রুটিনে থাকুক যোগাসন
আজ ২১ জুন বিশ্ব যোগ দিবস। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য রইলো যোগাসন দিয়ে কিছু জানা অজানা তথ্য ও ভিডিও। সবাই সুস্থ ও নিরোগ থাকুন।
শরীরের সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটিয়ে আত্মিক উন্নতি ও শরীরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যোগাসনের বিকল্প নেই। যোগ শব্দের অর্থ দেহ ও মনের প্রগাড় সংযোগ বা ঐকান্তিক মিলন। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ বা মিলনকে যোগ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে বিধিসম্মতভাবে অঙ্গ সঞ্চালনই ব্যায়াম। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষেরই সুস্থ থাকার জন্য কিছু না কিছু যোগ ব্যায়াম করা দরকার । বলতে হয়, ‘সুষম খাদ্য খাও, যোগাসন কর, লাইফ স্টাইল পাল্টাও, টেনশন (স্ট্রেস্) মুক্ত জীবনযাপন কর।’ টেনশন বা স্ট্রেস্ থেকে মানুষের যে কত রোগ হতে পারে এবং আয়ু কমে যেতে পারে আধুনিক বিজ্ঞানীরা তা অনেকভাবে দেখিয়েছেন। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ থেকে শুরু করে প্রায় সকল রোগের গোড়ায় রয়েছে মানসিক চাপ। যোগাচার্যদের মতে যোগাসনের মাধ্যমে সবচেয়ে কার্যকরি উপায়ে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
যোগাসনকে অনেকে যোগ ব্যায়াম বলেন। আসন আর ব্যায়ামে কিছুটা পার্থক্য আছে। ব্যায়াম হচ্ছে খেলাধুলা, সাঁতারকাটা, হাঁটা, জগিং, সাইক্লিং, জিম, এ্যাক্রোবিক ইত্যাদি। খালি হাতে ব্যায়াম করা যায় আবার যন্ত্রযোগেও ব্যায়াম করা হয়। এর মাধ্যমে অঙ্গ সঞ্চালন হয় বটে। এতে যেমন দ্রুতি আছে তেমন শারীরিক পরিশ্রমও আছে। শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক পূর্ণ প্রশান্তির জন্য যোগাসনের বিকল্প নেই। বলা হয়, জগিংয়ে দশভাগ উপকার হয়, টেনিস খেলায় হয় পনেরো ভাগ, সাঁতারে হয় পনেরো ভাগ। কেবল যোগাসনের মাধ্যমে এক শ’ ভাগ উপকারিতা পাওয়া যায়। যোগাসন ছাড়া এমন কোন ব্যায়াম নেই যাতে শরীরের অস্থি সন্ধিতে এবং ফুসফুস, প্লীহা, পাকস্থলী, মূত্রথলী, যকৃৎ, বৃক্ক ইত্যাদি অন্ত্রে ভালভাবে রক্ত সঞ্চালন হতে পারে। যোগাসন ছাড়া এমন কোন ব্যায়াম নেই যাতে মেরুদণ্ডে আড়াআড়ি আর লম্বালম্বী চাপ পড়তে পারে এবং মেরুদণ্ড দুইদিকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে। যোগাসন শরীরের প্রয়োজনীয় গ্রন্থিগুলোকে অধিক সতেজ ও সক্রিয় করে তোলে। তাই যোগাসনকেই সর্বোত্তম বলে ধরা হয়।
আসনের উপকারিতা
১) দেহের নমনীয়তা বাড়ায়।
২) দেহ ও মনের সমতা রক্ষা করে।
৩) অবাঞ্চিত চিন্তা মনে আসতে দেয় না ।
৪) সূক্ষ্মতর ও উচ্চতর সাধনার জন্য মনকে প্রস্তুত ও সাহায্য করে।
৫) গ্রন্থিগত ত্রুটি দূর করে আর গ্রন্থিরস ক্ষরণে সমতা আনে।
এইভাবেই আসনের মাধ্যমে বৃত্তি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় ।
আসনের নামকরণ
ক) কিছু কিছু আসনের ভঙ্গিমা প্রাণীদেহের বিশেষ চলাফেরার মতো। তাই তাদের নামকরণ সংশ্লিষ্ট প্রাণীটির নামানুসারে রয়েছে যেমন – মৎস্যমুদ্রা, গরুড়াসন ইত্যাদি ।
খ) কিছু আসন প্রাণীর- সংরচনার বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবের সমান। তাদের নামকরণ সে অনুযায়ী হয়েছে, যেমন- কুর্মাসন, শলভাসন (শলভা মানে পঙ্গপাল) ইত্যাদি।
গ) কিছু আসন বিশেষ গুণসম্পন্ন হওয়ায় তাদের নামকরণ সেভাবেই হয়েছে। যেমন-সর্বাঙ্গাসন। এতে সমগ্র দেহযন্ত্র উপকৃত হয়।
ঘ) কিছু আসন যিনি প্রথম আবিষ্কার করেছেন তার নামানুসারে হয়েছে। যেমন: মৎস্যেন্দ্রাসন (যোগী মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক আবিষ্কৃত)। এই আসনটিও সমগ্র দেহযন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
আসন প্রধানত দুই প্রকারের-স্বাস্থ্যাসন আর ধ্যানাসন। স্বাস্থ্যাসনের অভ্যাস করা হয় মূলত দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্য আর কিছু করা হয় আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য। ধ্যানাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মনের একাগ্রতা আর সাধনা। ধ্যানাসনের উদাহরণ হলো- পদ্মাসন, বদ্ধ পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, বীরাসন।
এই দুই প্রকারের মধ্যেই আবার বহুসংখ্যক আসন আছে। যোগীরা সব মিলিয়ে ৫০,০০০ আসন ভঙ্গি আবিষ্কার করেছেন। কোন আসন করলে কী উপকার হয় বা কোন আসন কার করা উচিত একজন যোগাভ্যাসকারীর পক্ষে বুঝে ওঠা অসম্ভব। তাই আসনের ক্ষেত্রে একজন অভিঙ্গ আচার্যের মূল নির্দেশনা অপরিহার্য। আচার্যের বিনা নির্দেশনায় আসন অভ্যাস করলে উপকারের চেয়ে বিপদের ঝুঁকি থাকতে পারে।
যোগাসনের নিয়মিত অভ্যাস সুস্থ ও সবলভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে আপনাকে সফলতা পেতে সাহায্য করবে ঠিকই, তবে সফলতার জন্য চাই সঠিক নিয়মে যোগাসন অভ্যাস। তাই চলুন যোগব্যায়াম শুরু করার আগে জেনে নেওয়া যাক যোগাসনের নিয়মকানুন নিয়ে বিশদ আকারে।
সুস্থ থাকতে যোগাসনের নিয়মকানুন
০১. ৫/৬ বছর বয়স থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যোগ ব্যায়াম অভ্যাস করা যায়। শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী কয়েকটি আসন বেছে নিতে হবে। সব বয়সে সব রকম আসন করা যায় না। অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের কোন আসন দুইবারের বেশি করা ঠিক নয়। ছেলেদের ১৪/১৫ বছর বয়সের পূর্বে আর মেয়েদের ঋতু প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত প্রাণায়াম ও মুদ্রা অভ্যাস করা উচিত নয়।
০২. সকাল, সন্ধ্যা ও স্নানের পূর্বে বা রাতে যেকোনো সময় যোগ ব্যায়াম করা যায়। তবে সে সময় যেন ভরপেট না থাকে। অল্প কিছু খেয়ে আধ ঘন্টা পরে আসন করা যেতে পারে, কিন্তু প্রাণায়াম বা মুদ্রা খালি পেটে অভ্যাস করাই বাঞ্ছনীয়। প্রাতঃক্রিয়াদির পর আসন করা ভালো। তবে যাদের কোষ্ঠবদ্ধতা, পেট ফাঁপা প্রভৃতি রোগ আছে, তারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিছানায় কয়েকটি নির্দিষ্ট আসন ও মুদ্রা করতে পারে।
৩.যাদের অনিদ্রা রোগ আছে, রাতে খাবার পর শোবার পূর্বে কিছুক্ষণ বজ্রাসন করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ভরপেট খাওয়ার পরও কিছুক্ষণ বজ্রাসনে বসলে খাদ্য হজম বা পরিপাকক্রিয়া সহজতর হতে পারে।
০৪. আসন, মুদ্রা বা প্রাণায়ামে একটি ভঙ্গিমায় বা প্রক্রিয়ায় একবারে যতটুকু সময় সহজভাবে করা যায় বা থাকা যায়, ঠিক ততটুকু সময় করা বা থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে কোন ক্ষেত্রে কয়েকটি নির্দিষ্ট আসন ছাড়া একবারে এক মিনিটের বেশি থাকা উচিত নয়। পদ্মাসন, ধ্যানাসন, সিদ্ধাসন ও বজ্রাসনে ইচ্ছেমতো সময় নেওয়া যেতে পারে।
০৫. একবারে ৭/৮ টির বেশি আসন অভ্যাস করা ঠিক নয়। আসনের সঙ্গে বয়স অনুযায়ী ও প্রয়োজন মত দু’একটি প্রাণায়াম, মুদ্রা অভ্যাস করলে অল্প সময়ে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়। এক একটি আসন বা মুদ্রা অভ্যাসের পর প্রয়োজন মত শবাসনে বিশ্রাম নিতে হবে। ৫ /৭ মিনিট খালি হাতে কিছু ব্যায়ামের পর আসন বা মুদ্রা করলে ফল খুব দ্রুত পাওয়া যায়। কিন্তু কোন শ্রমসাধ্য কাজ বা ব্যায়ামের পর বিশ্রাম না নিয়ে কোন প্রকার যোগ ব্যায়াম করা উচিত নয়। সপ্তাহে একদিন বিশ্রাম নেয়া উচিত।
০৬. আসন অভ্যাসকালে জোর করে বা ঝাঁকুনি দিয়ে কোন ভঙ্গিমা বা প্রক্রিয়া করা ঠিক নয়। আসন অবস্থায় মুখে যেন কোন বিকৃতি না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
০৭. আসন অভ্যাসকালে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু মুদ্রা বা প্রাণায়ামে নিয়মানুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
০৮. কম্বল, প্যাড বা পাতলা তোষকের উপর আসন অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়। শক্ত মাটি বা পাকা মেঝেতে অভ্যাস করলে যেকোনো সময়ে দেহে চোট লাগতে পারে।
০৯. আলো-বাতাসহীন বা বদ্ধ ঘরে যোগ ব্যায়াম অভ্যাস করা ঠিক নয়। এমন জায়গায় অভ্যাস করার চেষ্টা করতে হবে, যেখানে বায়ুর সঙ্গে প্রচুর অক্সিজেন নেয়া যায়।
১০. ১২/১৩ বছরের উপর এবং ৪৫ /৪৬ বছরের নীচে (স্বাস্থ্যানুযায়ী বয়সসীমা কম-বেশি হতে পারে) মেয়েদের স্বাভাবিক কারণে মাসে ৪ /৫ দিন কোন আসন করা ঠিক নয়। তবে ধ্যানাসন, শবাসন প্রভৃতি অভ্যাস করা যায়।
১১. মেয়েদের ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবা হলে তিন মাস পর্যন্ত কিছু সহজ আসন বা প্রাণায়াম করা যেতে পারে, কিন্তু মুদ্রা অভ্যাস একেবারে করা উচিত নয়। সন্তান প্রসবের তিন মাস পর আবার ধীরে ধীরে সব আসনাদি অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়। গর্ভাবস্থায় সকাল ও সন্ধ্যায় খোলা জায়গায় পায়চারি করা বিশেষ উপকারী।
১২. আসনাদি অভ্যাসকালে এমন কোন পোশাক পরা উচিত নয় যাতে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
১৩. যোগ-ব্যায়াম অভ্যাসকালে কথা বলা বা অন্যমনস্ক হওয়া ঠিক নয়। কারণ মনের সঙ্গে দেহের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যোগ ব্যায়ামের মূলমন্ত্র। একাগ্রতাই অভীষ্ট ফল এনে দিতে পারে।
১৪. যোগ ব্যায়ামে তাড়াতাড়ি ফল পাবার আশা করা ঠিক নয়। এতে বিশ্বাস ও ধৈর্য্যের একান্ত প্রয়োজন। নিয়মিত ও নিয়মমতো যোগ-ব্যায়াম অভ্যাসে সুফল আসবেই।
১৫. যদি তামাকের অভ্যাস বা মাদসাক্তি থাকে, বর্জন করুন।
১৬. যতটা সম্ভব মন প্রফুল্ল রাখা বাঞ্ছনীয়। কুচিন্তা বা দুশ্চিন্তা যেন মনে না আসে।
এই তো জানা হয়ে গেলো যোগাসনের নিয়মকানুন । তাহলে এবার যোগব্যায়াম শুরু করে দিন যোগাসনের নিয়মকানুন জেনে আর নিজের উপর আস্থা রেখে এগিয়ে যান। সফলতা আপনার হাতের মুঠোয়।
.