অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩৩) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা।
আমাদের যাত্রা একদিন পিছিয়ে গেল কারণ সেদিন খুব বৃষ্টি হল।
সাধারণত এই সময় এত বৃষ্টি হয় না, কিন্তু ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক বৃষ্টি হওয়া জায়গায় এই ধরনের দুর্ঘটনা হয়েই থাকে।
মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্যই কয়েক হাত দূরের কোনো জিনিস দেখা যায় না। সমগ্র পৃথিবীটা যেন একটি কোমল ধোঁয়ার ভেজা চাদর ঘিরে রেখেছে। পর্বতের ওপরে পড়া বৃষ্টির জল অভাবনীয় জায়গা দিয়ে প্রবল স্রোতে গিরিকন্দরের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। সারাদিন বৃষ্টি ছাড়ল না, কখনও কিছুটা কমলো, কখনও বৃদ্ধি পেল।বৃষ্টি কমে যাওয়ার সময় পৃথিবীর ধুয়ে পরিষ্কার হওয়া রূপটা স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল।
আমাদের কেম্পটার উঠোন দিয়েও পাহাড়ের জলের স্রোত নিচে বয়ে যাচ্ছিল। বৃষ্টির দেওয়ালের আড়ালে পাহাড়ের সুড়ঙ্গ দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের কল কল ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল।
এই ধরনের আবহাওয়ায় কীভাবে বাড়ি থেকে বের হওয়া যায়?
আমরা দুজনেই বাড়ির মধ্যেই রইলাম।
বারান্দার সামনে স্টোভের চালার নিচে চেয়ার পেতে বসে চুলোয় আমরা আগুন জ্বালিয়ে নিয়েছিলাম।বৃষ্টির ছাঁট পরে একপাশে পড়ে থাকা সরল কাঠের খড়ির স্তূপটা ভিজে উঠেছিল।ডিজে খড়িগুলো জ্বালাতে গিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। গরম জল করা ডেকচিটাতে স্নান করার জল বসিয়ে দিয়ে আমরা চা বিস্কুট খাচ্ছিলাম। চারকোনা চালার টিনের চালের টই দিয়ে পড়তে থাকা বৃষ্টির জলের জন্য আমরা একটা মশারির ভেতরে ঢুকে আছি বলে মনে হচ্ছিল।
নানীর আসতে দেরি হচ্ছিল। বৃষ্টি কিছুটা কমতেই নানী একটা প্রদীপ হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল। তার কাপড়-চোপড় ভিজে গিয়েছিল। হাতে আনা ডিম পাউরুটি শাকসবজির পুঁটলিটা রেখে সে ভেজা শাড়িটা বদলে সঙ্গে নিয়ে আসা শুকনো কাপড়টা পড়ে নিয়েছিল। ভেজা শাড়িটা বারান্দার রশিতে মেলে দিয়েছিল।
‘আজ মঙ্গলবার বৃষ্টি দিয়েছে’,নিজেকে নিজেই বলার মতো নানী বলেছিল।‘শনিবারের আগে কোথায় আর ছাড়বে!’
মেয়েটির চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গিয়েছিল, দুচোখে তার উৎকণ্ঠা এবং আশঙ্কা।
‘না, এই ধরনের কোনো কথা নেই,’ তাকে আমি বলেছিলাম। ‘এইসব মানুষের মধ্যে প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস বলতে পার। ওই দেখ মেঘ হালকা হয়ে আসছে। ফাঁকে ফাঁকে দূরের দেবদারু গাছগুলি দেখা যাচ্ছে। মেঘ গলে শেষ হলে বৃষ্টি শেষ হবে। তখন পুনরায় উজ্জ্বল রোদে চারপাশ ঝলমল করে উঠবে।’
‘রোদ উঠবে?’
‘’উঠবে।কেন উঠবে না!’
সরল গাছের মজ্জা পোড়ার সুগন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল।সুন্দর ফুরফুরে গন্ধ।
বিকেলের মধ্যে আবহাওয়া ঠিক হয়ে গিয়েছিল এবং আমরা পায়ে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। চারপাশে একটা ধুয়ে নেওয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাব।
আমরা বিশেষ কথা বলতাম না।দুজনেই যেন নিজের নিজের চিন্তায় ডুবেছিলাম। সে হাতে করে একটা দূরবীণ যন্ত্র নিয়ে এসেছিল। মাঝে মধ্যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সে চোখে দূরবীণটা লাগিয়ে দুরের পর্বতমালার দিকে তাকাত। বৃষ্টির পরে আকাশ বাতাস পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল।
‘সেটা কি?সেই বাড়িটা?’চোখে দূরবীণ লাগিয়ে সে জিজ্ঞেস করেছিল।
খালি চোখে সে দেখানো অনুসারে তাকিয়ে অস্পষ্টভাবে একটা বাড়ি বলে মনে হচ্ছিল।‘বোঝা যাচ্ছে না’,আমি তাকে বলেছিলাম। সে দূরবীণটা এগিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিলাম। বড়ো বড়ো দুটো ঘর চোখে পড়ল ।দূরবীনের কাঁচ দূরের ঘর দুটিকে কাছে দেখাচ্ছে। ব্যারাকের মতো দুটো লম্বা ঘর। চার-পাশটা বোধ হয় দেওয়াল দিয়ে ঘেরা,ঘর দুটির মাঝখানে একটি লম্বা উঠোন, আর দুই একটি ছোটো ছোটো ঘর ছিল আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চৌহদ থাকা কিছু একটা অনুষ্ঠানেই হবে। কি বা? সেনাবাহিনীর কিছু নাকি? ম্যাকলডগঞ্জে ক্যান্টনমেন্ট আছে ! আগে কখনও ঘরটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাকে বললাম আগে কখনও বাড়িটা দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।
সে হাতটা এগিয়ে দিয়ে দূরবীনটা নিয়ে চোখে দিল। অনেকক্ষণ ধরে দূরবীনে মেয়েটি দূরের বাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। খালি চোখে তো প্রায় অস্পষ্ট ভাবে দেখা যায় দূরের বাড়িগুলি দূরবীন দিয়েও খুব ভালো করে দেখা যায় না।
‘লামা, লামা, ওই যে লামা’ মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠল।
‘লামা? কীসের লামা?’
‘একটা ঘর থেকে ওই যে গাঢ় লাল কাপড় পরা একজন লামা বেরিয়েছে।সারি বেঁধে বের হচ্ছে। ওটা বোধহয় বৌদ্ধ লামাদের থাকা ঘর ।‘
‘ বিহার–বৌদ্ধ বিহার।’
‘আমরা একবার সেখানে যাব।’
আমি কিছুটা অসুবিধায় পড়েছিলাম।যাব বললেই কি সোজা বিহারে যাওয়া যায়?চিনি না,জানি না,হঠাৎ কী বলে যাব।নিয়ম আছে কিনা।আমেরিকায় থেকে মেয়েটির চিন্তা ভাবনা সেই দেশের মতোই হয়েছে—দ্বিধা সঙ্কোচ নেই।আমরা উচিত অনুচিতের বিচার নিয়ে এতটাই মেতে থাকি যে বেশিরভাগ সময় আমাদের সঙ্কোচ বেঁধে রাখে।’
‘সেখানে যাবে?বৌ্দ্ধ বিহারে?’তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করেছিলাম।
‘বিহারে যাব,দেখতে যাব।একটা বৌদ্ধবিহার দেখার আমার খুব ইচ্ছা আছে। আজ তো দেরি হয়ে গেল আগামীকাল যাব। সে চোখ থেকে দূরবীনটা নামিয়ে এনেছিল এবং আগ্রহের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।
‘ঠিক আছে যাব’ আমি বলেছিলাম।
তার মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
‘সেই বৌদ্ধ বিহারটা আমি আজকেই দেখলাম,’ তাকে বলেছিলাম।আগে কখনও খেয়াল করিনি।কতবার এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করেছি,কখনও চোখে পড়েনি। আসলে বিহারটা বোধহয় মূল রাস্তায় নয়,মূল রাস্তা থেকে নিশ্চয় কিছুটা ভেতরের দিকে যেতে হয়।
মেয়েটির হাত থেকে দূরবীনটা নিয়ে আমি পুনরায় বিহারটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।যথেষ্ট নিচে বলে মনে হল বিহারটা, প্রায় মেকলডগঞ্জের কাছেই হবে বোধহয়।একটা খাড়া পাহাড়ের কাঁধে কিছুটা সমান জায়গায় বিহারটা। সেখানে যাবার পথটা এখান থেকে দেখা যায় না। ওই যে নেমে যাওয়া মূল রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটার থেকে অন্যদিকে ফাঁকা পাহাড়টাতে বিহারটা আছে বলে মনে হচ্ছিল। বোধ হয় রাস্তার পাশে গভীর গর্তটার ওপর দিয়ে ঝুলন্ত একটা সেতু দিয়ে সেই পাহাড়ে যেতে হবে।
‘অনেকদূর হাঁটতে হবে বলে মনে হচ্ছে,’ ওকে বললাম ।
‘খুব ভালো হবে,’ও বলল। ‘আমরা সকালবেলা এখান থেকে যাত্রা করব।’
‘যদি আজ রাতে বৃষ্টি না হয়।’
‘হবে নাকি?’মেয়েটির চোখে আশঙ্কার ছায়া নেমে এল।
আকাশের দিকে তাকালাম।আকাশটা পরিষ্কার হয়ে আসছিল বলে মনে হচ্ছিল। দূরের পর্বতের গায়ে তখনও ঘন মেঘ জমা হয়েছিল। রাতে যদি বৃষ্টি দেয় তাহলে সকালের দিকে আকাশ পরিষ্কার হতে পারে।
‘হওয়া উচিত না, কিন্তু বলা যায় না।’
সন্ধ্যার আগে একটা গাড়িও ঠিক করা হল। নানী এসে খবরটা দিয়েছিল। জিনিসপত্র নিয়ে একটা জিপ এসেছে, রাতে থেকে ড্রাইভার সকালে ফিরে যাবে। ভাড়া পেলে সে তো খুশিই হবে। পুরোনো জিপ গাড়ি গ্রামের দোকানগুলিতে চাল,আটা, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি জিনিস নিয়ে আসে। আমি দ্রুত গিয়ে গ্রামে খবর করেছিলাম। ড্রাইভারটা ঘুমিয়ে ছিল। তার সঙ্গে ভাড়ার বন্দোবস্ত করলাম। পরের দিন আমরা সকালবেলা বেস ক্যাম্প থেকে বের হব এবং পথে বৌদ্ধবিহারে থেকে রাতের আগে আগে মেকলডগঞ্জে পৌঁছে যাব। মেয়েটিকে সে কিছু জায়গা দেখাতে পারবে।
গাড়ি ঠিক করে আসতে আসতে মেয়েটি স্নান করে বারান্দায় আরাম চেয়ারে বসে ছিল।
‘গাড়ি পেয়েছ?’সে ব্যাঘ্রভাবে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘পেয়েছি,’ আমি আমার পরিকল্পনার কথাটা বললাম।
‘খুব ভালো হবে,’ সে আনন্দের সঙ্গে বলে উঠেছিল। ‘সারাদিনটা আমরা ধীরে ধীরে যেতে পারব। এসো, মুখ হাত ধুয়ে নিই এসো।নানী ডিম মেখে ব্রেড ভেজে নাস্তা তৈরি করেছে।তোমার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি।’
সামনের বারান্দায় বসে আমরা চা জল খাবার খেয়েছিলাম। আবহাওয়া পুনরায় গুমোট হয়ে পড়েছিল। মেঘগুলি ঘন হয়ে ধীরে ধীরে দূরের পাহাড় গুলির ওপর দিয়ে কাছে চলে এসেছিল।। সে উদ্বিগ্ন হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল –‘আগামীকাল রোদ উঠবে, তাই না?’
‘উঠবে, উঠবে’ আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম।
নানীও রাতের খানা তৈরি করার জন্য তাড়াহুড়া করছিল। বৃষ্টি পড়ার আগে সেও কাজকর্ম গুলি করে যেতে চায়।
‘আজ তোমার শেষ খাওয়া নানী, কাল আমরা চলে যাব। মেম সাহেব মেকলডগঞ্জে গিয়ে থাকবে,’ নানীকে বলেছিলাম।
নানী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আগে কেন জানাইনি বলে বকাবকি করছিল। তিনি নাকি ভেবেছিলেন আমরা গাড়িটা নিয়ে বেড়িয়ে রাতে পুনরায় ফিরে আসব।তাই তিনি আজ রান্নার কাজটা কোনোরকমে করে রাখতে চেয়েছিলেন। তাড়াহুড়ো করে মানুষটা বাড়ির আড়ালে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আমরা মুরগির ডাক শুনতে পেলাম ।একটা মুরগি এনে নানী বোধ হয় আড়াল করে রেখেছিল। মেয়েটিকে বলেছিলাম আজ পুনরায় মুরগির মাংসের ঝোল খেতে পাবে।
কিছুক্ষণ পরেই জোরে জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছিল এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নেমে এল। প্রথমে ঝিরঝির করে তারপরে বৃষ্টির গতিবেগ বেড়ে গেল ।বেস কেম্পটার টিনের চালে ক্রমাগত বৃষ্টির শব্দ হতে লাগল এবং টিনের টুই দিয়ে জল পড়ে থাকা মশারির ভেতরে আমরা ঢুকে পড়েছিলাম। উনুন থেকে নানীর মশলা ভাজার গন্ধ পরিবেশটাকে আরও গুমোট করে তুলেছিল। আর সেই গুমোট পরিবেশের মধ্যে আমরা কথা বলছিলাম।
‘আমাদের বেস কেম্পে এটা তোমার শেষ রাত’ওকে একবার বলেছিলাম।
‘আমিও সেটাই ভাবছিলাম,’সে বলল।
‘আর তো কোনোদিন এখানে আসা হবে না।’
‘তাইতো,’মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।কিছুক্ষণ থেমে বলেছিল,’পার হয়ে যাওয়া দিনগুলি ফিরে আসে না,পার হয়ে যাওয়া জায়গাগুলিতেও কমেই ফিরে আসা হয়। আর ফিরে যদিও আসা হয়,তখনও তো সেটা একই হয় না। প্রথমবার যত ভালো লেগেছিল পরের বার নাও লাগতে পারে। কখনও আবার উল্টোটা হয়,পরের বার বেশি ভালো লাগে।জায়গা বা সময় নয়,হয়তো আমরা মানুষটাই বদলে যাই। অথবা বদলে যায় আমাদের মন।’
‘তুমি তো চলে যাবে।আমি এখানে থেকে যাব। হয়তো নতুন নতুন মানুষের পরিচর্যা করব।নতুন টুরিস্টের।’
‘আমরা সবাই টুরিস্ট—ভ্রমণকারী।হ্যাঁ,এই পৃথিবীটাতে,এই জীবনটাতে আমরা ভ্রমণকারী মাত্র।টুরিস্টের মতোই আসি।বিষ্ময়ে চোখ মেলে তাকাই।ভালোভাবে দেখাই হয় না কিছু এবং আধা দেখা আধা বোঝা অবস্থায় আমাদের ফিরে যাবার সময় এসে যায়।’মেয়েটি খুব আবেগের সঙ্গে কথাগুলি বলল।‘কিন্তু এখানে এসে আমার খুব ভালো লেগেছে। ট্রেকিঙে না গেলেও ভালো লেগেছে।’
‘কেন ভালো লেগেছে?’
‘কেন ভালো লেগেছে?’নিজেকে নিজে প্রশ্ন করার মতো সে জিজ্ঞেস করেছিল।‘এখানকার বাতাবরণ ভালো লাগল,পরিবেশ ভালো লাগল।’
তোমাকেও ভালো লাগল বলবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু বলল না। সে বলল,’তোমার সঙ্গে কথা বলে ,তোমাকে অনেক কথা বলে আমার মনটা অনেকে হালকা হয়ে গেছে বুঝেছ।এতদিন একটু একটু করে কথাগুলি জমা হয়েছিল,দুঃখগুলি জমা হয়েছিল,বেরিয়ে যাবার পথ ছিল না।কাউকে বলতে পারছিলাম না।খুবই অসহ্যকর অবস্থা ছিল।’
‘ডিভোর্সের কথাটা ?’
‘কেবল সেটাই নয়। আমেরিকার সম্পূর্ণ জীবনটাই অসহ্যকর হয়ে উঠেছিল।’
সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করি নি। কী আর জিজ্ঞেস করব?এসব কথা তো জিজ্ঞেস করা যায় না। কিছুক্ষণ পরে সে নিজেই আরম্ভ করল।
‘মানুষের নিজের দেশে থাকা উচিত বুঝেছ।বিদেশে বড়ো নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হয়।
‘সবাই তো বিদেশ যেতে চায়।’
‘হয়তো চায়।কিন্তু গেলেই বোঝা যায় নিঃসঙ্গতা কী ভয়াবহ জিনিস।‘
‘ নিঃসঙ্গতা?’
‘ কথা বলার জন্য একজন মানুষ নেই। মানুষ পেলেও কথা বলা যায় না। আমেরিকার মানুষ, বিশেষ করে তোমার পরিচিত, বন্ধু মহলে খুবই সাহায্য করে, খুবই আবেগ প্রবণ। আমার যা সাধারণ ধারণা আছে তারা সময় দেয় না বা দিতে পারেনা, এরকম ও নয়, সময় দেয়, কিন্তু মন খুলে কথা বলা যায় না। বোধহয় আমাদের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক বাধা থেকে যায়—কালচারেল বেরিয়ার। হয়তো আমার নিজের ও অপারগতা হতে পারে। আমিই হয়তো ভাব বিনিময় করতে পারিনি। হয়তো আমার ছেলে পারবে। কিন্তু মোট কথাটা হল এই যে আমাকে সেখানে এক চরম নিঃসঙ্গতার মধ্যে সময় কাটাতে হল।’
‘ডিভোর্সের পরে?’
‘ না, তার অনেক আগে থেকেই শুরু।’ কথাটা বলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নানী চা খাওয়া কাপ দুটিতে দুইকাপ গরম মুরগির মাংসের ঝোল এনে দিয়েছিল। এমনিতে নানী সব সময় আগেই একটু ঝোল এনে দেয়।সুরুয়া নয়, রান্না করা ঝোল। আমরা ধোঁয়া উঠতে থাকা গরম ঝোলের পেয়ালা দুটি হাতে নিয়ে সাবধানে চুমুক দিতে আরম্ভ করেছিলাম।
‘ আসলে কী জান,’ মেয়েটি কিছুক্ষণ পরে নিজেই আরম্ভ করেছিল।’ প্রথম কয়েক বছর সবকিছুই ঠিক ছিল। তিনি মানে আমার হাজব্যান্ড আমাকে খুব আদর করত। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেত, লম্বা ছুটিতে নিয়ে যেত, বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করত– সবকিছুই পারফেক্ট। দুটো বছর কীভাবে পার হয়ে গিয়েছিল বলতেই পারিনা। স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজেক্টের কাজ করত, তিনি কাজ করা কোম্পানিটাই সেখানে সেই প্রজেক্টটা করেছিল। সকালে বেরিয়ে যায়, রাতে দেরি করে ফেরে, দিনে দশ বার ফোন করে।’
‘ আর তুমি সারাদিন একা থাকো?’
‘ প্রথম কয়েক মাস ছিলাম। তখন একা থাকলেও খারাপ লাগত না– একটা সময়ে পথ চেয়ে থাকার মধ্যেও আনন্দ থাকে। আমেরিকান টিভি প্রথমে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। তারপরে আমিও দিনে কলেজে পড়া শুরু করলাম। তখন তো সময় ভালোভাবেই পার হতে লাগল। তারপরে, পড়া শেষ হওয়ার পরেই ছেলেটির জন্ম হল।ছেলেটিকে বড়ো করে তুলতে গিয়ে দুই বছর ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। তারপরে ক্রমে সমস্যার শুরু হল।’
আমি চুপ করে রইলাম।
সে পুনরায় আরম্ভ করেছিল, ‘আমি কাউকে দোষ দিই না। সেই সময় থেকে আমার প্রাক্তন হাজবেন্ডের কাজে কোনো গন্ডগোল শুরু হয়েছিল। প্রথমে গন্ডগোলটা ব্যক্তিগত ছিল না। তিনি কাজ করার কোম্পানিটাতেই কিছু একটা হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি ক্রমে অনুভব করতে আরম্ভ করেছিলেন যে কোম্পানি আগের মতো তার কাজকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কাজ করার সুযোগ সুবিধাও কমিয়ে দিয়েছে।’
কেন?’
‘কী কারণ সেটা আমি তখনও ভালোভাবে বুঝতে পারিনি– পরেও বুঝতে পারলাম না। কথাটা বোধহয় এরকম ছিল যে বাজার খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কোম্পানি তিনি কাজ করতে থাকা প্রজেক্টের গুরুত্ব কমিয়ে দিল– বা হয়তো বন্ধ করে দিতে চাইল।
‘তারপরে?’
‘সেই সময় থেকেই তিনি খুব খিটখিটে হয়ে পড়লেন, অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সংসারে এটা ওটা নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছিল। তারপরে কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রমোশনের সময় তাকে উপেক্ষা করে তার চেয়ে অনেক জুনিয়র সাদা চামড়ার এক সাহেবকে প্রমোশন দিয়ে দিল। তখন তিনি প্রায় ভেঙ্গে পড়লেন। সেই সময় তিনি নিজেকে আমেরিকার বর্ণ বৈষম্যবাদের শিকার হওয়া বলেও বলেছিলেন।’
‘হয়েছিলেন কি?’
‘বলা মুশকিল। হয়তো হতেও পারে, না হতেও পারে। অবশ্য হলে আমি খুব আশ্চর্য হব না।’
‘তিনি গ্রিন কার্ড হোল্ডার ছিলেন না নাগরিক হয়েছিলেন?’
‘আমাদের বিয়ের আগেই তিনি সিটিজেনশিপ পেয়েছিলেন।’
‘আমেরিকার নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ও এরকম হয় নাকি?
‘ ব্ল্যাক বা নিগ্রোরা আমেরিকার নাগরিক হয় নাকি?’ হয়তো বর্ণবৈষম্য আজ কমে এসেছে, অধিক সূক্ষ্ম হয়ে পড়েছে, কিন্তু নেই বলা যায় না। কিন্তু একটা কথা কি জান, বর্ণ বৈষম্য সেখানে যেভাবে আছে, সেভাবে তার বিরুদ্ধে সাদা মানুষের ভেতরে খোলাখুলি প্রতিবাদ ও রয়েছে, মুক্ত আলোচনা আছে। খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করতে পারলে হিপোক্রেসি থাকে না।’
‘তারপরে?’
‘তিনি পদত্যাগ করলেন। সেই অপমান তিনি মেনে নিতে পারলেন না।’
‘পদত্যাগ করলেন?’
‘পদত্যাগ করার পর থেকেই সমস্যাগুলির সৃষ্টি হল। সেই সময়ে অর্থনীতিতে মন্দা অবস্থা চলছিল। বহুদিন তিনি কোথাও চাকরি পেলেন না। তিনি বেশ ভালো কাজই করতেন। সেই অনুসারে যে ধরনের চাকরি তার হওয়া উচিত ছিল সেই ধরনের কাজ পেলেন না।আমাকে সেইসময় চাকরি করতে হল।অর্থনৈতিকভাবে এতটা প্রয়োজন ছিল না,কিন্তু একটা চাকরি পেয়ে যাবার জন্য করতে চাইলাম।প্রথমে তিনি আপত্তি করেন নি।বরং খুশিই হয়েছিলেন।’
‘তারপরে?’
‘দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটল।আমি যে চাকরিটা পেয়েছিলাম সেটা অস্থায়ী প্রজেক্টের কাজ ছিল।কিন্তু দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাজটাতে নেশা লেগে গেল,কাজটাকে আমি ভালোবেসে ফেললাম।আমি জড়িয়ে পড়লাম—আর এটাই তিনি ক্রমশ অপছন্দ করতে লাগলেন।
‘তারপরে?’
আমাদের মধ্যে এটা-ওটা কথার মধ্যে ঝগড়া শুরু হল।ছোটো ছোটো কথা,কিন্তু বিরক্তিকর।তিনি খিটখিটে হয়ে পড়লেন এবং ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা আমার সহ্যের বাইরে চলে গেল।এত ছোটো ছোটো কথা যে ভাবলে এখন নিজের ওপরে ধিক্কার জন্মায়।’
নানী এনে দেওয়া মাংসের ঝোল শেষ হয়ে গিয়েছিল।আরও অল্প চাইলাম কিন্তু নানী আর ঝোল দিতে রাজি হলেন না।ঝোলের পরিবর্তে একপ্লেট আলু ভাজা এনে দিয়েছিলেন।আমরা গরম আলুভাজা খেতে শুরু করেছিলাম।তার পরের কাহিনি বলার আগে সে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল।বৃষ্টির দেওয়ালের মধ্যে বসে সে হয়তো অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে গিয়েছিল।
আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৩২) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
আমি তার দিকে তাকিয়েছিলাম।দূরের স্টোভটার আগুনের আলোতে তার মুখটা কোমল এবং করুণ হয়ে পড়েছিল।ধীরে ধীরে সে বলতে শুরু করেছিল,’দুই বছর পরে আমাদের প্রজেক্টটা যখন আরও তিন বছরের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজটা মঞ্জুর হল ,তখন তিনি আমায় সেখানে কাজ করায় বাধা দিলেন।তিনি অবশ্য ততদিনে একটা মোটামুটি সম্মানজনক চাকরি পেয়েছিলেন।কিন্তু,ততদিনে আমিও আমার কাজটিকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম—আমি প্রজেক্টটার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে পড়েছিলাম,কথাগুলি জেনে গিয়েছিলাম,কাজের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল।আর—আর কী জান ,সেই কাজটার মাধ্যমে আমি ক্রমে এক সম্মানজনক স্থান পেতে শুরু করেছিলাম—সেই বিষয়ে মানুষ আমার মতামত চাইছিল।’
‘স্বভাবিক ভাবেই এরকম অবস্থায় কাজ ছাড়াটা সহজ নয়,’ আমি ওকে সমর্থন করেছিলাম।
‘এটাই ভাবি কখনও,কোনটা আসলে জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল?কাজটা,কাজের আনন্দ এবং কাজের মাধ্যমে পাওয়া স্বীকৃ্তি না পারিবারিক শান্তি?’ ।
‘আমেরিকায় সেটা একটা করার মতো প্রশ্ন কি?
‘হয়তো নয়– তাদের জন্য,’ সে সম্মতি জানাল। ‘কিন্তু আমরা ভারতীয় মানুষরা ভারতীয় সংস্কার এবং মূল্যবোধ সহজে ছাড়তে পারি না, বুঝেছ। পরিবারটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কথা।এই যে ডিভোর্স-ফিভোর্স হল–এটাও এখন আমার জন্য খুব বড়ো কথা নয়, মেনে নিতে পারার মতো কথা। কিন্তু এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটায় ছোট্ট ছেলেটি যে মনোকষ্ট পেয়েছে– তার কোমল অন্তরে সে কম দুঃখ পেয়েছে কি? এই দুঃখটা হয়তো সব সময় তার মনে থাকবে। হয়তো বেড়ে যাবে। এই কথাটা ভেবে ভেবেই কখনও আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়, বুঝেছ?’
‘আমরা তো সমস্ত কিছুকেই ভাগ্যের লিখন বলে সহজে মেনে নিতে পারি– সেটাই তো ভারতীয় চরিত্র।’
‘পারবে? পারবে তুমি? সবকিছুই ভাগ্য বলে মেনে নিতে পারবে?পারলে হয়তো সমস্ত কথা অনেক সহজ হয়ে যেত।তুমি পার কি ?সমস্ত কথা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিতে পার?’
‘আমি চিন্তা করার কথাটা কবেই বাদ দিয়েছি।বাদ দিয়েছি মানে বাদ দিতে চেষ্টা করছি। এখন আমি প্রতিদিনই–প্রতিদিনই কেবল সেই দিনটির জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। না ভূতো না ভবিষ্যতি,অতীতো নেই– ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও নির্বিকার। কেবল আজকের জন্য– বর্তমানের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করি।’
‘কিন্তু কেন?’
‘হয়তো যে পর্যায় আমি পার করে এসেছি, যে সমস্ত কথা-কাণ্ড দেখে এসেছি, যেভাবে একটা প্রজন্মের সুন্দর স্বপ্ন, সত্যি বলছি অসম্ভব, ইমপ্র্যাকটিক্যাল হলেও সুন্দর এবং বিশুদ্ধ স্বপ্ন চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখেছি ।তারপরে বুঝেছ, মানুষ অতীত ভবিষ্যৎ কোথাও আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না,বিশ্বাস করতে পারেনা,’ কথাটা বলার সময় হয়তো আমি যথেষ্ট আবেগিক হয়ে পড়েছিলাম। মেয়েটি আমার দিকে মাথা তুলে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ছিল।স্টোভটাতে জ্বলতে থাকা আগুন তার চশমার কাচ দুটিতে ছোটো ছোটো আগুনের ঢেউ হয়ে নাচছিল। বাইরের বৃষ্টি বন্ধ হয়েছিল কিন্তু ঠান্ডা বেড়ে গিয়েছিল আর আমরা বারান্দায় বসে ছিলাম।
‘কিন্তু কেবল তুমি প্রজেক্টের দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু করার পর থেকেই তোমাদের পরিবারের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল কি?’
নানী বেড়ে রাখা ভাত খাওয়ার সময় পুনরায় পুরোনো প্রসঙ্গটাই ফিরে এসে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। বৃষ্টি থেমে যেতে দেখে নানী ভাত খেয়ে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো লাগিয়েছিল।আমরা খাওয়া দাওয়া করে তাকে ফ্রি করে দিলে তিনি যেতে পারেন।তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের তাড়াতাড়ি ভাত খেতে নিতে হয়েছিল।
মেয়েটি নীরবে কিছু সময় কিছু ভাবছিল।তারপর ধীরেধীরে উত্তর দিয়েছিল,আসলে আমার অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে উঠাটা তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।চাকরি থেকে ইস্তফা দেবার পরে অনেকদিন পর্যন্ত ভালো একটা কাজ না পাওয়ার জন্য তাঁর আত্মবিশ্বাস হয়তো কমে গিয়েছিল।তিনি সন্দেহপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন।আমাকে আমার ‘বস’এবং সহকর্মীদের সঙ্গে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন।কী অসহ্যকর এবং বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তোমাকে কী বলব!আমাদের মধ্যে ঘনঘন ঝগড়া হত এবং আমরা মা-বাবা দুজনেই আমাদের ‘ফ্রাস্টেশন’গুলি ছোট্ট ছেলেটির ওপরে উজার করে দিতাম।আমরা যে কতটা নির্দয় হয়ে পড়েছিলাম সেই কথাগুলি মনে পড়লে আমার এখনও হাঁটু দুটিতে জোর নাই হয়ে যায় বলে মনে হয়…’
প্রসঙ্গটা উত্থাপন করার জন্য আমার নিজের উপরে ধিক্কার জন্মাল। এসব কথাও উত্থাপণ করার জন্য আমাকে কিসে পেয়েছিল। কথা পাল্টানোর জন্য আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম আমরা এই সমস্ত কথা আর বলব না।
এই কথাগুলি বলে আমার নিজের মনটা হালকা হয়ে যাওয়া বলে অনুভব করলাম জান, সে খুব আন্তরিকভাবে বলেছিল। বুকের মধ্যে কোনো এক জায়গায় যেন এই কথাগুলি জমাট বেঁধে একটা পাথর হয়েছিল। আজ পাথরটা গলেছে। না, তার প্রতি এখন আর আমার কোনো খারাপ ভাব নেই, কোনো রিসেন্টমেন্ট নেই।সে আমাকে দেওয়া মানসিক কষ্ট, শারীরিক নির্যাতন– আমাদের যুগ্ম জীবনে এক সময় কিছু ভায়োলেন্স এসে পড়েছিল– এই সবকিছুই ইতিমধ্যে ক্ষমা করে দিয়েছি। আর আমি ক্ষমা করতে পেরেছিও। আর কি জান ক্ষমা করতে পারার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিগুলি আর এত দুর্বিষহ হয়ে থাকেনি। সে আজ একজন বান্ধবীর সঙ্গে একসঙ্গে থাকে– এই লিভিং টুগেদার আর কী।প্রথমে সে কথা শুনে এবং একবার শপিং মলে দুজনকে দূর করতে দেখে ডিভোর্সের পরেও আমি এক প্রচণ্ড ঈর্ষা অনুভব করেছিলাম।এখন কিন্তু সেই সমস্ত আবেগ থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি।এখন আর তার উপরে আমার কোনো খারাপ মনোভাব নেই।জীবনটাকে আমি এখন অন্যভাবে দেখতে শিখেছি— শিখতে চাইছি।’
‘তোমার জীবনে আর নতুন কোনো বন্ধুত্ব হল না নাকি?
‘এসেছিল।’
‘এসেছিল?’
‘ কিন্তু সেই বন্ধুত্ব একটা পর্যায়ের পরে আর এগোল না।
‘কেন?’
কেন মানে? আমি সব সময় একটা পর্যায়ে থেমে গেলাম– ঠিক তোমার– ঠিক শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার আগেই আমি প্রতিবার থেমে গেলাম।কিছু একটা ভেতরের সংকোচ বা বাধায় আমি থেমে গেলাম তাই সম্পর্কগুলি আর এগোল না।’
আমরা দুজনেই পুনরায় নীরব হয়ে পড়লাম। পৃথক দেশ পৃথক সমাজের কথা কীই বা মন্তব্য করা যায়। সত্যি কেনই বা বলা যায়? নানীকে আমি তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে নিতে বললাম। আমাদের ভাত খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। নানী থালা-বাসন গুলি সরিয়ে নিয়ে নিজেও তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া শেষ করেছিল। চৌকিদার রামলাল এসে পড়ায় তাকে নানীকে বাড়িতে রেখে আসতে বলে দিয়েছিলাম। দুজনেই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গিয়েছিল।
সকালবেলা তাড়াতাড়ি এসে আমি পরোটা বানিয়ে দেব এবং ডিম সিদ্ধ করে দেব। খাবে এবং সঙ্গে নিয়ে যাবে। যাবার সময় নানী বলে দিয়েছিল।
আমরা দুজনে বৃষ্টিস্নাত উঠোনে বেরিয়ে এসেছিলাম। আকাশটা তখন মেঘমুক্ত হয়ে ঝকঝক করছিল। চাঁদ ওঠেনি, যদিও আকাশটা আলোময় ছিল।। আর সেখানে ঝলমলে অনেক তারা ঝুলে ছিল। বাতাস এতটাই বিশুদ্ধ হয়ে পড়েছিল যে নিশ্বাস নিতে নাক ঝিমঝিম করে উঠেছিল। আমি অনেকক্ষণ নীরবে উঠোনের প্রান্তে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম, নানীকে বাড়িতে রেখে রামলাল ফিরে না আসা পর্যন্ত।
অনুবাদক