আফ্রিকার তরুণ প্রজন্মের তিনটি নির্বাচিত কবিতা
ভাষান্তর: মঈনুস সুলতান
ভূমিকা: উপনিবেশোত্তর আফ্রিকায় কবিতাচর্চার সৃজনশীল পরিসর যেমন নিত্যদিন প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি সৃষ্টি হচ্ছে আনকোরা সব শৈলীও। তরুণ প্রজন্মের কবিরা বিষয়বস্তু নির্বাচন ও প্রকাশভঙ্গিতে নিয়ে এসেছেন নতুনত্ব। দু-চারটি কবিতার বিচ্ছিন্নভাবে ভাষান্তরের ভেতর দিয়ে এ প্রবণতাসমূহের প্রতিনিধিত্ব করা দুরূহ। এ সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থেকে তিনজন কবির তিনটি অনুদিত কবিতা উপস্থাপিত হচ্ছে।
কবিতা তিনটি ‘নিউ-জেনারেশন আফ্রিকান পোয়েটস্’ নামক একটি ফোরামের উদ্যোগে পরিচালিত সম্পাদনা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরীক্ষাধর্মীতা, শৈলী ও শিল্পগত মান প্রভৃতি বৈশিষ্টকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
‘দেয়াল’ শিরোনামের প্রথম কবিতাটির রচয়িতার ধমনীতে আফ্রিকার শোণিত থাকলেও তিনি মূলত আফ্রিকান ডায়োসপোরার সন্তান। তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী জীবনের টানাপোড়েন। ‘ভিন্ন বিশ্বে’ শিরোনামের কবিতার রচয়িতা রাসাক মালিক নাইজেরিয়ার অধিবাসী। তাঁর পদাবলীতে ফুটে ওঠেছে যুগপৎ নির্মম সমাজবাস্তবতা সঞ্জাত উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষ। ‘ চলছে এরকমই’ শিরোনামের তৃতীয় কবিতার রচয়িতা আলেক্সিস্ তেইয়ি‘র নিবাস কেনিয়ায়। তাঁর পদাবলীতে প্রাধান্য পেয়েছে উত্তরাধূনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
কবিতা তিনটির অনুবাদের সাথে কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও যুক্ত করা হলো। এগুলোর সূত্র হচ্ছে ‘ নিউ-জেনারেশন আফ্রিকান পোয়েটস্ : অ্যা চ্যাপবুক বক্স সেট ।’ ভূমিকা, কবিদের বায়ো-বিষয়ক তথ্য এবং কবিদের ছবি প্রভৃতি ইন্টারন্যটের বিবধ সূত্র থেকে নেয়া হয়েছে।
কবি পরিচিত:অমোতারা জেমস কবিতা চর্চার সাথে সাথে প্রবন্ধও রচনা করেন। নিউইয়র্ক শহরে অধ্যয়নরত এই কবির ধমনীতে বইছে নাইজেরিয়া ও ত্রিনিদাদের মিশ্রিত শোণিত। কবিতা রচনার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি লাভ করেছেন ‘ব্রিজিং দ্য গ্যাপ এওয়ার্ড ফর ইমারর্জিং পোয়েটস্,’ও ‘লুমিনেয়ার এওয়ার্ড’ প্রভৃতি পুরষ্কার। তাঁর রচনা ‘রিক্লুস’, ‘উইন্টার টানজারিন’, ‘কসমোনাটস্ এভিন্যু ‘, প্রভৃতি জার্নালে সচরাচর প্রকাশি হয়ে থাকে।
বিকেলবেলা— ব্রুসকে আমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছি
যেন আলমারির পাল্লা দুটি বন্ধ রাখে সে
কারণ বিড়ালছানাটি ইতিমধ্যে জেনে গেছে
বন্ধ দুয়ারটি হচ্ছে দেয়ালের মতো— যা বেয়ে উঠা যায় না
তোমাকে তা ভেদ করে হেঁটে যেতে হয়।
গতকাল আমি জেনিফারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম
আমি তোমার ওখানে আসবো
তারপর হলো কী— খুলে বসলাম তোমার ইন্সটোগ্রাম
চেষ্টা করলাম, খুঁজে পেতে শেষ ছবিটি,
যেখানে আমরা রকমারি সব পোষাক গায়ে দিয়ে দেখছিলাম
যে রকম আমি সব সময় আমার মা এর সঙ্গে থাকি
যিনি আমাকে সত্য খুলে বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,
বিশেষ করে— যখন ব্যাপারটি ছিলো না তেমন শোভণ
মনে পড়ছে এক দিনের কথা— শপিং মল থেকে ব্যাগ-ভরতি ব্রা কিনে
ছুটে এসে চলন্ত সিঁড়িতে মা এর হাত মুঠোয় নিয়ে
তাঁর কাঁধে রেখেছিলাম মাথা
মাত্র দশ বছর বয়সের মেয়ে আমি—
কিন্তু মা আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন
লোকজন আমাদের আবার সমকামী ভাববে তো—
কোন কোন সময়— ভোর চারটার দিকে,
যে রকম বিড়ালছানাটি আঁচড় কাটে আলমারির বদ্ধ দরোজায়
ঠিক সে রকম আমার পাকস্থলী গরগর করে ওঠে
ছানাটি ভেদ করে যেতে পারে না কাঠের অন্তরায়
প্রতিটি গৃহে একটি কামরা সম্পূর্ণ আজানাই থেকে যায়।
আরো পড়ুন: শ্যারন ওল্ডসের পাঁচটি কবিতা । সায়মা মনি
কবি পরিচিতি: নাইজেরিয়ার তরুণ কবি রাসাক মালিক বর্তমানে ইবাদান নগরীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তাঁর কবিতা সচরাচর ‘মিশিগান কোয়ার্টারলি রিভিয়্যু’,‘পোয়েট লোর,’স্পিলওয়ে’,‘র্যাটোল,’ ‘কনোটেশন প্রেস,’‘গ্রে স্প্যারো,’ প্রভৃতি জার্নালে প্রকাশিত হয়ে থাকে।
ভিন্ন বিশ্বে ফের যদি জন্মাই, তাহলে হতে চাই এমন এক পিতা
যার সন্তানাদির দুর্দশায় পাগলপারা হয়ে সারাক্ষণ পালন করতে হবে না শোক,
যাকে হামশো মোকাবেলা করতে হবে না এমন পরিস্থিতির
যেখানে জায়নামাজের মতো ভাঁজ করা সন্তানদের নিঃসাড় দেহ
বাড়িতে ফিরে আসার ঘটনা দৈনন্দিন এক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়াবে।
বাস্তুহারা স্থানীয় লোকজন হন্যে হয়ে খুঁজছে আশ্রয়স্থল—
এ রকম এক জন্মশহরের গল্প আমি প্রতিরাতে বলতেও চাই না।
আমি চাই এমন একটি বসতবাড়ি— যার দেয়ালে থাকবে না গোলাগুলির কোন চিহ্ণ
দেখতে চাই— আমার সন্তানেরা তার আঙিনায় মাদুর পেতে খেলছে নিরিবিলি,
পর্যবেক্ষণ করতে চাই, আমার শিশুরা আমার জন্মভূমির নাম
প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করতে করতে বেড়ে উঠছে,
বুনো জন্তুদের মতো হিংস্রতার শিকার না হয়ে আমার শিশুরা সরণীতে নিরাপদে ঘুরে বেড়ানোর যেন সুযোগ পায়,
তারা যেন পরিণত না হয় খুনজখমের লক্ষবস্তুতে।
ভিন্ন এক বিশ্বে আমি চাই আমার সন্তানেরা পোষ মানাক মাঠের গঙ্গাফড়িং,
তারা যেন বৈঠকখানায় বসে পুতুল খেলতে পারে,
তারা যেন হাওয়ায় ভেসে আসা ফুলের সুরভীতে নিঃশ্বাস নিতে পারে,
দেখতে পায়— পাখিরা তাদের প্রসারিত ডানায় করে নিচ্ছে আকাশের মাপঝোক।
কবি পরিচিতি: কেনিয়ার নারীবাদী কবি আলেক্সিস্ তেইয়ি এর প্রধান প্রকাশমাধ্যম কবিতা, পাশাপাশি তিনি গদ্য ও শিশুসাহিত্য রচনা করে থাকেন। বেশ কতগুলো সাহিত্যসংকলনে তাঁর কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি কবি অন্য এক লেখকের সঙ্গে সহরচয়িতা হিসাবে ‘শর্টকাট’ নামে একটি শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ‘এনকোয়ার’ নামে একটি সাহিত্য সাময়িকীর কবিতা বিভাগের সম্পাদক হিসাবেও কাজ করছেন।
যে রাতে ছেড়ে চলে গেলে তুমি,
আকাশ জুড়ে বিষ্ফোরিত হয়েছিল অজস্র তারকা,
পোড় ছিল তারা দগদগে ক্ষতের মতো।
আকাশিয়ার যে ঝোপঝাড় বিক্ষত হয়েছিল ব্যক্তিগত যুদ্ধ বিগ্রহে
তাদের শাখা প্রশাখা নিষ্পত্র হয়নি এখনো।
বিপুল বেদনাবোধের উত্তাপে আমি হয়ে ওঠিনি চরমপন্থী কোন
আমার পদ্ধতি হচ্ছে— যা কিছু ঘটেছে আমার আগে
এবং যা উত্তরাধিকারসূত্রে ধারণ করে আছি আমি,
সে সম্পর্কে সচেতন থাকা।
যা আমি অনুভব করি— আমার সম্বিতে তা থাকা উচিত সবসময়
তেমন নতুন কিছু আমি বলছি না
অনুসরণও করছি না আনকোরা ভিন্ন কোন মার্গ।
আমার উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাগুলো আগের মতোই আছে
পরিবর্তন হয়নি তেমন কোন
যেমন— চা কী এত ঠান্ডা হয়েছে যে পান করা রীতিমতো মুশকিল?
জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে কবিতা ও গল্প লিখছেন। হালফিল লিখেছেন কিছু ভ্রমণ-ভিত্তিক আলেখ্য। প্রাচীন মুদ্রা, সূচীশিল্প, পান্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো দিনের মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।