Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ঠাকুমাকে

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১০) । অনিন্দিতা মণ্ডল

Reading Time: 4 minutes

কথা ৪

আমার মায়ের নাম ছিল মুক্তি। শিকলে বাঁধা পা নিয়ে মায়ের জীবন। কিন্তু মনে বেড়ি ছিল না। অদৃশ্য এক জাদুতে সে বেড়ি কাটা পড়েছিল। সম্ভবত জীবনের শুরুতেই বনের ধারে নদীর পারে ওরকম একটা কাঠের বাড়িতে থাকা আর কাকা মেসোদের সঙ্গে আনন্দে ঘুরে বেড়ানোর ছাপ পড়েছিল মনে। তাই মনটা চিরদিন অনর্গল রয়ে গেলো।

কিন্তু আমাদের সাবেক বাড়ির পাঁচিল মা বাবা কোনোদিন ভুলতে পারেনি। এমন হয়? ছেলের অকাল প্রয়াণে শোক পেয়ে মা তার বিধবা স্ত্রীকে নাবালক সন্তানসহ পাঁচিল তুলে পৃথক করছেন? কী, না, তাদের দেখে ছেলের শোকে তিনি  মুষড়ে পড়বেন। পাঁচিলের ডান পাশে যে বিশাল তিন মহলা বাড়ি ও ঠাকুর দালান পড়ে রইল সেখানে আমাদের সেই বড়দিদির (বাবার ঠাকুমা) সোনার ফ্রেমের চশমা আঁটা চোখা নাক টানা চোখের মুখটি এ বাড়ির চিহ্ন হয়ে রয়ে গেলো। তিনি নাকি অসম্ভব নীচু স্বরে কথা কইতেন। বেশি গয়না পরা পছন্দ করতেন না। ইংরিজি খবরের কাগজে চোখ বুলোতেন। ব্যক্তিত্বসম্পন্না ছিলেন বলে ছেলেমেয়েরা তাঁকে ভয় করে সমীহ করে চলতেন। আমার ঠাকুরদা তো বড়ই হলেন না। তাঁর চেয়ে ঢের বেশি বড় হয়ে গেলো ছোড়দাদু। বড়দিদির কড়া নিয়ম ছিল। রোজ যা আয় হবে সব এনে তুলে দিতে হবে তাঁর হাতে। তখন ঠাকুরদার দারুণ পসার। ১৯৩০/৩১ সাল হবে। তখনও ছোট দুই ভাই রোজগেরে হয়ে ওঠেননি।

ছোড়দাদু তখন তবলিয়া হিসেবে নাম করেছেন। ফলে তাঁর কথা পরিবারে মান্য হতে শুরু করল। ঠাকুরদা কারণে অকারণে বকাঝকা শুনতেন। হয়তো কোনোদিন চিৎপুর রোড দিয়ে ফিরতে ফিরতে চোখে পড়ল জোড়া ইলিশ। কিনে ফেললেন। কিন্তু তারপরেই ভয়। কি হবে? মা তো সাংঘাতিক রাগারাগি করবেন! বাড়িতে এসে বৈঠকখানা থেকে অন্দরে আর যান না। বড়দিদি ডাক পাঠালেন। ঠাকুরদা মৃদুস্বরে বুড়ো রামদাদাকে বললেন, কাল দরকারি সওয়াল আছে। বইপত্র ঘাঁটতে হবে। দেরি হবে। ওদিকে বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে নারায়ণের প্রসাদ নিয়ে তবে জল খাবারের ব্যবস্থা। রামদাদা যারপরনাই অস্থির। দাদাবাবু, খেতে হবে তো। ভেতরে চলো।

ঠাকুরদা সাহস সঞ্চয় করে বৈঠকখানা পেরিয়ে ঠাকুর দালান পেরিয়ে ভেতর উঠোনের গা বেয়ে সিঁড়িতে উঠতে যেতেন। দেখতে পেতেন দালানে বেতের মোড়ায় বসে বড়দিদি উঠোনে আমিষ হেঁসেলের একধারে জোড়া ইলিশ কোটার তদারক করছেন। ঠাকুরদাকে দেখেই বলতেন, আজকে টাকা এত কম কেন? ইলিশ কত দিয়ে কিনলে? রোজ রোজ তোমার মক্কেল ইলিশ দেয়, ভীম নাগের সন্দেশ দেয়, আমায় বিশ্বাস করতে বলো? ঠাকুরদা মাথা নীচু করে উঠে যেতেন।

সম্ভবত এক বাড়ি লোকজন, ঝি চাকরের সামনে ছেলেকে এমন হেনস্থা করে একটা সুখ পেতেন তিনি। যে ছেলে বাইরের পৃথিবীতে এমন মান্য এমন ধনী তাকে উপেক্ষা করা, ছোট করার মধ্যে আনন্দ পেতেন বড়দিদি।

এমন কতই পাঁচিল বড়দিদি তুলেছিলেন ভেতরে ভেতরে! সব কথা বাবা কি বলেছেন নাকি? কিছুটা অনুভব করা যায়। সেই সব অন্তরের পাঁচিল ভাইয়েদের মধ্যেও তুলেছিলেন তিনি। বড়বাবুর (বাবার ঠাকুরদা) প্রিয় সন্তান ধীরু, মানে ঠাকুরদা। নিজে পছন্দ করে ন’বছরের ঠাকুমাকে পুত্রবধূ করে বাড়িতে আনেন। ঠাকুমাকে সকলে সোনা বউ বলত। এমন রূপ ছিল তাঁর। শ্যামবর্ণা বড়দিদি সহ্য করতে পারেননি এই আদরের ডাক। এমন সোহাগিনী পুত্রবধূ। ঠাকুরদা নিজেও বিদেশ থেকে আধুনিক হয়ে ফিরেছিলেন। ঠাকুমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে হাওয়া খেতে যেতেন। সে এক আড়ম্বর। বাড়ির ভেতর থেকে আপাদমস্তক ঢেকে বেরোতেন ঠাকুমা। সদরের কাছাকাছি হলে ঝিয়েরা তাঁকে ঘিরে তুলে দিতেন গাড়িতে। পর্দা ঢাকা গাড়ির মধ্যে বসে কী হাওয়া খেতেন সেই পর্দানসীনা সে ভগবানই জানেন। এইভাবে কোথায় যেতেন তাঁরা? হাজরা রোডে বড়দিদির বাপের বাড়ি। আলোদিদি, অনাথদাদু, ডাক্তারদাদু, জাপুদিদিমা, এঁরা ছিলেন বড়দিদির আপনজন। সেখানে তাঁরা ঠাকুমাকে ভীষণ আদর করতেন। সোনা বউ বলে তাঁরাই প্রথম ডেকেছিলেন।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৯) । অনিন্দিতা মণ্ডল


অনেকদিন পর, ১৯৫৯ সাল হবে। একদিন মাঝরাতে বাবা ঠাকুমাকে ছাদে নিয়ে গেলেন। “ওই দেখো মা, ওই কানাইকাকাদের বাড়ি। আর ওইই পটলিপিসিমাদের জানলা। আর ওই যে বীণাদিদিদের ঘরের বারান্দা।” ঠাকুমা ছোট্ট মেয়ের মতন উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিলেন। কখনও শ্বশুরবাড়ির পাড়া চোখে দেখেননি। বাড়ির ছাদেই কখনও ওঠার অনুমতি ছিল না। মাঝরাতে মাতা পুত্রে আনন্দে মেতে উঠলেন। খুশি! খুশি! খুশি! আমার আবাল্য বাসভূমিকে একবার চোখে দেখি! একবার এই আকাশের হাওয়া আলো গায়ে মেখে নিই। মনে আছে বাবা এই স্মৃতি মন্থন করতে করতে যেন ফিরে যেতেন সেই রাতে।

আর একবার মধ্যরাতে গাড়ি চেপে ঠাকুমা কলকাতা ভ্রমণে গেছিলেন। যুগান্তর বাড়ির ছেলে বাবার প্রাণের বন্ধু। সেই মোকোকাকা আর বাবা মিলে ঠাকুমাকে কলকাতা ঘুরিয়ে ছিলেন। ঠাকুমা সেবারে অবশ্য অমন করে আনন্দ প্রকাশ করতে পারেননি। তখন তাঁর গলার স্বর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারদাদু বলেছিলেন, তপু সোনা বউঠান যা চায় করতে দে। তাই এই ব্যবস্থা।

সে বছর শেষ হতেই বাবা বিয়ে করলেন। ঠাকুমা আর ছ মাস রইলেন। পাঁচিল ভেঙে বেরিয়ে পড়া তাঁর আর হলো না। সে কাজটা বাবা করলেন।

একবার আমাদের শহরের প্রান্তে সেই ভাড়া বাড়িতে দিদা বলেছিল, তপেন তুমি টালা না ছাড়লে ভালো করতে। বাবার মুখ বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছিল। মা তবু দাদুর চাকরির সুবাদে নানা জায়গা ঘুরেছে। কিন্তু বাবা যে কত পুরুষের বনেদ উপড়ে ফেলেছে। বুকে কি কম রক্ত ঝরেছে? নিরুপায় ছিল বলেই এমন ঘটেছে।

কিন্তু এসব কথা বেশিক্ষণ চলতে পারত না। তখন সবে ‘দেখি নাই ফিরে’ শুরু হয়েছে। দিদা ভীষণ মনোযোগ সহকারে পড়ছে। হাউজিং থেকে স্বরূপ কাকু আসে আলোচনা শুনতে। আর, একই সময় অজিত জেঠু তৈরি করছে ‘পাপ পুণ্য’, তলস্তয়ের পাওয়ার অফ ডার্কনেস অবলম্বনে। বাবা সেই মহড়ার গল্প করছে। আমরা শুনছি। মনে মনে দুঃখ আছে। আমি অজিত জেঠুর ‘তিন পয়সার পালা’ দেখিনি। তখন এতই ছোট আমরা যে বাবা মা আমাদের রেখে কলকাতায় এসেছিল। সেই রবিবারে গিয়েছি বেলেঘাটায়। চারতলার বারান্দায় সেই প্রিয় মানুষ। তাঁর গলার দমক কী! ডাকছেন—মামনি মামনি! খোলা হাসিতে সরু রাস্তাটা ভরে যাচ্ছে। আমি গুটিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার লোকে কি আমাকে হাঁ করে দেখছে? আমি তো কিচ্ছু নই! আমি নগণ্য! আমি ক্লাস ইলেভেনের পুঁচকি। আর জেঠু তো বিখ্যাত।

সিঁড়িতে ওঠার মুখে মহড়া ঘর। পাশ কাটিয়ে উঠছি। একেবারে চারতলায় দাঁড়িয়ে আছে জেঠু। জেঠুর জুতো দেখে আমার এক্কেবারে ছোট বোন খুব ভয় পেয়েছিল। কিন্তু জেঠুর ওই বিশাল দেহ, ওই কণ্ঠস্বর আমাকে একরকম নিরাপত্তা দিতো। যেন অপার স্নেহ দিয়ে গড়া জেঠু। আমার যে আসার উদ্দেশ্য অন্যদের থেকে একদম আলাদা সেটা জেঠু জানত। “আয় আয় মামনি। আজ কলেজ বন্ধ?”

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>