| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৫) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

সেই রেলের চাকরি। সহকর্মীদের একটা দল। যারা এভাবেই সরকারি তহবিল তছরুপ করেছে। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু না। ওভাবে চাকরি রাখা যাবে না। চোরের দলে সাধু হয়ে থাকা যাবে না। রাজি না হওয়ায় একদিন শুনতে হয়েছিল, পানিশমেন্ট পোস্টিং হলে কিন্তু ছেলেপিলের মুখ দেখাও বন্ধ হয়ে যাবে। আর ভাগ নিবি না মানে? তোর নাটক চলবে? দিনের পর দিন তোর ডিউটি আমরা মেরে দিই। কি? না, বিপ্লব হচ্ছে। ভাগ। টাকা না নিলে পরে যা হবে হবে। কিস্যু বলতে পারবি না। তারপর এক-দিন মনে হল, এ যেন স্বাভাবিক। সত্যিই তো। নাটকের দল চালাতে টাকা লাগে। বাবার মুখটা আরও নীচু হয়ে আসে।   

আবার একটা ভরসার হাত আসে কাঁধে। দিদার গলার স্বর এমনিই নীচু। ‘তপেন একটু কফি খাবে?’ কালো কফি দিদার নিত্যসঙ্গী। বাবা কখনও কখনও মজা করে—মাসিমা ভি কে কৃষ্ণ মেননের ফিমেল ভার্সন। দিদা হাসে। এমনি করে দিন কাটে। শুধু থিয়েটারের কাছে আর ফেরা হয় না।

মনে পড়ে, এই তো সেদিন। দিল্লি আর আগ্রার বেঙ্গলি অ্যাসোশিয়েসান শারদীয়ায় নাট্যোৎসবের আয়োজন করে। দল নিয়ে সেখানে যাওয়া। কুড়ি থেকে পঁচিশ দিন থাকা। আগ্রার হোটেলের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথম দেখেছিলাম খাটিয়ায় মড়া নিয়ে যাচ্ছে বসিয়ে। সাদা চাদরে ঢাকা একটা মড়া শক্ত করে বেঁধে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা মাথার মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। কী যে অদ্ভুত লেগেছিল! তখনও মৃত্যুকে দেখিনি। চিনি না। তাই খাটিয়া দেখে বুঝতে পারিনি। মা যখন বলল, বুঝলাম একজন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খুকুমণিদির দাদা খুন হবার সময় বা তারপরে মৃত মানুষটাকে আমরা দেখিনি। ছোটদের দেখতে দেওয়া হত না। নৃশংস নিষ্ঠুর দৃশ্য। অথচ মৃত্যু যে স্বাভাবিক! জানা থাকলে বরং প্রস্তুত থাকা যায়। অকালে কেউ চলে গেলে ধাক্কাটা তত জোরে লাগে না। এমন প্রিয় কেউ যখন অকালে চলে গেছে তখন এক অভাবনীয় শূন্যতা আর শোক আমাদের শিশুমনকে বহু-দিন বিকল করেছে। খেলতে খেলতে সমস্বরে কেঁদে উঠেছি। রাতে ঘুমন্ত উঠে কাঁদতে শুরু করেছি। মা যদি মরে যায়? আতংকে গলা শুকিয়ে গিয়েছে। মায়ের হাতের স্পর্শে আবার ঘুমিয়েছি।

বাবার সঙ্গে আগ্রা গিয়ে আমরা প্রায়ই টাঙায় চেপে ফতেপুর সিক্রি যেতাম। তাজমহল তত নয়। কারণ মা আর বাবা, দুজনেরই প্রিয় ছিল ফতেপুর সিক্রি। ওখানকার নির্জনতা বরং আমাদের নিস্তব্ধ করে দিতো। চুপ করে বসে থাকতাম।

মনে মনে ভাবি, দিদা দাদু তখন কোথায় ছিল? আমার চেনা গণ্ডির মধ্যে তো ছিল না! অথচ কত কাছেই না ছিলাম আমরা! একটা অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্র নিশ্চয় আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। তাই বৃত্তের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম।   

কিসসা ২  

রাতের রেলগাড়ি যে কত দূরে যেতে পারে তার কোনও ধারণা প্রাপ্তবয়স্ক সচেতন মন করতেই পারেনা। সীমা দিয়ে গণ্ডি দিয়ে ভূগোলকে আমরা সান্ত করেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে অনন্ত ভূগোল আর সময়ের জাদুকরী মায়া হঠাৎ হঠাৎ মেঘ সরে গিয়ে জ্যোৎস্নার আলোর মতো বেরিয়ে আসে। কখনো মনে হয় স্বপ্নের জীবনটা সত্যি। কখনো বাস্তবের এই কঠিন জীবনটাও স্বপ্ন মনে হয়।

   সে-দিন সকালের রোদ্দুর খোলা জানলা দিয়ে মেঝেতে জ্যামিতিক নকশা তুলেছে। রেলিঙের ফুলকাটা নকশা।  সামনে একটা লম্বাটে টুলের ওপরে দিসতে কাগজ রেখে বুকে বালিশ চেপে লিখছে বাবা। কি লিখছে জানিনা। তবে জানি, এখন কিছু বললে শুনতে পাবেনা। যা বলব একটা উত্তর দিয়ে দেবে যা হোক। এটা লটারি। হ্যাঁ বলতেও পারে নাও পারে।

       আমি এখন ক্লাস সিক্স। আমাদের হাতিবাগানের ভাড়া বাড়িতে। গ্রে স্ট্রিট। বাজারের উলটো দিকে ক্ষুদিরাম বসু রোডের মুখে একটা একানে দোতলা বাড়ি। একতলায় রান্নাঘর একটুখানি উঠোন বাথরুম। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে একটা ছোট দালান আর রাস্তার ধারে একমাত্র শোবার ঘর। সারাটা দিন হট্টগোল আর লোকের ভিড়। নিস্তব্ধতা বলে কিছু নেই। রাতের বেলায় দুনিয়ার মাতাল হেঁটে বেড়ায়। পাইকিরি বাজারিদের সঙ্গে ফালতু বচসা। মফস্বলের সঙ্গে এই ব্যস্ত শহরের কোনও মিল নেই। সামনের মেঝেতে পড়ে থাকা ফুলেল নকশা নিয়ে খেলতে থাকি। পাঁচ ছটা তেঁতুল বীচি নিয়ে আলোভরা খোপে রাখি। আর লোফালুফি করে খেলতে থাকি। নকশাটা সেই তেঁতুল বীচির চকলেট রং নিয়ে পাল্টাতে থাকে। আমি ভুলে যাই। কি যেন? কি যেন অনুমতি নেবো বাবার থেকে?  চোখে ঘোর লাগে। মেঝেতে শুয়ে পড়ি। এতক্ষণ মাথা নীচু করে লিখে চলা বাবা হঠাৎ চোখ তুলে তাকায়।  ‘কি হলো?’ আমি উঠে বসি। একরাশ ঘন অবিন্যস্ত চুলে ভরা মাথা আর দুটো বড় বড় চোখ। অবাক হই। বাবা লক্ষ করেছে? তবে যে লিখতে গিয়ে কিচ্ছু দেখতে বা শুনতে পায়না? আস্তে আস্তে উঠে বিছানায় বসি। বাবা কাছে টানে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, কতদিন বলেছি ওসব তেঁতুল বীচি নিয়ে খেলা করোনা। আলোয় চোখে ওরকম ধাঁধা লাগে। আমি চুপ করে বসে আদর খাই। বাবা একসময় একটা ফাউন্টেন পেন আর দুটো কাগজ এগিয়ে দেয়। ‘যাও, বসে বসে তোমার যা ইচ্ছে লেখো।’ হাতে স্বর্গ পাই যেন। এমন সময় মায়ের কুন্ঠিত গলা ভেসে আসে।  গুগুল একটু কাঁচা লঙ্কা এনে দিবি? শেষ হয়ে গিয়েছে। লক্ষ্মী মেয়ে। দৌড়ে যা বাবা।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৪) । অনিন্দিতা মণ্ডল


    রেলগাড়ি থামে। আমি স্টেশন দেখে নেমে পড়ি। সবসময় এমন জনহীন স্টেশনেই কেন যে গাড়িটা থামে ! আমার হাতে কাঁচা লঙ্কার ঠোঙা আর ডান হাতে ধরা কাগজ কলম। প্ল্যাটফর্মের বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে আমি একপাশে লঙ্কার ঠোঙা রাখি। আর তারপর কাগজ পেতে কলম খুলে ধরি।

  বাবার কাপের শেষে পড়ে থাকা চায়ে চুমুক দিই। আঃ !

       মায়ের ডাকে চোখ খুলি। “কী ঘুম রে বাবা! নাও, খেয়ে উদ্ধার করো আমায়। এত ছুটে ছুটে খেলে বেড়ালে ঘুম পাবে না তো কী?” চারিদিকে ছড়ানো বই সরাতে সরাতে মা আমার হাত ধরে টেনে তোলে। আমি বলি—কাঁচা লঙ্কা আনতে ভুলে গেছি। মা উত্তর দেয় না। আমি আবার বলি—মামনের কলমটা কই? মা একথারও উত্তর দেয় না। শুধু নীচু স্বরে বলে—কী কপাল! ছাইপাঁশ সব স্বপ্ন দ্যাখে কেবল। আমি বোঝাতে পারি না, স্বপ্ন নয়, সত্যি।

আমার ভুলোকাকার জন্য ভীষণ মন কেমন করে। মনে পড়ে, ভুলোকাকা ওই ভাড়াটে ছেলেটার কথা শুনলেই চোখ নাচাত। আমরা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু সুতপাদি রেগে যেত। বলতো, ওরকম করার কিছু নেই।

ভুলোকাকা মিচকি হেসে বলত ওই ভাড়াটের কথা হচ্ছে। আমরা কিনা সাত পুরুষের ভাড়াটে। তাই বললাম। ভাড়াটের কথা শুনলেই দিদি, আমাদের বংশের কথা মনে পড়ে। ওঃ ভুলোকাকার গলায় সে কী গৌরব! “কত কত পুরুষ ধরে আমরা ভাড়াটে। যাই হোক এতে তুমি রাগ করনি।”

সুতপাদি তবুও ওর কচি মুখটাকে একটু গম্ভীর করত। অঙ্কুরদা ওকে রোজ টাটা করত। কি ভালোই লাগত।

এক-দিন ভাড়াটে ঘর ছেড়ে দিল। আমরা ভাবলাম সুতপাদিকে টাটা করার কেউ নেই। এবার থেকে সুতপাদি সময়মতো রিকশায় উঠবে। কিন্তু না। সে যেমন দেরি তেমন দেরি। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। ভুলোকাকা বলল-অব্যেস। সময় কি আর মানুষকে পোষ মানাতে পারে? মানুষই সময়কে পোষ মানায়।

তাই সুতপাদির দেরি দেখেও ভুলোকাকা রাগ করল না। বলল ভাড়াটেরা চলে গেলে একটু মন খারাপ হয়, আবার ঠিক হয়ে যায়। খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায় সবাই। আজ বড় দেরি হলো। শাস্তি বাঁধা।

আমরা কান খাড়া করলাম কারণ আজ ভুলোকাকা বলবে কিছু।

ভাড়াটে নিয়ে ওর কিছু কথা থাকবেই, কেননা ওরা সাত পুরুষের ভাড়াটে।

ভুলোকাকা গল্প শুরু করতো। আমরা শাস্তি পেয়েছি। এখন এক ঘন্টা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকবো। ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে থাকায় কোন অসুবিধা হতো না। যদি কারোর অসুবিধে হতো সে পেছনে পাঁচিলে খানিকটা ঠেস দিয়ে নিত। কিন্তু ভুলোকাকা গামছা পেতে ওখানে বসে বসেই গল্প বলতো।

-বাবা! আমাদের কত বাড়িই ছিল! এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি গিয়েছি। খুব সুন্দর সুন্দর সব বাড়ি।

– তোমার মনে আছে বাড়িগুলো?

– নাঃ। আমি আমার মন থেকে বলি। আমি কি সাত পুরুষের বাড়ি দেখেছি?

ভুলোকাকা রেগে যাচ্ছে দেখে আমরা চুপ করে গেলাম।

এবার আপনমনে গল্প শুরু হল।

“প্রথম যখন এখানে এসেছিল, তখন আমার সাত পুরুষ আগের বাপ দাদা এখানে বিলের ধারে হোগলা পাতার ঘর বেঁধেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক পেয়াদা এসে বললে তোরা এখানে ঘর বেঁধেছিস কি করে? এতো রাজার জায়গা!

আমার বাপ দাদা গেল ভয় পেয়ে। তারা ঘুরে ঘুরে বেড়াতো কিনা। যেখানে যে নদীর ধারে বিলের ধারে একটু জমি পেত বসে যেত। এবার কি হবে? তারা তো রাজার এলাকায় বসে পড়েছে! এখন খাজনা কোথায় পায়? কিন্তু পেয়াদা দিল এক চাপরাশ ঠুকে।

– থাকতে গেলে আশেপাশে চাষ করতে হলে রাজাকে কর দিতে হবে। খাজনা দিতে হবে।

কিন্তু জায়গাটা বড়ই ভালো। ওঠার কথা কেউ ভাবল না। তারা থাকতে শুরু করল সেখানে। অনেক দিনই ছিল। বেশি চাহিদা ছিল না তো। দুটো ধান দুটো মাছ হলেই তাদের চলে যেত।”

–তাহলে তারা সেখান থেকে চলে গেল কেন?

“কেন আর। তাদের রাজা একদিন অন্য রাজার কাছে হেরে গেল। সেপাইরা এসে তাদের সমস্ত ঘর বাড়ি ভেঙে তাদের ধানের গোলা লুট করে নিয়ে চলে গেল। কি আর করবে! আমার বাপ দাদা গরিব মানুষ।

লড়াই করতে জানেনা তারা। তাই সেখান থেকে হাঁটা দিল।”

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত