সহজিয়া কবিতার গভীর গমনে আজকের কয়েকজন কবি
কবির অভিপ্রায়টা ঠিক কী?
“ কবি হবেন দ্রষ্টা, নিজেকে তিনি বানাবেন দ্রষ্টা। নিজেকে তিনি দ্রষ্টা বানাবেন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের এক দীর্ঘ বিশাল আর সচেতন ভ্রষ্টতার ভেতর দিয়ে। সব রকমের প্রেম, কষ্ট এবং উন্মাদনার মধ্য দিয়ে। কবি নিজেকে খোঁজেন। নিজের ভেতরের সব বিষকে তিনি খরচ করে ফেলেন, রেখে দেন শুধু তাদের নির্যাস। অকথ্য অত্যাচার করেন নিজের ওপর, যেখানে তার সমস্ত বিশ্বাস প্রয়োজন, সমস্ত অমানুষিক ক্ষমতা, যেখানে তাকে হয়ে উঠতে হয় সমস্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় রোগী, বিশাল অপরাধী এবং অভিশপ্ত একজন। আর, বিশাল পন্ডিত। কেননা, তিনি পৌঁছতে পারেন অজানায়।“ ( আর্তুর র্যাঁবো, চিঠি)
দেড়শো বছর আগেকার ফরাসি কবির বলা এই বাক্যগুলি থেকে আমরা অনেক সময়েই বেরোতে পারিনি। আজো আমাদের কাছে কবিতার সংজ্ঞায়নের অনেকটাই এই ধারায় চলে। যদিও আমাদের চন্ডীদাস বিদ্যাপতিরা কখনো বলেননি কাব্যের সংজ্ঞা। হ্যাঁ বলেছেন বটে আমাদের সংস্কৃতিতে আরো আগেকার কেউ । আনন্দবর্ধন অভিনবগুপ্তের মত আলংকারিকেরা। কোন অজ্ঞাত লেখকের ( মত অতুলচন্দ্র গুপ্তের) লিখিত ধ্বন্যালোক-এর বৃত্তির লেখক আনন্দবর্ধন, আর ধ্বন্যালোকের ভিত্তিতে লোচন লিখেছিলেন অভিনবগুপ্ত। দুজনেই কাশ্মীর উদ্ভুত। রসাধারিত কাব্য নিয়েই তাঁদের আলাপ আলোচনার কথা যখন অতুল গুপ্ত মশায় লেখেন তাঁর কাব্য জিজ্ঞাসায়।
এই বইতেই আমরা পাই, তর্কের হাত কতদূর যায়, কাব্য কী তার আলোচনায় বার বারই জল ঘুলিয়ে যায়। কোনটা কাব্য আর কোনটা নয়, তা নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণ চলে। প্রথমে ভাবা হয় অলংকারই কাব্য, কিন্তু আলংকারিকদের সে প্রস্তাব নাকচ হয়। তখন ওঠে কাব্যের রীতির কথা । যাকে ইংরেজিতে বলা হয় স্টাইল। অলংকৃত পদ মাত্রেই কাব্য নয়, আবার কাব্যমাত্রেই অলংকারপ্রধান নয় ( অলংকারবিহীন কাব্যও হয় বইকি) তাই বলা হয়েছে, রীতিরাত্মা কাব্যস্য। বিশিষ্টা পদরচনা রীতিঃ। পদরচনার বিশিষ্টতাই রীতি। আর রীতি কাব্যের আত্মা। আবার এই রীতিবাদীদের নাকচ করে বলা হয়, রমণীদেহের লাবণ্য যেমন তার অঙ্গসংস্থান ও অলঙ্কারের বাইরে কিছু, তেমন কাব্যেও আছে অতিরিক্ত কিছু। এই অতিরিক্ত বস্তুটি কি, যা ভাল কাব্যকে ভাল কাব্য করে?
এর উত্তরে এসেছে বাচ্যের কথা। কাব্যের বক্তব্যের সৌন্দর্য না থাকলে যত অলংকৃতই হোক তার কোন মূল্য নেই। ভাবের বিশিষ্টতা বা বক্তব্য বিষয়ের উল্লেখযোগ্যতা থেকেই কাব্যের মহত্ব ।
এ প্রবন্ধে আমার কোন উদ্দেশ্য নেই অতুল গুপ্তের বইটিকে পুনর্মুদ্রণ করার। এত কথার অবতারণা একটিই কারণে, যে, আজকের অনেক তরুণ কবির মধ্যেই কাব্যবোধ প্রখর ও তীক্ষ্ণ। একিসংগে তারুণ্যের চমক প্রবণতা তাদের নেই। উল্টোদিকে আছে এক স্মিত ও শান্ত অবয়ব।
অনেকেই আছেন, আমি কয়েকজনকে বেছে নিলাম। প্রসঙ্গক্রমে আমি সব পুরুষ কবিদের বেছেছি সচেতনে। মেয়েদের কবিতার সহজিয়া প্রবণতা নিয়ে আলাদা করে পরে আরো এক লেখা লেখবার বাসনা আছে।
একজন লেখক একবার বলেছিলেন, আমি গদ্য লিখি সর্বসাধারনের জন্য, প্রবন্ধ লিখি পন্ডিতদের জন্য, আর কবিতা লিখি নিজের জন্য।
কবিতার জন্যেই এই যে আলাদা তাকটা তৈরি করলেন, লেখক,
তিনি তো মূলাধারে কবিই।
আমরা দেখেছি, নিজে অনেকরকম লেখা লিখলেও, নিজেকে কবি বলেই পরিচয় দিতে ঢের ঢের বেশি পছন্দ করেন অনেক লেখক।
হয়ত মানুষ তাকে ছাপ দিয়েছে অন্য কিছুর।
কেন কবিতার জন্য এই একটু বাড়তি, তুলে রাখা ভালবাসা? কেন এত মায়া আমাদের, কবিতার প্রতি? যার বাজার মূল্য, সর্বজনগ্রাহ্য ভাবেই, সবচেয়ে কম, প্রায় ব্যস্তানুপাতিকভাবে যার পাঠকপ্রিয়তা হ্রাস পায়, যত বেশি কবি হয়ে ওঠেন মুখচোরা ও আত্মচারী?
গভীরতম, গোপনতম কথাগুলি কবি লেখেন তাঁর কবিতায়, এবং হ্যাঁ, সত্যিই নিজের জন্য।
জনগণের জন্য লেখা কবিতাকে ঠিক কবিতা বলেই মনে হয় না। সেগুলোকে কেউ কেউ বলেন অকবিতা, কেউ কেউ বলেন পদ্য, কেউ কেউ পোস্টার।
জনগণ অবশ্য সেগুলোকে কবিতা ভেবেই ওয়াটস্যাপে ওয়াটস্যাপে শেয়ার করেন। তাতে দোষও কিছু নেই। শব্দ তো, হাজার হোক, পেটো বা চোরাই মদ তো নয়।
তবু, কিছু কবির মন খারাপ হয়, কেননা তাঁর কবিতা এতটাই গোপনচারী শব্দমালা যে এভাবে বহু জনে জনে শেয়ার হবে না কোনদিন।
মুশকিল হল, কবিতার এই বিশেষ জায়গা, এর মূলে ঠিক মানুষের কোন অনুভূতি কাজ করছে, তাকে তুলে রাখার এই অদ্ভুত বাসনা, শেয়ার না হলেই তাকে ভাল ভাবার মতই, দুর্লভের আনন্দ, এগুলো বোঝানো প্রায় অসম্ভব।
ঠিক যেমন অসম্ভব, বলা, একজন মানুষ কেন কবিতা লেখে।
ইন্টারনেটে দেখেছি ‘হাউ টু রাইট পোয়েট্রি ‘দিয়ে গুগলালেই একগুচ্ছ সাইট বেরোয়ে। আচ্ছা তাহলে কবিতা শুধুই কারুকর্ম বা স্কিল?
নাহ, আমার তা মত নয়। আমার মতে, কবিতাপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যাতীত। মগজের নানা কোণা থেকে নানা স্মৃতি অনুষঙ্গ অ্যাসোসিয়েশন এসে যায় শব্দ আকারে। আর সেটাকে আন এডিটেড ভাবে বসান কোন কোন কবি। যত বেশি যুক্তি শৃঙ্খল তত বেশি কবিতার হত্যা, এভাবেই হয়ত তথাকথিত আধুনিক, ইভোকেটিভ, অনুষঙ্গপ্রধান কবিতার কথা বলা যায়।
কবিতাকে খুলে খুলে আবার জোড়া দিয়ে দিয়ে বোঝার নিবিড় সন্ধানী চেষ্টায় আমাদের অন্ধ বিশ্বাস যায় না। এই বিষয়ে আমার জানা এক অনেক পুরনো গল্প বলি। এক কারিগর জন্ম ইশতক লেখাপড়া না শিখে, মোটরসাইকেল ও স্কুটার শিখেছে। সে তার শিক্ষানবিশি করেছে যন্ত্র সারাবার কারখানায়। ধরা যাক সেটা একটা স্কুটারের কারখানা। বাইকের কারখানা।
লোকটা আজন্ম যন্ত্র শিখেছে, যন্ত্র পড়েছে, বাইক জুড়েছে, বাইক বলেছে।
ইয়ামাহা স্কুটারের প্রতি তার লোভ একটাই কারণে। ওটা সে ভাঙা পায়নি, ওটা সে জোড়া দেয়নি। তাই ইদানীং একটু টাকা হাতে পেয়েই সে একটি ইয়ামাহা স্কুটার কেনে। না, তাতে সে চড়ে না, চালায় না সে স্কুটার টা।
সে শুধু প্রতি অংশ খোলে, নাটবল্টু এবং সমস্ত জোড়। খুলে খুলে এই স্কুটারকে পরিণত করে একটি যন্ত্রাংশের জাঙ্ক-এ।
তারপর আবার জোড়া দেয়।
জোড়া দিয়ে যেটা পায় তাকে কি আর অবিকল আগের ইয়ামাহা স্কুটারটা বলা যায়? এটা একটা দার্শনিক প্রশ্ন।
তবে এভাবে খুলে ও জোড়া দিয়ে অনেকে শিখে যায় আরো একটি ইয়ামাহা তোইরির ছক ও সিদ্ধি। যদি ভেতরের ম্যাজিক হাপিশ হয়ে যায়, তাহলে বলব , আসল ইয়ামাহার ম্যাজিক তার করায়ত্ব নয়।
এখানে ইয়ামাহা শব্দটির জায়গায় কবিতা শব্দটি বসান পাঠক। কবিতাকে খুলে ও জোড়া দিয়ে সেভাবেই কি কবিরা আয়ত্ত করেন তাঁদের শিল্প?
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
কবি নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এত কথা বলতেই হল, কারণ তার চারটি বইয়ের পুঙ্ক্ষাণুপুঙ্ক্ষ পাঠের মধ্যে আমি দেখেছি নির্মাল্যের কবি অভিপ্রায়কে। সে বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবে, অলংকারের আগে তার বিষয় ধরা, বিষয় বাছা, সবটাই এক সচেতন মনীষার কাজ। আর এই মণীষা একভাবে প্রাচীনতম ভারতীয় কাব্যের ধারার সঙ্গে যুক্তও থাকতে চায়। কখনোই সে ঐতিহ্য বিচ্যুত নয়, ছন্নছাড়া নয়, এমনকি সে কোনভাবে সমস্ত ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা নতুন ধুমধাম তোইরি করতে চায়না।
এখানেই নির্মাল্য, নির্মাল্য। এখানেই সে দ্রষ্টাও বটে।
সেকারণেই তার বই ‘আগামী জন্মের লতাপাতা’র উৎসর্গ পত্রে লেখা হয়, আমার শিকড় , আমার দেশ। সেজন্যেই সে তার দ্বিতীয় বই ‘রক্তগন্ধার লিপি’-র প্রথম কবিতায় চায়, “সিগারেট রাংতার মতন আমার এই নেশ আযে চাঁদকে অথবা লিপিকে কবিতাবস্তু করে একদিন ঠিক পাঠিয়েই দেবে আমার গ্রামের ঠিকানায়। গ্রাম মানে এই মরাঘাট এত জঙ্গল উলঙ্গ হয়ে গল্প শোনাবে আমার মায়ের কাছে। “
চারিদিকের ধ্বনিত কোলাহলের দিকে সম্পূর্ণ বধির কান ফিরিয়ে যেন নির্মাল্য বসে আছে। কবি নির্মাল্য পড়লে এরকমই মনে হয় আমার। সে ইচ্ছা করেই মুখ ফিরিয়েছি রংচং থেকে, আলোকোজ্জ্বল নতুন দিনে র বর্ণমালা থেকে। তাকে তো লিখতে হবে আবহমানের বাংলা কবিতাই।
সে তাই লেখে, আগামী জন্মের লতাপাতার “দূরের প্রণত “ কবিতাটিতে, “আমাদের কবিতার কাছে আমরা সবাই প্রণত হয়েছি। / শান্ত। কোথাও গহন, মৃত্যুময় জল পড়ার শব্দ / শুনতে পাই। কখনো শুনেছি কি এমন স্বনন, পুনর্জন্মে? /…আমরা সবাই শহরে ও গ্রামে এইসব কুঁড়েঘরে কবিতার/ বুকে গাঁথা হয়ে আছি; প্রণত হয়েছি আরো। “
হাড় দিয়ে তোইরি করে
ব্রহ্মা বলেছেন তুমি নারী
তোমাকে দিলাম এই ফল
শুরু হোক আদমসুমারি।
( আপেল, এইসব নিষিদ্ধ গান)
প্রথম বইয়ের অনেক কবিতাই অতিক্ষুদ্র, কিন্তু ক্ষুদ্রতার ভিতরে অত্যন্ত যত্নে করা কারুকার্যের মত দর্শন ও চিত্রকল্প পাচ্ছি ।
আর একটিঃ
এই ক্লান্ত নৌকার তলায় সারারাত জেগে থাকে জল
এই ঘট ভেসে যায় দূরে, নির্জীব হয়ে থাকে জল
সবুজ আঁধার আজ বালিশ ধরল চেপে দুই বুক জল
এই আগুনের শব হয়ে পুড়ে যাওয়া একা
কান্না লুকিয়ে ফেলে – জল। ( জল, এইসব নিষিদ্ধ গান)
বরং চাষ ও বাসের কথা লেখ
লেখ সর্বসহা পৃথিবীর কথা,
বরং মাতি ও শস্য ফলনের
আনন্দতির কথা লেখ, বরং
নিজেকে নিজের আবিষ্কার করার
সেই প্রথম শব্দটি লেখ – ওঁ
( জন্ম, রক্তগন্ধার লিপি)
আগামী জন্মের লতাপাতায় লিখছেন নির্মাল্য,
এই শহর ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন
এই মানুষ ধ্বংস করবে নিজেকে স্বয়ং
গর্ভিণী স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি আগাম আশ্রয়ের খোঁজে
সন্তর্পণ ভুলে গেছি, দূরে ইস্পাত কাটার ধ্বনি
ইটের গাম্ভীর্য হয়ে মনে পড়ে কবে কোন
অতীত পতন আমাকে ফিরিয়ে নিয়েছে ওগো শহর
তোমার ঘৃণায় আমরা ভেবেছি এইখানে হৃদয় নেই
জল নেই, জলের কলের নীচে মুখ পেতে
দুটি দুইজন কেবল পাথর, শহর! শহর!
শহর বনাম গ্রামের গল্পে নির্মাল্য গ্রামকেই বেছে নিতে থাকলেন ক্রমাগত। এর আগের কবিতাতেই তিনি বললেন,
‘আমাকে ধারণ করো’ – হে পাহাড়, গভীর সবুজ
‘আমাকে নির্দেশ দাও’ – এই আর্ত ভূমি
…
মাটির বালক আমি জন্ম পেলাম
অমোঘ পেলাম গুরুভার (একশো পৃথিবীর মুখ)
মনে পড়ে যায় মণীন্দ্র গুপ্তর কবিতা, মনে পড়ে দেবারতি মিত্রের কবিতা। যোগ, শান্তি, ওম, পাহাড়চূড়ায় একাকী মন্দির, জল, হাওয়া, প্রকৃতি, প্রকৃতি। এসে পড়ে লেখাগুলিতে। মনে পড়ে অনিতা অগ্নিহোত্রীর কবিতাও। না পাওয়া মানুষ, গরিব মানুষ, সার দিয়ে এসে বসে পড়েন এই সব কবিতায়। তাঁদের সব ঐশ্বর্য নিয়ে এসে বসে পড়েন।
মনে পড়ে মুজিবর আনসারি বা শোভন ভট্টাচার্য বা সমসাময়িক অনেক কবির কবিতায় শিকড়সন্ধান, বাংলাভাষার ভেতরের সাংস্কৃতিক সব চিহ্ন উদ্যাপন।
‘লুলো মাহাতোর একদিন’ একটি অসাধারণ কবিতা, ওখানে এই প্রাকৃতিকতার কথা কী চমৎকার উঠে আসে নির্মাল্যর লেখায়, যা একইসঙ্গে একটি নৈতিক দায়িত্বের মত সমাধা করেন তিনি।
নাবাল দেশের উপর বর্ষা নেমে এল।
আমি বৃদ্ধ লুলো, মাঠ থেকে তাড়া আলু
নিয়ে আসছি ঘর…।
…
কুয়াশার বড় পিন্ড চোখে লেগে ফুলে গেছে তারা
কালো আরও কালো হয়ে গেছে মুখ
যেমন বিজলি ধরে কলাপাতা মেঘ –
তেমনই বিষাদ চেপে জ্বর লাগছে আমার,
এখন চুটায় আগুন দিয়ে, দেখছি –
স্বপ্নের ঝিঙা উচ্ছা শশা এই রাতের বাগানে
বর্ষায় যেন ছেলে –মেয়ে, খেলছে চাঁদের উপর,
ছোট ছোট হাত যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে নরম কপাল।
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়
একদা এক কবিতা-অনুষ্ঠানে আলোচনা হয়েছিল, কবিতা কাকে বলে।
বিখ্যাত অনেকের মধ্যে বিখ্যাততম উক্তিটি করেছিলেন তারাপদ রায়। বলেছিলেন, কবিতা কী, এই নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন আগের কবিরা। কেউ কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। সুতরাং আমি বরং এ আলোচনায় নীরব থাকব, বাড়ি ফিরে আর দুটি কবিতা লিখব। হাসির গল্পও লিখতে পারি।
সত্যিই কিছু শব্দ সংকলনই কবিতা নয়, কবিতা নয় মৃত শব্দের এলোমেলো কংকালের আবর্জনামাত্র। অথচ, কোন লেখায় কতটা কবিতা আছে, তা মাপার কোন থার্মোমিটার নেই। সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে শ্লেষচ্ছলে বাংলাদেশের কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ উল্লেখ করেন কবিতা আলোচনার কয়েকটি নির্দিষ্ট পন্থার দিকে, আমাদের চিরাচরিত কবিতা আলোচনার পথটিও সেরকমই পূর্ব নির্ধারিত। দুলাইন লিখে তিন লাইন উদ্ধৃতি।
অথচ সত্যিই কি কবিতা আলোচনার যোগ্য? কাকে বলে কবিতা, কী এই নিয়ে বইয়ের পর বই আছে, পাতার পর পাতা আলোচনা আছে। তথাপি, শেষ সিদ্ধান্ত বলে কিছু হয়না। বরঞ্চ কবিতার সংজ্ঞা দিতে দিতে কবিরা পৌঁছে যান নানা উপমা রূপকে, যা নিজেই কবিতার ধারক… অর্থাৎ সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করতে করতে সংজ্ঞার থেকে আরো দূরে সরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
মাঝে মাঝে এই সংজ্ঞায়নের বিফলতা থেকেই , হয়ত সিদ্ধান্ত করা হয় যে কবিতা প্রায় ঐশ্বরিক এক অস্তিত্ব, যার প্রতি বিশ্বাস বা ধর্মীয় আনুগত্য জরুরি।
সেন্ট টমাস অ্যাকিনাস-এর একটি উক্তি তাই মানিয়ে যায় এক কাব্যগ্রন্থের শুরুতেঃ
যার বিশ্বাস আছে, তার প্রয়োজন নেই ব্যাখ্যার। যে অবিশ্বাসী, তার জন্যে কোন ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়।
এই উক্তি দিয়ে যে কাব্য গ্রন্থের সূচনা, দেখা যাক সেই ‘জলবিষুব জংশন ‘ এ কবি শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কবিতা কীভাবে ধরা দেয়? তা কি আনে মহাপৃথিবীর কথা, ইতিহাসকে কেটে ফালাফালা করে, নাকি, মর্ত্যধুলো মাখা একেবারে তাৎক্ষণিকের কথাই বলে?
“আমি আর ঈশ্বর বড় এক গাছের নীচে বসি/ এখনো অনেক আসবাব বানানো বাকি/ হেমন্তের বিকেলে ছায়াপথ দিয়ে রিকশা যায়”
সম্ভবত প্রকৃত কবিতার নিকটবর্তী হবার একটু একটু একটু করে কয়েক পা হাঁটার নামই কবিতা,মনে হয় এই কবিতা পড়লে। কবিতা মর-মানুষের অমরত্বইচ্ছার কথা বলে, এভাবেও সংজ্ঞায়ন হয়েছে জানি, তাই মনে হয় ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন খুব প্রিয় এ কবির। ‘হেমন্তের পোস্টার’ কবিতায় আবার সেই কথা… “শীতের আগে পর্ণমোচী অরণ্যে যাই আমি ও ঈশ্বর/ প্রতিটি গাছের গায়ে সাঁটা ‘সন্ধান চাই’ পোস্টার/ কে কাকে সন্ধান করে বারবার?/ দুজনে হাত দিয়ে ছুঁই হেমন্তের পোস্টার/সন্ধান চাই পোস্টারের নীচে বসে থাকি আমি ও ঈশ্বর/ এক লক্ষ নক্ষত্র ফুটে ওঠে আমাদের কোলে/ আমাদের হয়তো কেউ খোঁজে পর্ণমোচী বনে/ শুধু পাতা ঝরে পড়ে আমাদের বিপন্ন সাইকেলে”
অথবা ‘স্তব’ কবিতায়,
এই তো সেই সব জলপাইকাঠের আসবাব/ যা আমি আর ঈশ্বর সমস্ত হেমন্তকাল ধরে তৈরি করেছি
চার্মিং, চার্মিং… মাথার মধ্যে বিড়বিড় করে বলি এই কবিতা পড়ে। আর বুঝি, শুধু বিষয়ের মধ্য দিয়ে এ কবি ঈশ্বরের সামীপ্য চাইছেন না, তাঁর সামীপ্য কবিতার আরো নানা ঈশ্বরের সঙ্গে… র্যাঁবো থেকে বিনয় মজুমদার থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় মৃদুল দাশগুপ্ত অব্দি বিস্তৃত তাঁর বন্ধুদের সংখ্যা। শক্তির হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান অবধারিত অনুষঙ্গে যেমন আসে, তেমন আসে জলপাইকাঠের এস্রাজ, মৃদুলের। আর তারো আগে, র্যাঁবোর , বিখ্যাত চিঠিতে তাঁর শিক্ষককে লেখা, ‘আমি হলাম অন্য কেউ। কী দুরবস্থা সেই কাঠের টুকরোর, যে হঠাৎ দেখে, সে হয়ে উঠেছে বেহালা।‘
নিজেকে অন্য কেউ করে তোলাটাই একজন মানুষের কবি হয়ে ওঠা, এভাবেও ভাবা চলে হয়ত বা।
সবাই তো জানে আমি আর ঈশ্বর খুব মিশুক নই
তেজপাতার বস্তা থেকে ঘ্রাণ নেই তেজপাতা ও অবয়বের
অসমাপ্ত এস এম এস করি, মোবাইল হারাই ছায়াপথে
কথা বলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাই ( তেমন মিশুক নই)
ক্রমাগতই, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা, তাঁর শব্দচয়নের অত্যন্ত সমকালীনতার পাশাপাশি, ধারাবাহিক বাংলা কবিতার সূত্রগুলিকে সংকলন করতে করতে যায়, আর আমাদের আক্রান্ত করে, নিয়ে চলে এক ঘোরের মধ্যে। এটাই ত যে কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে সবচেয়ে বড় পাওয়া।
রাজদীপ রায়
রাজদীপ রায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধের আলো’ পড়তে শুরু করেই সেই একই অনুভূতি , কবি সর্বদাই হতে চাইছেন অন্য কেউ, কখনো সেই অন্য বুদ্ধ তো কখনো কৃষ্ণ… তার চারপাশের নারীপুরুষেরাও কখনো প্রপিতামহী তো কখনো মঙ্গলকাব্যের দেবী। এ কবিতা খুব নিচু স্বরে কথা বলে ( এই নিচু স্বর অনেক পড়া, অনেক দেখা আজকের কবির অনিবার্য স্বর, সব ঔদ্ধত্য ও অহংকার সরিয়ে রোজকার ডেলিপ্যাসেঞ্জারের মত এক গসাগু কষা নিচু স্বর আমরা অর্জন করেছি আজ)…”সামান্য গল্পের কাছে/ হাঁটু মুড়ে শুয়ে থাকি/একদিন অসামান্য হব বলে” (বুদ্ধদেব)
রাজদীপের প্রিয় বিষয় মৃত্যু, প্রিয় বিষয় প্রাচীন সাহিত্যের চরিত্ররা, পুরাকাল ও মিথপুরাণ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অথবা মঙ্গলকাব্য, যে কোন আধারকে ধরে নিয়েই রাজদীপ কবিতা লেখেন…
মৃত্যু বলে যদি কিছু থাকে তবে এই পতঙ্গের/ ঘ্রাণ। যা এখন বাঙ্ময়, যা দিয়ে এখন পুজো / হবে। হোম আরতির পর পুরোহিত এসে দরজা/খুলে বলবেন, যা – তোর হয়ে গেছে, তুই রোদ্দুরে যা…( ছদ্মবেশ)
এই কবির নিজস্ব মৃত্যুচেতনা এরকম : “ আকাশ দু’ভাগ করে উড়ে যাচ্ছে নিষাদ রোদ্দুর/ এইমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে মারার কারণে তার মুখে/রাধাভাব।“ ( মাথুর)
‘মহালয়া’ কবিতায় এক সুবিপুল বিস্তার পায় তাঁর এই মৃত্যু ও ধারাবাহিকতা চেতনা।
“পিতৃতর্পণের দিনে পূর্বপুরুষেরা ছাই খুঁজতে আসেন
বসতবাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে, চেনা চা দোকানে…তিনি দেখছেনঃ তাঁর লাগানো
তুলসিগাছটা আর নেই – যে আরামকেদারায়
বসে রোদ্দুর মাখতেন, সেটা বারান্দার এক কোণে
বর্গী আক্রমণ হয়ে গেছে…। … সেই হাওয়ায় তিনি ফিরে যান…
বাড়ির নতুন বউ স্বপ্নে দেখে বাবা এসেছেন।
চা খাচ্ছেন, সঙ্গে এক জামবাটি মুড়ি-চানাচুর…”
মগ্ন এক পারিবারিক নস্টালজিয়া বিধুরতা আমাদের ছেয়ে ফেলে, তুচ্ছ হয়ে ওঠে অসামান্য।
স্নেহাশিস পাল
অনেকগুলো মুখ, কান্না, হাসি, ভাবনা নিয়ে। অস্পষ্ট। অনেকগুলো হাত, কবিতা লিখছে। ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্যগুলো শুরু হচ্ছে, অনুভূতিগুলো লিপিবদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু পুরোটা হচ্ছে না। কমপ্লিট সেনটেন্স হচ্ছে না। কেউ তার কথা শেষ করতে পারছে না । কেউ শেষ কথাটা বলছে না।
কিন্তু মন, শেষ কথা খুঁজবই বা কেন? শেষ কথা নেই, শেষ কথা হয়না। কবিতা শেষ কথা বলবে কেন? সেটা তো তার কাজ নয়। কবির তো কাজ নয় জীবনকে ব্যাখ্যা করা, জীবনকে ভাষ্য করা? কবির তো কাজ জীবনযাপনটাকেই কবিতায় অনুবাদ করা।
আবার শুধু সেটাই কি? প্রত্যাশাও কি থাকবে না কবির কাছে, ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে বেঁধে তুলে নেওয়ার? জুড়ে জুড়ে একটাই বড় ছবি তৈরির? অথচ সেইসব “কবিতা-কবিতা” কবিতারা হয়না আজকাল। সেটাই তো কনফিউশন রে , মন! কবি ঈশ্বর, কবি স্রষ্টা, এসব ঘেঁটে গেছে। কবি দ্রষ্টা হলেও, খন্ড দ্রষ্টা। চলচ্চিত্র না, বায়োস্কোপ বাক্সের মত। হালকা জলছাপ ছবির মত। এইসবের ভেতর দিয়ে বাংলা কবিতা কোথাও একটা যাচ্ছে হয়ত।
বুঝলি মন,কবিতার বই, পড়তেই গেলেই আমার প্রশ্ন , এটা আদৌ বই হয়ে উঠেছে কিনা। না কি কয়েকটা কবিতার এক সংকলন শুধু । স্নেহাশিস পালের ‘জোনাকির মুকুট’ একটা পৃথিবীর মত বই। নিরুচ্চার এক শান্ত পৃথিবীও। এক কবিকে আদ্যোপান্ত খুঁজে পাচ্ছি এখানে। ভাষা আগে, না যাপন আগে, বোঝবার আগেই কোথা দিয়ে যেন এগিয়ে যায় লেখাগুলো, পথ করতে থাকে নিজেরাই। ‘অন্ধ বাউল অভয়ারণ্যের ওয়াচ টাওয়ারের মত গোধূলি ডেকে আনে…’ পড়লে বোঝা যায় এই কবির পায়ে অনেক ধূলো…। ‘শীত নেমেছে দিগন্ত জুড়ে, /পাড়াপড়শিরা সন্দেহের আলো জ্বেলে বসে থাকে,/বন্ধুরা – শুধু ঝরাপাতা মাড়ানোর শব্দের মতো জানান দেয়, তারা আছে…’ এই আশ্চর্য প্রদেশে এভাবেই পথরেখা আঁকা থাকে স্নেহাশিসের। ‘মাথার উপর দু’একটা তারা দেখা যায়,/ ওরা যেন পোস্টকার্ড হয়ে চলে গেছে/ কান্নার দেশে, পোস্টম্যান শুধু প্রদীপ হয়ে যায়-‘ । সেভাবে দেখলে একটিই দীর্ঘ কবিতা লেখা থাকে বই জুড়ে। সেখানে আদি কাল থেকে ফেরিওয়ালা, চাষি, বোষ্টমি ও যুবক দইওয়ালারা আসে যায়, ‘মা ভগবতী উনুনে আঁচ বসিয়ে যান স্নানে/ একটু পরে বসুন্ধরা মাতবে রন্ধনে।‘…
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় লেখেন ‘মাটির পাখি উড়ন্ত পাখা’। কবি নিজেকে এইভাবে বিবরণ করেন, ‘আমার অনুশোচনা আমার জীবন/ আমার উত্থান…পতনের অব্যবহিত পরেই/ আমার জীবনীশক্তি ইয়েতির কাছ থেকে নেওয়া’… বেশ আশা জাগে। ‘জীবদ্দশা শব্দটি এলিয়ে আছে বালিশের গায়ে/ দুটি জুলজুলে চোখ তাকিয়ে রয়েছে/ কখন খাবার দেবে কাজের মহিলা/’ এই সব পংক্তিমালা চমকে দেয়, কবিকে ক্ষণিক দ্রষ্টাই মনে হতে থাকে। কিন্তু একইসঙ্গে, মন রে, আবার
ঝাপসা হয়ে যায় কবির চোখ। পরের কয়েক লাইনেই হয়ত মুহূর্ত-ধরার ওই ম্যাজিক হাওয়া হয়ে গেল পুরো, খুব মামুলি পংক্তিরা ভিড় করল। হতে হতেও , পুরোটা যেন হয়না। কেন যেন, একটু তাড়াহুড়ো থেকে যায় কোথাও।

কবি,কথাসাহিত্যিক