ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১৩) । অনিন্দিতা মণ্ডল
কথা ৫
আমাদের মফস্বল শহরের বাড়িটা ছিল এক পাগলা গারদের গায়ে। দোতলার ওপরে থাকতাম আমরা। লম্বাটে গড়নের বাড়িটার সামনে ছিল একটা গলি। আর পেছনে ছিল খুকুমণিদিদের একতলা বাড়িটা। গাছপালার ছায়ায় স্নিগ্ধ। তার পেছনে অজস্র আম নারকেল আর তাল সুপুরি গাছের মধ্যে ছিল পাগলা গারদ। আমরা তেতলার ছাদে অনায়াসে উঠতে পারতাম। মা শুধু ভাস্করদাকে দেখতে পাঠাতো।
‘ভাস্কর, যাও ছাদে। ছেলেমেয়েগুলো কী করে দ্যাখো’। ভাস্কর-দা উড়িষ্যাবাসী। লম্বা চেহারা। গায়ে লম্বা মের্জাই আর পরনে তাঁতের ধুতি। তার ডান পায়ে ছিল গোদ। আমাদের সব বিস্ময়ের উৎস ছিল ওই ডান পা। দূরের পাগলা গারদের ছাতে তখন তারা পাগলি দুহাত আকাশে তুলে গান গাইত আর নাচত। তারা পাগলিকে দেখে ভাস্করদা দুঃখ করত, ‘আঃ, ঝিটা সুন্দর অছি। কেমতি হইল পাগলি! আঃ!’ আমরা তারা পাগলিকে দেখে কিছুই বুঝতাম না। দিদি ওর মতো গান করতে চেষ্টা করত আর আমি তার তালে তালে নাচতাম। ভাস্করদা ভাবত আমরা ওকে ভেঙাচ্ছি। খুব রেগে যেত। ভাই ছিল ভারী নরম। ও তখন মাত্র পাঁচ। ও গিয়ে ভাস্করদাকে জড়িয়ে ধরত, ডান পায়ে হাত দিয়ে বলত, ব্যাথা? ভাস্করদা খুব লজ্জা পেত। ‘আঃ! ছি ছি!’
ভাস্করদা আমাদের কেউ হত না। মাঝে মাঝে আসত আমাদের বাড়ি। আমাদের মাকে ডাকত ‘মা’ বলে। আমরা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। এত বড় মানুষটা মায়ের ছেলে? মানে আমাদের দাদা? দিদি একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘ভাস্করদা আমাদের দাদা হয়, মা?’ মা হেসে মাথা নেড়েছিল। মা যেহেতু বলেছিল ভাস্করদা মায়ের ছেলে এবং আমাদের আপন দাদা, আমরা নিশ্চিত জেনেছিলাম ভাস্করদা আমাদের নিজের দাদা। বড় হয়ে বুঝলাম উড়িষ্যাবাসী ভাস্করদা হয়ত মায়ের থেকেও বয়সে বড় ছিল। শৈশব চলে গেলে জীবন থেকে সত্যি সম্পর্কগুলোও বিদায় নেয়।
ভাস্করদার একমাত্র আকর্ষণ যে ‘মা’ সে আমি বড় হয়ে বুঝেছি। ও বসে বসে মায়ের সঙ্গে ভাঙা বাংলায় নিজের দেশের গল্প করত। এ শহরে এক দোকানে চাকরি করত। মাঝে মাঝে দেশে যেত। মা উনুনে রান্না চড়িয়ে বাটনা পিষতে পিষতে দোরগোড়ায় বসে থাকা ভাস্করদার সঙ্গে গল্প করত। মা বলত, ‘ভাস্কর, আমার মা আর দাদারা তো তোমার দেশ ঘেঁষেই থাকে গো। চাঁইবাসা নাম শুনেছ? ওই কাছেই আমার দাদারা থাকে’। মায়ের কথা শুনে ভাস্করদা ওর চোখগুলো ছোট ছোট করে চাইত। মনে করতে চাইত ওর দেশ থেকে মায়ের দেশ কতদূরে। কিন্তু না পেরে চোখ নামিয়ে ফেলত। মা বুঝতে পেরে বলত, ‘ও আর কতই বা দূরে হবে। বড় জোর একবেলা? নাও চা টুকু খেয়ে ফেলো’। ভাস্করদা রেকাবি থেকে গরম রুটি তরকারি আর চা খেতে খেতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত। সত্যিই তো! মায়ের চেয়ে ওর দেশ বেশি দূরে হতে পারে নাকি?
আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১২) । অনিন্দিতা মণ্ডল
একবার বিজয়ার প্রণাম সারতে আমাদের নিয়ে বাবা আর মা রওনা হয়েছে শহরের দিকে। সদরের কাছে পা গুটিয়ে ধুলোয় বসে আছে ভাস্করদা। মাকে প্রণাম না করলে হবেনা। কিন্তু বাবা? বাবা তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাকে বলে। ভাস্করদা বাবার বাবার বয়সী না হোক, মায়ের তো বাবার বয়সী বটেই। বাবা দৌড়ে ট্যাক্সিতে বসে পড়েছে। আমরাও ভেতরে। দেখছি, মা দাঁড়িয়ে। ভাস্করদা মায়ের সামনে গড় হয়ে প্রণাম করছে। মা বলছে, থাক থাক। ভাস্কর কাল এখানে একটু ভাত খেও। কেমন?
ট্যাক্সি চলছে। আমরা পেছনের কাঁচ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, হাত দুটো জড় করে ভাস্করদা দাঁড়িয়ে।
সেবার বিজয়ার প্রণাম করতে গিয়ে দেখি, আমাদের শান্তির জল আসে বাবার যে ঠাকুরদার বাড়ি থেকে, এবছর তাদের পুজো বন্ধ। ছোড়দাদু বললেন, বাগবাজার থেকে শান্তি আসছে। কার বাড়ি, কে শান্তির জল আনছে, সেকথা জানা গেলনা। কিন্তু রাত হল সেই শান্তির জল আসতে। বাবার মুখটা বেদনায় ভরে আছে। বাড়ি ফেরার সময় মা জিজ্ঞেস করল, ‘মেজদাদু তো খুব ধনী ছিলেন গো। ও বাড়ির পুজো বন্ধ হয়ে গেল কেন? ওদের তো শুনেছি ট্রাস্ট আছে।’ বাবা চুপ করে ছিল। হঠাৎ বলল, “আমাদের পুজো কেন বন্ধ হল জানো? ওই পাঁঠা বলির সময় একবার এমন কান্নাকাটি করেছিলাম যে বড়ঠাকুরদা বলি বন্ধ করে দিলেন। তারপর যে বছর বাবা চলে গেলেন সেবছর থেকে পুজো বন্ধ হল। কালাশৌচ ছিল বলে আমাদের দালানে যাওয়ার অনুমতি নেই। ওদিকে কুমোর চলে এসেছে ঠাকুর গড়তে। বাবার বড়ঠাকুরদা তখন বৃদ্ধ হয়েছেন। বললেন, বৌমা, এ বাড়িতে আর পুজো কোরো না। তোমার কোল আলো করা ছেলে চলে গেছে। তার বাপমরা ছেলেপিলেগুলো এবার মায়ের মুখে আনন্দ দেখতে পাবে না। জগজ্জননী কি লজ্জায় তাদের মুখের দিকে চাইবেন? এ পুজো আর হবে না। ধীরু নেই। মনে রেখো’। বড়দিদি অবশ্য সে কথা ভালো মনে নেননি। কিন্তু কি করা? বড়ঠাকুরদা তখনও বেঁচে। নব্বইয়ের ওপরে বয়স। সংসারে সন্ন্যাসী। কথা শুনতেই হবে।
শাস্তি অবশ্য পেতেই হতো। ছেলে নেই, ছেলের আয় নেই। ফলে, সে বছর থেকে প্রতি বছর পুজোর সময় আমার ঠাকুমা বাপের বাড়ি চলে যেতেন। বড়দিদি নাকি মলিন মুখ পুজোর সময় সহ্য করতে পারতেন না।
মা অন্ধকারে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। আমরা তখন ঘুমে ঢুলে পড়ছি।
গলির মুখে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে হতো। কিন্তু আমরা তিনজন তো ঘুমিয়ে। বাড়িতে খাটে কে শুইয়ে দিলো টের পাইনি। সকালে মা বলল ভাস্করদা গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। এক দিকে ভাই আর একদিকে আমাকে কাঁধে ফেলে বাড়ি এনেছে। আর দিদিকে নিয়ে এসেছে বাবা।
আমাদের সেই পূর্বপুরুষ, বাবার বড়ঠাকুরদাকে আমরা দেখিনি। বাবার শিশুকালেই তিনি চলে গিয়েছেন। কিন্তু যখনই তাঁর মুখ মনে করার চেষ্টা করেছি, দেখেছি ভাস্করদার মুখ। উৎকলবাসী সেই প্রৌঢ়। যার মুখে আমরা সমুদ্র আর জগন্নাথ ছাড়াও এক অন্য উড়িষ্যার গল্প শুনেছি। ভাস্করদার সেই বাড়িও কম অদ্ভুত নয়।
ভাস্করদা বলত ওদের বাড়ি এক পাহাড়তলিতে। সে উড়িষ্যা হলে কি হয়, সেখানে সমুদ্র নেই। নরম পাহাড় জঙ্গল আর ছোট ছোট নদীতে ভরা। সেসব নদী এমনি সময়ে ভারি শান্ত ও রুগ্ন। কিন্তু বর্ষায় তারা ভীষণ দামাল হয়ে যায়। অবাধ্য কিশোরের মতো। আমরা অবাক হতাম। তারা কি মায়ের কথাও শোনে না? ভাস্করদা বলত, ওদের মা জন্মের পরেই ওদের ছেড়ে চলে যায়। তাই ওদের শাসন করবার কেউ নেই। ওই অবাধ্য কিশোরের দামালপনার জন্য ভাস্করদারা নাকি মাঝে মাঝেই নিজেদের ঘরদোর ছেড়ে পাহাড়ের গায়ে উঠে যায়। সেখানে অস্থায়ী ঘর বানায়। আমি বলে উঠি, জানি। ভুলোকাকাদের ওরকম একটা বাড়ি ছিল। অবশ্য অনেকদিনের কথা। ভুলোকাকা নিজে সে বাড়ি দেখেনি। তবে ও জানে। ভাস্কর-দা হাসে, বলে, মিথ্যুক। ভুলোর ঘর তো রেললাইনের ওপারে। মাখলায়। আমি ক্ষুণ্ণ হই, না না! অনেক পুরুষ আগে ভুলোকাকার বাপ ঠাকুরদাদের ওরকম বাড়ি ছিল তো। নদীর ধারে। বন্যায় জল আসত উঠোনে। ভাস্করদা হাসে, আচ্ছা আচ্ছা। বুঝেছি। তবে আমাদের বন্যা এখন কমেছে। নদীতে বাঁধ পড়েছে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। যাক। কিন্তু ভাস্করদার মুখটা তো দুঃখী লাগে। ভাস্করদা বলে, জমিতে পলি পড়ে না গো আর। খেতে ফসল ভালো ফলে না। তাই তো এদিকপানে চলে এসেছি। পেটের ধান্দায়। নয়তো বাপ পিতেমোর ভিটে ফেলে কেউ আসে? আমি কিছুতেই ভুলোকাকার সঙ্গে ভাস্করদাকে মেলাতে পারি না। একজন ভাড়াটে বলে কী গর্ব করে! আর ভাস্করদা? পিতৃপুরুষের ভিটের জন্য তার মন খারাপ হয়!
একদিন হিসেব মিলে গেল। ভাস্কর-দা যেন বাবার সেই বড়ঠাকুরদা। আর ভুলোকাকা ঠিক বাবার মতোই। ওর রক্তে সেই আদিম পুরুষের টান। কোথাও সে শিকড় নামায় না। স্রোতে ভেসে ভেসে সে ভিন্ন ভিন্ন পাড়ায় পড়শি করে।
কয়েকটি ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। জাগ্রত বিবেকে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লেখা হয়। মাতৃ শক্তিতে ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অমিয়কায়’ প্রকাশ হয়ে চলেছে। খোয়াবনামা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘লঙ্কাধীশ রাবণ’। ঋতবাক প্রকাশনা থেকে ঐতিহাসিক গল্প সঙ্কলন ‘রাজোচিট; প্রকাশিত। এছাড়া ঋতবাকে নিয়মিত লেখা প্রকাশ হয়। আত্মপ্রকাশ ‘একালের রক্তকরবী’ থেকে।