irabotee.com,বহুরূপী

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৫) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Reading Time: 2 minutes

এক একটা দুপুর বড় দীর্ঘ হত। সেইসব দুপুরে ছেলেধরার ভয় তুচ্ছ করে আমরা মাঝেমাঝে চৌকাঠ ডিঙোতাম। দেখতাম, নির্জন দুপুরে হাতে মস্ত খাঁড়া নিয়ে পথে নেমেছেন ‘মা কালি’।সবাই  ফিস্‌ফিস্‌ করে যতই তার মনসাতলার ‘গুপী’ নামটি বলাবলি করুক না কেন, আমরা তাকে মা কালি ভেবেই পয়সা দিতাম,পেন্নাম ঠুকতাম। তার নকল জিভ,নরমুন্ডের মালা,হাতের খাঁড়া আমাদের বেশ আকর্ষণ করত। চুল এলো করে,মাথায় লাল টকটকে সিঁদুর পরে ওরকম মা কালি হবার ইচ্ছে আমাদেরও হয়েছে। নেহাত হাতের কাছে কোন খাঁড়া ছিল না তাই, সে ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি।তবে আমাদের পাশের বাড়ির বিনু ওদের বাড়ির ছাদে একদিন মা কালি সেজে দাঁড়িয়েছিল।ওর পায়ের নীচের শিব হয়েছিল ওরই ভাই শানু। মায়ের লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে, এলোচুলে চওড়া করে সিঁদুর দিয়ে ভাইয়ের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ও। পয়সা কেউ দেয়নি, পেন্নামও ঠোকেনি।উল্টে অনেকেই ফিস্‌ফিস্‌ করে আলোচনা করছিল, “মেলাতলায় কেনা পিচবোর্ডের ওপর রাংতা মারা খাঁড়া নিয়ে কী গুপীর মত সাজ হয়? একেবারেই ফালতু লাগছে।”

irabotee.com, বহুরূপী

মা কালির শিবও বিড়বিড় করে বলছিল, “তাড়াতাড়ি শেষ কর।চারটে বাজে। সিনেমা ভাঙলেই মায়েরা এসে যাবে, এসব দেখলে বেধরক পেটাবে।আমি কিন্তু শুধুশুধু মার খেতে পারব না। এবার উঠে পড়ব।”

ওই ‘শুধুশুধু’ কথাটা ও এমনি এমনি বলেনি।ওর শিবের পার্ট যে নেহাতই এলে – বেলে, মা কালিই যে আসল, সেকথা আর সকলের মত ওরও অজানা ছিলনা। তাছাড়া সারাক্ষণ পেটের ওপর পায়ের ভার কারোর ভাল লাগার কথা নয়।  বলাবাহুল্য ওদের বাড়িতে সেদিন বড়রা সকলেই কিছু সময়ের জন্য অনুপস্থিত ছিলেন।

লাল সস্তা সিল্কের  কাপড়ের আঁচল উড়িয়ে দিন দুপুরে মা লক্ষ্মীও আসতেন।হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি। গুপীকে তখন একেবারে অন্যরকম লাগত।শান্ত, স্নিগ্ধ। কে বলবে এই সেই ভয়ঙ্করী মা কালি!

বহুরূপী গুপী কখনও কখনও ছাইভস্ম মেখে শিবও সাজত।শিবকে আমরা খুব একটা পাত্তা দিতে চাইতাম না।মাঝেমাঝে ত্রিশূল তুলে হুঙ্কার দিলে,আমরা একটুও ভয় না পেয়ে হাসতাম।গুপী ছাড়াও আরো অনেকে আসতেন সেজেগুজে।কখনও একা কখনও বা জোড়ায় জোড়ায়। সব বহুরূপীরাই মায়েদের কাছে খুব সমাদর পেতেন।কলা মূলো চাল ডাল তাদের ঝোলায় পড়ত।তারাও খুশি মনে ফিরে যেতেন।


আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৪) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


নিয়ম করে আসত মুড়িবুড়ি।তার কাছে থাকত টিন ভরা ভাজা মুড়ি।প্রতি সপ্তাহে এসে সে মুড়ি দিয়ে যেত।মায়েরা দুধের বড় বড় টিনের কৌটোয় ভরে রাখতেন মুড়ি। মুড়িবুড়ির কাছে শুখনো খোলায় ভাজা ছোলা বাদামও থাকত।মুড়ি দিয়ে খাওয়ার জন্য সেসবও কিছুকিছু নেওয়া হত।তবে শুধুমুখে খাওয়ার নিয়ম ছিল না।আর আমাদের যত মজা নিয়ম ভাঙাতেই।

শীতকালে আর একটা মজা ছিল।পাড়ার খেঁজুরগাছের গায়ে হাঁড়ি লাগানো থাকত। সেই হাঁড়িতে জমানো রস শীতের সকালে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতে আসত লোকজন। সেই টাটকা রসের গন্ধ আর স্বাদে মন ভরে যেত।আরো মনে আছে ওইসময়েই খেঁজুরের গুড় বা পাটালি বাড়িতে বিক্রি করতে এলে মুখে তার স্বাদ নিয়ে, তবেই কিনতেন বাড়ির বড়রা।আর আমরা ছোটরা হাত পেতে বসে যেতুম।বুঝি আর না বুঝি উপরি পাওনায় সব সময় যোগ দিতে হবে তো।শীতের সকালের সেসব মধুর আহ্লাদ এখন একেবারেই ভ্যানিস্‌।হাত পাতলেই ফল নির্ঘাৎ শূন্য , তাই কেউ আর হাতও পাতি না। 

‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ বিক্রি করতে আসত একজন।গোলাপী রঙের সেই ফোলানো রঙিন কুয়াশার মত জিনিসটা ছিল আদ্যন্ত রহস্য মোড়া।তবে স্বভাবে ছিল চটচটে,আর মুখে দিলেই হাওয়া। খেলেই জিভ রঙিন হত। শোনপাপড়িওলা দশ পয়সায় যে শোনপাপড়ি বিক্রি করত, তার কাঁচের বাক্সটিও গলায় ঝুলিয়েই আনত  ।একদম ছোটতে নাগাল না পেলেও, বড় হতেই বাক্সের মধ্যে উঁকি মেরে ফাউএর বায়না করতাম আমরা।ফাউ চাওয়ায় আমরা বেশ অভ্যস্ত ছিলাম।তবে সব জিনিসের যে ফাউ হয়না সেটাও মাঝেমাঝে বুঝতে হত।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>