| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

ইরাবতী পুনর্পাঠ গল্প: সাইকেলের রিমে সূর্যোদয় । আবুল বাশার

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

সূর্য এবং সূর্যের আলোর যে অভেদ তত্ত্ব তা সবচেয়ে সার্থক হয়েছে সাইকেলের রিমে।

মনে হলো বাহিরা মোমিনের। রব মোমিনের মেয়ে বাহিরা।

রসুলপুরে ওই বাপ-মেয়ের ভিটে। রসুলপুরের মোমিন পাড়ায়।

মোমিন ওদের পদবি। ওরা জোলা।

ওরা গরিব।

গরিব মানে দরিদ্রসীমার কখনও একচুল ওপরে এবং কখনও একচুল নীচে ওঠানামা করে ওদের পরিবার।

রব কিন্তু জাত-ব্যবসা করেন না।

করেন খলিফার কাজ। এখানে খলিফা মানে কোনও দিব্যপদ বা প্রশাসকের পদ নয়। খলিফা রবের বেলায় ‘খলিফা’ কোনও পদ নয়; তিনি একটা কাঁঠাল কাঠের টুলে বসে ঊষা-মেসিনে অর্থাৎ সেলাই-কলে জামা-লুঙ্গি-টুপি-বোরখা এবং কাফন ‘তয়ের’ করেন; তাঁরই কাট, তাঁরই সেলাই। ঊষা, সে-ও তো সূর্যই।

তারই আলো এসে পড়েছে রিমে. কাঁসার নরম আলোর মতো স্নিগ্ধ; বেলা বাড়লে কোমল ইস্পাত হয়ে ঝলসাবে।

এখন ঊষালোক রিমের ওপর বিচ্ছুরিত হয়ে ঠিকরে এসে চোখে লাগলে, চোখ, বাহিরার চোখ আশ্চর্য পুলকে পান করতে থাকে সেই আলো। বাপ-মা পান করতে থাকেন চোখের সাদা অংশে মেখে। বাহিরার অন্য ভাই (তিন জন) ও বোন (১ জন) খুশি হয় এই দৃশ্যে, যখন তেল দিয়ে সাদা নরম কাপড়ের টুকরোয় ঘষে-ঘষে রিমকে আরও মরচেহীন উজ্জ্বলতায় শাণিত করে তুলতে থাকে বাহিরা মোমিন।

এ রকম একটা সাইকেল বাহিরার ইজ্জত।

কেন, কী করে সেই কথাই বয়ান করতে গল্পের এই ভিয়েন।

টুলের চারটে পায়া বোধহয় ঠিক নেই। সমান নয়। নাকি সমান ছিল, পরে কাঠের রস সরবার সময় ছোটো-বড়ো হয়ে গিয়েছে খোদা মালুম। কাঠালের কাঠ তো, এমনিতেই নানান সমস্যা আছে। রস মরবার সময় কিছুটা বেঁকে-তেড়ে যায়।

ফলে রব মোমিন সেলাই-কল চালাতে-চালাতে পাছা সড়কে যাচ্ছে বুঝতে পারেন। অল্প-কেমন কাত হয়ে গেল, টের পান। তখন কোমর ঈষৎ বেঁকেও যায়। তাতে করে দাঁড়া ঠিক রাখতে গিয়ে, রবের মুখ সামান্য বেঁকে যায়; অল্প করে জিভ বার হয়ে পড়ে—তখনই স্ত্রী কাছে থাকলে বলেন, ‘জিভ সামলান মোমিন সাহেব, পাছা তোলেন, ঝুলে পড়ছে যে, তোলেন—তোলেন!’—‘সবই হচ্ছে ধনু ভাস্করের কাজ, বুঝলে না! বেগড় হবেই হবে! তা ছাড়া কচি কাঁঠাল গাছের কাঠ তো, ঘুণ ধরে কিনা দেখো! তা বেশ! বলছ যখন…।’

বলে কলের পা-দানিতে দু-পা দিয়ে ধাক্কা মেরে; অল্প-একটু পাছা তুলে সিধে হয়ে বসে নেন, তারপর বলেন, ‘পাছা হেলেছে তো কী, সেলাই সিধা থাকলেই হলো!’

রবের হাতের কাজ তত সূক্ষ্ম না; কাট-সেলাই-এর বানীও তাই কম। গঞ্জের মলিন দাস দর্জির সঙ্গে পেরে ওঠেন না। তাই নিয়ে তাঁর মনে ভারি দুঃখ।

গঞ্জে গিয়ে দর্জিগিরির সাহসই তাঁর হয়নি কখনও। রসুলপুর গ্রাম-এলাকার নিতান্ত গরিব মুসলমানই তাঁকে দিয়ে পোশাক করায়; শৌখিন হিন্দু বাবুরা মলিনের কাছে বরাত দেন। একটু শৌখিন মুসলমানও মলিনের কাছে পাজামা-পাঞ্জাবি করিয়ে নেয়।

তবে রব নিজেও জানেন, কলকাতায় এবং মফস্বল শহরে নামজাদা দর্জির বেশিরভাগই মুসলমান। কিন্তু তিনি মোটা কাজকে সূক্ষ্ম করতে পারলেন না। সূক্ষ্ম জিনিস সবার দ্বারা হয় না। তবে কথা সত্য, এই মুসলমানের দারিদ্রই মুসলমান এই দর্জিকে মোটা কাজের বরাত দিয়ে এই যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে।

মোটা কাজ, তাই বানি কম। এই হলো সার কথা।

তবে হ্যাঁ, এই ভয়াবহ গরিবির সঙ্গে লড়তে গিয়ে সংসারে এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর তা হচ্ছে, রব মোমিনের ছেলেরা বেশি দূর লেখাপড়া করে উঠতে পারেনি। রব তাঁর পুত্রদের স্কুল ছাড়িয়ে এনে যা হোক-কিছু উপার্জনের রাস্তায় দিয়েছেন।

বড়ো ছেলে রেজার কাজ ধরেছিল, পরে রাজমিস্ত্রি হয়েছে। ওর নাম জার্মান মোমিন; ও যখন আঁতুড়ঘরে তখন রেবা মোমিনের কী করে যেন পায়ের একটা আঙুল কেটে গিয়েছিল; সেই রক্তপড়া বন্ধ করতে জার্মান পাতার রস দেওয়া হয়; তখন রেবার মাথায় আসে, এ বাচ্চার নাম জার্মান হওয়াই তো ভালো।

তাই শুনে দাদিমা কারিমন বেওয়া (বিধবা) বললেন, ‘ছেলের নাম যদি জার্মান রাখারই ইচ্ছে বউমা, তাই রাখো—তাতে করে একটা সুবিধাও আছে।’

—‘কী সুবিধা মা?’ শুধোলেন রব।

কারিমন বললেন, ‘জার্মনের পর আরও যদি একটা মদ্দাবাচ্চা হয়, জাপান নাম দিব। তারও পরে যদি আরও একটা খোদা দেন তো, নাম রাখিও রাশিয়া মোমিন। লোকে আপত্তি করবে না।’

জার্মান ক্লাস এইটে ঠেলেঠুলে উঠল বটে, সংসারে অভাব। তাই তাকে রাজমিস্তিরির সহায়ক রেজা হতে হলো জীবনের গতিকে।

তবে রবের পত্নী রেবা নিজেও কিছু করিৎকর্মা মহিলা। খুব ভোরে, প্রত্যুষের আগে ফজরের নমাজ কায়েম করে ফুল তুলতে বার হন জজের বাগান আর মাস্টার পাড়ার মধ্যবর্তী মেথর রোডের বরাবর।

ফুল আর বেলপাতা নিয়ে বটতলায় বসেন। পূজোর জন্য ওই ফুলপাতা হিন্দু বাঙালি কিনে নিয়ে যায় রেবার কাছ থেকে।

প্রাক-প্রত্যুষ নমাজ হলো ফজর। তখন নুরের (আল্লাহর একটি নাম নুর) হাওয়া বয়। সম্ভবত মরু আরাবার বিভিন্ন জাতি আল-সাবাকে নুরের হাওয়া মনে করে। অন্তত সেইরকমই ইঙ্গিত মেলে আরবের ভৌগোলিক প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক সাক্ষ্যে ও প্রত্যয়ে। বাঙালি কবি পুবের হাওয়াকে যেমন করে স্তুতি করেছেন, তাইই হয়তো আল-সাবা (আরবেও আল-সাবা পুবের হাওয়া)।

ভোররাতে প্রায় সারা বছরই নুরের হাওয়া চলে। সেটাকে বাংলার এক নামী লেখক বলেছেন, ‘আঁধার-তাড়ানো’ হাওয়া। সেই হাওয়া গায়ে মাখতে-মাখতে মেথর রোডের এলাকায় বিভিন্ন হিন্দু বাড়ির প্রাচীর-ঘেরা ক্ষুদ্র জমির ফুলগাছ থেকে ফুলচুরি করেন রেবা মোমিন। এ মেথর রোডে অনেকগুলি ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস। যদিও নিম্ন ও মাঝারি বর্ণের লোকেরও জায়গা এটি। সবার বাড়ির সামনেই ফুলগাছ।

একটি মুসলিম চটি আছে এখানে। আছে হিন্দু বসতির ফাঁকে-ফাঁকে দু-চারটি মুসলিম ঘর—মেথর রোড অত্যন্ত শান্ত জায়গা। মুসলিম ‘চটান’ নাম মাস্টার পাড়া।

বাগান বা ফুলগাছ সকলি মেথর রোডের এলাকায়। অর্থাৎ হিন্দু-বসতিকে ঘিরে।

সেখান থেকেই ফুল চুরি করেন রেবা।

মোমিনপাড়া থেকে দ্রুত হেঁটে চলে আসেন রেবা মোমিন। তাঁর বাড়ি মাস্টার পাড়ায় নয়। রসুলপুর ( কেউ-কেউ বলেন, এটির নাকি আধুনিক কালে ‘অঘোর পল্লী’ নাম হয়েছে )। সে যা হোক। সেখান থেকে রিকশা করে মাকে বটতলা পর্যন্ত এনে নামিয়ে দেয় রাশিয়া মোমিন। আগে হেঁটেই আসতে হতো।

বটতলাতেই বাজার বসে। সবজি আর মাছের বাজার। এখানেই মাটিতে পাতলা চট ফেলে পুজোর ফুলের দোকান দেয় রেবা।

মা চণ্ডী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আর গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার—এই যে জোড়া মিঠাইয়ের দোকান, তার সামনের চাতালে জায়গা পেয়েছেন রেবা। ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মাটি পাড়ার ঘোষ বাবুরা। মিঠাইয়ের দোকানও ঘোষ বাবুদের—ওঁদের নানা ধরনের ব্যবসা রয়েছে এই মোড়ে।

একজন মুসলিম গৃহবধূ বটতলার মোড়ে চট পেতে পুজোর ফুল বেচেন এবং সেই ফুলও চুরি করা; যদিও সেটাকে চুরি মনে করেন না কেউ, ভাবেন, গরিব মানুষ নিচ্ছে নিক; ও ফুল তো এমনি ঝরে যাবে, যদি সে জিনিস তুলে নিয়ে গিয়ে মোড়ে চট পেতে বসে বেচে দু’পয়সা পায় তো মন্দ কী? ভগবান ফুলের পুজো পেলেই খুশি, কে তোলে আর বেচে এবং কোন ভক্ত সেই ফুল নিবেদন করে, সেই ব্যাপারে ভগবান বাছবিচার করেন না। ভারতবর্ষের ভগবান কোনও কালে অনুদার ছিলেন না। সেই ভগবান যে ছোটোলোক বানাবার চেষ্টায় আছেন যেন কারা! যাক গে। কথা হলো, রেবা এভাবে দু-পয়সা সংসারে জোগান দিতেন।

তবু সংসারের সাত-সাতটা প্রাণীর দু-বেলা ভালো করে মুখ ও পেট ভরত না। পুং বাচ্চাদের (জার্মান-জাপান-রাশিয়া)—এদের লেখাপড়া বেশিদূর এগোলো না। স্কুল থেকে মাঝপথে ছাড়িয়ে এনে কাজে জুড়ে দেওয়া হলো।

কিন্তু দুই মেয়ের বেলাতেই রব মোমিনের সিদ্ধান্ত অন্য রকম হলো। স্কুল থেকে মাঝপথে ছাড়িয়ে আনলেন না। কারণ মেয়েদের কাজ ধরানোর ব্যবস্থা তাঁর হাতে কিছু ছিল না।

তবে হ্যাঁ, ছাড়িয়ে আনার ইচ্ছে না থাকলেও, ছাড়িয়ে আনতে বাধ্য হওয়ার পরিস্থিতি রচনা করল ইজ্জতপুরের মাঠ।

বাহিরা-আহিরা দুই বোন। ওদের ছোটোমাসি ( ছোটোখালা )-র নাম মাশুরা মল্লিক—এই মাশুরা ছিল অবিবাহিতা, কোথাও কোনও দাগা খেয়ে সে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। অথবা কোনও অজ্ঞাত কারণে সে বিয়ের ব্যাপারে অকাট্য ভয় পেত।

অত্যন্ত হাসিখুশি ছিল মাশুরা মাসি; বড্ড অকারণে সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে হাসির নির্ঝর বইয়ে দিতে পারত।

তার একটি দোকান ছিল গঞ্জে; কাঠ-টিন দিয়ে তৈরি স্টল; নাম সদরঘাটের ব্লাউজ কর্নার। নিজেই হাওড়ার হাট থেকে ব্লাউজ (পাইকারি দরে কিনে) এনে স্টল সাজিয়ে বেচত। খুব জোরদার বিক্রিবাটা না থাকলেও যা বেচতে পারত, তার নাফা থেকে গরিব ভাইয়ের সংসার টানত মাশুরা।

একদিন সে ইজ্জতের মাঠে শেষ হয়ে গেল; তাকে ৪ জন মিলে ধর্ষণ করল—তাদের একজন ৫০ বছর, একজন ৩২ বছর, একজন ২৫ এবং একজন মাত্র ১৬ বছর। ধর্ষণের পর খুন করল। এরা ইজ্জতের মাঠের পাকুড়-দিঘির কাছে ইটভাটায় কাজ করত।

খুন শুধু যে একা মাশুরা হলো তাইই নয়, তার সঙ্গের ভাইটাও হলো। ভাই রসম আলি মল্লিক ছিল এক-প্রকার বোবাই; মুখ দিয়ে দুর্বোধ্যে শব্দ বার হতো; কথা বলার চেষ্টায় তার কোনও ত্রুটি ছিল না; কিন্তু সে কথা আল্লার ফরিস্তাও যে বুঝে উঠতে পারত, এমনটি বলা যায় না, সেক্ষেত্রে মানুষ তো মানুষই বটে, পারবে কী করে!

তবে মানুষ কিছু-কিছু বুঝে যেত রসমের অঙ্গভঙ্গিমা দেখে, যেন সে চমৎকার মূকাভিনয় করে সব ঘটনা বুঝিয়ে দিত। লোকে তার এই দেহভাষাযুক্ত অভিনয় উপভোগ করত। এমনকী ওই সরব বোবা ভাইটি কারও কারও মুদ্রাদোষ নকল করে দেখাতে পারত।

চৌদ্দ বছরের এই ভাইটাকে সঙ্গে নিয়ে গন্ধে যেত-আসত-ব্যবসা করত মাশুরা মল্লিক। ভাইই ছিল তার বডিগার্ড। কিন্তু ভাই পারল না দিদির ইজ্জত রক্ষা করতে; চোখেরই সামনে খুন হলো দিদি। তারপর তার বুকে সেঁধিয়ে গেল বিষাক্ত সরু গুপ্তি।

পাকুড়-দিঘির কাছে এসে ব্রেক কষে সাইকেল আচমকা থামিয়ে দিয়ে সাইকেলের ‘সিট’ থেকে নেমে পড়ল বাহিরা মোমিন। দিঘির পাড়ে পাকুড় গাছটির তলায় দাঁড়ালো; দাঁড়িয়ে কচুরিপানা (বাতরাজ)-এর দলবাঁধা ঝাঁকটার দিকে তাকালো।

সবচেয়ে বড়ো বাতরাজটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারল, কয়েকটি বাতরাজকে কিছু-একটা দিয়ে কেউ বেঁধে দিয়েছে। আর ওই বড়ো বাতরাজটার গোড়ায় একটা পুচকে সোনা ব্যাঙ বসে আছে, যেন ও আর কেউ নয়, ও ঠিক রসম আলি।

—‘মামু!’ বলে কান্নায়-ধরা গলার খাদে ডেকে উঠল বাহিরা।

এই রকম সুন্দর-সুন্দর জীবদের গলার খাদে অর্ধস্ফুট স্বরে ডেকে উঠে নিঃশব্দে কাঁদতে-কাঁদতে খানিকটা-বেশ আরাম পায় বাহিরা।

—‘যদি তুমি কাফিরদের হাত থেকে, বেনিয়্যাত হারামিদের কবল থেকে, যদি তুমি ওই শয়তান নারকীদের এক্তিয়ার থেকে ছাড় পেয়ে বেঁচে যেতে রসম মামু, ওগো বোবা, আধ-বোবা মামু, ওগো আল্লার খাসবান্দা মামু, যদি বেঁচে থাকতে, তা হলে তুমি কী করতে; ওগো সোনার মানুষ; ওগো রসুলের নিষ্পাপ উম্মত; কেমন করে দেখাতে কী করে কী হলো তোমার মাশুয়া আপার? বল, বল!’

এ বার কান্না উপচে নামল; দরদর করে নিঃশব্দে গাল ভাসিয়ে নামল। স্রোতে অত্যন্ত ধীরে ধীরে ভেসে, বাতরাজের গোল নৌকায় চড়ে বাহিরার চোখের সামনে দিয়ে কোনও এক সুন্দর দেশে চলে গেল সোনা ব্যাঙটা।

—‘বেঁচে থাকলে অঙ্গভঙ্গি করে দুর্বোধ্য স্বরে, তীব্র স্বরে মাশুরা খালার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা দেখাতে মামু! তাই তোমাকে খোদার কাছে চলে যেতে হলো! তোমরা মানুষকে বিশ্বাস করেছিলে!’

এই বলে রাস্তার ওপারের বাগান আর, ঝোপঝাড়, জঙ্গলের দিকে চোখ তুলে তাকাল বাহিরা।

মানুষের গলা অবদি উঁচু প্রাচীর-ঘেরা বাগান আর একটা। পরিপাটি জঙ্গল। জঙ্গলের ওপারে ইটভাটা। ওটার পাশে ক-একটা ইটভাটা। ওখান থেকে নসুহা-ননা-ছোটো রাম আর বাদুড়া এবং একটি যৌনপ্রেত বায় হয়ে এসেছিল। শোনা যায়, নসুহা কবরের খাপাটি খুলে সদ্য-দাফন করা নারীকে পর্যন্ত ধর্ষণ করতে ভালোবাসে।

খোদার পৃথিবীতে এ রকম নসুহা কেন জন্মে ধর্মশাস্ত্র ও বিজ্ঞানশাস্ত্র, কোনও শাস্ত্র বা সাহিত্য এর জবাব বার করতে পারেনি।

মানুষের হিমালয়-প্রমাণ মানবিক উচ্চতা নসুহার পায়ের তলায় এসে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গুঁড়িয়ে পড়তে থাকে—তখন মনে হয় এক-একটি মানব-সভ্যতার সার্থকতা একটি ফুলের পাপড়িতে মাখা। রেণুকণার এক কণার সমানও নয়। পুরুষ আসলে কী, যা কোনও খলিফাও ব্যাখ্যা করতে পারেননি। কোনও বুদ্ধও।

—‘খালাম্মা! তুমি কোনও একজন নসুহা আর তার দলের হাতে পড়েছিলে। আমাদের বড়ো অপরাধ বা বাড়তি অপরাধ আমরা সুন্দরী। দ্যাখো খালা, ইজ্জতের মাঠে সরষেদানার মতো আলো ছিল তখন বিদ্যুতের খুঁটির ঝুলন্ত বাল্বে; সেই আলো কখনও কখনও বেশ টলটল করে জ্বলতও কোনও কোনও সন্ধ্যায় ও রাতে। কোনও কোনও রাতে এমনটা হতো বলে নসুহা তার ছেলে দিয়ে, এটা কামুক-কিশোরে একটা তাকে দিয়ে ইট ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাল্বগুলোকে ভেঙে দিত। নসুহা আসলে আলোকে ভয় পায়। তার ওই ছেলেটাও তোমাকে ধর্ষণ করেছে। তোমাকে বহুদিন থেকে নসুহা টার্গেট করেছিল। তুমি খালা এত অবোধ ছিলে যে, পাড়ায় এসে বলেছিলে সরল গলায়, ওরা অমন করে বাল্ব ভাঙে কেন, ওইটুকুনই তো আলো! শোনা যাচ্ছে, আলো জোর হবে, কবে হবে জামাইবাবু! আমার বাবাকে মাঝে-মাঝে শুধোতে খালামা! বাবা চুপ করে থাকত। আমার বোবা মামু দুর্বোধ্য গলায় চোখে আলো জ্বেলে বলত হবে-হবে। মনে করো খালাম্মা; তুমি বেহেশ্ত থেকে আমাকে দেখেছ মা?’


আরো পড়ুন: পুনর্পাঠ গল্প: কাফননামা । আবুল বাশার


দিঘির ধারে উঁচু রাস্তাটা ঢাল হয়েছে। দিঘির গা-ঘেঁষে কিনারা বরাবর একটি চিকন সরুপথ ঘাসের ভিতর দিয়ে সিঁথিকেটে চলে গিয়েছে। এটি ধরে সাইকেল নিয়ে সাঁই-সাঁই করে চলে যেতে পারে বাহিরা। তার নাকে এসে লাগে জলজ উদ্ভিদের গন্ধ আর মনটা কেমন উন্মনা হয়ে যায়। তখন সাইকেলের গতি কমে আসে।

মাসুরা আর রসমের এ রকম ভয়াবহ-করণ-বীভৎস মৃত্যু মোমিন পাড়া ও রসুলপুরের সাধারণ মানুষের মনে এক অকাট্য ভয় ধরিয়ে দিলো। আহিরা কাছের স্কুলে যায় বলে এবং নীচের ক্লাশে পড়ে বলে রব মোমিন ছোটো মেয়ের পড়া বন্ধ করলেন না; কিন্তু বাহিরার গঞ্জের হাইস্কুলে গিয়ে বিদ্যা-উপার্জন পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন খলিফা।

বাহিরা বলল, ‘আমি পড়ব আব্বা!’

রব বললেন, ‘হবে না।’

—‘হবে।’

—‘কী করে হবে?’

—‘আমি দৌড়ে চলে আসব।’

—‘সাড়ে-চার-পৌনে পাঁচ মাইল পথ, তুই দৌড়ে আসবি? মুখের কথা।’

—‘পারব।’

—‘কী করে পারবি মা?’

—‘আমি দুলদুলি ঘোড়ার মতো ছুটে পার হয়ে আসব ইজ্জতের-মাঠ; পাকুড়-দিঘি ছুট্টে পালিয়ে আসব আব্বা!’

—‘পাগল!’

‘পাগল’ বলা মাত্রই ঝরঝর কেঁদে ফেলল বাহিরা। সে বুঝতে পারছিল, সব থেমে গেল। জীবনটাই বুঝি থেমে গেল। আর কি কোনও উপায় হয় না?

ইজ্জতের মাঠ কিভাবে অতিক্রম করবে বাহিরা—সূর্য ডোবার আগে।

বাড়ির বাইরে বার হয়ে এসে সকাল-সন্ধ্যায় একা দাঁড়াতো বাহিরা। কখনও দুপুরে দাঁড়াতো। তারপর এগিয়ে যেত চারা বটতলার শূন্য মাচা পর্যন্ত এখানে চৌমাথা। এর উত্তরে ছোটো নদী। পশ্চিমে তাদের পাড়া। পুব-দক্ষিণ এবং উত্তরে শস্যের মাঠ। পুবের দিকে গেছে যে মেঠোপথ, সেটা ধরে দশা রসি এগোলে শুরু হয়ে যাচ্ছে ইজ্জতের মাঠ।

সেই মাঠের সিকি ভাগ গেলে পাকুড়-দিঘি। উল্টো দিক থেকে এলে পাকুড়-দিঘির আগে নিতান্ত ছোটো-ছোটো বিচ্ছিন্ন পাড়া—দু-চার ঘর বসতি মাত্র। তারপর মাঠ; আগে মাঠ, পরে মাঠ—রাস্তায় লোক চলাচল করে সত্য, কিন্তু ক্রমান্বয় লোকের আনাগোনা নেই। সকালের দিকে যদিও বা গঞ্জে যাওয়ার লোক চোখে পড়ে, কিন্তু দুপুরের আগেই পথ প্রায়-নির্জন চেহারা নেয়।

ফেরার সময় দলবেঁধে ফেরার ঘটনা কম। হয়তো দু’তিন-জন একসঙ্গে ফিরছে এমনটা ঘটে। কিন্তু একা ফিরছে এমনটা তো হয়ই। এই যে রাস্তার চরিত্র, তা বদলে যায় হাটের দিন। সপ্তাহে দু-দিন হাট। বাকি দিনগুলোয় এই পথ একজন কিশোরী বা যুবতীর পক্ষে মোটে নির্ভরযোগ্য নয়।

সেই পথের দিকে একা চেয়ে থাকে বাহিরা।

ভাবে, তার যদি ডানা থাকত!

ভাবে, যদি তার একটা বুররাক থাকত!

কিন্তু ওই যে জীবটা, ওটায় তো হজরত রসুল ছাড়া কেউ চড়েননি।

মাঝে-মিশেলে জিল্লুরের এক্কা যায়। কিন্তু সেটায় সময়ের ঠিক নেই। যাওয়া-আসার বাঁধা সময় নেই। তা ছাড়া ওই এক্কার ভাড়া টানবার ক্ষমতা বাপের নেই।

একটি বুররাক। একটি সাইকেল।

এই পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারে বাহিরা। তারপর হতাশায় ডুবে যায় সে। মোটা কাজের দর্জি রব মোমিনের পয়সা কোথায় যে সাইকেল হবে!

গল্প এটাই যে, সাইকেল হলো। কান্নার অশ্রু আনন্দের অশ্রুতে বদলে গেল। প্রায়-একটা স্বপ্নের মতো ঘটনা। বিশ্বাসই করতে পারছে না বাহিরা। যত বার দেখছে, ভাবছে, এ এক আশ্চর্য বুররাক; যেন আকাশের ছায়াপথে চলমান এক বিস্ময়-যান।

আরবি লোকের উট। কাজাকিদের ঘোড়া। আর বাংলার গরিব ছাত্রীর কাছে একটি সাইকেল প্রকৃত গতির ছন্দ ও উৎসাহ। কেউ বোধহয় বাহিরার মনের কথা শুনে ফেলেছিলেন।

যেদিন বাড়িতে সাইকেলটা এল, বাড়িতে অনেক কলরব হলো। বাবাও বারবার নেড়েচেড়ে দেখতে থাকলেন; মা ছুঁয়ে দেখল, বোন ছুঁয়ে দেখে বলল, ‘চ। প্র্যাকটিস করবি! চল বু, লস্করের মাঠে।’

জ্যোৎস্না রাতেও এসার নামাজ পর্যন্ত প্র্যাকটিস করেছে বাহিরা। দ্রুতই শিখে ফেলল সাইকেল চড়ার ভারসাম্য রাখার কায়দা। তারপর উদয়ের পথে ঊষার আগে ভোরের তারকার শুভ্রালোক জড়িয়ে গেল সাইকেলের চাকায়।

একদিন সেই চলার গতিকে রোধ করে দাঁড়াতে পাকুড়-দিঘি রাস্তায় চার নসুহাকে দেখা গেল দাঁড়িয়ে রয়েছে—তাদের দূর থেকে দেখেই সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দেয় বাহিরা। তারপর তীব্র করে গতি। তীব্রতর করে। সন্ধ্যা হয়-হয়। রাস্তায় সরষেদানার আলো নয়। টলটল করছে আলোর পরিপূর্ণ বাল্ব; সূর্যাস্তের আগে জ্বলে উঠেছে। আকাশে চাঁদ সূর্যাস্তের আগেই এসে গিয়েছে।

এখন বাহিরা গলা তুলে বলতে থাকে—‘ব্রেক ধরবে না। সরে যা। থামবে না। সরে যা। হাঁটুর চাকি চাকার ধাক্কায় ঘুরে যাবে। সরে যা। সরে যা ননা-নসুহা। আমি মাশুরা নই। আমি বাহিরা। না সরলে চাকি ঘুরে গেলে দোষ দিস না তানা-বানা-নসুহা-ননা।’

ওদের মধ্যে সবচেয়ে জোয়নাটা এগিয়ে এল।

সাইকেল সত্যিই উঠে গেল ওই নসুহার হাঁটুর চাকি লক্ষ করে। ঘা খেয়ে সত্যিই ঘুরে গেল চাকি। পা বেঁকে প্রচন্ড কাতরে উঠে মাটিতে পড়ে গেল তানাবানা সেখ।

বাড়ি ফিরে রেঞ্জ দিয়ে নাট ঢিলা করে খুলে একটি ব্রেকের রবার বাহিরা ফেলে দিল ডোবার জলে।

মুরুব্বিরা এল। অভিযোগ তুলল, ‘একী করলে বাহিরা?’

বাহিরা শান্ত গলায় বলল, ‘কী করলাম?’

মুরুব্বি বললে, ‘চাকি ঘুরিয়ে দিলে?’

‘ব্রেকের রবার ছিল না, জোর করে সামনে এল, হটো-হটো বললাম, হটল না। চাকি ঘুরে গেল।’ জবাব দিলে বাহিরা।

—‘অন্যায়!’ বলে উঠলেন অন্য একজন।

—‘অন্যায় হতো, যদি আমি পশ্চাদদেশে মারতাম। চাকি কখন ঘোরে কাকা? থানায় যান। কোর্টে যান। জানতে পারবেন। ওই দেখুন, রবার আছে? নেই। রাস্তায় আগেই খসে গিয়েছিল। ব্রেক ফেল করেছে। মানা তো করলাম আমি; হটো বললাম। হটল না। তানাবানা সামনে থেকে কেরদানি করছিল। চাকি কখন ঘোরে? সামনে এগিয়ে এলে ঘোরে। ডান পায়ের চাকি ঘুরে গেছে, তাই না! আমি যদি বাঁ পায়ে মারতাম, তা-ও বলতেন, বাঁ-পায়ে মেরেছে! ব্রেক ফেল করাতে অঘটন ঘটেছে। কেউ কি সাধে কারও চাকি ঘুরিয়ে দেয়? সাধ করে এসব হয়টয় না। শুনুন, এই সাইকেল মমতা আমাকে দিয়েছেন উচ্চ পড়াশুনোর জন্য আর ইজ্জত বাঁচাতে। যদি থামতাম। ওই তানাবানা সাইকেলের হাওয়া ছেড়ে দিত। এ কাজ আর এক নসুহা আগে একদিন করেছে। ঈর্ষায় জ্বলছিল কামাগ্নি। যাতে পড়তে না পারি। মানুষ না হই।….থানায় যান। কোর্টে যান। বলুন, হাঁটুর চাকি ঘুরে গেছে। শুধু বলবেন, চাকি ঘুরে গেছে। থানার বড়োবাবু আমাকে ডাকলে আমি শুধু বলব, এ সাইকেল মমতা আমাকে দিয়েছেন। রাস্তায় ধরে-আটকে সেই সাইকেলের হাওয়া ছেড়ে দিয়ে ৬ মাইল সেই সাইকেল গড়ানো কি প্রগতি বড়োবাবু। চাকি ঘুরলে দোষ কার বলুন।’

এই বলে থামল বাহিরা। মুরুব্বিরা দল নিয়ে সরে গেল।

সাইকেলের রিমে সূর্য প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল। ব্রেকে রবার ফিট করছে বাহিরা। রিমে সূর্যের আলো সরস্বতীর গায়ের রঙের মতো শুভ্র।

 

 

 

সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৭ পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত