আমিত্ব’র বিরুদ্ধে নজরুলের আমি । আবু আফজাল সালেহ
কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) বিপ্লবী ও বিদ্রোহী চেতনার লক্ষ্য ছিল অবিচার, অকল্যাণ, অসত্য, অমঙ্গল এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, স্বদেশ বা ভারতবর্ষের স্বধীনতা ও মুক্তির জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং আমিত্বের বিরুদ্ধে আমি ও আমরা-কে তুলে ধরে প্রতিবাদ করা; সহযাত্রীদেরকে উঠসাহ জোগানো। ইংরেজিসাহিত্যের কবি বায়রন ও শেলীর চিন্তাধারা দ্বারা নজরুল প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন।
‘আমি দাবানল দাহ, দাহন করিব বিশ্ব’ অথবা ‘আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে’ বলে নিজেই প্রথমসারির যোদ্ধা হতে চান কবি নজরুল।এরপর অন্যদেরকে প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন : ‘বল বীর/ বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির!’, ‘আমি চির উন্নত শির’, ‘মম ললাটে রুদ্র ভগমান জ্বলে’, ‘আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্র দল’, ‘লাথি মেরে সব ভাঙরে তালা, যত সব বন্দিশালা’, ‘আগুন জ্বালা’ ইত্যাদির আমি অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে, বিপ্লবী যোজনা সৃষ্টি করেছে। প্রতিবাদী কাফেলায় নেতৃত্ব দিতে চেয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি কখন থামবেন? যখন ‘অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভ‚মে রণিবে না’ তখন থামবে কবির বিদ্রোহ, বিপ্লবী মনোভাব :
‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন–রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খক্ষ কৃপাণ ভীম রণভ‚মে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ–ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।’
নজরুল নিপীড়িত ও বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষের কবি। শ্রেণীবৈষম্যের শিকার মানুষগুলোই হয়ে ওঠে তার কবিতার বিষয়বস্তু। জীবিকার জন্য শ্রমজীবী মানুষ নজরুলের কবিতায় স্থান পেয়েছে। তিনি তাঁর কবিতায় গণমানুষের ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা তাঁর কাছে একটু অন্যরকম ছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষেও স্বাধীনতাকামীদের অশান্তির কারণ। নজরুল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ঘৃণা করতেন। নজরুল কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বা ভারতবর্ষ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয়-অংশগ্রহণ তাকে একাধিকবার কারাবরণ করতে বাধ্য করে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও অবিভক্ত বাংলার সংগ্রামে নজরুল সবসময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন গণমুখী সাহিত্যিক; ধর্মান্ধতা, অন্যায়-অবিচার, চরমপন্থা, শোষণ-তোষণ, নিপীড়ন ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদী। নজরুলের ‘আমি’র মধ্যে খুঁজে পাই এক অদম্য মানবিক-চেতনা।
নজরুল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন যা প্রায় প্রতিটি সমাজে রয়েছে। এসব অপশক্তি স্বাভাবিক ও মানবিক সম্পর্ককে নড়বড়ে করে দেয়; উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। নজরুল অত্যাচারীদের মুখোশ খুলে দেন এবং শোষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। যারা সামাজিক শ্রেণী, মানব সম্পর্ক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সু¯পষ্ট ব্যবধান তৈরি করে থাকে এবং যেখানে মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট হয় সেসব অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নজরুল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক কুসংস্কার এবং প্রতি অবিচার দরিদ্র, নারী এবং নিষিদ্ধ মানুষ। ব্রিটিশ সরকার তার বই ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে চায়। অসংখ্য হুমকি-ধামকি এবং একাধিক কারাবরণ করলেও তাঁর বিপ্লবী চেতনাকে থামানো যায়নি। নজরুল প্রকৃতির উপজাত থেকে বাস্তবের শিক্ষা বা জীবনের পাঠ নিতে চেয়েছেন। জীবনের বাস্তব পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রকৃতির কাছে আবদ্ধ হয়ে, তিনি সাধারণ মানুষের গান গেয়েছেন। তিনি ঘূর্ণিঝড় থেকে ধ্বংসের চেতনা নেন, হারিকেন, টর্নেডো, আগ্নেয়গিরি, ভ‚মিক¤প, বন্যা ইত্যাদি থেকে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। নজরুল নিজেকে বলেছেন ঘূর্ণিঝড, হারিকেন, টর্নেডো, বজ্র, টর্পেডো, মাইন, আগ্নেয়গিরি, ইসরাফিলের শিঙ্গা/বাঁশি, সমুদ্রের উত্তাল গর্জন, অরফিয়াসের বাঁশি, উন্মত্ত বন্যা ইত্যাদি ভেবেছেন; এসব শব্দের ব্যবহার করে বিদ্রোহীসত্তাকে জোরালো করেছেন। এগুলো সব বিদ্রোহের উপাদান, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরাক্রমশালী। এই সমস্ত ইঙ্গিত করে তিনি সমাজের সমস্ত মন্দ ও প্রতিক‚লতার চ‚ড়ান্ত ধ্বংসকারী হতে চান বলে আমরা মনে করি। নজরুলের ‘‘বিদ্রোহী’’ কবিতায় বিপ্লবী সুর-
‘মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস।
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বির
আমি দূর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার
আমি অনিয়ম উশৃঙ্খল
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
আমি মানি না কো কোন আইন
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম, ভাসমান মাইন…।’
একজন সংস্কারক, সাহসী, আপসহীন সাংবাদিক হিসেবে নজরুলের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। লাঙ্গল, ধূমকেতু, সেবক এবং নবযুগের সম্পাদক হিসেবে তিনি জ্বলন্ত সম্পাদকীয় ও মন্তব্য লিখেছেন এবং জনগণকে পরাধীন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে আহ্বান জানিয়েছেন। সাম্যবাদীর মূলসূত্র ছিল এমন ‘নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই’ অথবা ‘পীড়িতের নাই জাতি ও ধর্ম, অধীন ভারতময়, তারা পরাধীন, তারা নিপীড়িত, এই এক পরিচয়’। তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার মূলসুর বা চেতনা হচ্ছে ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’। নজরুল তাঁর চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।
নজরুলের কালবৈশাখী, টর্পেডো, সাইক্লোন, অর্ফিয়াসের বাঁশি, কিন্তু কম জোরালো নয়। ‘মানুষ’ ছিল তাঁর মূল উপজীব্য। নজরুলের আমি’র মধ্যে আমিত্ব নেই। নজরুলের ‘আমি’ মুক্তিপিয়াসিদের পথপ্রদর্শক; অন্যায়ের প্রতি, অবিচারের প্রতি প্রবল বিরোধিতা। নজরুলের ‘আমি’ সমস্ত অত্যাচারী শাসকের প্রতি অস্ত্র, কুসংস্কারের প্রতি ঘৃণা। নজরুলের ‘আমি’ নষ্ট করেছে ক্ষমতাবানদের তথাকথিত ‘আমিত্ব’।

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট