রাজীব বরুয়া’র একগুচ্ছ অসমিয়া কবিতার বাংলা অনুবাদ
এক সময় অসমের নাম ‘কামরূপ’ ছিল। আরও প্রচীনকালে কামরূপ ছিল ‘প্রাগজ্যোতিষ’ নামে। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত। এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা এবং উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় রাজ্য দ্বারা অসম বেষ্টিত এবং অসম সহ প্রতিটি রাজ্যই উত্তরবঙ্গের একটি সংকীর্ণ অংশ দ্বারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া অসমের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে। চা, রেশম, পেট্রোলিয়াম এবং জীববৈচিত্রের জন্য অসম বিখ্যাত। অসমিয়াদের প্রধান উৎসব হলো বিহু। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অসমিয়ারা বিহু পালন করে। বিহু তিনটি- ব’হাগ (রঙালি) বিহু, মাঘ (ভোগালী) বিহু আর কাতি (কঙালি) বিহু। অসমীয়া সাহিত্য অন্য সমস্ত ভাষার মতো অসংখ্য উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং অন্য অন্য বিষয়ক গ্রন্থে পূর্ণ। অসমীয়া সাহিত্য ভাষাটির বর্তমানের সাহিত্য সম্ভার ছাড়াও এর ক্রমবিবর্তনের সময়ে সৃষ্টি হওয়া পুরানো অসংখ্য সাহিত্যের সম্ভারে পরিপূর্ণ, যে ধারার আরম্ভ ৯ম-১০ম শতকের চর্যাপদ থেকে আরম্ভ হয়েছিল বলে ধরা হয়। অজিৎ বরুয়া, অনন্ত কন্দলী,অনিরুদ্ধ কায়স্থ, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী, আনন্দরাম বরুয়া , ইমরান শাহ, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, ভোলানাথ দাস, মফিজুদ্দিন আহমদ হাজারিকা, মহেন্দ্র বরা, মাধবদেব, রবীন্দ্র সরকার, রমাকান্ত চৌধুরী, বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, স্নেহ দেবী, হরিবর বিপ্র, হীরেন ভট্টাচার্য সহ আরো অনেক অসমীয়া ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি আছেন। এই সময়ে অসমীয়াতে কি রকম কবিতা লেখা হচ্ছে কারা লিখছেন, এই সময়ের কবি রাজীব বরুয়া’র কবিতা নিয়ে আজকের আযোজন। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন অনুবাদক বাসুদেব দাস।
রাজীব বরুয়া’র জন্ম ১৯৬৩ খ্রিঃ। ১৯৯৯ খ্রিঃ‘মুনিন বরকটকী পুরস্কারে সম্মানিত শ্রী রাজীব বরুয়ার কাব্যগ্রন্থগুলি যথাক্রমে ‘অঘরী দিনর ডায়েরী’,’গছে পোহর দিয়া দিন’,’পানীর ঘর’,’খালি বটলর মালিতা’,’হয়তো মুদ্রাদোষ’ ইত্যাদি। আকাশবাণী,গুয়াহাটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর পদে রয়েছেন। শ্রী রাজীব বরুয়ার একটি কাব্যগ্রন্থ ইংরেজিতেও অনূদিত হয়েছে।
বৃষ্টির বেদীতে
অন্যকে ভেজাতে গিয়ে বৃষ্টি নিজেও ভিজে
নিজে নেচে অন্যকে নাচায়
বৃষ্টির ফৌটা সবখানেই একভাবে পড়ে
কে কীভাবে গ্রহণ করে বা এড়িয়ে চলে
সে খবরে বৃষ্টির প্রয়োজন নেই
গাছ কারও পেছন পেছন গিয়ে ছায়া দেয় না
ছায়ার খোঁজে গাছের নিচে যেতে হয়
কাঁচা মাটির গন্ধ নিতে জানে যারা জানে
কীভাবে কাতর মাটি স্বাগত জানায় বৃষ্টিকে
শিশুকে অনেকক্ষণ বুকের দুধ না দিলে
দুগ্ধবতী মায়ের স্তন যেভাবে টনটন করে
স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্মান জার্মানী বন ঢেকে রাখলেও
পথের পাশে জঙ্গলে পড়ে থাকা
অচল গাড়িটা সবসময় বৃষ্টিতে ভেজে
একদিন একটি তেজন্বী ঘোড়ার মতো গাড়িটা
দিন নেই রাত নেই লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্স হয়ে
আমরা জার্মানী বনগুলির কথা না জানলেও
জানি,জীর্ণ আ্যান্থুলেন্স কীভাবে বৃষ্টিকে গ্রহণ করে
গাড়িটার ভেতরের বাতাসে আজও বয়ে থাকা
কোনো রোগির মরণ কাতর চিৎকার আত্মীয়ের কান্নার রোল
আর দীর্ঘ নিঃশ্বাসগুলি
নিভিয়ে দেবার আগে জ্বলে উঠা প্রদীপের মতো আশাগুলি
বৃষ্টি সবাইকে মুক্তির পথ দেখায়
এই মুক্তিযজ্ঞের ধোঁয়ার গন্ধ আমরা পাই
যেভাবে পাই শুকনো মাটিতে বৃষ্টি পড়লে সেই ফুরফুরে গন্ধ…
আরো পড়ুন: সৌরভ শইকীয়ার একগুচ্ছ অসমিয়া কবিতার বাংলা অনুবাদ
সুপ্রভাত
আপনি জানালা দিয়ে দেখা আকাশটা দূরে চলে গেল
সকালে দরজা খোলে যখন দেখেন …
সামনের বারান্দায় ছটফট করে পড়ে আছে
একটা আধমরা কাক এবং
তাকে দেখে পোষা কুকুরটা যদি তেড়ে যায় …
আপনার ঘরের ওপরে কাক গোষ্ঠীর কোলাহল
কচ্চিৎ না শুনে থাকেন
সকালে পেছনের দরজা খুলে দেখেন ….
একটা ইদুর মুখে নিয়ে একটা বিড়াল দৌড়ে গেল
কুয়োর পারে সাপ ব্যাঙকে গিলছে
খরা না আসতেই শুকিয়ে গেল আপনার কুয়োর জল
এরকম একটি সকালে কী দিতে পারেন
তবুও পাশ দিয়ে পার হয়ে যাওয়া পরিচিত মানুষেরা
আপনাকে সুপ্রভাত বললে আপনিও যেন
সুপ্রভাত বলতে ভুলবেন না
হওকনা তার প্রভাত সবল-সুঠাম
এগিয়ে দিন একটা নীরোগ হাত…
সুপ্রভাত
আরো পড়ুন: অসমিয়া কবি অর্চনা পূজারী’র অনুবাদ কবিতা
কার কাছে বলব
আমি স্বীকার করতে চাই অতীতের ভুল
কার কাছে বলব -শোনার মতো কারও সময় নেই
বাতাসকে ডেকেছিলাম –শুনে ছড়িয়ে দাও
কিন্তু বাতাসের সময় নেই -এখন বসন্ত কাল
সান্ত্বনা দিতে চাই গাছের কোমল কিশলয়
রোদও শুনতে চায় না –কমে যেতে পারে তেজ
আর বৃষ্টি,
হতে পারে ভালো শ্রোতা
তবে অনেকদিন দেখা-দেখি নেই
আমার পাশেই থাকা মানুষটিকে কথাগুলি শোনাতে চেয়েছিলাম
তিনি বললেন –আমি অতীতে বাস করি না
আমার কাছে বর্তমানই সেরা |’
মানুষ আছে –অথচ
অন্যের ভুলের ভার নিয়ে কেউ বাড়ায় না জঞ্জাল
আজ আমি স্থির করেছি –তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠব
ভুলগুলি বলব সকালকে
যেখান থেকে প্রতিদিন আরম্ভ হয় দিন
আরো পড়ুন: অতিকায় ডানাঅলা অতিশয় বৃদ্ধ এক লোক । গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
ন্যানো জীবন
এই শরীরটাকে আমি আবার তুচ্ছ করেছি
যাকে কখনও নিজেই চিনতে পারি না
কী প্রয়োজন এই বিরাট বপুর
যেখানে সেখানে এত ভিড়-ভীতি ,বক্রতার যুদ্ধ-বিপ্রহ
পদের ওপরে পদ আর বিপদ
মূল সমস্যা আজ জোড়াতালি
কে কার জন্য রাখে ছোট-বড় অবকাশ
আমার নতুন চারা গজিয়েছে
যুগপৎ খসিয়ে ফেলেছি শরীরের মাংসল ভার
আমি পূর্ণরূপে প্রকাশিত হতে চাই
সবাই দেখুক আমার সকাল
শরীর আর গর্ভের মেটে রঙ
উর্ধমুখী গাছের সম্মুখের
ছোট কায়া একটা হলেই আমার উদযাপন হবে
হয়তো তুমি ভাবতে পার
পুরুষালি দেহের বল পূর্ণ করে যৌবনের প্রয়োজন
বইতে পারে সময়ের ফসলের আঁটি
মেটাতে পারে পাথর খেয়ে হজম করা ক্ষুধা
যৌবনের সারথির প্রয়োজন কত
যৌবন নিজেই একটি বিপুল শক্তি
ক্ষুদ্রতায় বেঁচে থাকুক আমার বিশাল ইচ্ছাধারী জীবন
বাধাহীন গভীর আশাবাদের আয়ু …
আরো পড়ুন: ম্যাক্সিম গোর্কি’র অনুবাদ গল্প: শরতের একটি রাত
মৃত্যুপক্ষ
মৃতেরা বড় স্বার্থপর
অন্যের ঘুমের ক্ষতি করে
নিজে এত নিখুঁতভাবে শুতে পারে
নিজে হাসে না বলেই অন্যকেও
হাসার অনুমতি দেয় না
জীবনের একেবারে সামনে বিশ্বরূপ ধরে
এভাবে দাড়িয়ে থাকে যাতে
কেউ কাউকে চিনতে পারে না
সময়কেও নিজের পক্ষে টেনে নেয়
অকালে যাতে ভেঙ্গে না ফেলে শোকের ঘড়ি
ঘন্টা-মিনিট-সেকেণ্ডের কাটায় ঝুলে থাকে
শিশিরের ভারী ফোঁটা আর
শুকনো বাতাসের কাঁটা
কর্ম-ধর্মের জন্য সবারই সময়ের প্রয়োজন
মৃতের ও নিজের কাজ থাকে
মৃত্যুপক্ষ করে না অপরাধ ,রাতটাই বেইমান
কারও কেন আসে না ঘুম…
অনুবাদক