| 7 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১৫) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

কিসসা ৬

একটা সবজেটে শহর, যার অলিগলি জুড়ে বাগানে ঘেরা ছোটবড় বাড়িঘর, সেই সব ছেড়ে চলে এলাম পৃথিবীর কেন্দ্রে। ঠিক হাওড়ার মতোই যেখান থেকে সবখানে যাওয়া যায়, কিন্তু ফিরে আসতে হয় সেখানেই। আসার সময় কী ভীষণ দুঃখ ! স্কুলের দিদিমণিরা বললেন, আবার এসো কিন্তু। দেখা করে যেও। পাড়ার মাসি পিসি কাকা মামা দিদা দাদু জেঠিমা জেঠু, সকলে মুখে দুঃখ মেখে রেখেছে। কেন যে তোরা চলে যাচ্ছিস !

ট্রেনে উঠলেই একরকম ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে। স্থবিরতা নেই। চলমান একটা সময়। দুধারে চলছে জীবন। জানলা দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে পলকে পাল্টে যাওয়া ছবি। কে থামে? কেউ থামে? চলতেই হয়। চলার লাবডুব শব্দ রেলগাড়ির সঙ্গে তাল মেলায়। আমার দুঃখ প্রকাশ করা হয়না। দুঃখে বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু তা ছবি হয়ে ওঠেনা। মন খারাপ। কিন্তু কেন, সেটা বুঝতে পারিনা। শুধু দেখি মুখোমুখি বসে বাবা আর মা। দুজনের মুখের ওপর দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে দুঃখের কুয়াশা।

নতুন শহর কিন্তু নতুন নয়। জন্মেছি এখানেই। রক্তের ধারা নিয়ে বেঁচেছি কটা বছর। তারপর হঠাৎ অন্য শহরে যাওয়া। আবার ফিরে আসা। সেই শহর আমাকে প্রথমেই টেনে নিলো। কী ভীষণ গতি তার ! কোনো ছবি চোখের সামনে ভাসতে না ভাসতেই উধাও। কিছু চোখ মেলে বেশিক্ষণ দেখতে পাবোনা। মিলিয়ে যাবে দৃশ্য।

স্কুলে ভর্তি হতে কদিন অপেক্ষা করতে হবে। তার মাঝে পুরোনো সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্ক একবার ঝালিয়ে নেওয়া। বল তো কে আমি? মনে পড়ছে না? জানি ত। বাবা আনে না, সম্পর্ক রাখে না যে। ছটফট করে সরে আসি।

তারপর একদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো, নাঃ, বেরিয়ে পড়ি। ছোট্ট দু বছরের ভাইয়ের হাত ধরে তার দশ বছরের দিদি বেরিয়ে পড়ল পথে। মা হাঁফ ছাড়ল। ঘরের কাজ সেরে নেওয়া যাবে। হাঁটছি এক নতুন গলিতে। যার মাঝ দিয়ে ট্রেন নয়, ট্রেনের মতো, ট্রাম চলছে। দুপাশে অজস্র দোকানের পসরা। আর সিনেমা হল। গৌরী সিনেমা ছাড়া এর আগে দেখিনি এরকম। এই দেখলাম। কী ভিড় সব সিনেমা হলের সামনে ! হাঁটতে হাঁটতে অনেক এগিয়ে গেছি। দেখি পায়ের তলায় ফুটপাতে লেখা ‘দর্পনা’। ফেরার পথ ধরলাম।

বাড়ি ঢুকে দেখি মা ভীষণ চিন্তায় পড়েছে। এত গাড়িঘোড়া চারদিকে।

আমি আবার ফুটপাতে খেলা দেখানো সেই জাদুকরকে ডাকতে থাকি। গিলি গিলি গে গিলি গিলি গে। ফিরে এসো ছবি। ওই যে দেড়শো খোকার কাণ্ড দেখেছিলাম না? ইস্কুল থেকে নিয়ে গিয়েছিল কি? মনে পড়ে না। জাদুকর তার বিরাট জোব্বা থেকে নেড়ে নেড়ে সাতরং রুমাল বের করে আনে। সে যত নাড়ায় তত ছবি জেগে ওঠে। আমি আনন্দে ভাসতে থাকি। ওই ত দিলীপ নন্দী কাকু ঠাকুর বানাচ্ছে। ওই যে পাশের বাড়ির জেঠিমা হাসছে। সব স্থলপদ্ম তুলে নিলি? ওই দিদির বন্ধু রীতাদি দিদির কাঁধ ধরে কাঁদছে। কেন চলে যাচ্ছিস রে? আমার আনন্দ আমার দুঃখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ঠিক জাদুকরের সাতরং রূমালের মতো। নাড়তে নাড়তে যা কেবল সাদা হয়ে যায়। আমার মনে পড়ে। প্রিয়মুখ কি কেউ সাদা চাদরে ঢেকেছিল?

আমাকে জাগিয়ে দিয়ে জাদুকর ডেকে ওঠে, মা। তুমি আর কত ঘুমোবে? আমরা পৌঁছে গেছি ত! যেন অন্য জীবনে জেগে উঠি। এ যে আত্মজ!

শরতের আকাশের মতো নির্মল আর কিইবা আছে ! তুলো তুলো মেঘের ময়ূরপঙ্খী উড়িয়ে আকাশ ডাক দেয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসি। বিছানার পাশে রাখা চায়ের পেয়ালা। সেই গাঢ় বাদামী রঙের ননীর অমৃতবিন্দু দেওয়া চা। মা দার্জিলিং চা ছাড়া খেতে ভালোবাসেনা। আমি খুঁজে খুঁজে আনি। গ্রে স্ট্রীটের বীণা টি হাউস থেকে প্রথমে। তারপর স্কুলের পথে অরফ্যান টি থেকে। দোকানের মধ্যে জমাট অন্ধকার। বাইরে সর্পিল কিউ। অন্ধকারে ভেসে ভেসে আছে অগুণতি বিস্কুট রঙের পেটি। ওপাশের ভদ্রলোক আমার হাতের তেলোয় ঢেলে ঢেলে রাখছেন বিভিন্ন ধরণের চা পাতা। আমি গম্ভীর মুখে শুঁকে শুঁকে দেখছি। শেষে বলছি, ওই প্রথমে যেটা দিয়েছিলেন ওটাই। ভদ্রলোক প্রশ্রয়ের হাসি হাসছেন। হুঁ, তবে? আমি ত প্রথমেই সেরাটা দিয়েছি। পেছনের লোকে বিরক্ত হচ্ছে। এই খুকি, হলো? ভদ্রলোক ধীরে সুস্থে আমাকে চা পাতা দিচ্ছেন। ওমা ! সঙ্গে আবার ছোট্ট একটা প্যাকেট ! ও কাকু ! আমার কাছে আর পয়সা নেই ত ! ভদ্রলোক হাসছেন। একটু বিব্রত। ওটা নতুন এসেছে। এমনিই দিলাম। মা খেয়ে কি বলেন জানিও ত। আমি সংকোচে পা ফেলি। বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পাই। আপনার কেউ হয় নাকি? নাঃ, কেউ না। ওর মা চা ভালোবাসে বলে কেমন বেছে বেছে চা কেনে। কিচ্ছু জানেনা। তবু।

       একটা অমাবস্যার রাত্রে কংকালি তলা থেকে ফিরেছিলাম প্রান্তিকের বাসা ঘরে। ফিরতি পথে পৌষের কঠিন শীতে থেমেছিলাম প্রান্তিক স্টেশনে। সেদিন ওই স্টেশনকে সত্যিই মনে হয়েছিল শেষ প্রান্তস্টেশন। ধূধূ রুক্ষ প্রান্তরের খোয়াই ঢেউয়ের মধ্যে জেগে আছে একটা সাত হাত চওড়া আর বিশ হাত লম্বা প্ল্যাটফর্ম। মাঝে দুটো গাছ প্ল্যাটফর্ম ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই বেদী। বসা যায়।  আমি একটু চায়ের খোঁজে গেছিলাম। একটা ছোট্ট উনুন জ্বালিয়ে চা বিক্রি করছিল যে লোকটা তাকে আমার অদ্ভুত মনে হয়েছিল। চা বিক্রির চেয়েও ওই হাড় কাঁপানো শীতে ওর বোধহয় আগুনের উত্তাপ বেশি প্রয়োজন হয়েছে। নয়ত একমেবাদ্বিতীয়ম একটিমাত্র ক্রেতার জন্য সে ওই শীতের অন্ধকার রাত্রে স্টেশনে উনুন জ্বালিয়ে বসে থাকবে কেন? চা খেতে খেতে আমার অবিশ্বাসী মন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল – হ্যাঁ গো? তোমার চায়ের বিক্কিরি কেমন? সে কেমন একরকম হেসেছিল! উল্টে আমায় প্রশ্ন করেছিল – এখানে নয়া? অবাক আমি! কি করে জানলে? সে আবারো হেসেছিল। চা কেন গো? শুধু কি চা? ওই উনুনের তাত কি একা আমার? কেন পড় নাই? একজন আগুন জ্বাললে পাঁচজনে পোহায়! আমি ইদিকসিদিক চাই। পাঁচ কেন, একজনকেও ত দেখিনে।  সে তার ময়লা চাদরখানা পাক মেরে মেরে মাথা মুখ সব ঢেকে ফ্যালে। বলে – বসো দিকি। কংকালি হয়ে এলে আর রামীকে দেখতে পেলে না? ওই যে গগনজোড়া তারার চাদর সে ত সেই মেলেছে ! ওকে রোজ ধুতে হয় কিনা। সে আসবে আঁচ পোহাতে। সঙ্গে আসবে তার বাউল। সে ভারী দুঃখী কিনা। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আনতে হয়। সে তার ভ্রমরকালো চুলে আঙুল দিতে দিতে উদাস গায় – সই কেমনে ধরিব হিয়া।

আমি একমনে শুনতে থাকি। আর সত্যি সত্যি বিশালাক্ষীর ছেলে উদ্দাম ছুটে আসে। আমি তার নতুন পদের অনুভবে কাঁপতে থাকি। কে যেন আমায় চাদরে জড়িয়ে ধরে। বলে শীত করছে? আমি প্ল্যাটফর্ম থেকে রেললাইন দেখি। একজোড়া রেখা। কেউ কারো সঙ্গে মেলে না। অথচ পাশাপাশি চিরকাল। সে চাদরে ঢাকতে ঢাকতে গেয়ে ওঠে, সুখের লাগিয়া এ ঘর বান্ধিনু অনলে পুরিয়া গেলো।

চায়ের ভাঁড় এগিয়ে দিতে দিতে চা ওলা ডাকে,  ও বোস্টুমী এ নাও চা। ফিরে দেখি এক বাউলানি। তবে কি চা ওলা তার চণ্ডীদাস?  অনলে পুড়িয়ে রাখে হৃদয়বাসনা?

একটা প্ল্যাটফর্মের মাঝে লাল ইঁটের শক্ত দেওয়াল। তাতে ঠেস দিয়ে বসে আছে বুড়ো ভিখারিনি। তার শতচ্ছিন্ন ময়লা কাঁথার ওপরে রোদ্দুর পড়ে গৌরব দিচ্ছে। ওপাশের দেওয়ালে টুকরি নিয়ে বসেছে ফলওয়ালা। তার ফলের ঝুড়ি থেকে কমলালেবু দিয়েছে ভিখারিনিকে। সে পরম আদরে লেবুর কোয়া খুলছে। সামনে ঝুড়িতে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে অনাথ ছেলেটা দাঁড়িয়ে। ওর মোটা চশমার ভাঙা কাঁচে রামধনু রং। ও ওই দেওয়াল ভেদ করে যেতে চায় পৌনে দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। নাঃ, জাদুকর বলেছে কেউ দেখতে পাবে না। ওই আপাত অদৃশ্য প্ল্যাটফর্মে থাকবে সাদা ধোঁয়া তোলা একটা লাল রঙের রেলগাড়ি। তাতে চেপে বসলেই জাদুকরের বাড়ি। কাল রাতে স্বপ্নে যে দৈত্যের মতো লোকটা তাকে বলে দিয়েছিল সূলূক, সেই নাকি আসবে তাকে নিয়ে যেতে। ছেলেটা জানে সত্যিই ওই দেওয়ালের মধ্যে আসলে একটা অন্য পৃথিবী আছে। সেই যাদু পৃথিবীতে তার মরে যাওয়া বাবা মা এখনো বেঁচে। তার অপেক্ষায়।  তাকে তাই যেতেই হবে। এখানে এতদিন ধরে ও যাদের বাড়ি বাসন ধুতো, কাপড় কাচতো, তারা জানেই না যে ও আসলে একটা গরীব অনাথ দুর্ভাগা ছেলে নয়। জানলে ওরা কক্ষনো এভাবে ওকে দুঃখ দিতো না।


আরো পড়ুন:  অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১৪) । অনিন্দিতা মণ্ডল


ছেলেটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। বুড়ি ভিখিরি তার দিকে সন্দেহের চোখে দ্যাখে। কমলালেবু খেতে চায় নাকি এটা? আরেকটা ভিখিরি বাড়ল? বিপদ বড়! তাড়াতে হবে এটাকে। এমন সময় ফলওয়ালা ছেলেটার দিকে ফিরে তাকায়। প্রশ্রয়ের হাসি হাসে। বলে – যা রে ছেলে। দেওয়ালের ওপারে আছে অন্য পৃথিবী। তোর রেলগাড়ি অপেক্ষায় আছে। শিগগির যা। ছেলেটা ঝুড়ি নিয়ে সটান দেওয়ালে ধাক্কা দেয়। বুড়িটা অবাক চোখে দ্যাখে বাচ্চাটা গায়েব!

ওপারে তখন রেলগাড়ির কামরায় একটা সুন্দর ছেলে। তার বাবা মার কাছে চলেছে। এ পৃথিবীর সব ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে সে চলেছে অন্য রেলগাড়ি চেপে অন্য স্টেশনে।

ফলওয়ালার দিকে তাকিয়ে বুড়ি সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করে – ছেলেটাকে কোথায় পাঠালে? ফলওয়ালা গূঢ় হাসে। বলে,  সে খবরে তোমার দরকার কি? তুমি ত নিশ্চিন্ত। এখানে নতুন ভিখিরি আসেনি।

       রেলগাড়ি তখন বনের মধ্যে পাতা রেললাইন ধরে ছুটে চলেছে। নীচে তার নীল নদী ফেনা তুলে ছুটছে। বনের গায়ে পাহাড়জোড়া নানা রঙের ফুলের গালচে। কত কত সুস্বাদু খাবারের প্যাকেটে তার বার্থ ভরে গেছে! এত খাবার সে কক্ষনো খায়নি। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছে, এসব সত্যি নয়,  স্বপ্ন। এক্ষুনি ভেঙে যাবে। চোখ জলে ভরে উঠছে। আর তক্ষুণি সে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। আহা স্বপ্ন! স্বপ্ন তুমি বেঁচে থাকো। নইলে আমি কি নিয়ে বাঁচি !

একবার মরুভূমির কাছে গিয়েছিলাম। যত কাছে যাই তত বালুকণা উড়ে উড়ে চোখ মুখ ট্রেনের বার্থ সব ভরিয়ে দেয়। ভোরের নরম হাওয়া তখনও সূর্যের রক্তচক্ষুকে আড়াল করে আছে। তাই বুঝতে পারিনি মরুভূমি আসলে ঠিক কতটা নিষ্ঠুর কতটা প্রাণহীন। খুব দ্রুত কাঁচের জানালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। তবুও চেষ্টা করে দেখতে চাইলাম। কিচ্ছু নেই কোত্থাও। উঁচুনিচু ঢিবি ঢিবি জমির মাঝে মাঝে নাতিউচ্চ ছোট ছোট ঝোপ। অন্ধকারে বুঝিনি, কাঁটাঝোপই হবে নিশ্চয়। মন হাহাকার করছিল। চিরকাল প্রকৃতির বিচিত্র বর্ণ বিচিত্র ঢং আমাকে ভুলিয়ে রাখে। এ পৃথিবীতে যে দুঃখ আছে, সুখও আছে, হাসিকান্নার নির্দিষ্ট সময় আছে, প্রকৃতির মধ্যে সেসব ভুলিয়ে দেবার সমূহ আয়োজন আছে। কিন্তু একী ! এত নিষ্প্রাণ ! শুধু তাই নয়, কি ভীষণ বেআব্রু! কোথাও কোনো আড়াল নেই ! চারিদিক ধূধূ ! হঠাৎ যেন সমস্ত মন একেবারে বিকল করে দিলো। মা হাতে টান দিলো। নেমে চল। সকলে নেমে গেছে।

সেদিন সকাল হতেই দেখি চারিদিকে একটাই রং। আগুনের মতো সাদা। কি মাটি কি আকাশ সর্বত্র ওই এক রং। আকুলিবিকুলি করে উঠলো মন। ফিরে যাই বরং। আমার চলে যাওয়াই ভালো। কিন্তু কি একটা সুর নয়? চোখ বন্ধ করলে আমি শুনতে পাই ভালো। বন্ধ করলাম। শুনি কে যেন এদেশীয় বীণ বাজাচ্ছে। ভালো করে শুনতে থাকি। শুনতে শুনতে মনের মধ্যে একটা ছোট্ট নদী বইতে থাকে। বেশ শীতল লাগে। ক্রমশঃ সুর নিকটে আসে। চোখ খুলে ফেলি। দেখি ওমা ! কে যেন দুটো কাঠের খুঁটি পুঁতেছে। মাঝে একটা দড়ি। সেই দড়ির ওপরে সূর্যের সাতরং ঘাগড়া পড়ে একটা ছোট্ট মেয়ে দুদিকে হাত ছড়িয়ে হাঁটছে। বীণ বাজাচ্ছে এক পাকাচুলো বুড়ো। আমি অবাক ! এই নেইরঙের রাজ্যে ও এত রং পেলো কোথা থেকে? এগিয়ে গেলাম। মেয়ে তখন নেমে এসেছে। আমার দিকে চেয়ে হাসতেই বললাম, দড়ির ওপর হাঁটতে ভয় করে না? সে মাথা দুদিকে নাড়লো। না। করে না। সারা জীবন হাঁটতে পারি। বিষাদ গ্রাস করছে। দড়ির ওপর হাঁটতে হাঁটতে কখনো ত নেমে দাঁড়াতেও ইচ্ছে করে।

মা আবার ডাকে। ওরে ঘরে ঢুকে আয়। মরুভূমির দুপুর ভয়ংকর। গা পুড়ে যাবে। আমি তখন পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্র বলছি। তিনি বলছেন – কল্পনা করুন। আপনার মা তপ্ত বালুর ওপরে হাঁটছেন। আপনি তাঁকে পাদুকা দিন। মাথার উপরে সূর্য। আপনি ছত্র দান করুন। ছায়া দিন। আমি হাতজোড় করি। মনে মনে বলি, মা ছাতাটা সরিও না। স্বস্তি দাও। এখানে বড্ড রুক্ষ জীবন।  

       আমার কাছে কোথাও যাওয়া মানেই ফিরে আসা। সেই ছোট্ট থেকে আমি জানি, যে যেখানেই যাক না কেন ঠিক ফিরে আসে। গভীর রাত্রে যখন নিঝুম ঘুমে ডুবে আছি, সেই ছোট্ট আমিও একটি মাত্র টোকার আওয়াজে জেগে উঠতুম। জানলার খড়খড়িতে টোকা যতই মৃদু হোক তার অসীম ক্ষমতা। মা নিঃশব্দে উঠে যেতো দরজা খুলতে। ঘুমের মধ্যেই টের পেতাম বাবা একটা বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুলো। মা যে কেমন করে অত অন্ধকারে একটিও শব্দ না করে উঠে যেতে পারতো তা কে জানে ! আবার নিঃশব্দে পাশে এসে শুতো। আমি কাঠ হয়ে শুয়ে থাকতাম। ভোরের দিকে বাবা উঠে বাথরুমে যেতো। একবার আলগোছে কার যেন গায়ের চাদর ঠিক করে দিতো। কপাল থেকে অদৃশ্য চুল সরিয়ে দিতো। আমি ভাবতাম কখন সকাল হবে।

যার জন্য রাতের অর্ধেকটা জেগে জেগে শুয়ে থেকেছি সেই ছোটকা তখন রান্নাঘরের সামনে পিঁড়ে পেতে রাজ্যের গল্প জুড়েছে। মার মুখ থমথমে। হাসিতে যোগ দিচ্ছে না। গম্ভীর বাবা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অগত্যা আমাদের ভাইবোনেদের নিয়েই ছোটকা ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আমরা তখন সহজ পাঠের দেশে। ওর চেয়ে বেশি কিছুই বুঝি না।

সন্ধ্যের আগেই ছোটকা তৈরি। এবার অনেকদিনের জন্য যাওয়া। দিল্লি যাবো। কবে আসব আর বলতে পারি না। এবার বাবা মুখ খুলল – থানায় যেতে হবে একবার। আমি যাবো সঙ্গে। দারোগা বাবু আমাদের নাটকের দলের লোক। আমি বলেছি, আমার ভাই দারুণ ব্রিলিয়ান্ট। সে এসবের মধ্যে নেই। শুধু একবার দেখা করে যেতে হবে। ছোটকার মুখে অদ্ভুত হাসি। চোখটা অকারণ মুছে নিয়ে বলল – আচ্ছা সে হবে। খাওয়া দাওয়া সেরে দেখা করে আসব খন। বাবা অবাক। তুই যে বললি সন্ধ্যের গাড়ি? ছোটকা হাসল। কাল গাড়ি। আজ নয়। আজ অমলের বাড়ি থাকবার কথা ছিল। কিন্তু তুমি যখন এত ভয় পাচ্ছ তখন নয় থেকেই যাই। বাবা নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস ফেলল। তবে কাল সকালে দেখা করব।

সেদিন সন্ধ্যেয় ছোটকা মেতে উঠলো আমাদের নিয়ে। ঘোড়া হলো, ব্রহ্মদত্যি হলো, বেতাল হলো, অরণ্যদেব হলো। সাধ মিটিয়ে খেলে নিলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে মা বাবার মৃদু কথা শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ দরজায় ঝনঝন শব্দ। এত রাতে? ঘরের জোরালো আলো জ্বলে উঠলো। বাবা কে কে বলতে বলতে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা খুলতে গেলো। খোলা দরজা দিয়ে বাবাকে ঠেলে দিয়ে ঢুকে এলো গোটাকতক জোরালো টর্চ। বাবা হতবাক হয়ে দেখছে উর্দিপরা দারোগা ও তার লোকজন তছনছ করছে ঘরদোর। – কি হলো? –ভাইটি কই? দেশের ভালো করবে আপনার সেই ভাইটি? বাবার চোয়াল ঝুলে পড়ছে। মা আমাদের দু’হাতে জড়িয়ে বসে। ছোটকা কোথাও নেই।

সবাই চলে গেলে মাকে জিজ্ঞেস করল বাবা – হতভাগা কোথায় গেলো? মা ঠোঁটে আঙুল দিলো। দূরে একটা মেল ট্রেনের হুইসল বাজলো জোরে। ট্রেনটার চাকার আওয়াজ আর হুইসল আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো।

সেদিনের পর ছোটকার কথা কেউ জোরে জোরে বলতো না। চুপিচুপি আলোচনা হতো। তবু্ সকলের বিশ্বাস ছিলো, ট্রেনটা আবার ফিরিয়ে আনবে সেদিন রাতের সেই যাত্রীকে। সেই অনিকেত মানুষটা কিন্তু অসম্পূর্ণ রেখেছিল তার যাত্রা। আর কখনো ফিরে আসেনি।

সেইদিন থেকে বুঝেছিলাম সব যাত্রা ফিরতি পথে এসে শেষ হয় না। যতই বলি মৃত্যুর পর অসংখ্য জন্ম আছে, কিন্তু সেকথা সত্যি করে দেবার জন্য এখনো কেউ ফিরে আসেনি।

রওনা হতেই হবে। ওসব কারো ইচ্ছেতে হয় না। হঠাৎ একদিন দুটো চকচকে ইস্পাতরেখার ওপরে এক অদৃশ্য হাত দাঁড় করিয়ে দেয়। আর তারপর চলা শুরু। থামার সিগন্যাল এলে আপনিই ব্রেক কষবে।

যাত্রাই একমাত্র ধ্রুব। বাকি সব আপেক্ষিক। এসব দ্বেষ প্রেম ক্ষতি ধ্বংস সহানুভূতি সীমাসংঘাত জমি সম্পদ সব, সব আসলে আপেক্ষিক। আপেক্ষিক কথাটার সাদা মানে – মিথ্যে। যেমন পৃথিবীর অবিচ্ছিন্ন যাত্রা সত্ত্বেও ভেবে নিচ্ছি যে সে স্থির। আপেক্ষিক। মিথ্যে।

এরকম করে ভাবতে ভাবতে মাথায় অনেক কুয়াশা জন্মায়। তাহলে চলতে চলতে ফুরিয়ে যেতেই আসা? নক্ষত্রেরও একদিন নিভে যেতে হয়?

হয়। নিভে যাওয়া নক্ষত্র তখন স্থির। তার যাত্রাপথ তখন বহুদিনের পুরোনো পোড়ো স্টেশনের মতো বাতিল। আর তার কেন্দ্রে তখন জমা হয়েছে অসীম স্থৈর্য। ধ্যানী ঋষির মতো। সেই স্থিরতা তার চারপাশের অবিরাম গতিশীল অস্তিত্বগুলোকে টেনে আনতে থাকছে। ক্রমে তারা তার পরিধি ছাড়িয়ে কেন্দ্রে ঢুকে পড়ছে। আর তাহলেই তাদের অস্তিত্ব মিশে যাচ্ছে নিভে যাওয়া নক্ষত্রের মাঝে।

এরকম করে বাইরে ঘুরতে থাকা সক্কলে তখন শোক করতে শুরু করে। আহা গো ! বড় ভালো ছিলেন মানুষটা। চলে গেলেন ! তারা জানতেও পারছে না যে ওই নক্ষত্রের তখন চলার তাড়া নেই। সে শুধু ভিতরপানে পাড়ি দিয়ে চুপটি করে বসে। তার সব ইন্দ্রিয় এখন কাজ শেষ করেছে। কিন্তু সে নিভে গিয়েও ফুরিয়ে যায়নি।

মাঝে মাঝে কৃষ্ণ গহ্বর জানিয়ে যায় সে আছে। এই যে আমি, চরৈবেতি করছি প্রতিনিয়ত, এই আমার হাত পা একদিন কচ্ছপের মতো ভিতরে সাঁধ করবে। আমার প্রাণবায়ু মিশিয়ে যাবে। দেহ বিলীন হবে। কিন্তু চেতনা? সে সেই কৃষ্ণগহ্বর। যা প্রতিনিয়ত আমাকেই গিলছে একটু একটু করে। আর তারপর আমি নিভে গেলেও সে তার ইন্দ্রিয়াতীত অস্তিত্ব নিয়ে অনন্ত কাল ধরে ধ্যানে বসে থাকবে। মাঝে মাঝে তার কাছাকাছি যদি কেউ আসে তবে সে প্রবল বেগে তাকে তার কেন্দ্রে টেনে নেবে।

গতকাল স্বপ্নে ওরকম এক তারাকে দেখলাম। সে আমাকে স্বপ্নেও দেখা দিলো না। কিন্তু চোখের দেখার বাইরেও আমি তার অস্তিত্ব টের পেলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল মুখ ! এ তো আমার সেই দেড় বছরের ছোট ভাই ! সেই যে চলে গেলো একদিন! শোক স্বপ্নেও ধাক্কা দেয়। আর সেই শোকের মধ্যেও অনুভব করলাম ওই কালো মরে যাওয়া তারাটা আমাকে আকর্ষণ করছে।

যাত্রা শেষ হলে আমিও তো ওখানেই যাবো ! ওখান থেকেই যে শুরু হয়েছিল চলা ! তারপর অনন্তকাল মিশে থাকব তারার কোলে।

আমাদের ছোটবেলার বাড়িটার সামনে ছিল ধুধু মাঠ। ওই বয়সে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে যখন চারপাশ দেখতাম তখন সব কিছুকে খুব উঁচু খুব বড় লাগত। ঘরগুলো বিরাট। উঠোনটা কত্ত বড় ! আর মাঠটা যেন তেপান্তরের মাঠ। যার একদিকে পাঁচিলের পাশ দিয়ে চলে গেছে বড় রাস্তা আর অন্যদিকে ফলসার বিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশন। কখনও ঘুমন্ত মাঝরাতে হুইসেল দিতে দিতে বেড়িয়ে যেত মেল ট্রেন। আর সেই শব্দে ঘুমের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুরণন। যেন সেই ট্রেনের কোটরে আমরা মায়ের সঙ্গে চলেছি। মা কত বার বাবাকে বলছে – শুনছ, ভেতরে ঢুকে এসো। কিন্তু বাবা নির্বিকার সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে। একহাতে শুধু হাতলটা ধরা। আমি যেন সেই উন্মুক্ত চলমান ছবি দেখবো বলে গুটিগুটি মায়ের হাত ছাড়িয়ে বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আর বাবা আমাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখ গোল করে বলেছে এত অবাধ্য কেন তুমি? পড়ে গেলে কি হত? আমি বাবাকে বলতে পারি না – তুমিও তো মায়ের কথা শুনছ না। পড়ে গেলে কি হত বলো তো? বরং ঘুমের মধ্যে মায়ের পিঠের মধ্যে মুখ গুঁজে দিই। মা বুঝতে পারে ট্রেনের শব্দে আমার স্বপ্নচৈতন্য জাগছে। আমি মনে মনে মামার বাড়ি চলে যাচ্ছি। ওইতো কত রাত্রি ! কাঁচের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সরে সরে যাচ্ছে অন্ধকার। কখনও বা একটি দুটি হলুদ আলো। ফাঁকা ফক্কা লেভেল ক্রসিং। ঝাঁকড়া মাথা আরো অন্ধকার গাছেরা। এসবের মধ্যে সমানে সঙ্গে চলেছে চাঁদ। সে যেন ট্রেনে না উঠেও আমার যাত্রাসঙ্গী। ওই যে চাঁদের মধ্যে একটুকরো কালচে ছোঁয়া। ওইতো চাঁদের বুড়ি চরকা কাটছে। আমাকে যখন মা বলে “ওই যেদিন তুই জন্মালি সেদিন পৌষের কি শীত ! বাপরে ! কিন্তু তুই হলি দুপুর  একটা। কষ্ট হলো না আমার”। আমি ভাবি আমি হলাম? আমি জন্মালাম? তাহলে আমি চিরটি কাল এমন করে মায়ের গায়ের মধ্যে নাক মুখ গুঁজে ঘুমই না? এই সেদিন এসবের শুরু? ভয়ংকর দুঃখ হয়। ছোট্ট বুকটা মনে হয় ফেটে যাবে। মাকে আমি মাত্র সেদিন পেয়েছি ভেবে নিজের অসহায় অবস্থার কথা জেনে কেঁদে উঠি। আর ঠিক তখনই দাদি এসে জিজ্ঞেস করে কি হলো রে? কাঁদতে কাঁদতে বলি – আমাকে কোথা থেকে পেলে? দাদি চাঁদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়। ওই দ্যাখ চাঁদের বুড়ি চরকা কাটছে। তোর মা আর আমি এইখানে খাটিয়ার ওপর বসে ছিলাম। বুড়ি তখন তোকে ছুঁড়ে দিলো। তুই এসে তোর মায়ের কোলে পড়লি। ঠিক যেমন তোর মা আমার কোলে এসে পড়েছিল একদিন। আমি আনন্দে ভুলে যাই যে মা বলেছিল তুই হলি দুপুর একটায়।

ট্রেনের স্বপ্ন শেষ না হতেই একদিন মা আমাকে ঠেলে তুলল। উঠে পড়ে মায়ের সঙ্গে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মা বারান্দার পূব কোণে এনে আমাকে হাত দিয়ে দেখালো। একেবারে শেষ বাড়িটার পাঁচিলের গায়ের শিউলি গাছটা ফুল দিয়েছে। ভোর রাত্রে সেই ঝরে পড়া সাদা শিউলির বিছানা মাঠের ওপর এক অদ্ভুত সুররিয়ালিস্টিক ছবি তৈরি করেছে। আমি হাঁ করে দেখছি। মা বলল “গুগুল যা তো, ওই শিউলি কটা কুড়িয়ে নিয়ে আয়। শ্বেত পাথরের টেবিলটার ওপর সাজিয়ে দেবো”।

সেইদিন প্রথম স্বপ্নের ট্রেন আমাকে তারা ফোটা শিউলির সামনে নামিয়ে দিলো।

দিনের আলোর একটা অদ্ভুত দম্ভ থাকে। সে যেন চারিদিকের দৃশ্যমান জগৎকে সমস্ত গোপন কোণ থেকে তীক্ষ্ণ আলো দিয়ে প্রকাশ করে দিচ্ছে। কোথাও কোনো গোপনীয়তা নেই। রহস্যময়তা নেই। সব অকপট। ভালোবাসা, ভালো থাকা, স্নেহছায়া থেকে শুরু করে বিদ্বেষ লোভ মোহ সব যেন প্রকাশ্য দিনের আলোয় রাজপথে পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। এই হয়তো ভালোবেসে আজন্ম প্রতিবেশীকে বলছি, এই পৃথিবী তোমার আমার সকলের। আবার পিছন ফিরে লোভের এবং লাভের অংশীদারকে বলছি, ভাগাভাগি চলে কি করে? এ দেশ শুধু তোমার আমার।

 দিনের আলোর এই সীমাহীন দম্ভ কিন্তু মিথ্যে। সে দেখাতে পারে না মনের গহনে লুকিয়ে থাকা যাযাবর জীবনের মোহ। রাত নামলে আলো ফুরোয়। মনের মধ্যে নরম হলুদ প্রদীপের মতো আলো জ্বলে ওঠে। আর অদ্ভুত ! তখনই সেই আলোয় আমরা পরস্পরের মুখ দেখতে পাই। দেখি এক জীবন জুড়ে আমরা মুখোমুখি বসে আছি। আমাদের পায়ের তলায় কোনো শক্ত মাটি নেই। আমাদের মাথার ওপরে একমাত্র চিরন্তন আশ্রয় আকাশ। তাঁবুর মতই অট্টালিকাও গতিশীল। গুটিয়ে নিয়ে সময় পথ চলতে শুরু করে। কেউ কোনোদিন মাটি খুঁড়ে তুলে আনে জানলার কাঠ। আমরা রেলগাড়ির কামরায় মুখোমুখি বসে ভাবি, তাই তো ! তাঁবু তবে কবেই ছিঁড়ে গেছে ! তবু কি শেষ হয়? আবার নতুন নদীর পাড় খুঁজি। খুঁজি নতুন পর্বতের সানুদেশ। একা একা সংসার পাতি। এভাবেই নতুন নতুন গন্তব্যে পৌঁছে যাই।

এই যাত্রা তবু ফুরোয় না। পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণায়মান জগৎ আমার পায়ের তলার মাটিকে স্থির থাকতে দেয়না। আমি রাতের রেলগাড়ির কামরায় বসে জানালায় চোখ রাখি। সরে সরে যাওয়া ভুবন জানিয়ে দেয় সময় মতো স্টেশনে নেমে যেতে হবে। শেষ স্টেশন এলেই নামতে হবে।

আপাতত প্রতি রাতের এই প্রাণের খেলার পরে দিনের নতুন স্টেশনের অপেক্ষায় থাকি। অনেক মানুষের ওঠানামার ভিড়ে ক্ষণিকের থেমে থাকা রেলগাড়িকেই নিত্য সত্য ভেবে আরও একবার ভ্রান্তিবিলাসী হই।

তারপর …সব রঙ শেষ হলে …সব লোভ নিভে গেলে, আমি চিরকালীন রাতের যাত্রি হবো। রেলগাড়ি যেখানেই নিয়ে যাক, চাঁদের আলোয় ভেসে যাবো অনন্ত আশ্রয়ে।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত