিত ফিলিস্তিনি কবিতার বিষয়বস্তু। পুনরুক্তি এবং একঘেয়েমির শিকার হবার কথা পাঠকদের। কিন্তু সেই দুর্বলতাকে ফিলিস্তিনি কবিরা অনায়াসে জয় করে নেন হার্দিক আন্তরিকতার গাঢ়ত্ব এবং একই বিষয়ের মাঝে আণুবীক্ষণিক বৈচিত্র্যের প্রক্ষেপ ঘটিয়ে।
তোয়াফিক জায়াদ যখন সংগ্রামের ডাক দেন-
‘মৃত্যুকে পেছনে ফেলে জেগে ওঠো/ যদি বা পালাতে চায় আগামী ভবিষ্যৎ/ দেব না তাকে আমরা উড়ে পালাতে।’ [মৃত্যুকে পেছনে জেগে ওঠো। অনুবাদ: ধরিত্রী রায়]
ঠিক তখনই মাহমুদ দারবিশের কণ্ঠে বেজে ওঠে একই সুর ভিন্ন মাত্রায়–
‘তোমার থালায়/ এখনো একটু মধু রয়ে গেছে!/ ওটুকু বাঁচাতে/ মাছিগুলোকে হটাও।’/ [ আশা। অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত]
একই শব্দাবলী উচ্চারিত হয় শামী আল কাসেমের কবিতায়। কিন্তু তাঁর উচ্চারণ অনেক প্রত্যক্ষ–
‘যতক্ষণ আমাদের শহরের মহল্লায়/ শত্রুর বেয়নেট ঝলসাবে/ ততক্ষণ প্রতিরোধ, ততক্ষণ লড়াই।’ [রাফার শিশুরা-২ । অনুবাদ: মানব মুখার্জী]
মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে এখনও যেখানে গোত্র-গোষ্ঠী-কাবিলায় পরস্পর প্রচ- বিভেদ, ফিলিস্তিনিরা তখন অসংকোচে তুলে ধরতে পারেন আরব জাতীয়তাবাদের গর্বিত পতাকা। মাহমুদ দারবিশ লেখেন–
‘আমার নাম লিখে নাও,/ আমি একজন আরব/ পেশায় পাথরভাঙ্গা সঙ্গী-সাথীদের সাথে/ রুটি বানানো, জামাকাপড় আর বই/ ছেলেপুলেদের জন্য। জেনে রাখো/ কোনোদিনই দাঁড়াব না তোমাদের দরজায় ভিখারীর মতো।’ [পরিচয়পত্র। অনুবাদ: সিদ্ধেশ্বর সেন]
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন জন্ম দিয়েছে একজন অসাধারণ প্রতিভাবান কবির। তিনি ফাদোয়া তুকান। চিত্রকল্প এবং প্রতীকের বহুপ্রভ ব্যবহারে বর্ণাঢ্য তাঁর কবিতা।
স্বদেশকে প্রকাশ করার অনেক উপমা আমরা লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন কবিতায়। কিন্তু ফাদোয়া তুকান এমনকি স্বদেশের সমান্তরাল মেনেছেন পাতালে শিকড়বিস্তারী বৃক্ষকে। তাঁর কবিতায় বারবার বৃক্ষের চিত্রকল্পে আসে–
‘ফিলিস্তিন/ নবীন পল্লবের নির্যাসে জারিত তোমার মূল/ হে প্রিয় বৃক্ষ, ফিলিস্তিনের বৃক্ষরাজি/ যে অমর, মৃত্যুহীন। তারা পাহাড় পেরিয়ে প্রবেশ করেছে গভীরে।/ তারা খুঁজে নিয়েছে তাদের পথ/ পরিব্যপ্ত হয়েছে ধরিত্রীর গভীরে/ বৃক্ষ, হে বৃক্ষ/ তুমি বেঁচে উঠবে আবার।’ [প্লাবন ও বৃক্ষ। অনুবাদ: তহমিনা চৌধুরী]
ফাদোয়া তুকানের অন্য একটি কবিতা–
‘কেননা তোমার ধুলালুণ্ঠিত আশার মধ্য থেকে/ ক্রুশ কাঠে বেড়ে ওঠার মধ্য থেকে/ চুরি করে নেওয়া হাসির মধ্য থেকে/ শিশুদের হাসি থেকে/ ধ্বংসরাশি থেকে,/ অত্যাচারের থেকে/ রক্তের দাগে লাঞ্ছিত যত দেয়ালের সারি থেকে,/ জীবন ও মৃত্যুর/ সব শিহরণ থেকে, উদগত হবে জীবন/ [চিরদিনের প্যালেস্টাইন। অনুবাদ: শঙ্খ ঘোষ]
১৯৭৭ সালে বিশ্বসভায় স্বীকৃত হলো ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের ন্যায্যতা। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মঞ্চে দাঁড়ানোর অনুমতি পেলেন ইয়াসির আরাফাত। চিরাচরিত ফেদাইন পোশাকে সজ্জিত, আবেগ আর আত্মবিশ্বাসের সৌরভ ছড়িয়ে আরাফাত বলেছিলেন– ‘এক হাতে সংগ্রামের অস্ত্র, আরেক হাতে শান্তির জলপাই শাখা নিয়ে আমি এসেছি আপনাদের সামনে। আমাকে জলপ্ইা শাখা ফেলে দিতে বাধ্য করবেন না।’
একই সুর ধ্বনিত হয় আনতোয়াই জারার কবিতায়–
‘এই এসেছি আপনাদের কাছে/ খোলা হাতে পারাবতের সার/ আর আমাদের স্বদেশ, প্যালেস্টাইন/ নিদ্রাজাগর, সদা সমুৎসুক/ অপেক্ষমাণ দশক দশক জুড়ে/ এখন বড় ব্যস্ততার কাল/ হাতের মুঠোর এই জলপাইয়ের ডাল/ হারিয়ে যেতে দেবেন না আপনারা।’ [ শান্তির নদী ও যুদ্ধের কামান। অনুবাদ: সুলতান আহমেদ]
 
০৬.
দুঃখকষ্টময় আর্তি, বিলাপ, পরাধীন জীবনযাপনের অভিশাপ, স্বজন হারানোর শোক, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, আশাভঙ্গের বেদনা– সবকিছুর চিহ্ন পাওয়া যাবে ফিলিস্তিনি কবিতায়। কিন্তু নেই হতাশা। হতাশার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে ফিলিস্তিনি কবিতায়।
এখানেও ষড়যন্ত্র, কণ্টকময় পথ। তবু নিশ্চিত– নিজেদের ভূখণ্ড, নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাবেই ফিলিস্তিনিরা। এই আশাবাদের সত্যতা ছড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনের ইতিহাসের গভীরে, রক্তসিক্ত মরুপাথরের প্রতিটি ইঞ্চিতে। আর সে কারণেই ফিলিস্তিনী এক নাম-না-জানা কবি উচ্চারণ করেন–
‘তোমার অশ্রুভেজা চোখ আর রক্তাক্ত হাতকে বলো/ রাত্রির অন্ধকার যাবে কেটে/ রইবে না কোনও বন্ধন আর বন্দীশালা।/ অতলে হারিয়েছে নীরো, কিন্তু রোম বেঁচে আছে আজও। তার চোখের আগুনে পুড়ে/ একটি যবের শুকনো ছড়া থেকে/ ঝরে পড়া বীজে/ লক্ষ সবুজ শীষ/ মাথা তোলে প্রান্তরে।’
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত