| 10 অক্টোবর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: কেন পুরুষ পাখিরাই সুন্দর

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
প্রকৃতিতে কান পাতলেই বসন্তের আগমন টের পাওয়া যায়। আর এ বার্তা দেয় কোকিল। বাংলা সাহিত্যে বসন্ত আর কোকিল নিয়ে কবিতার ছড়াছড়ি। অনেকেই হয়তো জানেন না যে কোকিলের কুহু ডাকে মানুষ মাতোয়ারা সেটি আসলে পুরুষ! মজার ব্যাপারে হলো, বসন্তের কবিতায় বারবার কোকিলের প্রসঙ্গ এলেও সম্ভবত পাঠকও কোকিলের লিঙ্গ অনুসন্ধানে কখনো প্রবৃত্ত হন না। অথবা অনেকে ধরেই নিয়েছেন এমন কুচ-বরণ তীক্ষ্ণ সুরেলা কণ্ঠের পাখিটি নিশ্চয়ই মেয়ে!
 
প্রকৃতপক্ষে স্ত্রী কোকিলের গলার স্বর ভাঙা ভাঙা, খুবই বিশ্রী! গায়ের রঙও মোটেই আকষর্ণীয় নয়- কিছুটা খয়েরি, তার ওপর সাদা ডোরা ও ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে। স্বভাবে খুবই লাজুক!
 
বেশিরভাগ পাখি প্রজাতিতেই লিঙ্গভেদে এমন চেহারা ও আচরণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পুরুষ প্রজাতিটিই হয় সবচেয়ে উজ্জ্বল, কেশরের মতো বড় পালকযুক্ত আর সরব। অনেক পুরুষ পাখি রীতিমতো স্থাপত্য ও নৃশ্য শিল্পী। এরা সুন্দর করে ঘর বানায়, নাচে। কিন্তু এর মানেই যে সৌন্দর্যে পুরুষরা নারীর চেয়ে এগিয়ে- এমন লিঙ্গ বৈষম্যমূলক গড়পড়তা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাও ঠিক হবে না। এমন ধারণা বহুদিন প্রতিষ্ঠিত থাকলেও সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
 
গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ পাখির সৌন্দর্য আসলে অনাকর্ষণীয় চেহারার স্ত্রী পাখিরই পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে বিবর্তনীয় বিকাশ। তাছাড়া আত্মরক্ষা ও প্রজাতিরক্ষার জন্য এমন পার্থক্য থাকাটা জরুরি। তাছাড়া স্ত্রী পাখিকে সঙ্গী করতে এই তথাকথিত সুন্দর পুরুষ পাখিদের প্রচুর ঘাম ঝরাতে হয়। অনেক সময় একটি স্ত্রী পাখির ভরণপোষণের দায়দায়িত্ব বহন করে একসঙ্গে একাধিক পুরুষ পাখি।
 
মানুষের সাধারণ ধারণা, নারীরাই বেশি সুন্দর হয়, আর পুরুষেরা হয় রুক্ষ্ণ প্রকৃতির। কিন্তু অনেক পাখির ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম অনেক চিন্তাশীলকেই ভাবিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার ‘সঙ্গী বাছাই তত্ত্বে’ (থিওরি অব সেক্সুয়াল সিলেকশন) অনেক যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, প্রজাতির প্রজন্ম রক্ষায় সহায়ক বলেই নারী-পুরুষে কিছু পার্থক্য সৃষ্টি হয়। যেমন: বড় ঝুঁটি, লেজযুক্ত উজ্জ্বল চকচকে বর্ণ সুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ করে। এ কারণে স্ত্রী পাখি এমন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়।
 
ডারউইনের সঙ্গী বাছাই তত্ত্বেরই সম্প্রসারণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ত্রীলিঙ্গকে আকৃষ্ট করতে পুরুষরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততে সুন্দর ও শক্তিশালী শিং, সুন্দর রঙিন পালক অথবা অন্যান্য আলঙ্কারিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রদর্শন করে। এটি তাদের সুস্বাস্থ্যকে প্রকাশ করে। স্ত্রী পাখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখে, যেন কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির সামনে গরীব শিল্পী তার শিল্পকর্ম প্রদর্শন করছে! স্ত্রী পাখির অনুমতি মিললেই কেবল মিলন হতে পারে। এভাবে সঙ্গী বাছাই প্রক্রিয়ায় নারীকে মুগ্ধ করতে নাচ গান শিল্প দক্ষতা ইত্যাদি প্রদর্শন করে পুরুষ। আর স্ত্রী জাতি যেন বসে থাকেন বিচারকের আসনে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে এমন অতি সাধারণ একটি ধারণা বহুদিন ধরেই বেশ পাকাপোক্ত হয়ে রয়েছে। তবে আধুনিক গবেষণা বলছে, স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে এই শারীরিক ও আচরণগত পার্থক্য ব্যাখ্যা এটি খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি।
 
ডারউইনের ধারণাটিকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী অ্যাঙ্গাস জন বেটম্যান। তার মতে, পাখি ডিম বেশ বড় এবং এতে প্রচুর পুষ্টি থাকে। ডিম উৎপাদনে একটি স্ত্র্রী পাখিকে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু পুরুষ পাখির শুক্রাণু থাকে লাখ লাখ আর উৎপাদন খরচও কম! তাছাড়া একটা পুরুষ পাখি চাইলেই অনেক স্ত্রী পাখির সঙ্গে মিলিত হতে পারে। কিন্তু একটি স্ত্রী পাখির সন্তান জন্মদানে একটির বেশি পুরুষের অংশগ্রহণ সম্ভব নয়। এ কারণেই স্ত্রী পাখিকে খুব ভেবে চিন্তে সঙ্গী বাছাই করতে হয়। তাকে ভাবতে হয় কে তাকে সবচেয়ে সুস্থ শিশুটি উপহার দিতে পারবে। এ কারণে সেরা পুরুষটি বেছে নিতে হয় তাকে।
 
 
রঙ এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই প্রজাতির সদস্যদের দূর থেকে চিনতে পারার ক্ষেত্রেও রঙের ভূমিকা রয়েছে। এমন কিছু পাখি আছে যেগুলো ‘সে খাওয়ার যোগ্য নয়’ শিকারী প্রাণীকে এমন বার্তা দিতে গায়ের রঙ ব্যবহার করে। সীমানা ও সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতায় পুরুষ প্রজাতির মধ্যে লড়াইয়ে রঙ শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। উজ্জ্বল রঙ দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী বুঝতে পারে এলাকা এরই মধ্যে দখলে গেছে এবং এর মালিক লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত। লাল স্কন্ধ ও লাল পাখার একটি কালো পাখি এর চমৎকার উদাহরণ। ঘাড়ের লাল অংশটি তারা ঢেকে রাখতে পারে। এ রঙ শুধু স্ত্রী পাখিকেই দেখায়, কখনোই কোনো শিকারী পাখি এটি দেখতে পারে না। আরো একাধিক পাখি প্রজাতির মধ্যে এমনটি দেখা যায়।
 
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পাখিরা মানুষের চেয়ে বেশি রঙ দেখতে পারে। পাখিরা একটি রঙের বর্ণালীর অতিবেগুনী অংশটি দেখতে পারে। এ কারণে মানুষের চোখ দেখতে অক্ষম এরমন রঙও তারা দেখে। দেখা গেছে, অনেক পুরুষ পাখিকে খালি চোখে এক রঙের মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের উজ্জ্বল অতিবেগুনী রঙ রয়েছে। স্ত্রী পাখি এই রঙের উজ্জ্বলতা বিচার করেই সঙ্গী বেছে নেয়।
 
পুরুষ পাখিদের এই যে সৌন্দর্য ও শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, তার আরেকটি কারণ হলো, স্ত্রী পাখির সঙ্কট সব সময়ই থাকে। কারণ স্ত্রী পাখিদের ডিমে তা দেয়া ও বাচ্চা লালনপালনে অনেক সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। অবশ্য কিছু পাখির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। তাদের মধ্যে পুরুষরা ডিমে তা দেয় এবং বাচ্চাদের দেখাশোনা করে, আর স্ত্রী পাখিরা এলাকা পাহারা দেয়। পুরুষ সঙ্গী বেছে নিতে স্ত্রী পাখিদের প্রতিযোগিতায়ও অবতীর্ণ হতে হয়। এক্ষেত্রে স্ত্রী পাখিরাই বেশি রঙিন ও উজ্জ্বল হয়। ফালারোপ, স্যান্ডপাইপার এসব ধরনের পাখির উদাহরণ।
 
 
২০০৫ সালে একটি গবেষণায় চমৎকার একটি তথ্য পাওয়া গেছে। টিয়াপাখির দুই লিঙ্গের মধ্যেই উজ্জ্বল ও রঙিন রঙ দেখা যায়। পুরুষরা উজ্জ্বল সবুজ আর স্ত্রী পাখিরা লাল ও নীল। এদের একসঙ্গে দেখলে আলাদা দুই প্রজাতি মনে হয়। সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়, এদের ক্ষেত্রে স্ত্রী পাখি বাসায় থাকে আর পুরুষ পাখি খাবার খুঁজে আনে এবং পাহারা দেয়। বছরের ১১ মাসই তাদের এটি করতে হয়। খাবারের সন্ধানে পুরুষ পাখিকে বাইরে যেতে হয় ফলে তাদের চিল শকুনের শিকারে পরিণত হওয়ার ভয় বেশি। কিন্তু তাদের গায়ের সবুজ রঙ গাছের পাতার সঙ্গে মিশে যায় ফলে শিকারী পাখির জন্য শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। সবুজের সঙ্গে অতিবেগুনী রঙও থাকে ফলে শিকারী পাখি দেখতে না পেলেও অন্য টিয়ার কাছে তা সহজেই ধরা পড়ে। ফলে তাদের রঙ একদিকে ছদ্মবেশ আরেকদিকে প্রদর্শন দুই কাজই করে। নীড়ে থাকার কারণে স্ত্রী পাখিকে শিকারী পাখি সহজে দেখতে পারে না। কিন্তু তাদের লাল ও নীল রঙ দেখে অন্য টিয়া পাখি দূর থেকে সহজেই তাকে শনাক্ত করতে পারে।
 
এক কথায় বলতে গেলে, রঙের এই পার্থক্যের উদ্দেশ্য হলো শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে স্ত্রী পাখিকে রক্ষা করা। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য স্ত্রী পাখিকে সারাক্ষণ নীড়ে বসে থাকতে হয়। এ সময় তার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা প্রায় থাকে না। তাই সাধারণত স্ত্রী পাখিদের গায়ের রঙ সাদামাটা ধরনের হয়, যেন সহজে চিল-শকুনের নজরে না পড়ে। বিপরীতে পুরুষ পাখির থাকে আকর্ষণীয় রঙ ও সাজ। তাছাড়া এই পুরুষ বেশ শক্তিশালী হয়, তাদের তাকে তীক্ষ্ণ ঠোঁট ও নখ। তাদের রঙ দেখে আকৃষ্ট হয়ে কোনো শত্রু আক্রমণ করতে গেলে তাড়া খেতে হয়। তাই কোনো শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষ তাকে সহজে ঘাঁটায় না। ফলে নারী পাখিরা নির্বিঘ্নে বাচ্চা ফোটাতে পারে। এভাবে ‘কম সুন্দর’ নারী পাখিরা প্রজাতির বংশবিস্তারে বিশেষ সুবিধা পায়। যদিও কোকিল সাধারণত নিজে বাসা বাঁধে না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রেও সঙ্গী বাছাইয়ে একই সূত্র কাজ করে।
 
বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস ও সায়েন্টিফিক আমেরিকান অবলম্বনে জাহাঙ্গীর আলম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত